০৫. অতৃপ্ত আত্মার রোষানলে
মিনিট পনেরো না হাঁটতেই রনি শুকনো গলায় বললো, আমরা ঠিক পথে যাচ্ছি তো স্বপন? আমার কাছে সব কিছু কেমন যেন গোলমেলে মনে হচ্ছে!
গোলমেলে মনে হচ্ছে কেন? স্বপনের মুখে মৃদু হাসি–মিনিট দশ পনেরো পরেই ইল নদীর তীরে পৌঁছে যাবো আমরা। সেখান থেকে ফুর্সটেনেক মাত্র তিন কিলোমিটার।
টিটলিঙের ঘটনাগুলো সম্পর্কে কিছু ভেবেছো তোমরা? হাঁটতে হাঁটতে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো রনি।
কী ভাববো?
দুর্গের পাহাড় বেয়ে উঠতেই আমাদের লক্ষ্য করে বড় বড় পাথরের টুকরো ছোঁড়া হলো। আমাদের উপোষ রেখে মারার জন্য খাবারগুলো সরিয়ে নিলো। যাতে এখানে আটকা পড়ি–ফুয়েল চুরি করে গাড়িটাকে অকেজো করে দিলো। এ সবের ভেতর একটা যোগসূত্র আছে।
তুমিই তো বললে জিপসিদের কাজ হতে পারে।
বলেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে জীবিত মানুষের জন্য নিষিদ্ধ কোনো জায়গায় এসে পড়েছি আমরা। এখানকার বাসিন্দাদের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটিয়েছি।
আমার ধারণা কোনো খারাপ লোক আমাদের ভয় দেখিয়ে মজা পেতে চাইছে। রনির ধারণার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলো শীলা ।
বার বার লোক লোক করছো কেন? এই জঙ্গলে আমাদের ভয় দেখাবার জন্য লোক আসবে কোত্থেকে?
গ্রাম থেকে আসতে পারে। চোর, গুন্ডা, স্মাগলার হতে পারে। আমরা থাকলে। হয়তো ওদের কাজের ব্যাঘাত ঘটবে মনে করছে।
চোর, গুণ্ডা যদি থেকেও থাকে তারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে আমরা যে এখানে থাকতে আসিনি। আমাদের না তাড়ালেও আমরা চলে যেতাম।
তোমার আত্মাদেরও তো বোঝা উচিৎ ছিলো আমরা থাকতে আসিনি। বলে মুখ টিপে হাসলো শীলা।
আত্মাদের নিয়ে ইয়ার্কি কোরো না শীলা। ওরা রেগে গেলে মানুষের অনেক ক্ষতি করতে পারে।
ঠিক আছে। আমরা তো চলেই যাচ্ছি। টিটলিঙের দুর্গে শান্তিতে থাকুক তোমার আত্মারা। আমরা আর ওদের বিরক্ত করবো না।
গাড়ি নেয়ার জন্য তো আসতে হবে।
তাও তো কথা। গম্ভীর হওয়ার ভান করলো শীলা–আত্মাদের শান্তির ব্যাঘাত না ঘটিয়ে গাড়িটা কিভাবে আনা যায় বলতো?
ভালো হয় আমরা আবার টিটলিঙে আসার সময় সঙ্গে যদি কোনো ওঝা নিয়ে আসি।
কোথায় পাবো ওঝা?
ওঝা না পেলে গির্জার ফাদার যদি রাজী হন তাহলেও চলবে।
স্বপন হেসে বললো, ঠিক আছে রনি । ফুর্সটেনেকের গ্রামে গিয়ে ওঝা খুঁজে বের করা যাবে। তার আগে পেটে যে ক্ষিদের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে সেটা নেভানো দরকার।
ওরা ততক্ষণে বাভারিয়ার বন থেকে বেরিয়ে ইল্যু উপত্যকায় এসে পড়েছে । সরু ইল নদীর দুপাশে খানিকটা ঘাস বিছানো সমতল জমি, তারপর খাড়া পাহাড় উঠে গেছে। পাহাড়ের গায়ে পাইন ফার আর নাম না জানা গাছের সমারোহ।
বাইরে থেকে ট্যুরিস্টরা এদিকে এলে ইল্যু উপত্যকায় হেঁটে বেড়াবার লোভ কেউ সামলাতে পারে না। সেদিন সারাটা পথে ওরা একজন ট্যুরিস্টের দেখাও পেলো না। দুপুর দুটো নাগাদ ওরা ফুর্সটেনেক গিয়ে পৌঁছলো। সূর্য তখনই পশ্চিমে হেলে পড়েছে, মাঝে মাঝে আল্পস-এর ওপর থেকে আসা কনকনে ঠান্ডা বাতাসও বইছে।
ফুর্সটেনেকের দুর্গের পাশেই ছোট্ট একটা রেস্তোরাঁ রয়েছে ট্যুরিস্টদের জন্য। ইল্যু নদী থেকে ধরা তাজা ট্রাউট মাছ ভাজা, সসেজ আর ঘরে বানানো বাদামি পাউরুটি দিয়ে ওরা দুপুরের খাবার সারলো। সঙ্গে ঘরে তোলা কাঁচা মাখনও ছিলো পর্যাপ্ত। রেস্তোরাঁয় ওরা ছাড়া মাত্র দুজন ধর্মযাজক ছিলেন খদ্দের হিসেবে। ওরা ঢোকার পাঁচ মিনিট পরই ওঁরা এসে রেস্তোরাঁয় ঢুকেছেন। খেতে খেতে রনি ওঁদের দিকে ইশারা করে বলেছিলো, দেখে তো মনে হচ্ছে গির্জার পাদ্রী। ওঝার কথা জিজ্ঞেস করবো নাকি?
মজা দেখার জন্য স্বপন গম্ভীর হয়ে জবাব দিয়েছে বলে দেখতে পারো।
ধর্মযাজক দুজন খাওয়া শেষ করে কফির অর্ডার দিয়েছেন। রনি নিজেদের টেবিল থেকে উঠে এস অভিবাদন জানিয়ে বললো, কিছু যদি মনে করেন, আপনারা কি এ গ্রামে থাকেন?
দুজনের ভেতর বয়স্ক যিনি, চুলদাড়ি যার সব সাদা হয়ে গেছে, একটু অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁ, কেন?
আমরা একজন ভালো ওঝা খুঁজছি।
ওঝা কি জন্য?
