০৩. রাজপ্রাসাদে আরেক মারাওস্কি
ওয়ারস শহর যেখানে শেষ হয়ে গ্রাম শুরু হয়েছে ঠিক সেখানে রিনি জনির মনু মামার বাড়ি। লাল আকাশের পটভূমিতে কাঠের রেলিং ঘেরা অনেক খানি জায়গা জুড়ে কটেজের মতো বাড়িটাকে মনে হচ্ছিলো ভিউ কার্ডের ছবির মতো। হালকা নীল বর্ডার দেয়া ধবধবে সাদা রঙের কাঠের দোতালা বাড়ি, পেছনে পাথরের চিমনি থেকে ধোয়া উড়ছে। চারপাশে আপেল আর নাশপাতির গাছ। বাড়ির পেছনে কাঠের ঘেরা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে শুরু হয়েছে বিশাল এক মাঠ। গরম কালে ওখানে আলুর চাষ হয়। শীত আসার আগেই সব আলু তুলে মাটির তলায় খড় বিছিয়ে রেখে দেয়া হয়, পরের মৌসুমের জন্য।
মারাওস্কির ভাড়া করা ট্যাক্সিওয়ালা নম্বর মিলিয়ে মনু মামার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দুবার হর্ন টিপলো। তারপর পেছনের বনেট খুলে রিনি জনির হাতব্যাগ আর স্যুটকেস নামিয়ে দিলো।
হর্নের শব্দ শুনে সবার আগে ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এলো বিশালদেহী এক গ্রে হাউন্ড কুকুর। তার পেছনেই ছুটতে ছুটতে এলো মনু মামার মেয়ে শীলা, জনির চেয়ে দুবছরের ছোট, গায়ের রঙও জনির মতো শ্যামলা দুচোখে দুষ্টমির ঝিলিক, চুলগুলো উঁচু করে বাধা লাল পলকা ডটের ফ্রকের সঙ্গে ম্যাচ করা চওড়া রিবন দিয়ে। শীলা ছুটে এসে রিনিকে জড়িয়ে ধরলো–হাই রিনি আপু, জনি ভাইয়া, তোমাদের না কাল সকালে আসার কথা!
শীলার পেছন পেছন হাসিখুশি মনু মামা আর রাশভারি মনু মামী বেরিয়ে এসেছেন। মনু মামা অবাক হয়ে বললেন, কীভাবে এলি তোরা? আমাকে একটু আগেও লট-এর অফিস থেকে বললো তোদের ফ্লাইট ফ্র্যাঙ্কফুর্টে আটকা পড়েছে, কাল সকালের আগে পৌঁছবে না।
আটকা পড়েছে ঠিকই, আমরা অন্য ফ্লাইটে এসেছি। এই যে মারাওস্কি চাচা, ইনি ব্যবস্থা করেছেন। এই বলে রিনি মারাওস্কিকে পরিচয় করিয়ে দিলো বাংলাদেশের রাষ্টদূতের সঙ্গে। মনু মামা তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে চলুন, আমাদের সঙ্গে এক কাপ কফি পান করবেন।
মারাওস্কি ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, আজ খুব তাড়া আছে। আরেক দিন এসে খাবো। বাড়ি তো চিনেই গেলাম।
রিনি বললো, আমরা ওয়ারস থাকতে থাকতেই আসবেন।
নিশ্চয় আসবো লক্ষ্মী মেয়ে। এই বলে রিনি, জনি আর শীলাকে আদর করে মারাওস্কি বিদায় নিলেন।
শীলাদের গম্ভীর মুখো গ্রে হাউন্ড স্পটি এরই মধ্যে জনির সঙ্গে ভাব জমিয়ে ওর গায়ে মাথা ঘষে আদর জানাচ্ছে। মনু মামা অতি কষ্টে ওদের ভারি স্যুটকেসটা টেনে নিয়ে যেতে বললেন, চল, ভেতরে যাই। যে ঠাণ্ডা পড়েছে আজ রাতে নির্ঘাত বরফ পড়বে।
মামী রাশভারি গলায় জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের আব্দু আম্মু কেমন আছেন রিনি?
ভালো আছেন। মা আপনার জন্য কাশ্মিরী স্কার্ফ পাঠিয়েছেন।
গতবার বলেছিলাম তোমার মাকে। গম্ভীর গলায় বললেন মামী।
ড্রইংরুমে বসে মামা বললেন, তোদের সাহস তো কম নয়। বুড়ো পেইন্টারটা না থাকলে একা এয়ারপোর্ট থেকে এখানে আসতি কী করে?
মামার গলায় উদ্বেগ দেখে রিনি হেসে ফেললো–শোন মামা, লন্ডন থেকে মাঝপথে প্লেন বদলে ওয়ারস আসতে পারলাম আর এয়ারপোর্ট থেকে তোমাদের ঝোরনি আসতে পারবো না–এতটা বোকা ভাবছো কেন?
জনি বললো, তবে এটাও ঠিক আপু মারাওস্কি চাচা না থাকলে আমরা আমাদের ফ্লাইটেই আসতাম, মামাও সময়মতো এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠাতে পারতেন।
যা হবার হয়েছে। মামী বললেন, রিনি জনি মুখ হাত ধুয়ে নাও। শীলা তোমাদের ঘর গুছিয়ে রেখেছে। আধঘন্টা পর সবাইকে ডিনারে ডাকা হবে।
এসো রিনি আপু, জনি ভাইয়া। তোমাদের ঘর ওপরের তলায়, আমার ঘরের ঠিক পাশে। এই বলে ওদের হাত ব্যাগ দুটো নিয়ে শীলা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ধুপধাপ শব্দ করে ওপরে গেলো।
রিনি দেখলো ওর পায়ের শব্দে মামীর কপালে ভাঁজ পড়েছে।
জনি উঠে ওদের ভারি স্যুটকেসটা ওপরে নিতে যাবে–মামী বললেন, ওটা ওখানে থাক এর পর সামান্য গলা তুলে ডাকলেন–আঁদ্রে।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো ঝাড়া সাত ফুট লম্বা দশাসই শরীরে সুন্দর চেহারা এক পোলিশ যুবক। মামী ওকে পোলিশ ভাষায় কি যেন বললেন। আঁদ্রে একটু হেসে রিনি জনিকে সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানালো। তারপর ছত্রিশ কেজির ভারি জাম্বো স্যুটকেসটা খেলনার মতো তুলে নিয়ে ওপরে চলে গেলো। রিনি জনির বিস্ময় দেখে মামা বললেন, আঁদ্রে আমাদের বাড়িতে কাজ করে। দুহাতে চার মণ ওজন অনায়াসে তুলে ফেলে। অথচ বেচারা কথা বলতে পারে না।
জনি বললো, আমি বাজি ধরতে পারি মামা। স্টালোন, শোয়ার্জনিগার কেউ আঁদ্রের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে পারবে না।
ওরা কারা? কুস্তিগীর নাকি!
