৫-৬. মাফিয়া বনাম মারাওস্কি

০৫. মাফিয়া বনাম মারাওস্কি

ক্র্যাকভের পুরোনো শহরের পুরোটাই জাদুঘর। ওয়ারসতে জাদুঘর দেখে তাচ্ছিল্য দেখিয়েছিলো জনি। ক্র্যাকভের ঘরবাড়ি দেখে ও হতবাক। বার বার বলছিলো, সত্যি বলছো শোয়েব ভাই? এদের ইউনিভার্সিটি ইউরোপের সবচেয়ে পুরোনো? কিংবা এই বাজারটা ছশ বছর ধরে একরকম আছে?

হোটেলে জিনিসপত্র রেখে ওরা ব্যাটারি কার–এ ঘুরতে বেরিয়েছে। ভারি মজার গাড়ি। বড় সড় খেলনার মতো দেখতে হালকা গড়নের, তেল লাগে না, ব্যাটারিতে চলে, কোনো শব্দ হয় না। পুরোনো শহরের রাস্তা জখম হবে বলে সাধারণ গাড়ি ঢুকতে দেয়া হয় না। ঘন্টা হিসেবে গাড়ি ভাড়া করেছিলো শোয়েব। প্রতি ঘন্টা পঁচিশ হাজার ফুলটি। পোলিশরা ওদের টাকাকে বলে যলটি। পঁচিশ হাজার শুনে আঁতকে উঠেছিলো জনি। শীলা হেসে বললো, পঁচিশ হাজার মানে তোমাদের দু পাউন্ডেরও কম।

শুনে আরও অবাক হলো জনি–এত সস্তা।

গাড়ি চালাচ্ছিলো জনির সমবয়সী পেজেক। চালাতে চালাতে গড়গড় করে ইংরেজিতে বলে যাচ্ছিলো দু পাশের ঘরবাড়ির বিবরণ। কোন বাড়ির ভেতরে কি আছে, কোন দুর্গে কটা কামরা আছে, সবই পেজেকের নখদপর্ণে। জাগিয়েললিয়ন ইউনিভার্সিটির পুরোনো ইমারত দেখিয়ে পেজেক অভিজ্ঞ গাইডের মতো বললো, তেরশ চোষট্টি সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। ইউরোপের সবচেয়ে পুরোনো

পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কোপার্নিকাসের নাম আশা করি জানা আছে। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।

বিস্তা নদীর তীরে পাহাড়ের ওপর ওয়োভেল দুর্গ আরেক দর্শনীয় স্থান। কিছুটা পথ গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। বাকিটুকু হেঁটে যেতে হবে। পেজেক বললো, দুর্গটার ভেতরে দেখতে যাবে নাকি?

একশ বার যাবো। রিনি জনি দুজনই সমান উত্তেজিত। রিনির আকর্ষণ পুরোনো পেইন্টিং আর এন্টিকস্ । জনির ধারণা এসব পুরোনো দুর্গে নিশ্চয় সেই সময়ের কোনো অতৃপ্ত আত্মার দেখা পাওয়া যাবে। আগেকার দিনের কাউন্ট আর ব্যারনরা তো কম দুষ্কর্ম করে নি।

শোয়েব আর শীলা ওয়াভেল দুর্গে আগেও এসেছিলো। শীলার ভেতর কোনো উচ্ছ্বাস না থাকলেও শোয়েবের ভালো লাগছিলো সবার গার্জেন হয়ে ঘুরে বেড়াত।

পেজেক বহুবার এসেছে বলেই সব গড় গড় করে বলে যাচ্ছিলো। সারা পৃথিবীতে এরকম রাজকীয় দুর্গ মাত্র আটটি আছে। সবচেয়ে পুরোনো বলেই পোল্যান্ডে এর গুরুত্ব বেশি। বিশাল এলাকা জুড়ে পাঁচশ বছরের পুরোনো দুর্গ।

শীলা ভেতরে ঢোকে নি। রিনিদের বলেছে, তোমরা ঘুরে এসো। আমি অপেক্ষা করছি।

দুর্গের বাইরের চত্বরে ছোট ছোট ফেরিওয়ালা নানারকম সুভেনির বিক্রি করছিলো। শীলা জনির জন্য কয়েকটা ছোট খাট সুভেনির কিনে ও ফেরিওয়ালার কাছ থেকে এক কাপ কফি নিয়ে বুড়ো ওক গাছটার নিচে বসলো। গ্রাম থেকে আসা ছেলে মেয়েরা একা ওকে বসে বসে কফি খেতে দেখে অবাক হচ্ছিলো, শীলাও মজা পাচ্ছিলো।

অনেকগুলো ঘর ঘুরে পেইন্টিং-এর চেম্বারে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো রিনি । শোয়েব বলতে যাচ্ছিলো–কি হলো? রিনি ইশারায় ওকে থামিয়ে দিলো।

লম্বা চেম্বারের চার দেয়ালে পাঁচ ছশ বছরের পুরোনো সব নানা আকারের পেইন্টিং ঝোলানো। ঘরে মাত্র একজন লোক চোখের সামনে আতস কাঁচ ধরে গভীর মনোযোগের সঙ্গে পেইন্টিং দেখছে। লোকটা আর কেউ নয়, মাফিয়াদের সেই গুপ্তচর, রিনি যাকে সকালে ওদের ট্রেনের কামরায় উঁকি মারতে দেখেছিলো।

চাপা গলায় রিনি বললো, মাফিয়াদের সেই লোকটা!