আজ সকালে আমরা টিটলিঙের দুর্গে গিয়েছিলাম। সেখানে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যাতে আমাদের মনে হয়েছে কোনো অতৃপ্ত আত্মা কিংবা কোনো অশুভ শক্তি সেখানে আছে। কেউ গেলে বিপদ হতে পারে।
কিভাবে বুঝলে ওখানে অশুভ শক্তি আছে?
টিটলিঙের দুর্গে যাওয়ার পর থেকে অস্বাভাবিক যেসব ঘটনা ঘটেছে রনি সব খুলে বললো ধর্মযাজকদের। ওর কথা শুনে ওঁরা দুজনই বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বুড়ো ফাদার বললেন, খুবই ভাবনার কথা। ঠিক আছে বাছা! আমার পরিচিত এক ওঝা আছে। ও মুনসেন গেছে এক খারাপ আত্মাকে তাড়াবার জন্য। কাল নয়তো পরশু ফিরবে। এলে ওকে বলবো টিটলিঙ যেতে।
ফাদারকে ধন্যবাদ জানিয়ে রনি টেবিলে ফিরে এলো। স্বপন আর শীলা অতি কষ্টে হাসি চেপে বসেছিলো। দারুণ এক কাজ করে ফেলেছে–এমন এক মুখের ভাব করে রনি বললো, শুনলে তো, সব ব্যবস্থা করে ফেললাম।
স্বপন গম্ভীর হওয়ার ভান করে জানতে চাইলো, পুরোনো দুর্গে খারাপ আত্মা থাকে, ওদের ওঝা দিয়ে তাড়াতে হয়, এত কিছু তুমি জানলে কোত্থেকে রনি?
জানতে চাইলেই জানা যায়। আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিতে উইচক্রাফট আর ব্লার্ক আর্টের ওপর অনেক বই আছে।
শীলা নিরীহ গলায় বললো, আমিও কিছু পড়েছি। আমার ধারণা ছিলো এসব আত্মা-ফাত্মারা রাতে বেরোয়। টিটলিঙ না গেলে জানতেই পারতাম না দিন দুপুরে ভূত এসে স্যান্ডউইচ খায়।
খেতে নিশ্চয় দেখোনি তুমি । ওরা খেয়েছে কে বললো? ফেলে দিয়েছে কোথাও। ওরা যদি কারও ওপর ভর করে তাহলে তাকে দিয়ে দিনেও অনেক কিছু করিয়ে নিতে পারে।
স্বপন চিন্তিত গলায় বললো, গাড়িটা যে রেখে এলাম–পাজি আত্মারা ওটা নিয়ে আবার না বর্ডারের ওপারে বেচে দিয়ে আসে।
স্বপনের কথায় রনির সন্দেহ হলো ও আর শীলা আত্মা নিয়ে রসিকতা করছে। গম্ভীর হয়ে বললো, আত্মা কেন তোমার গাড়ি চুরি করতে যাবে?
ফুয়েল চুরি করেছে, লাঞ্চ প্যাক চুরি করেছে, গাড়ি চুরি করতে কতক্ষণ! ওরা জানে গাড়িটা লোপাট করতে পারলে আমরা এ জীবনে আর টিটলিঙ দুর্গের ধারে কাছে যাবো না।
ওঝা যখন পাচ্ছি না–সূর্য ডোবার আগেই গাড়িটা ওখান থেকে উদ্ধার করা দরকার।
চলো তাহলে। কে জানে কপালে কী আছে। হাসি চেপে স্বপন আর শীলা উঠে দাঁড়ালো। পাদ্রীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রনিও বেরিয়ে এলো রেস্তোরাঁ থেকে।
পেট্রল পাম্প থেকে দশ লিটারের দুটো জেরিকেন আর মোবিল নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়লো টিটলিঙের পথে। সূর্য ততক্ষণে আরও কিছুটা হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। রনি হিসেব করে দেখলো সূর্য ডোবার আগেই ওরা টিটলিঙ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
ই নদীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্বপন ভাবছিলো রনিকে নিয়ে ভাঙা দুর্গের ভেতরে নিয়ে একবার ভয় দেখিয়ে ওর মাথা থেকে ভূতের ভয় তাড়াতে হবে। দিনের আলো থাকতে থাকতে টিটলিঙ পৌঁছানোর জন্য রনি আগে আগে পা চালিয়ে হাঁটছিলো আর মাঝে মাঝে ওদের তাড়া দিচ্ছিলো জলদি হাঁটার জন্য। স্বপন একটা ফন্দি বের করে কথাটা শীলার কানে কানে বললো। শীলাও মুখ টিপে হেসে ওকে সমর্থন জানালো।
নদীর তীর ছেড়ে ওরা বনের ভেতরের পথে উঠতে যাবে এমন সময় টিটলিঙ থেকে আসা এক জিপসি পরিবারের মুখোমুখি হলো ওরা। দুজন সাদাচুলো বুড়ো বুড়ি, তাদের সঙ্গে মাঝ বয়সী দুজন পুরুষ আর মহিলা, সঙ্গে চার থেকে আট বছরের গোটা চারেক ছেলে মেয়ে। একটা বেতো ঘোড়ার পিঠে পোটলা-পুটলি বোঝাই করে ওরা ফুর্সটেনেকের দিকে যাচ্ছিলো। স্বপন অমায়িক গলায় গুটেন্টাখ উনকেল বলে বুড়োকে সম্বোধন করে বললো, আপনারা কি টিটলিঙ থেকে আসছেন?
বুড়ো সন্দেহভরা চোখে স্বপনকে দেখলো। জার্মানরা কখনও এত অমায়িক গলায় ওদের সঙ্গে কথা বলে না। ভুরু কুঁচকে বললো, রাস্তা যখন টিটলিঙের ওখান থেকেই তো আসবো! তোমরা কারা?
আমাদের দেশ অনেক দূরে। ইন্ডিয়ার পাশে বাংলাদেশ নামে একটা ছোট্ট দেশ আছে। এখন আমরা জার্মানির বাসিন্দা, বাড়ি ডেগেনডর্ফে।
ইন্ডিয়া! কথাটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে বুড়োর ঘোলাটে চোখ দুটো চকচক করে উঠলো–আমাদের পূর্ব পুরুষ ইন্ডিয়া থেকে এসেছিলো। তোমরা কি ইন্ডিয়া গিয়েছো কখনও?