না মামা। ফিল্ম অ্যাকটর। বেচারা আঁদ্রে, কথা বলতে পারলে সিনেমার প্রডিউসাররা ওকে লুফে নিতো।
ওপর থেকে শীলা ডাকলো, রিনি আপু, তোমরা আসছো না কেন?
যাই। বলে রিনি ছুটে সিঁড়ির কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। মামীর কপালে ভাঁজের কথা মনে পড়ায় পা টিপে টিপে ওপরে উঠলো।
ওকে ওভাবে পা টিপে হাঁটতে দেখে শীলা অবাক হয়ে বললো, তোমার পায়ে কি হয়েছে রিনি আপু? ব্যথা পেয়েছো?
রিনি মুখ টিপে হাসলো–তুমি যেভাবে ধুপধাপ করে ওপরে উঠেছে, দেখ নিতে মামীর কপালে কয়টা ভাঁজ পড়েছে।
জানি। শীলা হেসে বললো, কি করবো, মনে থাকে না যে!
শীলার কথা শেষ না হতেই কাঠের সিঁড়িতে বেদম শব্দ করে জনি ওপরে উঠলো। রিনি বড় বড় চোখে একবার জনিকে আরেকবার শীলাকে দেখলো। শীলা ঝর্ণার মতো বাঁধভাঙা হাসিতে গড়িয়ে পড়লো। জনি অবাক হয়ে রিনি আর শীলাকে দেখলো। নিশ্চয় কোনো মেয়েদের ব্যাপার হবে–এই ভেবে গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকলো।
খাবার টেবিলে আয়োজন দেখে রিনি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলো আর জনির চোখ দুটো খুশিতে চকচক করে উঠলো। মামী বাঙালী খাবারই তৈরি করেছেন। দুরকমের মাছ রান্না, মুরগী, ফুলকপি ভাজি আর নিরামিষ। ওরা টেবিলে বসতেই আঁদ্রে আস্ত একটা ভাপানো রুই মাছ বড় ডিশে করে টেবিলের মাঝখানে রাখলো। রুই মাছটার ওপর সস আর গাজর, মটরশুটি সেদ্ধ ছড়ানো। জনি বলেই ফেললো, দেখে মনে হচ্ছে দারুণ ডেলিশাস হবে।
রিনি শুকনো মুখে শীলার পাশে বসে এক টেবিল চামচ ভাত আর দুচামচ নিরামিশ তুলে নিলো ওর প্লেটে। মামী প্রথমে কিছু বললেন না। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ওটুকু খেয়ে ও যখন ফুট সালাদের দিকে হাত বাড়ালো মামী গম্ভীর হয়ে বললেন, ওটা সবার। শেষে খেতে হয় রিনি।
রিনি কাষ্ঠ হেসে বললো, আমার খাওয়া শেষ মামী।
জনি তখন মাছ শেষ করে মাংশের পর্ব শুরু করেছে। খেতে খেতে বললো, ও রাতে কিছুই খায় না মামী। ডায়েটিং করে।
ডায়েটিং করার বয়স এটা নয়। এই বলে মামী ওর পাতে বড় এক টুকরো স্যামন মাছ তুলে দিলেন–যখন আমাদের মতো বয়স হবে তখন হিসেব করে খাবে। তোমরা না খেলে এত রান্না করলাম কেন?
জনি বললো, বাড়িতে আম্মুও ওকে একথা বলেন।
তোমার মোড়লি করতে হবে না। রিনি শুকনো মুখে মাছের টুকরো খুঁটে মুখে দিলো যেন দায়ে পড়ে এন্টিবায়োটিক খাচ্ছে।
খাওয়া শেষ করে সবাই ড্রইং রুমে বসলো। টেলিভিশনে তখন দুর্ধর্ষ এক ফাইটিং ছবি হচ্ছিলো। ভাষা না বুঝলেও জনি নিবিষ্ট মনে ছবি দেখতে লাগলো। পাইপে আগুন ধরিয়ে একগাল ধোয়া ছেড়ে মামা বললেন, তোমাদের জন্য আমি বারো দিনের চমৎকার একটা প্রোগ্রাম বানিয়ে রেখেছি। মনে হয় রিনি জনির অপছন্দ হবে না।
রিনি কোনো কথা বললো না। ও ভাবছিলো বারো দিন যদি এ ধরনের রিচ ফুড খেতে হয় তাহলে নির্ঘাত ওর ওজন তিন থেকে চার পাউন্ড বেড়ে যাবে। কী ভয়ানক কথা!
রাতে ওদের ঘরে ঘুমোতে এসে নিজের এই আশঙ্কা জনিকে না বলে পারলো না রিনি। বাইরে তখন ঝুর ঝুর করে সাদা তুলোর মতো তুষার পড়ছে। ডবল কাঁচ লাগানো বড় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তুষার পড়া দেখতে দেখতে জনি বললো, ঘাবড়াচ্ছিস কেন আপু! আজ প্রথম দিন বলে একটু বেশি রান্না হয়েছে। রোজ কি আর এরকম হবে!
রিনি ওর বিছানায় কম্বলের তলায় ঢুকে বললো, তোর কি কোনো চিন্তা আছে! রোজ এরকম হলেই তো তুই খুশি।
নারে আপু! মামী শুধু আমার জন্য রোজ এত কষ্ট করবেন না। শুয়ে পড়লি কেন? কি চমৎকার স্নো ফল–দেখ না। ওই উঁচু জায়গাটা দেখ আপু। বাড়ির পেছনে খোলা প্রান্তরের এক জায়গায় আঙ্গুল দিয় দেখালো জনি–মনে হচ্ছে মস্ত বড় একটা সুইস কেক।
রিনির দুচোখে তখন ঘুম নেমেছে। জড়ানো গলায় বললো, খেতে হয় তুই খা। আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
তুষার পড়া দেখতে জনির সব সময় ভালো লাগে। ছুটির দিনে ঘুম থেকে উঠেই পার্কে ছোটে। ওর কাছাকাছি বয়সের পাড়ার ছেলে মেয়েরা সেখানে প্রতিযোগিতায় নামে কারা কত সুন্দর স্নো ম্যান বানাতে পারে।
সকালে নাশতার অফিসে মামা শীলাকে বললো, শোয়েবকে আমি ফোন করে দিয়েছি। ওর বাবাকে অফিসে ড্রপ করে দশটার ভেতর চলে আসবে। পোল্যান্ডে শোয়েবের চেয়ে ভালো গাইড তোমরা পাবে না।
শোয়েব কে মামা? জানতে চাইলো রিনি।
আমাদের এম্ব্যাসির কাউন্সিলার মাহবুব সাহেবের ছেলে। এ লেভেল শেষ করে এ বছর ওয়ারস ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। আমাদের চেয়ে বেশি দিন ধরে ওরা ওয়ারসতে আছে।
শীলা বললো, জানো রিনি আপা, শোয়েব ভাই গত বছর ফরেন মিশন আইস স্কেটিং টুর্নামেন্টে ফার্স্ট হয়েছে।
দারুণ তো! জনি উত্তেজিত গলায় বললো, আমি তাহলে এখান থেকে স্কেটিংটা শিখে নেবো।
দশটা বাজার দশ মিনিট আগেই এসে গেলো শোয়েব। তামাটে রঙের ছিপছিপে গড়নের ধারালো চেহারার তরুণটিকে দেখেই রিনি জনির ভালো লেগে গেলো। ওরা সবাই আপেল গাছের তলায় স্নো ম্যান বানানোর কসরৎ করছিলো। বাইরের দরজায় শোয়েবের গাড়ি থামতেই সবাই ছুটে গেলো সেখানে। শোয়েব গাড়ি থেকে নেমে মৃদু হেসে বললো, হ্যালো এভরিবডি। আঙ্কলকে দশটা বলেছিলাম। দশ মিনিট আগে আসার জন্য নিশ্চয় কিছু মনে করো নি।
শীলা উচ্ছ্বসিত গলায় বললো, আব্লু বলার পর থেকে ঘড়ি দেখছি কখন দশটা বাজবে। এসো, এদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি।
আমি জানি। তুমি হচ্ছে রিনি আর তুমি জনি। হেসে বললো শোয়েব।
ওর হাসির জবাবে রিনিও হাসলো। জনি এগিয়ে এসে শোয়েবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বড়দের মতো করে বললো, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হয়েছি শোয়েব ভাই।
শোয়েব বললো, ভাই বললে আপনি বলা চলবে না, রাজী?
