অন্যরকম আটদিন – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির
ওদের দুজনের পরীক্ষার ফল যে ভালো হবে না এ কথা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলো জয় আর টুপুল। ফল বেরোবার দিন দুজন একসঙ্গে এসেছে স্কুলে। দুজনের মুখই শুকনো। অন্যদিন ক্লাস শুরু হয় দশটায়, কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট যেদিন দেয়া হয় সেদিন অন্য কোনো ক্লাস হয় না। একটাই পিরিয়ড, শুরু হয় নটায়। ওরা আটটার সময় স্কুলে এসে চুপচাপ বসেছিল ফুটবল খেলার মাঠের এক কোণে ঘন সবুজ, বকুল গাছটার তলায়।
ঢং ঢং করে ক্লাস শুরুর ঘন্টা বাজালো বুড়ো ধনাই। ওদের মনে হলো বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুড়ির বাড়ি মারছে। ঘন্টা থেমে যাওয়ার পর ওরা যখন ক্লাসে ঢুকলো তখনও বুক ঢিব ঢিব করছিলো।
লক্ষ্মীবাজারের এই মিশনারি স্কুলটায় জয় আর টুপুল ইনফ্যান্ট ক্লাস থেকে পড়ছে। সুত্রাপুরের একই পাড়ায় বাড়ি, স্কুলে আসে একসঙ্গে, ক্লাসে বসে একসঙ্গে, বাড়ি ফেরে একসঙ্গে। পাড়ার সবাই এমন কি ক্লাসের টিচাররা পর্যন্ত ওদের ডাকেন মানিকজোড় বলে। লেখাপড়ায় আহামরি ভালো ছাত্র না হলেও ওদের ছাড়া ফুটবল টিম অচল। একজন লেফট ব্যাক, আরেকজন রাইট ব্যাকে দু বছর ধরে স্কুল টিমে খেলছে।
জয় আর টুপুল বসেছিল ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে। সামনের বেঞ্চে ভালো ছেলেরা বসে। ফাস্ট বেঞ্চে শাহেদ, বাবু, কবিররা হাসাহাসি করছিলো নিজেদের মধ্যে। প্রথম তিনটে প্লেস ওদের তিনজনের বাইরে যায় না। মনিটর টুলু চাপা গলায় বললো, স্যার আসছেন, সবাই চুপ।
হালকা মেজাজে ক্লাসে ঢুকলেন পি ডি কস্টা স্যার। ইশারায় ওদের বসিয়ে মৃদু হেসে সবার মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে বললেন, আশা করি ক্লাস নাইনে এটাই তোমাদের শেষ ক্লাস, যদি না কেউ ফেল করো।
টুলু দাঁড়িয়ে নিরীহ গলায় জানতে চাইলো–আমাদের ক্লাসে কি এবার কেউ ফেল করেছে?
ফেল করাটা অভিনব কোনো ঘটনা নয়। সেভেন থেকে এইটে উঠতে গিয়ে তিনজন ফেল করেছে। ওরা ক্লাস নাইনে উঠে আগের বছরের ফেল করা দুজনকে পেয়েছে। টুলুর কথা শুনে জয় আর টুপুলের বুক কেঁপে উঠলো।
পিডি কস্টা স্যার রহস্য হেসে বললেন, কে ফেল করেছে সে কথা এখন বলা যাবে না। একটু পরে হেডমাস্টার আসবেন। রেজাল্ট তাঁর মুখ থেকেই শুনবে।