রহস্যের গন্ধ পেয়ে জনির রোমাঞ্চ হলো। পেজেক কিছু বুঝতে পারলো না। শোয়েব ওর কানে কানে বললো, এই লোকটা ভালো নয়। আমরা আড়াল থেকে দেখতে চাই ও কি করে।

নিশ্চয় পেইন্টিং চুরি করবে, তাই না আপু? খুশি আর উত্তেজনা উপচে পড়ছিলো জনির গলা থেকে। অতৃপ্ত আত্মার দেখা না পেলেও জলজ্যান্ত একজন চোরের দেখা পেয়েছে এবং ওদের চোখের সামনে চুরির পর্বটি সমাধা হবে–ওর জন্য এটাও কম রোমাঞ্চকর নয়।

রিনি কোনো কথা না বলে শোয়েবদের নিয়ে পা টিপে টিপে হেঁটে বড় জানালার পর্দার আড়ালে লুকোলো। মাফিয়াদের গুপ্তচর ছবি পর্যবেক্ষণের কাজে এমনই ব্যস্ত ছিলো যে, অন্য কোনো কিছুর ওপর ওর নজর ছিলো না।

সেদিন কোনো ছুটির দিন ছিলো না। তাছাড়া এটা ট্যুরিস্টদেরও আসার সময় নয়। গ্রাম থেকে আসা দর্শনার্থীরা রাজাদের ধনরত্ম আর যুদ্ধের সাজসজ্জা দেখতেই বেশি আগ্রহী। যে কারণে এদিকটা ছিলো একবারেই ফাঁকা। দুর্গের গার্ডদেরও সাধারণত যেখানে দর্শনার্থীর ভিড় বেশি সেখানে থাকতে হয়। ট্রেজারি চেম্বারে গোটা ছয়েক গার্ড লক্ষ্য করেছে শোয়েব। ওর আর রিনির মনে হলো পেইন্টিং চোর সব কিছু হিসেব করেই এসেছে। বড় পেইন্টিং নিতে পারবে না। তবে দেয়ালে ছোট ছোট অনেক পেইন্টিং রয়েছে। রিনি জানে অনেক মিনিয়েচার পেইন্টিং-এর দাম বড়গুলোর চেয়েও বেশি।

অনেকক্ষণ ধরে মাফিয়াদের গুপ্তচরটা ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। জনি রীতিমতো অধৈর্য হয়ে উঠেছিলো–চুরি করতে কি এত সময় লাগে। যে কোনো সময় গার্ড এসে যেতে পারে। তখন কি আর চোর ধরার কৃতিত্ব ওরা নিতে পারবে? চোরটা হাঁদা নাকি! শোয়েব আর রিনিও কম অবাক হয় নি। চুরি ছাড়া লোকটার কি অন্য কোনো মতলব আছে? পেজেকও জনির মতো উত্তেজিত হয়ে লোকটার গতিবিধি লক্ষ্য করছিলো।

কয়েকটা পেইন্টিং ভালোভাবে লক্ষ্য করে লোকটা একটা মাঝারি আকারের ছবির সামনে দাঁড়ালো। তারপর পকেট থেকে নোটবই আর পেন্সিল বের করে ওটা কপি করতে লাগলো যেভাবে আর্ট স্কুলের ছাত্ররা করে। যে কোনো পুরোনো মিউজিয়ামে এরকম দৃশ্য দেখা যায়, কিন্ত এই আধবুড়ো লোকটা নিশ্চয় আর্ট স্কুলের ছাত্র নয়। রিনি অবাক চোখে শোয়েবের দিকে তাকালো।

লোকটার মতলব বুঝতে শোয়েবের এতটুকু অসুবিধে হলো না। রিনি আর জনির হাত ধরে ওখান থেকে সরে এলো পাশের চেম্বারে। পেজেকও এলো ওদের পেছন পেছন। চাপা উত্তেজিত গলায় শোয়েব বললেন, রিনি ঠিকই ধরেছে, লোকটা খুবই পেশাদার পেইন্টিং চোর।

জনি একটু তাচ্ছিল্যের গলায় বললো, পেশাদাররা বুঝি চুরির সুযোগ পেয়েও আর্ট স্কুলের ছাত্রদের মতো পেইন্টিং কপি করে। চোরের ওপর হতাশ হয়ে বিরক্তিটা ও শোয়েবের ওপর ঝাড়লো।

শান্ত গলায় শোয়েব বললো, হাউ টু স্টিল এ মিলিয়ন ছবিটা বোধহয় জনি দেখো নি। ওটা দেখলে বুঝতে পারতে পেইন্টিং চুরি খুব সহজ কাজ নয়।

শোয়েবের সঙ্গে জনির ওভাবে কথা বলা রিনির মোটেই ভালো লাগে নি। অধৈর্য হয়ে জানতে চাইরো, কি ছিলো ছবিতে?

বিখ্যাত কোনো পেইন্টিং ঘরে বসে এরা কপি করে। হুবহু একরকম করে আঁকে। একরকম সাইজে একইরকম করে বাঁধায়। তারপর গার্ডদের কাউকে হাত করে আসল পেইন্টিংটা সরিয়ে নকলটা ওখানে ঝুলিয়ে দেয়। এক্সপার্ট ছাড়া কেউ টেরও পাবে না কোনটা আসল আর কোনটা নকল। ধরা পড়তে বহুদিন লাগে। এর ফাঁকে আসল পেইন্টিং অন্য কোনো দেশে পাচার হয়ে যায়।

শোয়েবের কথায় যুক্তি আছে। তবু জনি বললো, চার পাঁচ শ বছরের পুরোনো সব পেইন্টিং-এর ভেতর নতুন আঁকা একটা পেইন্টিং থাকলে আমিও ধরে ফেলতে পারবো, ওর জন্য এক্সপার্ট লাগবে না। শোয়েবের দেখা ছবিটা না দেখলেও ক্রাইম ছবি জনিও কম দেখে নি।

তুমি সব জানো আর যারা পেশাদার চোর তারা জানে না, এমন ভাবছো কেন? শোয়েবের গলায় সামান্য বিদ্রূপ–ওরা একটা ছবি আঁকার পর এমন সব কেমিকেলে ওটা ডুবিয়ে রাখে যাতে মনে হয় ক্যানভাসটা কয়েক শ বছরের পুরোনো। রঙ বেশি পুরু থাকলে একটু ফাটা ফাটা মতো হয়ে যায়, চকচকে ভাবটাও থাকে না।

আমরা এখন কি করবো? উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করলো রিনি ।

আমরা ওকে ফলো করে ওর স্টুডিওতে যাবো। ওখানে বসে নিশ্চয় ও অরিজিনালটার মতো ছবি আঁকছে। যদি দেখি আমার ধারনা ঠিক, তাহলে পুলিসকে জানাবো।