জনি হেসে বললো, রাজী।
রিনি কিছু বলতে পারলো না। কোনো কারণ ছাড়াই ও লজ্জায় লাল হচ্ছিলো। পরির মতো সুন্দর মেয়েটি কিন্তু আমার সঙ্গে এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলে নি।
শোয়েবের কথায় রিনি আরো লাল হয়ে বললো, মোটেও আমি সুন্দর নই।
শোয়েবের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাসলো–যাক, শেষ পর্যন্ত কথা বললো।
রিনি লক্ষ্য করলো হাসলে শোয়েবকে দারুণ হ্যান্ডসাম লাগে। একেই মনে হয় ভূবনজয়ী হাসি বলে। ওর কথা ভাবতে গিয়ে রিনির ফর্সা গালে পাকা আপেলের রঙ ধরলো। বুঝতে পেরে শোয়েব আবার হাসলো।
শীলা বললো, আজ কি প্রোগ্রাম শোয়েব ভাই?
প্রথমে মিউজিয়াম। তারপর ওল্ড সিটিতে লাঞ্চ। লাঞ্চের পর রয়েল প্যালেস।
আগামী কাল? জানতে চাইলো জনি।
এশিয়া প্যাসেফিক সেন্টার। বোট রাইডিং উইথ লাঞ্চ। এরপর বোটানিক্যাল গার্ডেন।
তারপর? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আরো লাল হলো রিনি।
শোয়েব হেসে বললো, ওয়ারস থেকে অনেক দূরে। ওল্ড মিউজিয়াম সিটি ক্র্যাকভ। নাইট স্টে। সল্ট মিউজিয়াম…
শীলা বাধা দিয়ে বললো, থাক থাক শোয়েব ভাই। আগে সব বলে ফেললে সারপ্রাইজ দেয়ার মতো কি আর থাকলো। চলো বেরিয়ে পড়ি।
যথাসময়ে সারপ্রাইজও দেবো। হাসি চেপে গম্ভীর মুখে গাড়িতে উঠতে উঠতে বললো শোয়েব।
স্পটিকে বারান্দায় শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিলো। শীলা ওকে ফেলে গাড়িতে উঠছে দেখে মহা চিৎকার জুড়ে দিলো। ভেতর থেকে শীলার মা এসে ধমক দেয়ার পর থামলো। শোয়েব ততক্ষণে গাড়িতে পুরো স্পীড তুলেছে! শীলা বললো, স্কুলে যাওয়ার সময় স্পটি কিছুই বলে না। অন্য সময় কোথাও গেলেই ও সঙ্গে যেতে চাইবে। না নিলে রেগে টং হয়ে যায়।
শোয়েব বললো, আমার সঙ্গে বেরোলে যে ওর রাগ বেড়ে যায় ওটাও বলো। আজ পর্যন্ত এমন একটা কুকুরের দেখা পেলাম না যেটা আমাকে পছন্দ করে। দেখলেই এমনভাবে তাকায় নয়তো ঘোয়াও করে ওঠে–রাগে পিত্তি জ্বলে যায়।
রিনি বললো, মানুষের পছন্দটা কুকুরের পছন্দের চেয়ে বেশি জরুরী।
ভালো বলেছো। গলা খুলে হাসলো শোয়েব। সব মানুষ না হলেও কোনো কোনো মানুষ যে পছন্দ করে সেটা আমি ঠিকই বুঝতে পারি, বিশেষ করে যাদের আমি পছন্দ করি।
শীলা বললো, অন্য কুকুরের কথা জানি না। তুমি যদি স্পটিকে ভালোবাসো, স্পটিও তোমাকে ভালোবাসবে। ও খুব লক্ষ্মী কুকুর।
জনি বসেছিলো সামনে, শোয়েবের পাশের সিটে। বললো, তোমাদের মিউজিয়াম কি খুব ভালো?
তোমরা কি বৃটিশ মিউজিয়াম দেখেছো? পাল্টা প্রশ্ন করলো শোয়েব।
রিনি বললো, অনেক বার দেখেছি।
গাড়ি চালাতে চালাতে শোয়েব বললো, বৃটিশ মিউজিয়ামের তুলনায় এটা কিছুই । তবে আমার দেখতে ভালো লাগে। পরিবেশটা খুব ঘরোয়া।
মিউজিয়াম দেখতে গিয়ে মুগ্ধ কিংবা বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু পেলো না জনি। ওর কাছে বৃটিশ মিউজিয়ামের তুলনায় খুবই গরিব মনে হলো। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করলে নিশ্চয় দারুণ কিছু। রিনির অবশ্য ততটা খারাপ লাগে নি। কারণ আর কিছু নয়, শোয়েব যেভাবে পোলিশ ভাষায় বিবরণ পড়ে সব কিছু বুঝিয়ে দিচ্ছিলো, মুগ্ধ হয়ে শুনছিলো রিনি। ভাবছিলো কখনো সুযোগ পেলে বলবে রবীন্দ্র সঙ্গীতের জন্য শোয়েবের গলা খুব ভালো। কে জানে গায় কি না।
মিউজিয়াম দেখে ওরা যখন ওল্ড সিটিতে খেতে এলো ঘড়িতে তখন প্রায় দুটো বাজে। পুরোনো দিনের বনেদী প্যাটার্নের বাড়ি দিয়ে তিন দিক ঘেরা বিশাল এক চত্বরে গাড়ি পার্ক করে রাখলো শোয়েব। এক দিকে খোলা চত্বরে রেস্তোরাঁর চেয়ার সাজানো রয়েছে। আরেক দিকে দেখলো হাতে আঁকা ছবির পশরা নিয়ে বসেছে কয়েকজন। রিনি ওদের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাতেই শোয়েব বললো, দেখবে নাকি! এরা সবাই শিল্পী।
ছোট থাকতেই ছবি আঁকার দারুণ শখ রিনির। বললো, আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
এগুলো একটা দেখার জিনিষ হলো আপু। জনি মুখ ভার করে বললো, আমার ক্ষিদে পেয়েছে।
রিনি ওর কাছে এসে চাপা গলায় বললো, সবার সামনে ক্ষিদে ক্ষিদে বলতে লজ্জা করে না তোর?