রনিকে দেখিয়ে স্বপন বললো, ও গিয়েছে, আমরা দুজন আগামী বছর যেতে পারি।
ভারি খুশি হলাম তোমাদের দেখে। এই বলে বুড়ো ওদের সঙ্গে হাত মেলালো। বুড়োর দেখাদেখি অন্যরাও এগিয়ে এসে স্বপনদের সঙ্গে হাত মেলালো।
আমার নাম আফেন্দি। আমার বুড়ির নাম বুনিলদা। আমার ছেলে ইস্ফান আর ওর বউ । এই পাজিগুলো নাতি নাতনি। পরিবারের সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বুড়ো জানতে চাইলো–অসময়ে তোমরা টিটলিঙ যাচ্ছো কেন? এটা তো টিটলিঙ ছেড়ে আসার সময়।
অসময় কেন হতে যাবে? ট্যুরিস্ট সিজন এখনও তো শেষ হয়নি।
শুকনো মুখে বুড়ো আফেন্দি বললো, তোমরা কি জানো না বাছা সূর্য ডোবার পর বাইরের কেউ টিটলিঙ থাকে না?
জানি না তো! কেন সূর্য ডোবার পর কী হয় ওখানে?
শার্লেমানের দুর্গ থেকে অশরীরী আত্মারা নেমে আসে গ্রামে। বাদুড়ের রূপ ধরে ঘুরে বেড়ায়। কাউকে বাগে পেলে ঘাড়ে দাঁত ফুটিয়ে দিয়ে রক্ত শুষে খায়।
আফেন্দির কথা শুনে রনির চেহারা কাগজের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। স্বপন জানে জিপসিদের মাথা নানা রাজ্যের কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাসে ঠাসা থাকে। বললো, আপনারা কি আজ সারাদিন টিটলিঙ ছিলেন?
আজ নয়, কাল এসেছিলাম। উঠেছিলাম আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। শুনলাম ইদানিং নাকি ওদের উৎপাত বেড়েছে। দিনেও কেউ দুর্গের আশেপাশে যেতে চায় না।
কী সর্বনাশ! ভয় পাওয়ার ভান করলো স্বপন–আমরা যে গাড়ি রেখে এসেছি! এখন কী হবে?
আকাশের দিকে তাকিয়ে সূর্যের অবস্থান দেখলো আফেন্দি। তারপর বললো, যদি পা চালিয়ে যাও আধঘন্টার ভেতর টিটলিঙ পৌঁছতে পারবে। সূর্য ডুবতে আরও এক ঘন্টা। চলি বাছারা, ঈশ্বর তোমাদের রক্ষা করবেন।
বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্বপন শীলাকে বললো, রনির কথা কিভাবে ফলে গেলো দেখলি?
কোন কথা? অবাক হয়ে জানতে চাইলো শীলা।
রনি কিন্তু প্রথমেই বলেছিলো জিপসিরা আমাদের লাঞ্চ প্যাক চুরি করেছে। আফেন্দি বুড়োর পরিবার কাল থেকে টিটলিঙ ছিলো। তার ছেলেটার চেহারা দেখে খুব একটা ভালো মানুষ মনে হলো না।
রনি বললো, প্রথমে জিপসিদের কথা মনে হলেও পরে আমি অন্য কথা বলেছি। আফেন্দিদের কথা শোনার পরও কি তোমরা বিশ্বাস করবে না?
স্বপন হাল ছেড়ে দিয়ে বললো, এত করে যখন বলছো, বিশ্বাস না করে উপায় কি! ঈশ্বর জানেন গাড়িটার কী হাল করেছে ওরা!
কে জানে, আমাদের রক্ত শুষে খাওয়ার জন্য গাড়িটা হয়তো এতক্ষণে ভ্যানিশ করে দিয়েছে। হাসি চেপে মন্তব্য করলো শীলা।
সেক্ষেত্রে গ্রামে কারও বাড়িতে রাত কাটাতে হবে।
জানো না বুঝি! কথাটা হঠাৎ মনে পড়ায় শীলা খুশিভরা গলায় বললো, আমি একটা বইয়ে পড়েছি, যে সব গ্রামে ভ্যাম্পায়ারদের উৎপাত আছে, সেখানে রাতে কেউ অচেনা লোকদের আশ্রয় দেয় না।
কেন, দিলে কী হয়? জানতে চাইলো স্বপন।
ভ্যাম্পায়াররা শুধু বাদুড়ের রূপ ধরে না। তারা মানষের রূপ ধরেও আসে ।
কী বিপদ! স্বপন চিন্তিত গলায় রনিকে বললো, এখন কী হবে রনি?
আমি একটা বুদ্ধি বের করেছি। কৌতুক মেশানো গলায় বললো শীলা।
কী বুদ্ধি?
ভ্যাম্পায়াররা রসুনের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। এসব গ্রামের লোকেরা ভ্যাম্পায়ার তাড়াবার জন্য দরজা জানালায় রসুনের মালা ঝুলিয়ে রাখে। আমরা তিনজন গ্রামের দোকান থেকে তিনটা রসুনের মালা গলায় ঝুলিয়ে আশ্রয় চাইতে যাবো। এতেই প্রমাণ হবে আমরা ভ্যাম্পায়ার নই।
শুনেই আমার বমি আসছে। স্বপন নাক কুঁচকে বললো, রসুনের গন্ধ আমি সহ্যই করতে পারি না।
উপায় নেই। গম্ভীর হওয়ার ভান করলো শীলা গ্রামের লোক যদি এ ধরনের কথা শোনে নির্ঘাত তোমাকে ওরা ভ্যাম্পায়ার ভেবে পুড়িয়ে মারবে।
পুড়িয়ে মারবে কেন? পুড়িয়ে মারে তো ডাইনিদের। আমাকে বোধ হয় সিলভার বুলেট দিয়ে গুলি করে মারবে।
হলো না! হেসে ফেললো শীলা–সিলভার বুলেট দিয়ে অয়্যারউলফকে মারে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ভ্যাম্পায়ারদের বুকে কাঠের ক্রস পুঁতে দিয়ে মারে।
কী সাংঘাতিক! স্বপন আঁতকে ওঠার ভান করলো। মৃত্যুটা তাহলে খুবই কষ্টের হবে শীলা।
কী সব আজে বাজে কথা বলছো তোমরা। রনি একটু বিরক্ত হয়ে বললো, তোমাদের কতবার বলবো ওদের নিয়ে রসিকতা করবে না? এতে ওরা আরও রেগে যেতে পারে।
শীলা তুমি ওদের বেশি রাগিয়ে দিচ্ছো। ক্রস-ট্রসের কথা ঘুণাক্ষরেও উচ্চারণ করবে না। জানো না ওরা যে ক্রস পছন্দ করে না?