ওপরের ক্লাসের রিপোর্ট কার্ড দেয়ার জন্য হেডমাস্টার নিজে আসেন। তার নিচের ক্লাসে যান এ্যাসিস্টেন্ট হেডমাস্টার আর প্রাইমারি সেকশনে ক্লাস টিচাররাই রেজাল্ট বলেন।
ক্লাস টেন-এর দুই সেকশনের রেজাল্ট দিয়ে ওদের ক্লাসে আসতে হেডমাস্টার ব্রাদার মার্টিনের সাতাশ মিনিট সময় লাগলো। ততক্ষণে প্রাইমারি সেকশনের ছেলেরা রিপোর্ট কার্ড নিয়ে স্কুল থেকে বাড়ি চলে গেছে। ওপরের ক্লাসের জন্য ঘন্টা বাজবে হেডমাস্টার যখন বলবেন।
এক গোছা হালকা সবুজ রঙের রিপোর্ট কার্ড হাতে হন্তদন্ত হয়ে ব্রাদার মার্টিন ক্লাসে ঢুকতেই টুলু তড়াক করে দাঁড়িয়ে দ্রুত গলায় বললো, স্ট্যান্ড, সেলুট টু।
টুলুর সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের সবাই দাঁড়ালো। ব্রাদার মার্টিন ইশারায় ওদের বসতে বললেন। পি ডি কস্টা স্যার ছাড়া সবাই বসলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। গাঙ্গুলি স্যারের কথায় পিন ড্রপ সাইলেন্স।
ব্রাদার মার্টিন ভূমিকা না করে রিপোর্ট কার্ডে নাম দেখে বললেন, এইবার তোমাদের ক্লাসে ফার্স্ট হইয়াছে শাহেদ জামান। আগে থেকেই তৈরি ছিলো শাহেদ। উঠে গিয়ে ব্রাদারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রিপোর্ট কার্ড নিলো। মৃদু হেসে নিচু গলায় ব্রাদার ওকে বললেন, কনগ্রাচুলেশন মাই বয়।
তিরিশ পর্যন্ত নাম ডাকার পরও যখন ওদের নাম ডাকা হলো না তখন জয় আর টুপুল রীতিমতো প্রমাদ গুনলো। বেশির ভাগ সময় ওদের রেজাল্ট দশ থেকে পনেরোর ভেতর থাকে। ক্লাস সেভেনের হাফ ইয়ার্লিতে একবার আঠারো আর কুড়িতে নেমেছিলো। বাড়িতে বকুনি আর পিটুনি খেয়ে ফাইনালে আবার দশ আর বারোতে উঠে গেছে।
একত্রিশ, বত্রিশ, ডেকে যাচ্ছেন ব্রাদার–ওদের নাম নেই। ক্লাস নাইনে সব মিলিয়ে চল্লিশ জন ছাত্র। তবে কি ওরা ফেল করেছে? টুপুল আর জয় দুজনই চোখে অন্ধকার দেখলো।
তেত্রিশে ব্রাদার ডাকলেন আমানুল্লার •াম, গতবার যে ফেল করে নাইনে উঠতে পারেনি। ওকে রিপোর্ট কার্ড দেয়ার সময় ব্রাদার মৃদু হেসে বললেন, তুমি যে পাশ করিয়াছ আমার বিশ্বাস হইতেছে না।
আমানুল্লা মুখ লাল করে টুপুলের বাঁ পাশে বসতেই চৌত্রিশ নম্বরের ডাক এলো–জয়ন্ত কুমার সরকার।
জয় কাঁপতে কাঁপতে উঠে গেলো। ব্রাদার ওর কার্ডে চোখ বুলিয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, তুমি এত খারাপ করিয়াছ ক্যান?