মুখ কালো করে জনি বললো, বারে, খিদে পেলে বুঝি বলবো খিদে পায় নি।
শোয়েব হেসে বললো, ঠিক আছে রিনি। আমরা বরং খেয়ে নিই আগে। তুমি কিছু মনে কোরো না। শুধু জনির নয়, খিদে আমারও পেয়েছে।
তবে? উত্তেজিত গলায় জনি বললো, আমরা কি তোর মতো ডায়টিং করছি যে খিদে পেলেও না খেয়ে থাকবো?
রিনি কাঁধ নাচিয়ে অসহায় চোখে তাকালো শীলার দিকে। শীলারও খিদে পেয়েছিলো। কথাটা বলা ঠিক কতটা মার্জিত হবে সেটাই ভাবছিলো ও। ছেলেরা বলাতে ও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। রিনিকে বললো, চলো রিনি আপু। আমি দেখেছি খিদে পেলে ছেলেদের মাথা গরম হয়ে যায়।
মেয়েরা বুঝি খিদে পেলে ঠাণ্ডা মাথায় অঙ্কের লেসন নিয়ে বসে! ফোড়ন কাটলো জনি।
শীলা বললো, তুমি বোধহয় জানো না জনি ভাইয়া, আব্দু বলেছেন ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা অঙ্ক ভালো পারে।
লাঞ্চে ওরা বেশি কিছু খেলো না। সেদ্ধ আলু, মাংসের স্টু আর সজির সালাদ ভাগ্যিস সেদিন রিনির মাংস খাওয়ার তারিখ ছিলো। নইলে শুধু সালাদ খেতে হতো।
খুব সস্তায় ওদের খাওয়া হয়ে গেলো। শোয়েব রিনিকে বললো, আমরা চারজন খেলাম, হিসেব করলে পুরো তিন পাউন্ড খরচ হয় নি। লন্ডনে এ খাবার খেতে কম করে হলেও তিরিশ পাউন্ড লাগবে।
তুমি কবে লন্ডনে গেছো শোয়েব ভাই? জানতে চাইলো জনি।
কয়েকবারই গিয়েছি। শেষ গিয়েছি গত সামারে।
বাইরে থেকে রয়েল প্যালেস দেখে রিনি জনি বেশ হতাশ হয়েছিলো। লন্ডনের গ্রামেও এ রকম সাদামাটা ক্যাসেল দেখা যায়। ভেতরে গিয়ে ওদের মাথা ঘুরে গেলো।
টিকেট কেটে ঢুকতেই এক জায়গায় ওদের জুতো খুলে নরম কাপড়ের চটি পরতে হলো। নাকি মেঝের কারুকার্য করা মার্বেল ক্ষয়ে যাবে। প্রত্যেক ঘরে আসবাবপত্র ছাড়াও দেয়ালে ছাদে সবখানে পেইন্টিং–এর ছড়াছড়ি। মারাওস্কি বুড়ো মিথ্যে বলেনি। পাঁচশ, ছশ বছরের পুরোনো বিখ্যাত সব শিল্পীর আঁকা। সব ছবি কারুকার্য করা সোনার ফ্রেমে বাঁধানো, দেয়ালের নকশায় সোনার কাজ, দরজার হাতল আর নকশা নিরেট সোনার তৈরি। গোটা রাজপ্রাসাদে নাকি কয়েক হাজার কেজি সোনা আছে।
রাজার সিংহাসন দেখে জনি বললো, ইচ্ছে করছে একটু বসে দেখি।
চারপাশে প্রহরীদের ভয়ে জনির সাহস হলো না। শোয়েব বলল, এ সিংহাসনে শেষ বসেছেন পোপ জন পল।
শোয়েব নিজে গাইডের কাজ করছিলো বলে ইচ্ছে মতো ঘুরে ঘুরে সব দেখতে পারছিলো ওরা। যারা গাইডেটুর নিয়েছে, দল বেঁধে সব গাইডের পেছন পেছন ঘুরছে। নিজের পছন্দ মতো কোনো জায়গায় যেতে পারছে না। এর ভেতর আর্ট স্কুলের ছেলে মেয়েরা মাঝে মাঝে বসে কোনো বিখ্যাত ছবি কপি করছে। এ রকম দৃশ্য রিনি জনি লন্ডনের অনেক গ্যালারিতেও দেখেছে।
হঠাৎ রিনি লক্ষ্য করলো বুড়ো মারাওস্কি রানির শোয়ার ঘরের এক কোণে বসে অনেক পুরোনো একটা পেইন্টিং কপি করছেন। কাছে গিয়ে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো, মারাওস্কি চাচা, আপনার সঙ্গে এখানে দেখা হয়ে যাবে ভাবি নি!
রিনির হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে বুড়ো জার্মান ভাষায় বললেন, আমি দুঃখিত। আমার মনে হয় না তোমাদের সঙ্গে আমার কখনো পরিচয় হয়েছে।
বুড়োর কথা শুনো রিনি অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। না, এই বুড়ো দেখতে যদিও মারাওস্কির মত, তবে মারাওস্কি নয়। এর বয়স অন্তত দশ বছর বেশি হবে। গলার স্বরও একেবারে অন্যরকম। আসল মারাওস্কি জার্মান বলতে পারে না। রিনি জার্মান ভাষায় মাপ চেয়ে বললো, আমাদের এক পরিচিত পেইন্টারের সঙ্গে আপনার চেহারা গুলিয়ে ফেলেছিলাম। আশা করি কিছু মনে করবেন না।
এরকম হতেই পারে। বুড়ো রিনিকে আশ্বস্ত করে বললেন, আজ সকালেও শুকনো মতো একটা লোক আমাকে তোমাদের মতো ভুল করেছিলো মারাওস্কি ভেবে। আমার মতো দেখতে লোকটা নিশ্চয় ওয়ারস থাকে। দেখতে হবে এত ভুল কি করে হয়।
আপনি কি রোজ আসেন এখানে?