তোমার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবো। অতি কষ্টে হাসি চেপে গম্ভীর গলায় জবাব দিলো শীলা।
গাড়িটা যেখানে ছিলো সেখানেই আছে। দেখে ওরা তিনজনই স্বস্তি বোধ করলো। গাড়িতে ফুয়েল ঢালতে ঢালতে স্বপন হাসি চেপে বললো, শীলা, রনি ঝটপট উঠে পড়ো। সূর্য ডোবার আগেই টিটলিঙ ছাড়তে হবে আমাদের।
শীলা বললো, এত তাড়া কিসের। এখনও চল্লিশ মিনিট সময় আছে হাতে। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখার মজাই আলাদা।
রনি আঁতকে উঠে বললো, না শীলা। এই অশুভ জায়গায় আমি এক মুহূর্তও থাকতে চাই না। প্লীজ, আর দেরি কোরো না।
ঠিক আছে চলো। অসহায় ভঙ্গিতে কাধ নাচিয়ে শীলা গাড়িতে উঠে বসলো।
স্বপন ওর জায়গায় বসে ড্রাইভিং বেল্টটা ঠিক করে চাবি ঘোরালো। ইঞ্জিন স্টার্ট হলো না। এক্সিলেটারে বার বার চাপ দিয়ে চেষ্টা করলো, কোনো লাভ হলো না। ওর কপালে বিরক্তির ভঁজ পড়লো।
শীলা হাসি চেপে রনিকে দেখছিলো। উৎকণ্ঠায় রনির চেহারা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এখানে আসার পথে স্বপন ওর কানে কানে বলেছিলো রনিকে ভয় দেখাবার জন্য ও ইচ্ছা করে গাড়িটা অকেজো করে রাখবে। রাত হলে দেখিয়ে দেবে অশুভ আত্মা, ভ্যাম্পায়ার এসব একেবারে বাজে কথা। ওয়ালেট ফেলে এসেছে বলে রাতে দুর্গের চত্ত্বর থেকে ঘুরে আসবে। তারপর ধীরে সুস্থে গাড়ি মেরামত করার ভান করে ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি ফিরবে। রনির ভয় ভাঙাবার জন্যই এরকম একটা প্ল্যান এঁটেছিলো স্বপন। শীলাও তাতে সায় দিয়েছিলো।
বেশ কয়েকবার স্টার্ট নেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে স্বপন যখন বিরক্ত হয়ে উঠছিলো শীলা তখন উদ্বিগ্ন হওয়ার ভান করে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে স্বপন। খারাপ আত্মাদের নজর পড়েনি তো?
স্টিয়ারিং-এর ওপর একটা ঘুষি মেরে বিরক্তি মেশানো গলায় স্বপন বললো, ঠাট্টা নয় শীলা! গাড়ি সত্যি সত্যি খারাপ হয়েছে।
বনেত খুলে ইঞ্জিন পরীক্ষা করলো স্বপন। শীলা মনে মনে প্রমাদ শুনলো। গাড়ি যদি সত্যিই বিগড়ে যায়, রাতে বাড়ি ফেরা হবে না। বাবা, মার ভীষণ দুশ্চিন্তা হবে। রনির হার্টবিট এমনই বেড়ে গেছে যে ওর মনে হচ্ছিলো যে কোনো সময় ওটা বন্ধ হয়ে যাবে। ভাঙা গলায় বললো, কী হয়েছে স্বপন, কিছু বুঝতে পারলে?
বনেতের তলায় মাথা নিচু করে ইঞ্জিন পরীক্ষা করতে করতে স্বপন বললো, মনে হচ্ছে কার্বুরেটরে ময়লা জমেছে।
এখন তাহলে কী হবে?
একজন মেকানিক লাগবে। বনেত বন্ধ করে রুমালে হাত মুছতে মুছতে স্বপন বললো, চলো, গ্রামের দিকে যাই।
শীলা আর রনি ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।
সূর্য ডোবার আর বেশি দেরি নেই। সারা আকাশ লাল রঙে ছেয়ে গেছে। পুব আকাশে থরে থরে সাজানো ধূসর রঙের মেঘের চারপাশে লাল ছোপ গোটা পরিবেশকে করে তুলেছে রহস্যময়। ধূসর মেঘে ভরা লাল আকাশের পটভূমিতে শার্লেমানের ভাঙা দুর্গের উঁচু পাহাড়টাকে খুবই অচেনা মনে হচ্ছে।
ঘন ফার গাছে ঢাকা মিনিট পনেরোর রাস্তা পার হতেই দূরে লোকজনের ঘরবাড়ি চোখে পড়ে। যেতে যেতে রনি বললো, শীলা যে বলেছিলে এসব গ্রামে ঢোকার আগে রসুনের মালা সঙ্গে রাখতে।
শীলা বিরক্তি চেপে বললো, এখানে রসুন কোথায় পাবে?
বা রে! তুমিই তো বলেছিলে গ্রামের মানুষ অচেনা লোকজনদের সন্দেহের চোখে দেখে।
আগে তো গ্রামে যাই! পরে দেখা যাবে।
স্বপন ভাবছিলো মেকানিক জোগাড় না হলে বাড়িতে ফোন করে জানাতে হবে। গ্রামে কোথাও রাত কাটাবার ব্যবস্থা করতে হবে। রনিকে নিয়ে হয়েছে আরেক বিপদ। ভয়ের চোটে কখন মুছা যায় কে জানে!
ফার বনের সীমানা পেরিয়ে প্রথম যে বাড়িটা ওদের চোখে পড়লো সেটা বেশ অবস্থাপন এক চাষীর।
বাইরের কাঠের দরজা দিয়ে ঢুকে বেশ খানিকটা ফাঁকা জমি পেরিয়ে বাড়ির কাছে এসে স্বপন গলা তুলে ডাকলো, বাড়িতে কেউ আছেন?
ওর গলা শুনে বাড়ির ভেতর থেকে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো গ্রে হাউন্ড কুকুর। ভারি গলায় ওকে ধমক দিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো মাঝবয়সী বিশাল দেহী বদমেজাজী চেহারার এক লোক। ওদের তিনজনকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো–তোমরা কারা? কোত্থেকে এসেছো?
আমরা ডেগেনডর্ফ থাকি। সকালে এখানে এসেছিলাম টিটলিঙের দুর্গ দেখতে। দুপুরে গাড়ি রেখে গিয়েছিলাম ফুর্সটেনেক। ফিরে এসে দেখি গাড়ির ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেছে।
টিটলিঙের দুর্গে দেখার কী আছে? তোমরা কি জানো না ট্যুরিস্টদের ওখানে যাওয়া বারণ?
জানি না তো! অবাক হয়ে বললো স্বপন কারা বারণ করলো? কেন?