শোয়েবের কথায় রোমাঞ্চকর কিছু করার আভাস পেয়ে জনি উৎফুল্ল হয়ে বললো, তাহলে আর দাঁড়িয়ে আছি কেন, চলো।

পেজেকের বোঝার সুবিধের জন্য ওরা কথা বলছিলো ইংরেজিতে। জনির মতো পেজেকও রোমাঞ্চিত হলো জাদরেল একটা চোরকে হাতে নাতে ধরার সুযোগ পাচ্ছে। বলে। রিনি মুগ্ধ হলো শোয়েবের ঘটনা বিশ্লেষণের ক্ষমতা দেখে।

আগের মতো পা টিপে টিপে উত্তেজিত চারজন পেইন্টিং চেম্বারের দরজার সামনে এসে হতভম্ব হয়ে গেলো। সারা ঘর খালি, মাফিয়াদের লোকটা পালিয়েছে। শোয়েব বললো, এখনো নিশ্চয় দুর্গ থেকে বেরোয় নি। পা চালিয়ে এসো, এখান থেকে বেরোবার আগেই ওকে ধরে ফেলবো।

পেজেক ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো। ওয়াভেল দুর্গে কামরার অন্ত নেই। পেজেকের মতে গাইড না থাকলে ওরা এত অনায়াসে ঘরের পরে ঘর পেরিয়ে ছুটতে পারতো না। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে রিনি একবার কিসের সঙ্গে যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো। সঙ্গে সঙ্গে শোয়েব ওকে শক্ত হাতে ধরে ফেললো। জনি বিরক্ত হয়ে ধমক লাগালো-তুই কি রে আপু! দেখে শুনে চলতে পারিস না?

রিনি শোয়েবকে ধন্যবাদ বলতে গিয়ে অকারণে লাল হলো।

দ্রুত পায়ে হেঁটে দুর্গের বাইরে এসেও চোরের কোনো সন্ধান পেলো না ওরা। শীলা তখন ওক গাছের তলায় কাঠের বেঞ্চে বসে গ্রাম থেকে আসা ক্ষুদে ক্ষুদে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করছিলো। রিনিদের হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে অবাক হয়ে ও উঠে এলো। রিনিকে বললো, এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে! কি খুঁজছো, টয়লেট?

আরে না! ব্যস্ত গলায় রিনি জানতে চাইলো, এ পথ দিয়ে একটু আগে রোগা মতো টেকো, চশমা পরা লোককে যেতে দেখেছো? গায়ে কালো ওভারকোট।

জনি বললো, চোরের মতো দেখতে?

শীলা অবাক হয়ে বললো, না তো! দশ মিনিটের ভেতর চোর ভালোমানুষ কাউকে বেরোতে দেখি নি। কেন, তোমাদের কিছু চুরি করেছে নাকি?

করে নি এখনও। তবে করবে। ভারিক্কি গলায় জবাব দিলো জনি।

করবে মানে? কি চুরি করবে?

পেইন্টিং! রহস্যভরা গলায় বললো জনি।

কি করে জানলে ও পেইন্টিং চুরি করবে?

আড়চোখে একবার শোয়েবকে দেখে জনি শুধু বললো, জানি।

শোয়েব আর রিনির কাছে শীলা জনির ফালতু কথা মোটেই ভালো লাগছিলো না। মাফিয়াদের একটা চর–যে কি না পেইন্টিং চুরির মতলবে এদেশে এসেছে–হাতের কাছে পেয়েও ধরা গেলো না, এটা কম দুঃখের নয়। রিনি শোয়েবকে জিজ্ঞেস করলো, এবার আমরা কি করবো? পুলিস স্টেশনে যাবে?

শোয়েব শুকনো হেসে বললো, আমরা কি প্রমাণ করতে পারবো নোকটা চুরির উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে?

না, তা পারবো না।

সেক্ষেত্রে পুলিস আমাদের কথা শুনবে না।

শীলার কাছে এদের কথাবার্তা সব দুর্বোধ্য মনে হচ্ছিলো। একটু বিরক্ত হয়ে বললো, তোমরা কেউ কি আমাকে দয়া করে বলবে দুর্গের ভেতর কি ঘটেছে?

তেমন কিছু ঘটে নি, তবে ঘটতে পারে। এই বলে শোয়েব ওকে সব খুলে বললো।

এরকম একটা উত্তেজনাকর কাহিনী শোনার পরও শীলার বিরক্তি গেলো না। বললো, আচ্ছা আমরা কি এখানে বেড়াতে এসেছি, না কোথাকার কোন মাফিয়া না কে, তার পেছনে ঘুরে মরবো?

শোয়েব বললো, আমি হার মানছি শীলা। আমরা দুদিনের জন্য বেড়াতেই বেরিয়েছি।

তাহলে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। জাহান্নামে যাক মাফিয়া আর পেইন্টিং চোর। এখন খিদে পেয়েছ, আগে খাবে। তারপর আমরা মার্কেট স্কয়ারে যাবো শপিং করতে।

শীলার রায় শুনে শোয়েব মৃদু হাসলো–ঠিক আছে শীলা। আমরা মার্কেট স্কয়ারেই খেতে যেতে পারি।

পুরোনো শহরের ঠিক বুকের মাঝখানে মার্কেট স্কয়ার। লম্বা, উঁচু ব্যারাকের মতো পুরোনো আমলের ইমারতের ভেতর ছোট ছোট খোপে বিচিত্র সব হস্তশিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেছে কারিগররা। চমৎকার সব ঘর সাজাবার জিনিষপত্র, নাম শুনে রিনি জনি দুজনই অবাক হলো। লণ্ডনের বাজারে এসবের দাম কম করে হলেও দশগুণ হবে। জমকালো পোষাক পরা নানা বয়সী পুতুল থেকে শুরু করে পা রাখার ছোট কার্পেট পর্যন্ত কিনে ব্যাগ বোঝাই করে ফেললো রিনিরা। দুপুরের খাওয়াও সারলো পুরোনো এক রেস্তোরাঁয় পোলিশ খাবার দিয়ে। বিটের সুপটা দারুণ লাগলো রিনির। অন্য সব পদও মন্দ ছিলো না।