আরও এক মাস আসতে হবে। এখানে আমি থার্টিনথ সেঞ্চুরির কয়েকজন জার্মান পেইন্টারের ওপর কাজ করছি।
ঠিক আছে। আঙ্কল মারাওস্কিকে আপনার কথা বলবো।
এই বলে রিনিরা ওখান থেকে চলে এলো। জনি বললো, ভালো করে দেখলে এ ভুল তুই করতি না আপু। চেহারায় কিছু মিল আছে, তবে আমাদের চাচার চেয়ে অনেক বুড়ো।
ভুল আমি একা করিনি। রিনি শান্ত গলায় বললো, আমার অনুমান যদি ঠিক হয় তাহলে বলবো মাফিয়ার লোকেরাও একই ভুল করেছে।
এখানে আবার মাফিয়া কোথায় পেলে রিনি? অবাক হয়ে জানতে চাইলো শোয়েব।
মারাওস্কি নিজের সম্পর্কে যা বলেছিলেন সব কথা ওকে খুলে বললো রিনি। শেষে যোগ করলো, আমার মনে হয় ওরা এখানেও বুড়োকে ফলো করছে।
কী সাংঘাতিক! এত বড় একজন পেইন্টারকে ওরা মেরে ফেলবে? অসহিঞ্চু গলায় বললো শোয়েব।
এখন না মারলেও পরে মারবে। জবাব দিলো রিনি।
শীলা বললো, কে কাকে মারবে এসব কথা বলতে আমার ভালো লাগে না। শোয়েব ভাই তো রিনি আপুদের শহরটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারো।
রিনি যদি চায় আনন্দের সঙ্গে পারি। এই বলে শোয়েব রিনি আর শীলার জন্য গাড়ির পেছনের দরজা খুলে মাথাটা এমনভাবে নোয়ালো যেন ও শোফারের কাজ করছে। বলা বাহুল্য রিনির ভালো লাগার ব্যারোমিটারের পারদ আরও খানিকটা ওপরে উঠলো।
জনি একটু গম্ভীর হয়ে সামনের সিটে বসলো। মেয়ে দুটোকে শোয়েব কেন এত পাত্তা দিচ্ছে এটা ওর বোধগম্য হলো না। বিটলস-এর লেট ইট বি গুণগুণ করে গাইতে গাইতে শোয়েব গাড়িতে স্পিড তুললো।
.
০৪. ক্র্যাকভে মাফিয়ার চর
পরের দিন রিনিদের সব কিছু রুটিন মতো ঘুরিয়ে দেখিয়ে সন্ধ্যার দিকে শোয়েব ওদের নিয়ে গেলো নিজেদের বাড়িতে। আগে থেকেই বলা ছিলো রাতে রিনি, জনি আর শীলা ওদের বাড়িতে খাবে।
শোয়েবের মাকে দেখে রিনির খুব ভালো লেগে গেলো। মনু মামীর মতো মেপে মেপে কথা বলা, এটিকেট আর ম্যানারের কোনো পরোয়া করেন না। মোটাসোটা, হাসি খুশি সাধারণ বাঙালী মহিলা, রিনিকে দেখেই–এসো মা এসো। এক্কেবারে পরিপুতুলের মতো দেখতে। কাল রাত থেকে শোয়েব তোমাদের কথা বলতে বলতে বাড়ির সবার কান ঝালাপালা করে দিয়েছে। কাল ভেবেছিলাম বুঝি বাড়িয়ে বলছে। এখন মনে হচ্ছে একটুও বাড়িয়ে বলে নি। এসো মা শীলা। তুমিও এসো বাবা। এই বলে জনিকে বুকে টেনে নিলেন শোয়েবের মা।
বাইরের ঘরে ওদের কথা শুনে ভেতর থেকে শোয়েবের বাবাও বেরিয়ে এলেন। মনু মামার চেয়ে বয়সে কিছুটা ছোট হবে। স্মার্ট চেহারা। শোয়েব অবিকল ওর বাবার মতো দেখতে। হাসিমুখে তিনি রিনিকে জিজ্ঞেস করলেন, ওয়ারস কেমন লাগছে মা? শোয়েব সব কিছু ঠিক মতো দেখাচ্ছে তো?
রিনি বললো, ভারি সুন্দর শহর ওয়ারস।
জনি বললো, শোয়েব ভাই গাইডের চাকরি করলে অনেক টাকা কামাতে পারতেন।
হা হা করে হেসে শোয়েবের বাবা বললেন, গত মাসে ব্রাসেলস থেকে আমাদের ইইসির অ্যাম্বাসাডর এসেছিলেন এখানে এক কনফারেন্সে। তিনিও বলেছেন শোয়েব একেবারে পাকা গাইডের মতো সব বুঝিয়ে বলতে পারে। শেষকালে মনে হয় ও গাইডই হবে।
শোয়েব বললো, যতোই বলো বাবা, গাইড হওয়ার জন্য নিশ্চয় আমি অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স পড়ছি না।
শোয়েবের মা বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবে নাকি! সবাই ভেতরে চলো।
রিনিদের নিজের ঘরে নিয়ে গেলো শোয়েব। ড্রইংরুমে একজন বিদেশী ভদ্রলোক বসেছিলেন। নাকি ফ্রেঞ্চ অ্যাম্বাসির ফার্স্ট সেক্রেটারি।
বাড়ির মানুষদের মতো শোয়েবের ঘরটাও ভালো লাগলো রিনির। মোটেও জনির ঘরের মতো লোমেলো নয়। দেয়াল ঘেঁষে মাঝারি সাইজের বিছানা, পাশে পড়ার টেবিল চেয়ার, এ পাশের দেয়ালে দুটো গদিমোড়া চেয়ার সব কিছু পরিপাটি করে গোছানো। দেয়ালে এলভিস প্রিসলি আর ম্যাডোনার দুটো বড় পোষ্টার। এলভিসেরটা সাদাকালো, ম্যাডোনার পোষ্টার রঙিন। পোষ্টারের পাশে দেয়ালে ঝোলানো একটা স্প্যানিশ গিটার, আরেক দিকের দেয়ালে পোল্যান্ডের দুটো প্রাকৃতিক দৃশ্যের অয়েল পেইন্টিং।
গিটার দেখে রিনি বললো, শোয়েব ভাই, তুমি কি গান জানো?