লোকটা রুক্ষ গলায় বললো, আমরা অতৃপ্ত আত্মার রোষানলে পড়তে চাই না। আমরা চাই না বাইরে থেকে অচেনা লোকজন এসে শার্লেমানের পবিত্র দুর্গ অপবিত্র করুক।
পাঁচ বছর আগেও আমরা দুর্গ দেখতে এসেছিলাম। তখন তো এরকম কথা শুনিনি?
তখন শোননি কী হয়েছে। এখন তো শুনলে। এবার বিদায় হও।
লোকটার কথা বলার ধরণ স্বপনের পছন্দ হলো না। বললো, আমরা জানতে এসেছিলাম এখানে কোনো মোটর মেকানিক পাওয়া যাবে কি না। আর রাতে কোথাও থাকা যাবে কি না।
ওই দিকে স্তেফানের সরাইখানা আছে। সেখানে গিয়ে খোঁজ করোগে। এই বলে লোকটা অভদ্রের মতো আর কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।
মনে মনে লোকটাকে ছোটলোক বলে গাল দিয়ে শীলা, রনিকে সঙ্গে নিয়ে স্বপন সরাইখানার পথে পা বাড়ালো।
শেষ বিকেলের সূর্য ততক্ষণে পশ্চিমের বার্চ বনের আড়ালে চলে গেছে। বনের ভেতর গাছের তলায় পরতে পরতে অন্ধকার জমতে শুরু করেছে। তবে পুব দিকের পাহাড়ের ওপরের অংশে তখনও বিষণ্ণ লাল রোদ শুয়েছিলো ক্লান্ত হয়ে।
.
০৬. গভীর রাতে কুকুরের কান্না
গ্রামের একেবারে উত্তর প্রান্তে ছিলো ফুর্তিবাজ বুড়ো স্তেফানের সরাইখানা। স্বপনরা যখন সরাইখানার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো স্তেফান তখন ওর নাতনির বয়সী মেয়ের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে নাচছিলো। সরাইখানার বেশির ভাগ খদ্দেরই ছিলো বুড়ো নয়তো আধবুড়ো। ছেলে ছোকরাদের জন্য টিটলিঙের জাদুঘরের পাশে ডিসকো ক্লাব আছে।
টেবিলে টেবিলে ফেনা ওঠা বিয়ারভরা মগ। খদ্দেরদের কেউ স্তেফানের নাচ দেখছিলো, কেউ নিজেদের ভেতর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গল্প করছিলো। অ্যাকর্ডিয়ান বাজাচ্ছিলো নাচিয়ে মেয়েটির হবু বর। স্বপন, শীলা আর রনি কাউন্টারের পাশে রাখা উঁচু টুলে গিয়ে বসলো। কাউন্টারে বসা এক ফো বুড়ো রনি আর শীলার গায়ের রঙ দেখে জিপসি ভেবে ভুরু কোঁচকালো। বেশ কিছুক্ষণ পর বাজনা থামলো। খদ্দেররা তালি বাজালো। স্তেফান ক্লান্ত হয়ে কাউন্টারের ভেতর এসে একগাল এসে বুড়োকে বললো, এখনও জোয়ান ছোকরাদের সঙ্গে বাজি ধরে নাচতে পারি।
বুড়ো চোখের ইশারায় স্বপনদের দেখালো। স্তেফান অজার্মান খদ্দের দেখে মোটেই বিচলিত হলো না। হেসে বললো, টিটলিঙের নতুন অতিথি মনে হচ্ছে! কোত্থেকে আসা হলো?
সকালে টিটলিঙে আসা আর গাড়ি খারাপ হওয়ার কথা বদমেজাজী চাষীকে যতটুকু বলেছিলো স্তেফানকেও ততটুকু বললো স্বপন। তারপর যখন গাড়ি সারাবার জন্য মেকানিক চাইলো তখন স্তেফানের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। শুকনো গলায় বললো, মেকানিক একজন আছে বটে, ও এখন ওদিকে যাবে বলে মনে হয় না।
আমরা বেশি মজুরি দেবো। রাতের ভেতর ডেগেনডর্ফ ফিরে যেতে চাই।
কাষ্ঠ হেসে স্তেফান বললো, হাজার মার্ক দিলেও গুস্তাভ এ সময় দুর্গের ত্রিসীমানায় যাবে না।
কেন গেলে কী হবে।
স্তেফান অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ওদের পাশে বসা ফো বুড়োর দিকে। বিষণ্ণ গলায় বললো জোয়াকিম,তুমিই বলো।
ফো জোয়াকিম চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, তোমাদের বুঝি কেউ বলেনি সন্ধ্যের পর দুর্গের এক মাইলের ভেতর যাওয়া বারণ!
না, বলেনি। আমরা পাঁচ বছর আগেও এই এই দুর্গে বেড়াতে এসেছি। ব্যাপারটা কি দয়া করে খুলে বলবেন?
পাঁচ বছর নয়, তিন বছর আগে থেকে এটা ঘটছে। দুর্গে অশুভ কোনো শক্তি আস্তানা গেড়েছে। কে জানে, শার্লেমানের আমলে যে সব স্যাক্সন বীরদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো তাদের অতৃপ্ত আত্মা কিনা। মোদ্দা কথা, না জেনে সন্ধ্যার পর যারাই দুর্গের আশেপাশে গেছে তারা কেউ জীবিত ফিরে আসেনি। পরদিন সকালে ডানিউবের তীরে তাদের রক্তশূণ্য মৃতদেহ পওয়া গেছে।
স্তেফান চাপা গলায় বললো, গত তিন বছরে পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে এভাবে।
কাঁপা কাঁপা গলায় রনি বললো, আপনারা কোনো ওঝাকে খবর দেননি?
আমরা খবর দেইনি। নিজে থেকে এসেছিলো মুনসেনের এক ওঝা। ওই পাঁচজনের ভেতর একজন ছিলো সে।
আপনার সরাইখানায় কি রাতে থাকার ব্যবস্থা আছে? প্রশ্ন করলো স্বপন।
নিশ্চয়ই আছে। স্তেফানের মুখে হাসি ফিরে এলো অসময়ে তিনজন খদ্দের পেয়ে। প্রত্যেকের জন্য কি আলাদা ঘর লাগবে?
রনি ব্যস্ত গলায় বললো, আলাদা নয় আমরা এক ঘরে থাকবো।
তারও ব্যবস্থা করা যাবে। ডিনার করবে নিশ্চয়? ডিনার আর ব্রেকফাস্ট নিয়ে সত্তর মার্ক পড়বে।
স্বপন মৃদু হেসে বললো, আপনি কি ডেগেনডর্ফের হোটেল জেরানিয়ামের নাম শুনেছেন?