পেজেক ওদের সঙ্গে খেতে বসে বেজায় খুশি। দুবছর ধরে ও ব্যাটারি কার চালাচ্ছে, আজ পর্যন্ত কেউ ওকে এরকম দামী রেস্তোরাঁয় খাওয়ায় নি। বড়জোর একটা আইসক্রিম না হয় এক কাপ কফি খেতে দিয়েছে। বাংলাদেশের এই হাসিখুশি চারটি ছেলে মেয়ের জন্য গভীর কৃতজ্ঞতায় ওর বুক ভরে গেলো।

আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি? মার্কেট স্কয়ারের বিশাল চত্বরে দাঁড়িয়ে জানতে চাইলো শীলা।

রিনিরা যেখানে যেতে চায়। মুখ টিপে হেসে রিনির দিকে তাকালো শোয়েব।

বারে, আমি কি করে জানবো কোথায় কি আছে? বলতে গিয়ে অকারণেই রিনির কানের ডগা লাল হলো।

পেজেক বললো, তোমরা ইচ্ছে করলে জার্টোরিস্কি মিউজিয়াম দেখতে পারো। পোল্যাণ্ডের সবচেয়ে পুরোনো জাদুঘর এটা।

জনি বললো, তোমাদের এখানে কোন জিনিসটা পোল্যান্ডের সবচেয়ে পুরোনো নয় বলতো।

আপাতত নিজেকে ছাড়া আর কিছু দেখছি না। এই বলে লাজুক হাসলো পেজেক–তবে আমাদের বংশ খুব পুরোনো।

রিনি বললো, ঠিক আছে পেজেক। আমরা তোমাদের সবচেয়ে পুরোনো জাদুঘর দেখবো।

শীলা বললো, যত পুরানোই হোক, তোমরা বৃটিশ মিউজিয়াম দেখেছো। ওর তুলনায় এসব মিউজিয়াম কিছুই না।

রিনি জনি প্রথমে তাই ভেবেছিলো। পেজেকের আগ্রহ দেখেই রিনি ওর কথায় সায় দিয়েছিল। প্রথম দেখাতেই জনির কাছাকাছি বয়সের ছেলেটার ওপর ওর মায়া পড়ে গিয়েছিল। এখনো স্কুলের গণ্ডি পেরোয় নি, বাবার আয়ে সংসার চলে না বলে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চাকরি করছে শুনে ওকে ভালো লেগে গেছে রিনির।  

জার্টোরিস্কি জাদুঘরের গ্যালারিতে ঢুকে রিনি অবাক হয়ে গেলো দ্য ভিঞ্চির অরিজিনাল পেইন্টিং দেখে। দ্য লেডি উইথ অ্যান এরমাইল-এর সামনে দাঁড়িয়ে রইলো হতবিহ্বল হয়ে। পেজেক বললো এখানে রাফায়েলের কিছু দুর্লভ ছবি ছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজীরা চুরি করে নিয়ে গেছে।

রিনি বললো, রাফায়েলের ছবি ওয়ারসর রয়েল ক্যাসেলে দেখেছি।

জাদুঘর দেখা শেষ করে পাথর বাঁধানো সরু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে শোয়েব পেজেককে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি বলতে পারবে গত কয়েক মাসে ক্র্যাকভের কোনো মিউজিয়াম বা ক্যাসেল থেকে কোনো কিছু চুরি গেছে কি না?

মনে হয় না। একটু ভেবে জবাব দিলো পেজেক–মূল্যবান কিছু চুরি হলে নিশ্চয় খবরের কাগজে দেখতে পেতাম।

গত বছর আন্দোলনের সময়ও নয়?

না, গত বছরও কিছু শুনি নি। তাছাড়া এখানে ওয়ারস বা গৃড়ানস্কের মতো কোন আন্দোলনও হয় নি।

শীলা গম্ভীর গলায় শোয়েবকে বললো, নিশ্চয় তোমার মাথায় ওসব মাফিয়াদের ভূত চেপেছে?

শোয়েব হেসে ফেললো, দুঃখিত শীলা! আসলে ভূতটা খুব পাজি। কিছুতেই তাড়াতে পারছি না।

রিনি নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো, তুমি কি ভাবছো?

আমার মনে হয় খুব শিগগিরই ওয়াভেল ক্যাসেলের পুরোনো কিছু ছবি চুরি হবে।

রহস্যের গন্ধ পেয়ে জনি উত্তেজিত হয়ে বললো, তুমি এতটা শিওর হলে কিভাবে?

কিছু কিছু জিনিস আছে আমি আগে থাকতে বুঝতে পারি।

ইএসপি। বিস্মিত গলায় একরকম চেঁচিয়ে উঠলো জনি–সত্যি বলছো শোয়েব ভাই, তোমার ইএসপি আছে?

আরে না। ই এস পি কোথায় পাবো। ঘটনার গতি দেখে অনুমান করতে পারি।বিব্রত গলায় শোয়েব বললো, আমার অনুমান ভুলও হতে পারে।

কিভাবে অনুমান করলে বলো না? অধৈর্য হয়ে উঠলো জনি।

আমার মনে হচ্ছে তোমাদের মারাওস্কিও খুব সম্ভব ক্র্যাকভ এসেছে।

আহা, হেঁয়ালি না করে খুলে বলবে তো? শীলার মনে হলো এর একটা মীমাংসা হওয়া দরকার।

রয়েল প্যালেসে যাকে আমরা মারাওস্কি ভেবেছিলাম সে আসলেই মারাওস্কি।

না, না, মারাওস্কি অতো বুড়ো নয়। প্রতিবাদ করলো রিনি ।

যারা নাটক করে চামড়ায় ভাঁজ ফেলার জন্য তারা এক ধরনের স্প্রে ব্যবহার করে।

ওই স্প্রে দিয়ে যে কারো বয়স পনেরো কুড়ি বছর বাড়িয়ে নেয়া যায়।

মারাওস্কির গলাও ওরকম মেয়েলি নয়। এবার প্রতিবাদ করলো জনি।

শোন জনি, নাটকে যারা অভিনয় করে তারা গলার আওয়াজও ইচ্ছে মতো বদলাতে পারে।

তুমি কি বলতে চাইছো? এবার শীলাও কৌতূহলী হলো।

কাল আমি মারাওস্কির পরিচয় জানার জন্য আর্টিস্টস ইনডেক্সটা দেখছিলাম। পেইন্টারদের তালিকায় আমি রবার্ট মারাওস্কির নাম না পেলেও অভিনেতাদের তালিকায় পেয়েছি। ও বেশ নাম করা অপেরা আর্টিস্ট। অপেরায় ইন্টারেস্ট নেই বলে ওর নাম শুনি নি। তবে ইনডেক্সে দেখলাম ও বেশ নাম করা শিল্পী। ওর ছবিও ওতে ছাপা হয়েছে। চেহারার মিলটা আমারও চোখে পড়েছে। জমজ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই কারণ ও বাপের এক ছেলে।