জানি বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না, তবে চেষ্টা করি।
অত বিনয় দেখাতে হবে না শোয়েব ভাই। শীলা বললো, তোমার গান ছাড়া এখানকার বাঙালীদের যে কোনো অনুষ্ঠান জমে না, এ তুমি ভালো ভাবেই জানো।
ওই যে, কোন বনে যেন শেয়াল রাজা–সেরকম আর কি। শোয়েব হাসলো।
আমি কিছুই শুনতে চাই না শোয়েব ভাই। আমাকে স্প্যানিশ গিটার বাজানো শেখাতে হবে। বিচারকের রায় দেয়ার ভঙ্গিতে বললো জনি।
কি সর্বনাশ! আঁতকে ওঠার ভান করলো শোয়েব–আজ ভোরে বললে তোমাকে আইস স্কেটিং শেখাতে হবে সাত দিনে, এখন বলছো গিটার শিখবে–তাও নিশ্চয় সাত দিনে। এর ওপর তোমাদের গাইডগিরি। সাংঘাতিক একটা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম নিতে হবে দেখছি।
জনি সব সময় ওরকম বলে। সব কিছু ওর শেখা দরকার, অথচ কোনো কিছুতেই লেগে থাকতে পারে না।
রিনির কথায় জনি খুবই বিরক্ত হলো। জবাব দেয়ার আগেই ওর চোখ পড়লো শোয়েবের টেবিলে ষ্টিফেন কিং-এর অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড কমিকটা রয়েছে। সব কিছু ভুলে গিয়ে মুহূর্তের ভেতর ও কমিক নিয়ে ডুবে গেলো।
শোয়েবদের বাড়ির সবই ভালো লেগেছিলো রিনির, শুধু খাবার টেবিলের আয়োজন ছাড়া। ওর অনুরোধে মনু মামী কাল কিছু আইটেম কমিয়েছেন কিন্তু এ টেবিলে যে এত আইটেম থাকবে ও স্বপ্নেও ভাবে নি। খাবার সময় ওর শুকনো মুখ দেখে শোয়েবের মা ভাবলেন রান্না বুঝি ভালো হয় নি, তাই বেচারি অনিচ্ছা নিয়ে খাচ্ছে। বললেন, বাড়িতে কাজের লোক নেই। রান্না মনে হচ্ছে ভালো হয় নি।
রিনি বললো, না চাচী, রান্না খুবই ভালো হয়েছে। রাতে আমি কম খাই।
কম খাওয়া মানে কি এই! শোয়েবের মা রিনির পাতে দু টুকরো মুরগির মাংশ তুলে দিলেন। বললেন, এ রান্নাটা আমার এক হাঙ্গেরিয়ান বান্ধবীর কাছ থেকে শিখেছি। একেবারে কম মশলা দিয়ে করা।
রিনির অসহায় অবস্থা দেখে জনি বললো, আপু, এ কদিনের জন্য তোর ডায়েট চার্ট ভুলে যা। ওটা বাড়ি গিয়ে ফলো করিস।
শোয়েবের বাবাও ঠিক মনু মামীর মতো বললেন, তোমাদের এ বয়সে কখনো ডায়েটিং দরকার হয় না। প্রচুর খাবে, খেলাধুলো করবে, গায়ে চর্বির চিহ্ন থাকবে না।
উপায় না দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিনি সবার কথা মেনে নিলো। খাওয়া শেষ হতে হতে সাড়ে নটা বাজলো। শোয়েবের বাবা বললেন, আজ আর রাত বাড়িয়ে কাজ নেই। এক রোববার সারাদিন কাটাবে এখানে।
রিনিরা আসাতে শীলার হয়েছে মজা। কোনো ফ্যামিলি পার্টি ছাড়া ওর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। শোয়েবের বাবার কথায় ও উৎফুল্ল হয়ে বললো, ক্র্যাকভ থেকে ফিরে এসেই আমরা পরের রোববারে পিকনিক করবো এখানে।
শহর থেকে শোয়েবদের বাড়ি শীলাদের বাড়ি থেকেও কিছু দূরে। যে জন্য কম ভাড়ায় অনেক জায়গাওয়ালা একটা ছবির মতো কটেজ পাওয়া গেছে। হেমন্তকালে লাল স্টবেরি আর র্যাপসবেরি পেকে ভরে থাকে পেছনের বাগানটা। শোয়েবের মা সেগুলো দিয়ে জ্যাম বানান, জুস বানান, পরিচিত সবার বাড়িতে পাঠান, তারপরও শেষ হয় না।
ঘরে ফিরতে ফিরতে শীলাদের সোয়া দশটা বাজলো। মনু মামা বললেন, দশ মিনিট আগে এলেই রিনি জনি তোমাদের মার সঙ্গে কথা বলতে পারতে। বলে দিয়েছি তোমরা খুব এনজয় করছে।
রিনি বললো, বলেছেন তো কি হারে ওজন বাড়ছে?
কি করে বলবো! অসহায় ভঙ্গিতে বললেন মনু মামা-দুদিনে কারো ওজন বাড়ে এ কথা আগে কখনো শুনি নি।
মামী গম্ভীর গলায় বললেন, সকাল ছটায় ক্র্যাকভের ট্রেন ধরতে হলে তোমাদের চারটায় উঠতে হবে। আশা করি সবার মনে আছে।
এতটুকু জিব কেটে শীলা–চলে এসো রিনি আপু, বলে সিঁড়িতে ধুপধাপ শব্দ করে ওপরে উঠে গেলো। পেছন পেছন জনিও ছুটলো। রিনি ওর স্বভাব অনুযায়ী কোনো শব্দ না করেই ওপরে গেলো। ওর মামী মনু মামাকে বললেন, তোমার মেয়ের উচিৎ রিনির কাছে ম্যানার শেখা।
এসব মেয়েলি ব্যাপার তুমিই বোঝে। পাইপ টানতে টানতে মনু মামা সেদিনকার বিলেতি কাগজ গার্ডিয়ানে মনোযোগ দিলেন।
ভোর সোয়া পাঁচটায় স্টেশনে যাওয়ার জন্য শীলার মা রেডিও ট্যাক্সিকে রাতেই বলে রেখেছিলেন। পাঁচটা দশ মিনিটে ট্রাক্সি এসে বাইরের দরজায় দুবার হর্ন দিলো। রিনি, জনি, শীলা আগে থেকেই তিনটা হাত ব্যাগ গুছিয়ে নাশতা খেয়ে তৈরি হয়ে ড্রইংরুমে বসেছিলো। শীলার বাবা এত সকালে ওঠেন না। সেদিন তিনি শীলাদের সঙ্গে নাশতা করে দ্বিতীয় পেয়ালা চা নিয়ে বসেছেন। ট্যাক্সির হর্ন শুনে শীলারা উঠে দাঁড়ালো। সবার গায়ে ওভার কোট, মাথায় টুপি, ভেতরে পর্যাপ্ত গরম কাপড়। তারপরও মামী বললেন, ক্র্যাকভ থেকে ঠাণ্ডা লাগিয়ে এসো না। সন্ধ্যার পর হোটেলে ফিরে যাবে। পরশু সন্ধ্যায় স্টেশনে তোমাদের জন্য গাড়ি অপেক্ষা করবে।
তোমার হুকুমের কোনো নড়চড় হবে না আম্মু। এই বলে শীলা স্পটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘর থেকে বেরোলো। রিনি জনি ওকে অনুসরণ করলো। স্পটি বুঝতে পেরেছিলো হাজার চাচালেও ওকে নেয়া হবে না। করুণ মুখে তাকিয়ে শীলাদের যাওয়া দেখলো। ট্যাক্সি ছাড়ার পর ও গম্ভীর মুখে শীলার বাবার সোফার পাশে এসে বসলো।
শোয়েব ওদের জন্য টিকেট কেটে স্টেশনে অপেক্ষা করছিলো। ওদের দেখতে পেয়ে হেসে সম্ভাষণ জানালো, গুড মর্নিং এভরি বডি।
জনি বড়দের মতো, গুড মর্নিং বললো। রিনি মৃদু হেসে মাথা নাড়লো। শীলা বললো, কতক্ষণ আগে এসেছে শোয়েব ভাই? নিশ্চয় আমাদের মুণ্ডপাত করছিলে।
আর পাঁচ মিনিট দেরি হলে করতাম। দশ মিনিট পর ট্রেন ছাড়বে। চলো উঠে পড়ি।
ফার্স্ট ক্লাসের টিকেট কেটেছিলো শোয়েব। রিজার্ভেশনও চেয়েছিলো। কাউন্টারের লোকটা বললো, তোমরা চারজন যাচ্ছে। একটা কামরা দিয়ে দিচ্ছি। অযথা রিজার্ভেশন টিকেট নিতে যাবে কেন?