জয় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। ব্রাদার বললেন, আশা করি ক্লাস টেন-এ ভাল করিয়া পড়াশুনা করিবে। এসএসসিতে ফার্স্ট ডিভিশন পাইতে হইবে।
রিপোর্ট কার্ড হাতে করে জয় এসে টুপুলের ডান পাশে বসলো। টুপুল তাকিয়ে দেখলো, জয়ের চোখে পানি, ঠোঁট কামড়ে কান্না চাপছে।
ছত্রিশে ডাকা হলো টুপুলের পোষাকি নাম—ইরফান হাবিব।
জয়কে ব্রাদার যে কথা বলেছিলেন শক্ত গলায় একই কথা ওকেও বললেন। শেষে আরও ভয়ঙ্কর এক কথা বললেন, তোমার বাবাকে বলিবে, আমার সঙ্গে যেন কাইল পরশুর মইধ্যে দেখা করেন।
পৌষের হাড়-কাঁপানো শীত ক্লাসে বসে টের পাওয়া গেলেও টুপুলের কপাল ঘেমে উঠলো। কান দুটো গরম হয়ে ভেতরে শোঁ শোঁ শব্দ হতে লাগলো। কোনো রকমে নিজের জায়গায় এসে বসার পর আর মাত্র দুজনের নাম শুনলো। ওদের ক্লাসের আটত্রিশ জন ক্লাস টেন-এ উঠেছে, দুজন ফেল করেছে।
ব্রাদার মার্টিন ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে যারা রেজাল্ট ভালো করেছে তাদের অভিনন্দন জানিয়ে কি সব বললেন। শাহেদের রেজাল্ট নাকি অসম্ভব ভালো হয়েছে। কবিরও চেষ্টা করলে ম্যাট্রিকে প্লেস পাবে। টুপুল আর জয়ের কানে সেসব কিছুই ঢুকলো না। এমন কি পাঁচ মিনিট পর ছুটির ঘন্টা শুনে সবাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও ওরা ওদের জায়গায় চুপচাপ বসে রইলো।
অনেকক্ষণ পর মস্ত এক চাবির গোছা হাতে মাঝবয়সী মোটাসোটা দপ্তরি হেনরি ক্লাস বন্ধ করতে এসে ওদের দুজনকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে অবাক হলো। বুঝলো, পরীক্ষার ফল ভালো হয়নি। এ রকম হয়। সমবেদনার গলায় হেনরি ওদের বললো, তমাগোরে বুঝি ফেল করাইয়া দিছে। এইখানে আর বইসা থাইকা কি করবা, বাড়িত যাও। মন দিয়া ল্যাখাপড়া কর, সামনের বার পাশ করন লাগবো।
দপ্তরি হেনরিকে কোনো কথা না বলে ওরা ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো। সারা স্কুল তখন খাঁ খাঁ করছে। ফুটবল মাঠে কয়েকটা কাক ছাড়া কোথাও প্রাণের চিহ্ন নেই। ওরা আবার বকুল তলায় গিয়ে বসলো। দমকল অফিসের পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটার ঘন্টা বাজলো। কা কা করে কাকগুলো উড়ে গেলে সারাটা স্কুলে নেমে এলো এক ভয়ঙ্কর নিরবতা।
বকুলতলার শানবাঁধানো চাতালে হলুদ রঙের কয়েকটা পাকা বকুল ফল পড়েছিলো। টুপুল ওর একটা মুখে ফেলে বললো, কি করবি কিছু ঠিক করলি?
জয় বললো, বললাম তো বাড়ি যাবো না।
তুই বাড়ি না গেলে আমিও বাড়ি যাবো না। রেজাল্ট দেখলে ভাইয়া পিঠের ওপর আস্ত বেত ভাঙবে।
তোর মতো মারলে তো ভালোই ছিলো। বাবা বলে দিয়েছে, পনেরোর ভেতরে যদি জায়গা না থাকে তাহলে যেন বাড়ি না ফিরি।
টুপুল মৃদু গলায় বললো, ও কথা সব বাবাই বলেন। তাই বলে তো সত্যি সত্যি তোকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন নি। তুই বুঝি বাবাকে চিনিস না? শুকনো গলায় জয় বললো, আজ পর্যন্ত বাবার কথার নড়চড় হতে কেউ দেখেনি।
টুপুল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, কোথায় যাবি কিছু ভেবেছিস?
তাই তো ভাবছি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো জয়।
আত্মীয়স্বজন কারও বাড়িতে যাওয়া যাবে না।
পাগল! সঙ্গে সঙ্গে হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেবে। এখানে যাওয়ার মতো কোনো বন্ধুর বাড়িও নেই।
আমাদের সেরকম বন্ধুই বা কোথায়!
কলকাতায় আমার এক পেনফ্রেন্ড আছে। স্বপ্নর কথা বলি নি তোকে?
গত বছর বলেছিলি। এখনও কি তোরা চিঠি লিখিস?
আগের মতো নয়। মাসে একটা। অনেকবার আমাকে লিখেছিলো কলকাতা যেতে।
সে তো তুইই লিখেছিস ঢাকা আসতে। পেনফ্রেন্ডদের ওরকম লিখতে হয়।
গিয়ে যদি হাজির হই ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
তোকে না ফেরালেও আমি কোন মুখে যাবো?