জনি বললো, তার মানে তুমি বলতে চাইছে রয়েল প্যালেসে মারাওস্কি ছদ্মবেশে গিয়েছিলো?

ঠিক ধরেছো। মৃদু হেসে জবাব দিলো শোয়েব।

কিন্তু কেন? চাপা উত্তেজিত গলায় জানতে চাইলো রিনি।

মাফিয়াদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য। সহজ গলায় বললো শোয়েব।

তাই যদি হবে, জনি বললো, রয়েল প্যালেসের ভিড়ের মধ্যে বসে না থেকে ও নিজের পরিচিত কারো বাড়িতে লুকিয়ে থাকলেই তো পারে।

মনে হচ্ছে লোকটার দেশপ্রেম খুব বেশি। নিজের জীবনের চেয়ে রয়েল প্যালেসের পেইন্টিং পাহারা দেয়া বেশি জরুরী মনে করছে সে। রিনিদের তো বলেছে এক সময় যে সে ওখানকার কিউরেটার ছিলো।

কাল যে লোকটা রয়েল প্যালেসে ছিলো, আজ হঠাৎ ক্র্যাকভ আসবে কেন? শোয়েবের বিশ্লেষণ জনির ঠিক মনঃপুত হচ্ছিলো না।

হয়তো কোনো সূত্রে খবর পেয়েছে মাফিয়াদের নজর ক্র্যাকভের ওপরও পড়েছে। এমনও তো হতে পারে–মারাওস্কি গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে জড়িত। পোল্যান্ডের বাইরে মাফিয়ারা ওর ওপর নজর রেখেছিলো। এখানে ও নজর রাখছে মাফিয়াদের তৎপরতার ওপর।

শোয়েবের কথায় যুক্তি আছে এটা বুঝতে রিনির অসুবিধে হলো না। ওর কথার সামান্য সূত্র ধরে শোয়েব এত কিছু ভেবেছে দেখে মনে মনে ও মুগ্ধ না হয়ে পারলো না।

.

০৬. মাফিয়াদের হাতে বন্দী

শোয়েবের ধারণা যে মিথ্যে ছিলো না, দিন ফুরোবার আগেই তার প্রমাণ পেয়ে গেলো রিনিরা। শেষ বিকেলে ওরা বসেছিলো বিস্তা নদীর তীরে। জায়গাটা ছিলো বাঁধানো চত্বরের মতো। গ্রাম থেকে আসা কয়েকজন বুড়ি আর গোটা দুই জিপসি পরিবার নানা ধরনের হাতের কাজের জিনিস ঝুড়িতে আর সাইকেল ভ্যানে সাজিয়ে বিক্রি করছিলো সেখানে। পর্যটকদের আসার সময় না হলেও কিছু দর্শনার্থী ভিড় জমিয়েছিলো প্রকৃতির শোভা দেখার জন্য।

মস্তবড় একটা কাপড়ের ছাতার নিচে বসে রিনি, জনি, শোয়েব আর শীলা কফি খাচ্ছিলো। একটু আগে পেজেক ওর গাড়ি জমা দিতে গেছে। দিনটা ওর দারুণ কেটেছে। আট ঘন্টা ডিউটি করে দু লাখ যুলটি পেয়েছে ও। দু লাখের ভেতর ও পাবে বিশ হাজার ফুলজি বাকিটা কোম্পানির। গত কয়েক মাসের ভেতর কোনো দিন এত বেশি আয় হয় নি ওর। তার ওপর বাংলাদেশের চমৎকার ছেলেমেয়েরা ওকে দুপুরে দামী রেস্তোরাঁয় খাইয়েছে। বিকেলে কেনাকাটা করার সময় পরির মতো সুন্দর মেয়েটা ওর মায়ের জন্য উলের একটা চমৎকার স্কার্ফ কিনে দিয়েছে। এত ভালো টুরিস্ট ওর জীবনেও দেখে নি পেজেক। ওরা বলেছে গাড়ি জমা দিয়েই চলে আসতে। রাতেও নাকি ওদের সঙ্গে খেতে হবে।

রিনি জনিদেরও ভালো লেগেছে পেজেককে। মাত্র ক্লাস নাইনে পড়ে। এই বয়সের একটি ফুটফুটে কিশোর সংসারের কথা ভাবে, যখন কিনা তার খেলার সময় তখন সে আয়ের জন্য রাস্তায় নেমেছে, তাকে ভালো না বেসে পারা যায় না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে ওর বাড়ির অনেক খবরই জেনেছে রিনি। ছন্নছাড়া একটা মেপল গাছের নিচে বসে কফির কাপে চুমুক দিতে জনি বললো, আমার ইচ্ছে করছে পেজেককে আমাদের সঙ্গে ওয়ারস নিয়ে যাই।

শীলা বললো, তোমার সঙ্গে ওয়ারস ঘুরে বেড়ানোর অবস্থা বুঝি ওর আছে! দেখছো না সারা দিন কাজ করতে হয় ওকে?

তাতে কি জনি বললো, আমরা ওকে দিনে দু পাউন্ড করে দেবো। ও সারাদিনে নিশ্চয় এত কামায় না।

শোয়েব বললো, আমার মনে হয় না এভাবে ও তোমার কাছ থেকে সাহায্য নেবে। ওর আত্মমর্যাদা বোধ খুব টনটনে।

বারে, বন্ধু ভেবে উপহার দেবো তাও নেবে না?