শোয়েব বলরো, পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। কমিউনিস্ট আমলের কিছু ভালো লোক এখনো আছে দেখছি।
লোকটা শোয়েবের কথায় প্রসন্ন হেসে বললো, একজন সত্যিকারের কমিউনিস্ট সব সময় মানুষের উপকারই করে।
শোয়েবের পোলিশ বন্ধুরা কমিউনিস্টদের যখন তখন যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করলেও পাঁচ বছর ধরে এদেশে আছে ও। নিজের চোখেই দেখছে, এক বছর ধরে কমিউনিস্ট বিরোধীরা দেশ শাসন করতে গিয়ে অবস্থা কতখানি খারাপ করে ফেলেছে। দেশে বেকার বেড়েছে, গরিব মানুষেরা আগে যেসব সুযোগ সুবিধে পেতো–কম খরচে চিকিৎসা, কম ভাড়ায় বাড়ি, কম পয়সায় খাওয়া, বিনে পয়সায় স্কুল; সব বাতিল হতেয় গেছে। এক বছর আগেও যে সব কারখানার শ্রমিক সলিডারিটির নাম করে লাফ-ঝাঁপ করতো, তাদের অনেকেই বলছে কমিউনিস্ট আমলেই ভালো ছিলাম।
ট্রেন তখন পুরো স্পিডে ছুটে চলেছে দিগন্ত জোড়া বরফ ঢাকা প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে। শোয়েব কাঁচের বন্ধ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছিলো। গ্রামগুলোর চেহারা আরো মলিন হয়েছে। গ্রামের মানুষ, এই শীতের ভোরে যারা কাজে বেরিয়েছে, সবার গায়ে পর্যাপ্ত গরম কাপড় নেই। ওর মনে হলো গণতন্ত্র চাইতে গিয়ে এ মানুষগুলো যা পেয়েছে তার চেয়ে হারিয়েছে অনেক বেশি।
ছোট্ট একটা স্টেশনে ট্রেন থামার পর শীলা বললো, তখন থেকে এত কি ভাবছো শোয়েব ভাই?
শোয়েব জানে ও যা ভাবছিলো সে সব কথা বললে এরা হাসবে। শীলা রাজনীতির কথা একেবারেই পছন্দ করে না। মৃদু হেসে ও বললো, আমার ইচ্ছে করছে বিখ্যাত কোনো জায়গায় না গিয়ে এরকম একটা নাম না জানা স্টেশনে নেমে যাই। ওই যে ছোট্ট কাঠের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে ইচ্ছে করছে গিয়ে দেখি বাড়ির মানুষগুলো কেমন। নিশ্চয় খুব অবাক হয়ে যাবে আমাদের দেখলে।
শোয়েবের কথাগুলো রিনির কাছে মনে হলো সুন্দর এক স্বপ্নের মতো। দেখতে ভালো লাগে অথচ যা সত্যি হয় না। শীলা আর জনির কাছে মনে হলো পাগলের প্রলাপ। শীলা বলেই ফেললো, মাঝে মাঝে তুমি এমন অদ্ভুদ সব কথা বলো যার কোনো মানে হয় না। বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে এখানে নেমে পড়বো আর অচেনা একটা বাড়িতে ঢুকে পড়বো?
সেটাই তো আসল মজা। রিনির দিকে তাকিয়ে কথাটা খুব আস্তে বললো শোয়েব। রিনি ছাড়া ওর কথা আর কেউ শুনলো না। রিনির চোখে সমর্থন দেখে শোয়েবের ভালো লাগলো। তখনই হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ধীরে ধীরে চলা আরম্ভ করলো।
ওরা যে কামরায় বসেছিলো সেখানে চারজনের বসার জায়গা। দরজাটা শোয়েব লক না করে সামান্য ফাঁক রেখে টেনে দিয়েছে যাতে টিকেট চেকারের ঢুকতে অসুবিধে না হয়। ট্রেন ছাড়ার মিনিট তিনেক পর দরজা ঠেলে কামরায় উঁকি দিলো শুটকো চেহারার মাঝবয়সী এক লোক। দেখার সঙ্গে সঙ্গেই রিনি ওকে চিনে ফেললো। ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে দেখা মাফিয়াদের সেই চর, যে কিনা মারাওস্কির খোঁজ খবর নেয়ার জন্য ওর সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলো। লোকটা ভেবেছিলো কামরায় বসার জায়গা পাবে। চারজন দেখে পরিষ্কার ইংরেজিতে সরি, বলে দরজাটা টেটে আগের জায়গায় এনে চলে গেলো। রিনির বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটে নি। শোয়েব অবাক হয়ে জানতে চাইলো–লোকটা কি তোমার পরিচিত রিনি?
এটা সেই লোক। চাপা উত্তেজিত গলায় রিনি বললো, ফ্র্যাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে যে মারাওস্কির খবর জানার জন্য আমার সঙ্গে কথা বলেছিলো। মাফিয়াদের গুপ্তচর।
জনি, তুই লক্ষ্য করিস নি?
জনি নিবিষ্ট মনে স্টিফেন কিং-এর কমিক বইটা পড়ছিলো, কাল রাতে যেটা ও শোয়েবের কাছ থেকে এনেছে। রিনির কথা শুনে ও শুধু বললো, আমার মনে নেই।
শোয়েব প্রশ্ন করলো, মাফিয়াদের গুপ্তচর এখানে কি করছে?
পরশু রয়েল প্যালেসে বুড়ো পেইন্টারটা কি বললো তোমার মনে নেই? ওকে মারাওস্কি ভেবে ভুল করেছিলো শুকনো মতো একটা লোক। তখনই আমার ডাউট হয়েছিল। এবার কনফার্ম হলাম। একটু থেমে কি যেন ভাবলো রিনি। তারপর শোয়েবকে জিজ্ঞেস করলো–লোকটাকে কি সরাসরি জিজ্ঞেস করবো, এখানে কেন এসেছে, কি চায়?