জয়ের কথা শুনে টুপুল একটু চুপসে গেলো। গত বছর ইয়ং অবজার্ভারে ঠিকানা দেখে কলকাতার স্বপ্নকে চিঠি লিখেছিলো টুপুল। স্বপ্নর মতো ওরও শখ স্ট্যাম্প জমানো, বই পড়া, ছবি দেখা, বেড়ানো আর খেলাধুলা। ছবি দেখে ক্লাস এইটের স্বপ্নকে ওর দারুণ লেগেছিলো। স্বপ্নরও যে ওকে ভালো লেগেছে সেটা জানতেও দেরি হয়নি। তৃতীয় চিঠিতে স্বপ্ন ওকে কলকাতায় বেড়াতে যেতে বলেছে। ওর বাবা-মাও নাকি খুশি হবেন বাংলাদেশের টুপুলকে দেখতে পেলে। টুপুলের পাসপোর্ট নেই। টুপুলের বাবা বলেছেন, এসএসসি পাশ করার আগে একা কোথাও যেতে পারবে না। পরের চিঠিতে স্বপ্ন জানিয়েছে ওরও নাকি একই সমস্যা।
টুপুলকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে জয় জানতে চাইলো–কি ভাবছিস?
কাষ্ঠ হেসে টুপুল বললো, কলকাতার স্বপ্নর কথা ভাবছি।
ওর কথা ভাবার কি হলো? ভারি গলায় জানতে চাইলো জয়।
ইন্ডিয়া যেতে হলে পাসপোর্ট ভিসা লাগবে। আমাদের কোনোটাই নেই।
অনেক টাকাও লাগবে। আমাদের তাও নেই।
টাকার কথা উঠতেই টুপুল বললো, তোর পকেটে কত টাকা আছে রে?
দশ টাকা। তোর?
পঞ্চাশ টাকা। পাশের বাড়ির ছোড়দির জন্য কি সব জরি কিনতে হবে। লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছে।
তার মানে ওটা তোর টাকা নয়। খরচ করা যাবে না।
বাড়িই যদি না যাই জরি কিনে কাকে দেবো?
কোনোদিনই যাবি না?
শক্ত গলায় টুপুল বললো, তুই যদি আমার সঙ্গে থাকিস কোনোদিনই না।
কি করবো তাহলে?
একটু ভাবলো টুপুল। আট বছর আগে মা মরে যাবার পর ওর পাঁচ বছরের বড়ভাই ওকে শাসন করার ষোলআনা দায়িত্ব নিয়েছে। নিজে পড়াশোনায় ভালো বলে টুপুলকেও তার মতো হতে হবে। রেজাল্ট একটু খারাপ হলে এমনভাবে ওকে পেটায় যেন ও মানুষ নয়। বাবার কাছে ওর সাতখুন মাপ। মার খেয়ে অনেক সময় টুপুলের মনে হয়েছে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবে। এ বাড়ির সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখবে না। একা সাহসে কুলোয় নি বলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এতদিন কোথাও যায়নি। জয় ওর একমাত্র বন্ধু। ও যদি সঙ্গে থাকে টুপুল যেখানে খুশি যেতে পারে।
জয় আবার প্রশ্ন করলো, কিছু বলছিস না যে?
আমরা চট্রগ্রাম গিয়ে কোনো জাহাজে চাকরি নিতে পারি। কিছু পয়সা জমিয়ে একদিন এক অচেনা বন্দরে নেমে যাবো। নতুন নতুন দেশ দেখবো, নতুন মানুষ দেখবো। বলতে গিয়ে টুটুল উদাস হয়ে গেলো।
জয় বললো, জাহাজে আমাদের কিসের চাকরি দেবে? বিদ্যে তো মোটে ক্লাস নাইন।
আমরা যে কোনো কাজ করতে পারবো। দরকার হলে জাহাজের খালাসি হবো। আমাদের স্বাস্থ্য তো খারাপ নয়।
খেলাধুলোর কারণে টুপুল আর জয় দুজনের স্বাস্থ্যই রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। বড়দের মতো ওদের হাতের আর পায়ের মাসল। বুকের মাপ আটত্রিশ–ড্রিল টিচার বলেছেন দুবছরের মধ্যে বেয়াল্লিশ পেরিয়ে যাবে। ক্লাস টেনের রবিউল ছাড়া স্কুল। টিমে ওদের চেয়ে ভালো স্বাস্থ্য আর কারও নয়।
টুপুলের কথা শুনে শুকনো হেসে জয় বললো, লেখাপড়ায় ইস্তফা দিয়ে শেষকালে জাহাজের খালাসিগিরি করে জীবন কাটাবো?