কেন শুনবো না! ডেগেনডর্ফের সবচেয়ে বনেদি হোটেল।
আমার বাবা ওটার মালিক। জেরানিয়ামের তুলনায় আপনার ভাড়াটা একটু বেশি মনে হচ্ছে।
একটু অপ্রস্তুত হয়ে স্তেফান বললো, আগে বলবে তো! ঠিক আছে, পঞ্চাশ মার্ক নিশ্চয় বেশি হবে না?
পঞ্চাশ মার্ক ঠিক আছে। আপনার এখান থেকে একটা টেলিফোন করতে চাই।
স্বচ্ছন্দে। হাসিমুখে টেলিফোনটা কাউন্টারের ওপর তুলে দিলো স্তেফান।
বাড়িতে ফোন করে স্বপন মাকে জানিয়ে দিলো গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় ওরা টিটলিঙ থেকে যাচ্ছে। মা জানতে চাইলেন–রাতে থাকছে থোয়?
স্তেফানের সরাইখানায় মা। ভারি চমৎকার জায়গা। হের স্তেফানও চমৎকার মানুষ। স্বপন লক্ষ্য করলো প্রশংসা শুনে স্তেফানের হাসি কান পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। বললো, ডালমানরা কি স্যুটিং থেকে ফিরেছে মা?
হ্যাঁ, এইমাত্র ফিরলো। রাতের খাবার ঘরে পাঠাবার কথা বলে ওপরে চলে গেলো।
ঠিক আছে মা, রাখছি। কাল দুপুরের আগেই ফিরবো। টেলিফোন শেষ করে স্বপন স্তেফানকে বললো, আমরা ক্ষুধার্ত। সাপার সেরে ঘরে যাবো।
কী খাবে বলো। ভাপানো ট্রাউট আছে, বুনো খরগোশের রোস্ট আছে, সঙ্গে সবজির সালাদ অ্যাসপারাগাস স্যুপ আর বাঁধাকপির আচার।
ট্রাউট দুপুরে খেয়েছি। খরগোশের রোস্ট আর সালাদ মন্দ হবে না।
টেবিলে গিয়ে বসো। পনেরো মিনিটের ভেতর খাবার দেয়া হবে।
স্তেফান অর্ডার নিয়ে ভেতরে রান্নাঘরে গেলো। স্বপনরা এক কোনে খালি টেবিল ঘিরে বসলো। শীলা ওর ভাইকে জিজ্ঞেস করলো মা কি আমাদের জন্য চিন্তিত ছিলেন?
চিন্তিত হবেন কেন? বলেই তো এসেছিলাম সন্ধ্যার আগে ফিরবো না।
ভ্যাম্পায়ারদের গ্রামে রাত কাটাবার কথা ভাবতেই রোমাঞ্চ হচ্ছে।
তুমি কি লক্ষ্য করেছো শীলা? রনি বললো এদের সরাইখানার দরজা জানালার কোথাও রসুন ঝোলানো নেই।
হাসি চেপে শীলা বললো, জোয়াকিমের কথা শোননি? অতৃপ্ত আত্মারা দুর্গের এক মাইলের বাইরে আসে না।
এখান থেকে দুর্গটা কত দূরে হবে মনে করো?
স্বপন বললো, মাইল দুয়েকের কাছাকাছি হবে। তোমার কি এখানেও ভয় লাগছে?
না, ভয় লাগবে কেন? শুকনো গলায় রনি বললো, ভ্যাম্পায়ারদের কথা শুধু বইতে পড়েছিলাম। এভাবে ভ্যাম্পায়ারদের গ্রামে রাত কাটাবো কখনও ভাবিনি।
ফিরে গিয়ে স্কুলের বন্ধুদের কাছে গল্প করতে পারবে।
ওরা বিশ্বাসই করতে চাইবে না।
শীলা বললো, আমরা কেউ কিন্তু ভ্যাম্পায়ারদের দেখিনি এখন পর্যন্ত। শুধু লোকজনের মুখে ওদের কথা শুনেছি।
স্বপন রহস্যভরা গলায় বললো, আজ রাতে যাবে নাকি তোমরা ভ্যাম্পায়ার দেখতে?
তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? রনি আঁতকে উঠলো–ভ্যাম্পায়াররা আমাদের নাগালের ভেতর পেলে জ্যান্ত ফিরে আসতে দেবে?
তিনজন একসঙ্গে থাকলে ওরা কিছু করতে পারবে না।
এসব কথা মুখেও এলো না। খেয়ে উঠেই আমি ঘরে গিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমোবো।
ঘরে চমৎকার ভেড়ার লোমের কম্বল আছে। নিজের হাতে ওদের খাবার টেবিলে রাখতে রাখতে বললো ফুর্তিবাজ স্তেফান–তোমরা কি আমার ঘরে বানানো বিয়ার নেবে?
না ধন্যবাদ! ফুট জুস পেলেই খুশি হবো আমরা।
খরগোশের রোস্টের সঙ্গে টমাটো জুস মন্দ লাগবে না। বলে রান্নাঘর থেকে তিন গ্লাস টকটকে লাল টমাটো জুস এনে টেবিলে রাখলো স্তেফান। বললো, এটা আমার তরফ থেকে উপহার।
ধন্যবাদ। স্বপন হেসে বললো, আমরা কি আপনাকে এক মগ বিয়ার পান করার জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারি?
স্বচ্ছন্দে। একগাল হেসে স্তেফান বড় চিনেমাটির মগভর্তি বিয়ার এনে ওদের টেবিলে বসলো।
খেতে খেতে শীলা স্তেফানকে বললো, খরগোশের রোস্ট দারুণ মজা লাগছে খেতে।
আজ সকালেই ফাঁদ পেতে ধরেছি। একটু থেমে ঢক ঢক করে বেশ খানিকটা বিয়ার গিলে স্তেফান বললো, গত দশ দিনে তোমরাই শুধু খরগোশের রোস্ট খেতে চাইলে। রোজই বানাই, ভাবি বাইরে থেকে কোনো খদ্দের আসবে, শুধু অপেক্ষাই সার।
স্বপন সাবধানে বললো, এসব ভ্যাম্পায়ার আর অতৃপ্ত আত্মার গল্প শুনলে স্বাভাবিকভাবেই ট্যুরিস্টরা এখানে আসতে চাইবে না। বিশেষ করে যেখানে মানুষ পর্যন্ত খুন হয়।
কাষ্ঠ হেসে স্তেফান বললো, গল্প কেন বলছো, ঘটনা তো মিথ্যে নয়। তবে এটা ঠিক বলেছো, তিন বছর ধরে ব্যবসায় ভারি মন্দা যাচ্ছে। আগে এরকম সময়ে বাভারিয়া
আর বোহেমিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্য সারা দেশ থেকে ট্যুরিস্ট আসতো।
আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন টিটলিঙের দুর্গে ভ্যাম্পায়ার আছে?
অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। পাঁচটা মৃতদেহই আমি নিজ চোখে দেখেছি। নদীর ধারে পড়েছিলো। গলায় দুটো দাঁতের দাগ, সারা শরীর মোমের মতো সাদা।
ওদের ভেতর কি এই গ্রামের কেউ আছে?
প্রথম দুজন গ্রামের ছেলে। ওরা মারা যাওয়ার পর গ্রামের কেউ আর দুর্গের ধারে কাছে যায় না। বাকি তিনজন বাইরের। একজন তো শুনলেই, মুনশেনের এক ওঝা। আর দুজন জিপসি।
খাওয়ার কথা ভুলে ভয়ে কাঠ হয়ে রনি স্তেফানের কথা শুনছিলো। ও কিছুতেই মেলাতে পারছিলো না ওঝা কী করে ভ্যাম্পায়ারদের খপ্পরে পড়ে। বললো, আপনারা যাকে মুনশেনের ওঝা বলছেন ও কি সত্যি সত্যি ওঝা ছিলো, নাকি মিথ্যে পরিচয় দিয়েছে?
মুনশেনের সেইন্ট নিকোলাসের গির্জা থেকে এসেছিলো। নাম বলেছিলো উলফ। কালো একটা ঝোলাব্যাগ কাঁধে নিয়ে বিকেলে গেলো দুর্গে। পরদিন সকালে ডানিউবের ধারে ওর লাশ পাওয়া গেলো।
আমার মনে হয় উলফ খুবই নবিশ ওঝা।
কিংবা এমনও হতে পারে–দুর্গের ভ্যাম্পায়াররা এমনই শক্তিশালী যে একটা দুটো ওঝা ওদের কিছু করতে পারবে না।
শীলা খেতে খেতে বললো, একটা ব্যাপার আমাকে ভাবাচ্ছে। এত বছরের পুরোনো দুর্গ, এতকাল কিছু হলো না। ছোট বেলায় আমরা অনেক বার বেড়াতে এসেছি। কখনও কিছু শুনিনি। তিন বছর ধরে হঠাৎ ভ্যাম্পায়ার এলো কোত্থেকে?
বিয়ারের মগে লম্বা চুমুক দিয়ে স্তেফান বললো, এ নিয়ে আমরাও আলোচনা করেছি। উলফ বলেছিলো, এমন হতে পারে যে কেউ অসাবধানে দুর্গের মাটির তলায় পুরোনো কবরের কোনো অশুভ আত্মার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। জানোই তো ভ্যাম্পায়ারদের স্বাভাবিক মৃত্যু নেই!
এর জন্য তো অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আপনার যেমন ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে।
ক্ষতি বলে কথা! আমারটা ছাড়া টিটলিঙে আরও দুটো সরাইখানা ছিলো। ট্যুরিস্ট তো কম আসতো না! গত বছর ও দুটো বন্ধ হয়ে গেছে। আশে পাশে দশ গাঁয়ের লোক আসতো আমাদের বিয়ার কেনার জন্য, সেসব বন্ধ হয়েছে। জাদুঘরে সারাদিনে দশটা লোকও যায় কিনা সন্দেহ। কারিগর টমাসের পরিবার নুরেমবার্গ চলে গেলো ছ মাস আগে।
সবাই মিলে কিছু একটা করছেন না কেন?
এখানকার মানুষগুলো খুবই নিরীহ। কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না। আমি একবার বলেছিলাম আমাদের গির্জার ফাদারকে সঙ্গে নিয়ে সবাই মিলে ক্রস হাতে মশাল জ্বালিয়ে দুর্গে যাই। ফাদারও রাজী ছিলেন। গ্রামের লোকজন সাহস পেলো না।
স্বপন বললো, গ্রামের যে দুজন মারা গেছে ওরা কারা? আপনি কি চিনতেন ওদের?
পিটার আর টমাস, দুই বন্ধু ছিলো। তোমাদের চেয়ে বয়সে একটু বড় হবে। মজা করতে গিয়েছিলো দুর্গে। কিছু নিশ্চয় করেছে। নইলে এমন অপঘাতে মরবে কেন?
ওরা থাকে কোথায়?
টমাসদের বাড়ি এই রাস্তার শেষ মাথায়। ওর বাবা ছুতোরের কাজ করে। পিটারের বাড়ি একটু দূরে। টমাসদের বাড়ির পশ্চিমে ডানিউবের তীরে। ওর বাবা নেই, মা জাদুঘরে কাজ করে।
মার নাম কি?
এঞ্জেলা গ্রিফান। জাদুঘরে টিকেট বিক্রি করে।
ভ্যাম্পায়ারের কবলে পড়ে যাদের অপঘাতের মৃত্যু হয়েছে তাদের সম্পর্কে স্বপনের এত কৌতূহল রনির ভালো লাগলো না। ওর খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো। বললো, সারাদিন অনেক ধকল গেছে। আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
পাঁচ মিনিট বসো। আমাদের দুই বিছানার একটা কামরায় আরেকটা বিছানা ঢোকাবার ব্যবস্থা করতে হবে। এই বলে স্তেফান ওপরে গেলো ওদের ঘর ঠিক করার জন্য।
শীলা বললো, এত সব খোঁজ খবর নিচ্ছো কেন স্বপন? ডালমানের শুটিং দেখার চেয়ে খুনীদের পেছনে ঘুরে বেড়ানো নিশ্চয় বেশি মজার হবে না।
খুনীদের পেছনে ঘুরবো কেন? কৌতূহল হলো তাই জানতে চাইলাম।
খুনী কাদের বলছো? শীলা আর স্বপনের অজ্ঞতায় অবাক হলো রনি–শুনলেনা ওগুলো অপঘাতের মৃত্যু? মানুষ মেরেছে নাকি যে খুন বলছো? এসব ব্যাপারে বেশি কৌতূহল দেখানো ভালো নয়।
রনি যে এত ভীতু এটা স্বপনের জানা ছিলো না। ওদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে, ওর আর শীলার বন্ধু, তাই কিছু বললো না স্বপন। তবে ও নিজে যেটা করবে বলে ভাবে সেটা না করে ছাড়ে না। সরাইখানায় দুই বুড়োর কথা শুনে ওর মনে হয়েছে টিটলিঙের এসব মৃত্যুর জন্য কোনো অশুভ আত্মা নয়, অন্য কেউ দায়ী।
এ বিষয়ে কথা না বাড়িয়ে শীলা আর রনিকে নিয়ে ওদের রুমে গেলো স্বপন। পুরোনো ধাঁচের কাঠের দোতালা সরাইখানা। বাইরে থেকে তেমন আহামরি কিছু মনে না হলেও রুমে ঢুকে স্বপনের মন ভালো হয়ে গেলো। বিছানাগুলো খুবই আরামের। বসার জন্য গদি মোড়া চেয়ার, ড্রেসিং টেবিল, ওয়ার্ডরোব সবই আছে।
বিছানায় শুয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে শীলা বললো, বাভারিয়া বেড়াতে এসে এভাবে ভ্যাম্পায়ারদের গ্রামে রাত কাটাতে হবে কখনও ভাবতে পেরেছিলে রনি?