শোয়েব মাথা নাড়লো–না রিনি। সেটা ঠিক হবে না। ট্যুরিস্ট হিসেবে এখানে যে কেউ আসতে পারে। আর ও যদি সত্যিই মাফিয়ার লোক হয় তাহলে ওর পরিচয় জেনে যাওয়া কাউকে ও নিশ্চয় খাতির করবে না। ওকে তুমি চিনেছো এ কথা ভুলেও উচ্চারণ কোরো না।
শোয়েবের কথায় যুক্তি আছে। রিনি আর এ নিয়ে কথা বাড়ালো না। শুধু বললো, মারাওস্কির দেখা পেলে ওকে সতর্ক করে দিতে পারতাম। ওর কপাল মন্দ। আমাদের ঠিকানা রাখলো অথচ নিজের ঠিকানাটা দিলো না।
শোয়েব বললো, রবার্ট মারাওস্কি নামে যদি কোনো পেইন্টার ওয়ারসতে থাকে তাহলে ওর ঠিকানা বের করা কঠিন হবে না। ওয়ারস-এর সব পেইন্টারের নাম ঠিকানাওয়ালা একটা ইনডেক্সবুক আছে আমার কাছে। ওতে মারাওস্কির নাম নিশ্চয় থাকবে। এ নিয়ে তুমি ভেবো না।
তাহলে তো খুবই ভালো হয়। লোকটা আমাদের এত উপকার করলো আর ওর। এই বিপদের মধ্যে ওর জন্য কিছু করতে পারবো না ভাবতেই খারাপ লাগছে।
বিশেষ করে এ বিপদের কথা আমরা ছাড়া আর কেউ জানে না।
দেখা হলে তখন সাবধান করে দিও। মৃদু হেসে বললো শোয়েব।
ভুরু কুঁচকে রিনি আর শোয়েবের কথা শুনছিলো শীলা। বললো, তোমরা কি সব মাফিয়া টাফিয়া নিয়ে বড়দের মতো কথা বলছো আমার একটুও ভালো লাগছেনা। মনে হচ্ছে আমরা বেড়াতে যাচ্ছি না, কোনো ক্রাইম ইনভেস্টিগেশনে যাচ্ছি।
ঠিক আছে, মাফিয়াদের কথা আর বলবো না। শীলার থুতনি নেড়ে রিনি হেসে বললো, বেড়াতে গিয়ে কি বলতে হয় তুই-ই বল।
শোয়েব ভাই একটা গান শোনাও না? আদুরে গলায় বললো শীলা।
ট্রেনের এই শব্দের ভেতর? খালি গলায়? আঁতকে উঠলো শোয়েব।
কি হয়েছে তাতে? এটা তো স্টেজ না-সামনে হাজার হাজার মানুষ বসে আছে! খালি গলাতেই গাও। শুনবো তো আমরা দুজন। জনি যেভাবে কমিকে ডুবে গেছে ওর না শুনলেও চলবে।
শোয়েবের গান অনেক অনুষ্ঠানেই শুনেছে শীলা। ওর জন্য নয়, শোয়েবের ইচ্ছে হচ্ছিলো রিনিকে গান শোনায়। অল্প কিছুক্ষণ ভাবলো কি গান গাইবে। তারপর মৃদু হেসে নরম ভরাট গলায় ও গাইলো, মনে রবে কিনা রবে আমারে।
রিনি মুগ্ধ হয়ে শোয়েবের গান শুনলো। মনে হলো ওর ভালো লাগার জন্যই বুঝি শোয়েব গাইছে। শীলা রিনিকে বললো, লায়নেল রিচির সে মি সে ইউ গানটা শোয়েব ভাই দারুণ গায়।
রিনি কোনো কথা বললো না। শোয়েবের দিকে তাকালো শুধু। রিনির চোখে অনুরোধের ভাষা বুঝতে ওর অসুবিধে হলো না। শীলার কথা মতো লায়নেল রিচিও গাইলো। গাইতে ওর ভালো লাগছিলো। ও চাইছিলো রিনি কোনো গান গাইতে বলুক। দেশে থাকতে ছায়ানটে চার বছর গান শিখেছে। পোল্যান্ডে এসে আমেরিকান ক্লাবের ভোকালিস্ট এরিকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো কূটনীতিকদের এক অনুষ্ঠানে। এরিক ওকে অনেকগুলো ইংরেজি গান শিখিয়ে দিয়েছে। শোয়েবের ভালো লাগে কান্ট্রি সং আর সফট মেলোড়ি।
দিগন্ত জোড়া বরফ ঢাকা ধবধবে সাদা প্রান্তরের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। কামরার জানালা সব বন্ধ করা। হিটিং সিস্টেম থাকার কারণে সারা কামরায় নরম একটা ওম ওম ভাব। রিনিরা ফ্লাস্কে করে কফি বানিয়ে এনেছিলো। শোয়েবের দুটো গান হওয়ার পর রিনি বললো, কফি দেবো শোয়েব ভাই?
দারুণ হবে রিনি । মনে মনে এ জিনিসটাই চাইছিলাম। উচ্ছ্বসিত গলায় বললো শোয়েব।
কাগজের গ্লাসে তিন কাপ কফি ঢাললো রিনি । জনি কফি বেশি পছন্দ করে না। ওকে অরেঞ্জ জুসের একটা ফয়েল প্যাকেট বের করে দিলো। কফি শেষ করে শোয়েব একটু ইতস্তত করে বললো, রিনি, তুমি যদি আপত্তি না করো আর শীলা যদি মাকে না বলে দেয়–আমার একটা সিগারেট খেতে খুব ইচ্ছে করছে।
তুমি সিগারেট খাবে? চোখ কপালে তুলে বললো শীলা।
শোয়েব একটু গম্ভীর হয়ে বললো, শীলা, আমার বয়স এখন উনিশ। আমাদের ক্লাসের বেশির ভাগ ছেলে মেয়েই সিগারেট খায়।
রিনি বললো, বাবা বলেছেন আঠারো বছর বয়স হলে আমরা ওয়াইনও খেতে পারি। শীলা কেন মিছেমিছি বলতে যাবে।
শোয়েব লাজুক হেসে জ্যাকেটের ভেতর থেকে মার্লবোরো লাইট বের করে ধরালো। ধোয়া ছাড়লো আনাড়ির মতো। বোঝাই যায় সিগারেট ধরেছে বেশি দিন হয় নি।
ক্র্যাকভ পৌঁছতে পৌঁছতে নটা বেজে গেলো, কথা ছিলো সাড়ে আটটায় পৌঁছানোর। মাঝখানে কয়েকটা স্টেশনে বেশিক্ষণ থামতে হয়েছিলো।
চারটা ছোট হাতব্যাগ নিয়ে ওরা চারজন ঝটপট ট্রেন থেকে নামলো ক্রাকভ স্টেশনে। সঙ্গে সঙ্গে হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন চলে গেলো। শোয়েব বললো, আমরা এখন যাবো হোটেল অরবিস-এ। ওখানে আমাদের রুম বুক করা আছে।
স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়াতেই ট্যাক্সিওয়ালারা ওদের ঘিরে ধরলো। শোয়েব ওদের পোলিশ ভাষায় কিছু যেন বললো। ওরা চলে গেলো কেন শোয়েব ভাই?
আমাদের ট্যাক্সির দরকার নেই। জবাব দিলো শোয়েব। ওল্ড সিটিতে হেঁটে যাবো। দশ মিনিট লাগবে। তাছাড়া ওখানে ট্যাক্সি এমনিতেও যাবে না।
যে যার ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে স্টেশনের বাইরের প্রশস্ত চত্বরটুকু পেরোতেই রিনির চোখে পড়লো–মাফিয়াদের সেই ইঁদুরমুখো গুপ্তচরটা। এক ট্যাক্সিওয়ালার পেছন পেছন বকের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে বাইরে ভিড়ের ভেতর হারিয়ে গেলো।