তা কেন? টুপুল বিব্রত গলায় বললো, সারা জীবন খালাসি থাকতে কে বলেছে! হাতে কিছু টাকা জমলে আমেরিকা চলে যাবো। টাকা থাকলে সেখানে গিয়ে পড়াশোনা করতে কোনো অসুবিধে হবে না। দরকার হলে পালা করে পড়বো। কখনো আমি চাকরি করবো, তুই পড়বি। কখনো তুই চাকরি করবি, আমি পড়বো। তারপর একটা র্যাঞ্চ কিনে কাউবয় হয়ে যাবো।
ব্রাদার ফিলিপ্স মাঝে মাঝে ওদের সিনেমা দেখান স্কুলের হলঘরে প্রোজেক্টর বসিয়ে। আগে ওদের মজা লাগতো কার্টুন ছবি। এখন ওরা কাউবয় ছবি দেখতে পেলে আর কিছু চায় না।
তোর কি মনে হয় ষাট টাকা দিয়ে আমরা দুজন চিটাগাং পর্যন্ত যেতে পারবো? জয়ের কথা শুনে টুপুল একটু দমে গেলো। চট্টগ্রাম যেতে ট্রেনে কত লাগে ওর জানা নেই। এটুকু শুধু জানে–ট্রেনের থার্ড ক্লাসের ভাড়া বাসের চেয়ে কম। ওদের ক্লাসের হিরুদের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে। ছুটি হলেই ওরা বাড়িতে যায়। ট্রেনের গল্প হিরুদের কাছে অনেক শুনেছে। মা থাকতে টুপুলরা বার দুয়েক বরিশালে নানার বাড়ি গিয়েছিল। এ ছাড়া কখনও ঢাকার বাইরে যায় নি। জয়ের দৌড় বিক্রমপুর পর্যন্ত। ফি বছর পূজোর ছুটিতে ওরা সবাই বিক্রমপুরে যায়। সেখানে এখনও ওদের আদিবাড়িতে ঘটা করে দুর্গা পুজো হয়। কিছুক্ষণ ভেবে টুপুল বললো, কলতাবাজারের সাদেক ভাই আমাদের ক্লাবের জন্য কিছু চাঁদা দিতে চেয়েছিলো। চল গিয়ে দেখি টাকাটা এখন পাওয়া যায় কিনা।
জয় উঠে দাঁড়ালো। সামান্য হেসে বললো, ক্লাবের চাঁদাটাও এভাবে মেরে দিবি?
টুপুল গম্ভীর হয়ে বললো, মারবো কেন? প্রথম মাসের বেতন পেলে ঠিক পাঠিয়ে দেবো। ছোড়দির জরির টাকা সুদ্ধো।
ওদের স্কুল থেকে কলতাবাজারে যেতে পাঁচ মিনিটও লাগে না। সাদেক হোসেন কলতাবাজারের বনেদি পরিবারের ছেলে। পুরানো ঢাকায় ওদের গোটা পাঁচেক বাড়ি আছে। বিয়ে থা করে নি। কাজকর্মও কিছু করে না। বাড়ি ভাড়ার যা টাকা পায় নাম কেনার জন্য অকাতরে চাদা দিয়ে বেড়ায়। খালি একবার পটাতে পারলেই হলো। ফুটবলের শখ আছে জেনে টুপুল দিন দশেক আগে ওদের ক্লাবের সেক্রেটারিকে নিয়ে এসে সাদেক হোসেনকে ভালোমতো পটিয়ে গিয়েছিলো।
ভরদুপুরে একজনের বাড়িতে এভাবে যাওয়া ঠিক হচ্ছে কিনা ভেবে ওরা একটু ইতস্তত করছিলো। দরজার কড়া নাড়তে ওদের বয়সী কাজের ছেলে এসে জানতে চাইলো, কারে চান?