মনে হয় না। দেখোনি রিনি ওর মার জন্য স্কার্ফ কিনে কিরকম বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিলো?

আমরা যদি ওকে গাইড হিসেবে হায়ার করি?

শোয়েব কি যেন বলতে যাবে তক্ষুণি রিনি চাপা উত্তেজিত গলায় বললো, শোয়েব এদিকে দেখো! রবার্ট মারাওস্কি বেরোচ্ছেন ক্যাসেলের ভেতর থেকে।

রিনির কথা শুনে ওরা চমকে উঠে তাকালো দূরে ক্যামেলের রাস্তার দিকে। তখনও সন্ধ্যা হয় নি। ওরা দেখলো লম্বা লম্বা পা ফেলে মারাওস্কি শহরের দিকে যাচ্ছেন। চলার ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিলো খুব তাড়া আছে ওঁর। রিনি আবার বললো, তুমি ঠিকই বলেছিলে শোয়েব। মাফিয়াদের খবর তিনিও পেয়ে গেছেন।

জনি আর শীলা এতই উত্তেজিত ছিলো যে ওরা লক্ষ্যই করলো না রিনি শোয়েবকে ভাই না বলে শুধু নাম ধরে ডাকছে। শোয়েব সকাল থেকে ভাবছিলো রিনিকে এক ফাঁকে বলবে ওকে ভাই না ডেকে শুধু নাম ধরে ডাকতে। জনি শীলা লক্ষ্য না করলেও প্রথমবার শোয়েব ভেবেছিলো ও বুঝি ভুল শুনছে। পরের বার শোনার পর ওর বুকের ভেতরটা আনন্দ আর উত্তেজনায় শির শির করে কেঁপে উঠলো। রিনিকে ওর বলতে ইচ্ছে করলো, জাহান্নামে যাক মাফিয়ারা, এসো আমরা এখানে বসে নদীতে সূর্য ডোবা দেখি। একটু পরেই আকাশে চাঁদ উঠবে।

জনি বললো, আমরা ওকে ফলো করতে পারি না আপু,? ওকে একা পেয়ে মাফিয়ারা যদি বিপদে ফেলে?

ঠিক বলেছিস জনি। রিনি আগের মতো উত্তেজিত গলায় বললো, মারাওস্কি চাচা আমাদের কম উপকার করে নি। ওর যাতে কোনো বিপদ না হয় আমাদের দেখা দরকার।

রিনিকে খুশি করার জন্য শোয়েব উঠে দাঁড়ালো–তাহলে আর বসে আছি কেন? চলো ওকে ফলো করি।

শীলা বললো, পেজেক এসে যে ফিরে যাবে।

রিনি ওর হাত ধরে টানলো–পেজেককে আমরা কাল সকালে ওর জায়গায় পেয়ে যাবো। দেরি না করে চলো। নইলে মারাওস্কিকে আমরা হারিয়ে ফেলবো।

রাস্তায় উঠে কিছুটা দূরত্ব রেখে ওরা রবার্ট মারাওস্কিকে অনুসরণ করলো। রিনির একটু খটকা লাগলো মারাওস্কিকে মেকাপ ছাড়া দেখে। মাফিয়াদের চোখে ধুলো দেয়ার জন্য বেশি বুড়ো সেজে রয়েল ক্যাসেলে বসেছিলেন অথচ এখানে দিব্যি দিনের আলোয় ঘুরছেন কোনো ছদ্মবেশ ছাড়াই। কথাটা শোয়েবকে বলতে সেও চিন্তিত হলো। বললো, তবে কি মারাওস্কি জানেন না মাফিয়াদের লোক যে এখানে এসে গেছে?

মারাওস্কি চাচা না জানলেও মাফিয়ারা জানে। এই বলে জনি উত্তেজিত হয়ে আঙুল তুলে দেখালো–ওই দেখো, মাফিয়াদের হেলথ মিনিস্টার ঠিকই তাকে ফলো করছে।

শুকনো কাঠির মতো দেখতে বলে জনি ওর নাম দিয়েছে হেলথ মিনিস্টার অব মাফিয়াজ কিংডম। এমনই শুটকো যে রাস্তায় লোকজনের ভেতর ওকে প্রথমে ওরা দেখতে পায় নি ওরা বেশ খানিকটা দূর থেকে অনুসরন করছিলো মারাওস্কিকে।

শোয়েব চাপা গলায় বললো, মাফিয়া শয়তানটাকে আর হাতছাড়া করা চলবে না। আজই ওকে হাজতে পোরার ব্যবস্থা করবো।

জনি বললো, আমরা যদি সত্যি সত্যি মাফিয়াদের একটা এজেন্টকে চোরাই মাল হাতে ধরতে পারি দারুণ ব্যাপার হবে।

সেক্ষেত্রে আমাদের যেতে হবে ওদের আসল ঠিকানায়। জনির কথায় সায় জানালো রিনি।

শীলা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললো, মাফিয়াদের পেছনে লাগতে গিয়ে আমরা যদি কোনো বিপদে পড়ি।

এই শুঁটকিটাকে একা আমিই সামলাতে পারবো। সহজ গলায় বললো শোয়েব।

মারাওস্কি আর মাফিয়ার চরটাকে অনুসরণ করে জাদুঘরের কাছাকাছি আসতেই উল্টো দিক থেকে আসা এক দঙ্গল জিপসির মুখোমুখি হলো ওরা। নদীর ধারে জিপসিরা তাবু ফেলেছে। পেজেক বলছিলো দুদিন পরই নাকি নদীর ধারে ওদের বিরাট মেলা বসবে। ডিসেম্বরের পূর্ণিমাতে প্রতিবছর এখানে জিপসিদের মেলা বসে। বেড়াল, কুকুর, ঘোড়া থেকে শুরু করে ফুলতোলা রুমাল পর্যন্ত সব পাওয়া যাবে ওখানে। গাছের ছালবাকল দিয়ে নানারকম ওষুধও বানিয়ে বিক্রি করে ওরা।