রনিও ওর বিছানায় শুয়ে নাক পর্যন্ত কম্বল টেনে দিয়েছে। শীলাকে বললো, এসব কথা রাতে একটুও ভাবতে চাই না। গুড নাইট শীলা।
স্বপন তখন বাথরুমে ছিলো। বেরিয়ে এসে দেখলো রনি আর শীলার মাথা পর্যন্ত কম্বলে ঢাকা। ওর মতো স্পোর্টসম্যানের পক্ষে পাঁচ মাইল হাঁটা কোনো সমস্যা না হলেও শীলা ধকল সইতে পারেনি। ভেবেছিলো রনিকে বুঝিয়ে বলবে এসব মৃত্যু সম্পর্কে ওর ধারণার পেছনে যুক্তিগুলো কী। ওদের ঘুমোতে দেখে আলোচনাটা পরদিনের জন্য স্থগিত রেখে স্বপন জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো।
কাঁচের জানালার বাইরে কুয়াশামাখা সাদা জ্যোৎস্নায় ডুবে আছে বাভারিয়ার এক ছোট্ট জনপদ। ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে আতঙ্কের সময় কাটাচ্ছে গ্রামের সরল মানুষ। মিউনিখ, ফ্রাঙ্কফুর্ট, বন কিংবা বার্লিনের মতো শহরের মানুষরা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না জার্মানিতে এখনও এমন জায়গা আছে, যেখানকার মানুষ বিশ্বাস করে হাজার বছরের পুরোনো দুর্গ থেকে ভ্যাম্পায়াররা বেরিয়ে আসে মানুষের রক্ত শুষে খাওয়ার জন্য।
রাত এমন কিছু গম্ভীর হয় নি। স্বপন ওর হাতঘড়িতে দেখলো সাড়ে নটা বাজে। স্তেফানের সরাইখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রামের কোথাও জীবনের কোনো সাড়া নেই। লোকজন বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। টেলিভিশন দেখতেও ওরা ভয় পাচ্ছে, যদি এতে অশুভ আত্মার নজর পড়ে। অনেক দূরে করুণ গলায় ডেকে উঠলো একটা কুকুর । তারপর আরও একটা। কয়েক মিনিটের ভেতর অনেকগুলো কুকুর কাঁপা কাঁপা গলায় ডাকতে লাগলো।
কুকুরের ডাক শুনে শীলা আর রনি বিছানায় উঠে বসলো। টেবিল লাইটের মৃদু আলোয় দেখলো স্বপন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রনি ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলো, ওখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছো স্বপন?
স্বপন ঘুরে দাঁড়ালো–একি, তোমরা ঘুমোওনি?
মাত্র ঘুম এসেছিলো। কুকুরগুলো কিভাবে ডাকছে শুনতে পাচ্ছো না?
হ্যাঁ পাচ্ছি। তুমি কি ভয় পেয়েছো?
মানুষের চেয়ে কুকুরের বোধশক্তি বেশি। ওরা নিশ্চয় টের পেয়েছে গ্রামে যে অন্য কোনো শক্তির আবির্ভাব হয়েছে।
শীত পড়তে শুরু করেছে রনি। এ সময় কুকুররা কাঁদে।
স্বপনের যুক্তি রনি গ্রহণ করতে পারলো না। শীত তো ওদের রাজধানী শহর বন-এও পড়ে। সেখানে কখনও কুকুরের এ ধরনের কান্না কেউ শোনেনি। স্বপন নিজেকে সবজান্তা মনে করে। শীলাও হয়েছে ওর মতো। রনি এ কথা কখনও অস্বীকার করতে পারবে না যে, পৃথিবীতে এখনও এমন অনেক ঘটনা ঘটে যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে যার কোনো ব্যাখ্যা করা যাবে না।
হঠাৎ সবগুলো কুকুরের কান্না একসঙ্গে থেমে গেলো। পূর্ণিমার চাঁদ ঢাকা পড়লো ঘন কালো মেঘের আড়ালে। রনি সভয়ে শুনলো অনেক দূরে ঘোড়ার খুরের খটখট শব্দ। স্বপনকে বললো, শুনতে পাচ্ছো?
স্বপন অবাক হয়ে জানতে চাইলো, কী শুনবো?
ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পাচ্ছো না?
স্বপন কান পেতে শুনলো। রনির কথাই ঠিক মনে হলো। খুব হালকা শব্দ ধীরে ধীরে জোরালো হচ্ছে। একটু পরে পরিষ্কার বোঝা গেলো। ঘোড়ায় টানা স্টেজ কোচ জাতীয় গাড়ি এদিকে আসছে। রনিকে ও বললো, ঘোড়ার গাড়িতে কেউ আসছে এদিকে।
ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে রনি বললো, মনে হচ্ছে কাউন্ট ড্রাকুলার মতো নরক থেকে উঠে এসেছে কেউ।
গাড়ির চাকার ঘর্ঘর আর ঘোড়ার খুরের শব্দ ধীরে ধীরে জোরালো হলো। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ল্যাম্প পোস্টের আবছা আলোতে স্বপন দেখলো ঠিক সিনেমার ড্রাকুলায় যেমন দেখা গিয়েছিলো, সেরকম একটা চার ঘোড়ায় টানা গাড়ি স্তেফানের সরাইখানার সামনের রাস্তা দিয়ে ছুটে গেলো দুর্গের দিকে। চালকের আসনে বসে আছে কালো কোট প্যান্ট পরা একজন।
স্বপনের বিশ্বাসের দেয়ালে গভীর ফাটল দেখা দিলো।