টুপুল গম্ভীর গলায় বললো, সাদেক ভাই আছেন?
আছে। কি কমু?
বল কাগজিটোলা ক্লাবের টুপুল এসেছে।
বসেন। বলে ছেলেটা ভেতরে চলে গেলো।
একটু পরেই সাদেক হোসেন বেরিয়ে এলো। চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। এরই ভেতর ছোটখাট একটা ভুঁড়ি গজিয়েছে। ফর্সা অমায়িক চেহারা। সোফায় বসে হেসে বললো, আরে তুমি? কোইথেইকা আইলা? তোমাগো কেলাবের খবর কি?
টুপুল একটু হেসে বললো, ক্লাবের খবর তো আপনি জানেনই। আমরা ঠিক করেছি আপনাকে আমাদের পেট্রন বানাবো।
একগাল হেসে সাদেক হোসেন বললো, পেট্রন-টেট্রন না বানাইলেও চান্দা দিমু কইছি, দিমু। ট্যাকা কি অখনই লাগবো?
ইতস্তত করে টুপুল বললো, আপনার যদি অসুবিধে না হয়–।
অসুবিধা কিয়ের? হেসে উড়িয়ে দিলো সাদেক–তোমরা কি বাড়ির থনে আইতাছ?
না, স্কুল থেকে।
তাইলে তো অখনো খাও নাইক্কা। আমি খাইবার বইছিলাম। লও, তোমরাও খাইবা।
খাওয়ার কথা শুনে ওদের খেয়াল হলো পেটের ভেতর প্রজাপতি উড়ছে। তবু জয় বিব্রত গলায় বললো, না না, আমরা বাড়ি গিয়ে খাবো। আপনি ব্যস্ত হবেন না।
তুমি নতুন আইছ তো, শরম লাগতাছে। আমার এইহানে শরমের কিছু নাই। এই বলে সাদেক গলা তুলে ডাকলো, আরে অই বিলা, কই গেলি?
যে ছেলেটা ওদের দরজা খুলে দিয়েছিলো সে ঘরে ঢুকতেই সাদেক বললো, টেবিলে আরো দুইজনের খানা লাগা।
টুপুলরা আর আপত্তি করলো না। করলেও সাদেক শুনতো না। দুপুরবেলা ওদের বাড়ি থেকে কেউ না খেয়ে ফেরত যাবে এমন অদ্ভুত কথা সাদেক জীবনেও শোনে নি।
জয় আর টুপুলের খিদে যেমন পেয়েছিলো টেবিলে আয়োজনও ছিলো অনেক। বড় বড় কই মাছ ভাজা, রুই মাছ রান্না, মুরগির দোপেয়াজি–পেট ভরে খেলো ওরা। খাওয়ার পর দুশ টাকা চাঁদা নিয়ে যখন রাস্তায় নামলো, তখন আর ওদের মুখে হাসি ধরে না। যেন বিশ্ব জয় করেছে।
বেশিক্ষণ ওরা মুখের হাসি ধরে রাখতে পারলো না। কমলাপুর স্টেশনে এসে টিকেট কাটতে গিয়ে শুনলো দুজনের চট্টগ্রামের ভাড়া একশ আশি টাকা। শোনামাত্র ওদের মুখ শুকিয়ে গেলো। স্টেশনে আসার পথে ওরা দুশ টাকার বাজেট করে ফেলেছে। ওদের দুজনের বাড়তি প্যান্ট শার্ট কিনতে হবে। একটা ব্যাগও লাগবে। ভেবেছিলো একশ টাকায় দুজনের টিকেট হয়ে যাবে। জয় অসহায় গলায় বললো, এখন কি হবে?
টুপুল মরিয়া হয়ে জবাব দিলো, টিকেট ছাড়াই ট্রেনে উঠবো।
ধরতে পারলে জেলে পুরবে।
তাতে কি! বাড়ি তো যাচ্ছি না?