জিপসিদের একটা পাজি মেয়ে শোয়েবকে দেখে চোখ টিপে শিস দিলো। মেয়েটার অসভ্যতায় ভারি রাগ হলো রিনির। হঠাৎ করে এমন একটা কাণ্ড ঘটায় শোয়েবও থতমত খেলো। আর ঠিক তখনই ওদের চোখের সামনে থেকে মাফিয়াদের চরটা কর্পূরের মতো উবে গেলো।

জনি এদিক ওদিক তাকিয়ে চাপা গলায় চিৎকার করে উঠলো, মাফিয়া শয়তানটা আবার আমাদের চোখে ধুলো দিয়েছে।

শোয়েব আর রিনিও চমকে উঠে চারপাশে দেখলো। শীলা মনে মনে খুশি হলো উৎপাতটা কেটে পড়েছে দেখে। শোয়েব ব্যস্ত গলায় বললো, আমরা মারাওস্কির ওপর নজর রাখবো। বদমাশ মাফিয়াটা নিশ্চয় আমাদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে লুকিয়ে ফলো করছে মারাওস্কিকে।

ওরা সামনে তাকিয়ে দেখলো এই ফাঁকে, রবার্ট মারাওস্কি অনেকটা পথ এগিয়ে গেছেন। ওরা তাঁকে ধরার জন্য দ্রুত পা চালালো। আকাশে তখন সন্ধ্যার বিষণ্ণ আলো ছড়িয়ে থাকলেও শহরের রাস্তায় অন্ধকার নেমে গেছে। লাইটপোস্টের আলো পর্যাপ্ত না হওয়ার কারণে পুরোনো শহরটাকে আধো অন্ধকারে রহস্যময় মনে হচ্ছিলো। লোকজন কাজ সেরে ব্যস্ত পায়ে ঘরে ছুটছে শীতের কামড় থেকে বাঁচার জন্য। রিনিদের গায়ে পর্যাপ্ত গরম কাপড় থাকাতে শীতের ভয় ওদের ছিলো না। মাফিয়া নিয়ে শীলার যে ভয় ছিলো সেটাও আর নেই। দূর থেকে ওরা লক্ষ্য করলো মারাওস্কি একটা পুরোনো বাড়িতে ঢুকলেন।

বাড়িটার কাছে এসে ওরা প্রথমে বুঝে উঠতে পারলো না কি করবে। মাফিয়াদের চরটা ধারে কাছে কোথাও নেই। শোয়েব বললো, আমরা কি অপেক্ষা করবো মাফিয়া শয়তানটার জন্য?

পকেট থেকে চুইংগাম বের করে মুখে ফেলে চিবোতে চিবোতে শীলা বললো, ও এখানে আসবে তার কোনো গ্যারান্টি আছে?

না, তা নেই। শোয়েব ইতস্তত করে বললো, তবে মনে হচ্ছে আসতে পারে। এখানে অপেক্ষা করার চেয়ে, রিনি বললো, আমরা বরং মারাওস্কি চাচাকে সাবধান করে দিই।

রিনির প্রস্তাব অন্যদেরও পছন্দ হলো। শীলা মনে মনে রিনিকে ধন্যবাদ জানালো শোয়েবের প্রস্তাবে রাজী না হওয়ার জন্য।

ক্র্যাকভের পুরোনো শহরের অন্য সব বাড়ির মতো এ বাড়িটার বয়সও পাঁচশ বছরের কম হবে না।একটু গলির ভেতরে বলেই সদর রাস্তার বাড়ির মতো অতটা যত্ন নেয়া হয় না। ওরা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেলের সুইচ খুঁজলো। কোথাও কিছু না পেয়ে শোয়েব দরজায় একবার নক করতেই পুরোনো ওক কাঠের পাল্লা দুটো নিঃশব্দে খুলে গেলো, ভেতর থেকে আটকানো ছিলো না বলে। দোতালা বাড়ি। ভেতরে পা রাখতেই জনির গা ছমছম করে উঠলো। হরর মুভিতে যে রকম হন্টেড প্যালেস দেখা যায় ঠিক সেরকম। কোথাও প্রাণের সাড়া নেই। ওরা প্রথম যে ঘরে ঢুকলো সেটা ড্রইং রুম। সোফাগুলো পুরোনো, কার্পেটের রংও জ্বলে গেছে। অবাক হয়ে গেলো ওরা দেয়ালে চোখ পড়াতে। গ্যালারির মতো তিন দিকের দেয়াল পেইন্টিং-এ ঢাকা। আঁকার স্টাইল দেখে রিনির মনে হলো এগুলো অন্ততপক্ষে দুশ বছর আগের আঁকা ছবি। কোনোটা আরো পুরোনো হতে পারে।

জনি চারদিকে দেখে বললো, মারাওস্কি চাচা হঠাৎ কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন?

শোয়েব গলা তুলে ডাকলো–এনি বডি হোম?

কোথাও কারো কোনো সাড়া নেই। এক পা দু পা করে ওরা পাশের ঘরে গেলো। রিনির বুকের ভেতরটা হঠাৎ ধ্বক করে উঠলো। বুড়ো মারাওস্কির কোনো বিপদ হয় নি তো। কে জানে পুরোনো বাড়িতে চোরাকুঠুরি থাকে। সেরকম কোনো একটায় তাঁকে লুকিয়েও রাখতে পারে।

দুটো ঘর দেখে ওরা তৃতীয় ঘরে পা রেখে চমকে উঠলো। অন্য ঘরগুলোর চেয়ে এ ঘরের আলোটা বেশি উজ্জ্বল। কোনো শিল্পীর ছবি আঁকার স্টুডিও। ইজেলে রাখা মাঝারি আকারের ক্যানভাসে ম্যাডোনার ছবি, আঁকা শেষ পর্যায়ে। কিছুক্ষণ আগেও যে এ ঘরে কেউ ছিলো টের পাওয়া গেলো অ্যাশট্রেতে রাখা সিগারেটের ধোয়া দেখে। সিগারেটের মাথায় বেশ খানিকটা ছাই জমেছে। সেখান থেকে সরু সুতোর মতো নীলচে ধোয়ার রেখা কিছুদূর উঠে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে। সারা ঘরে ভ্যাপসা গন্ধ।