পুলিশ যদি বাড়িতে খবর দেয়?
বাড়ির ঠিকানা কে দিচ্ছে? ধরলে বলবো বরিশাল থেকে এসেছি। ব্যাগ স্যুটকেস হারিয়ে গেছে।
স্টেশনে লোকজনের ব্যস্ত পায়ে আনাগোনা দেখতে দেখতে ওরা গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। প্ল্যাটফর্মে পর পর তিনটা ট্রেন দাঁড়ানো। তিনটাতেই লোক উঠছে। স্টেশনের একজন কুলিকে টুপুল জিজ্ঞেস করলো এর ভেতর কোটা চট্টগ্রাম যাবে।
কুলি মাঝখানের ট্রেনটা দেখিয়ে দিলো। দুপাশের তুলনায় মাঝখানেরটা একটু লক্করমার্কা। তবে নোকজনের ভিড় কম। পেছন দিকে প্রায় খালি একটা কামরা দেখে ওরা উঠে পড়লো।
কামরার এক কোণে দুজন বুড়ি গুটিসুটি মেরে বসে আছে। টুপুল চাপা গলায় জয়কে বললো, আমাদের মতো বিনা টিকেটের।
জয় বললো, চল ওপরের বাঙ্কে শুয়ে থাকি। প্যাসেঞ্জার কম দেখলে টিকেট চেকার নাও আসতে পারে।
সাদেক হোসেনের বাড়িতে ভরপেট খেয়ে টুপুলের মনে হচ্ছিলো লম্বা একটা ঘুম দেয়া দরকার। রেজাল্ট বেরোবার ভয়ে গত রাতে এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি।
ভালো বলেছিস। টুপুল হেসে বললো, এক ঘুমে চিটাগং চলে যাবো।
ওরা দু দিকের বাঙ্কে উঠে শুয়ে পড়লো। বালিশ ছাড়া শুতে একটু অসুবিধে হচ্ছিলো। তবে স্কাউটিং করার অভিজ্ঞতা থাকাতে এ নিয়ে ওরা মাথা ঘামালো না। কিছুক্ষণ পর চলন্ত ট্রেনের মৃদু দুলুনিতে মাথার নিচে হাত রেখে ওরা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। রাতে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে আসার আগে পর্যন্ত টেরও পেলো না ওরা ভুল ট্রেনে চট্টগ্রামের উল্টো দিকে চলে গেছে।
.
০২.
টুপুলের বাবা বাংলাবাজারের এক বইয়ের দোকানে ম্যানেজারের চাকরি করেন। রাত নটার আগে কখনো তাঁর বাড়ি ফেরা হয়না। দোকান বন্ধ করতে করতে সাড়ে আটটা বেজে যায়। সেদিন আটটার সময় টুপুলের বড়ভাই হাবুল হন্তদন্ত হয়ে দোকানে এসে হাজির। ওদের বাবা তখন সারাদিনের বিক্রির হিসেব মেলাচ্ছিলেন। হাবুল উদ্বিগ্ন গলায় বললো, টুপুলকে আপনি কোথাও পাঠিয়েছেন বাবা?
বাবা অবাক হয়ে বললেন, নাতো! কি হয়েছে?
এখনো ও বাড়ি ফেরে নি।
সে কি? ম্যাচ-ট্যাচ খেলতে কোথাও যায় নি তো?
না। ওর ক্লাসের ছেলেদের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছি। স্কুলের দপ্তরি বললো, দুপুর পর্যন্ত নাকি জয়ের সঙ্গে স্কুলে ছিলো। বাড়িতে খেতেও আসেনি।
তাহলে যাবে কোথায়? তোর মেজো মামার বাসায় খবর নিয়েছিস?
মেজ মামা, ফুপু-সবার বাসায় খবর নিয়েছি। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরাও খুঁজছে। কাল নাকি কোথায় ম্যাচ আছে।
জয়দের বাড়িতে কি বললো?