রিনি লক্ষ্য করলো ছবিটা খুবই পুরোনো স্টাইলে আঁকা আর বেশ পরিচিতিও মনে হচ্ছে। এ ধরনের ছবি আগেও কোথাও দেখেছে–কোথায় ঠিক মনে করতে পারছে না। শোয়েবকে বললো, মারাওস্কি চাচা যে ছবি আঁকেন বলেছিলেন কথাটা মিথ্যে নয়। তুমি মিছেমিছি ওকে অভিনেতা বানিয়েছে।

রবার্ট মারাওস্কি নামের বিখ্যাত অভিনেতা যে ছবি আঁকতে জানেন না এমন কথা ইনডেক্সে লেখা নেই। শান্ত গলায় শোয়েব বললো, তবে ছবি আঁকিয়ে হিসেবে তাঁর কোনো পরিচিতি নেই। মনে হয় এটা তাঁর সখ, কোনো প্রদর্শনী কখনো করেন নি।

কাছে গিয়ে ইজেলে রাখা ছবিটা খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে রিনি বার বার মনে করার চেষ্টা করছিলো ছবিটা এত পরিচিত মনে হচ্ছে কেন?

শীলা ছিলো রিনির ঠিক পাশে। জনি আর শোয়েব সামান্য পেছনে। ওদেরও নজর ছিলো ইজেলের সামনে দাঁড়ানো কৌতূহলী রিনির ওপর। ঠিক তখনই পেছন থেকে কারা যেন নিঃশব্দে এসে শোয়েব আর জনির পাঁজরে রিভলবারের নল ঠেকিয়ে পোলিশ ভাষায় স্বাভাবিক গলায় বললো, কেউ যদি এতটুকু নড়াচড়া করে তাহলে তাকে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে। সবাই মাথার ওপর হাত তোলে।

ওরা চারজন মুহূর্তের জন্য পাথরের মূর্তি হয়ে গেলো। শোয়েব আর জনির পাশে দুজন, সামনের দরজায় আরো দুজন ওদের দিকে স্টেনগান উঁচু করে ধরেছে।

মাথার ওপর হাত তুলতে বলা হয়েছে। শোয়েবের পাশের লোকটা কর্কশ গলায় ধমক দিলো।

ওরা দম দেয়া পুতুলের মতো হাত তুললো। হুঁশ ফিরতেই রিনি শোয়েবের দিকে তাকালো। সঙ্গে সঙ্গে আবার ধমক খেলো, কেউ এতটুকু নড়াচড়া

লোকটার কথা শেষ হওয়ার আগেই ঘরে ঢুকলো দামী স্যুট পরা লম্বা ছিপছিপে শরীরের এক বুড়ো। এক মাথা সাদা চুল আর মুখের ভাজ দেখেই শুধু বুড়ো মনে হয়, দাঁড়ানো আর হাঁটার ভঙ্গীতে মনে হয় বয়স বুঝি তিরিশের কোঠায়। কর্তৃত্বের গলায় লোকটা শোয়েবকে জিজ্ঞেস করলো, কোন সাহসে আমার বাড়িতে ঢুকেছো?

শোয়েব বললো, আমরা আঙ্কল মারাওস্কিকে অনুসরণ করে এখানে ঢুকেছি। ওঁকে একটা জরুরি কথা বলা দরকার।

কে আঙ্কল মারাওস্কি? জানতে চাইলো সাদা চুল।

তিনি একজন শিল্পী। যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে শোয়েব রিনি জনিকে দেখিয়ে বললো, ওয়ারস আসার পথে ওঁর সঙ্গে এদের পরিচয় হয়েছিলো। তিনি বলেছিলেন মাফিয়া লেগেছে তার পিছনে। বিকেলে মাফিয়াদের একজন লোককে যখন দেখলাম তার পিছু নিয়েছে ভাবলাম ওঁকে সাবধান করে দেয়া উচিত।

শোয়েবের পাশের লোকটি জার্মান ভাষায় বললো, হের রেইনহাইম। পাজিগুলো খুব ভালো গল্প ফেঁদেছে। আমি তখন থেকে দেখছি এরা আমাদের ডেরার ওপর নজর রাখছে। নিশ্চয় এরা কিছু জানে। মার দিলেই সব সুড়সুড় করে বলে দেবে। এদের আমার হাতে ছেড়ে দিন।

শোয়েবের ওপর থেকে চোখ না ফিরিয়ে সাদা চুল বললো, এখানে কোনে মারাওস্কি থাকে না। দুঃখিত, তোমাদের গল্পটি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয় নি।

আঙ্কল মারাওস্কি এখানে না থাকলে এসব ছবি কে আকঁলো?

রিনির কথায় সাদা চুল কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো, এগুলো যদি আমি আঁকি তোমাদের কি আপত্তি আছে?

আপনার কথা আমি বিশ্বাস করি না। আমি জানি এগুলো আঙ্কল মারাওস্কি এঁকেছেন। ওঁকে আমি ওয়ারসর রয়েল ক্যাসেলে দেখেছি ম্যাডোনার এ ছবিটা কপি করতে।

সাদা চুলের চোখের পাপড়ি সামান্য কাঁপলোতোমরা কি বিশ্বাস করলে আর কি করলে না এ নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই। আমার জানা দরকার তোমরা আমাদের কতটুকু জানো। তার ওপর নির্ভর করবে তোমাদের ভবিষ্যৎ। আপাতত তোমাদের আটকে রাখতে হচ্ছে বলে আমি খুব দুঃখিত।

দুঃখিত কথাটা বললো বটে সাদা চুলো, তবে ওর চেহারায় দুঃখের লেশমাত্র ছিলোনা।

কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুজন লোক ঘরে ঢুকলো দড়ি হাতে। অত্যন্ত দক্ষ হাতে ওদের হাতগুলো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললো। রাগে শীলার গা রি রি করে কাঁপছিলো। ওকে বাঁধার সময় চিৎকার করে বললো, আমাদের এভাবে আটকে রেখে ভেবো না পার পেয়ে যাবে। তোমাদের প্রত্যেককে এর ফল ভোগ করতে হবে।

ওরা কেউ শীলার কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না।