জয়ের বাবার খুব রাগ দেখলাম। জয়ও মনে হচ্ছে টুপুলের সঙ্গে আছে। বললেন, পরীক্ষার ফল বেরুতেই পাখা গজিয়েছে। দ্যাখো গে কোনো সিনেমা হলে নয়তো কোনো বাড়িতে আড্ডা দিচ্ছে।
হতেও পারে। চিন্তিত গলায় বললেন টুপুলের বাবা।
হাবুল গম্ভীর হয়ে বললো, সন্ধ্যার পর টুপুল কোথাও গেলে দাদিকে বলে যায়। দুপুরে না খেলেও বলে। সিনেমা দেখতে হলেও দাদির কাছ থেকে পয়সা নিতো।
বন্ধুরা কেউ দেখাচ্ছে হয়তো। চল বাড়ি যাই। এতক্ষণে হয়তো এসে গেছে।
অন্যদিন টুপুলের বাবা হেঁটে বাড়ি যান। হাঁটলে মিনিট পনেরো লাগে। সেদিন তিনি রিকশা নিলেন। রাস্তা ফাঁকা থাকাতে পাঁচ মিনিটেই বাড়ি পৌঁছে গেলেন।
কড়া নাড়তেই টুপুলের দাদি দরজা খুললে। টুপুলের আপন দাদি নন। বাবার দূর সম্পর্কের কাকি হন। সম্পর্ক কাছের না হলেও মা-মরা নাতি দুটোকে পাখির বাচ্চার মতো বুকে আগলে রাখেন। দরজা খুলেই তিনি ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলেন, কি রে, ছোঁড়ার কোনো খবর পেলি?
হাবুল মাথা নাড়লো–না দাদি।
হতভাগা কোথায় গেলো! বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন দাদি–কোনো বিপদ আপদ হয়নি তো?
টুপুলের বাবা বললেন, কাঁদছো কেন কাকি? আমি এক্ষুণি হাসপাতালে খবর নিচ্ছি। হাবুল থানায় গিয়ে দ্যাখ। এ্যাকসিডেন্ট হলে থানাওয়ালারা বলতে পারবে।
টুপুলের দাদি এরই ভেতর পীরের দরগায় দশ টাকা সিন্নি মানত করেছেন। হাবুলরা চলে যেতেই তিনি দরজায় খিল দিয়ে জোড়া মোরগ মানত করে নফল নামাজ পড়তে বসলেন।
থানা আর হাসপাতাল ঘুরে টুপুলের বাবা আর ভাই সাড়ে দশটার দিকে ফিরলেন। খবর না পেয়ে টুপুলের দাদি হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলেন। হাবুল বললো, থানার লোকেরা খোঁজখবর নেয়া শুরু করেছে। তুমি ভেবো না দাদি। কালই টুপুলের খবর পেয়ে যাবো।
ভাইপো আর নাতিকে খেতে দিয়ে দাদি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন, আজ পাশের খবর বেরুবে শুনে ইলিশের ডিমের বড়া করলাম। ছেলেটা কদিন ধরে খেতে চাইছিলো।
বাবা বললেন, ওরটা রেখে দাও। কাল এসে খাবে।
হাবুল বললো, ওকে ভালোমতো শাসন করা দরকার। কিছু না বললে বেড়ে যাবে।
তোমার আর শাসনের দরকার নেই বাছা। দাদি শুকনো গলায় বললেন, ছেলে বড় হয়েছে। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা ঠিক নয়।
আমি ওর ভালোর জন্যেই শাসন করি।
হঠাৎ দাদির মনে হলো টুপুল ছেলেধরার পাল্লায় পড়েনি তো? কথাটা বলতে গিয়ে আবার তিনি ফুঁপিয়ে উঠলেন। টুপুলের বাবা মাথা নাড়লেন–না কাকি। এতবড় ছেলে ছেলেধরার হাতে পড়বে না।
বড় কোথায় দেখলি বাপ! সবে তো পনেরোতে পড়লো।
পনেরো হলেও দেখতে ওকে আঠারো-ঊনিশের মতো দেখায়। ওকে নিয়ে ছেলেধরাদের কোনো কাজ হবে না।
ছেলেধরা না হোক, গুণ্ডা-বদমাশের পাল্লায় তো পড়তে পারে। ধরে নিয়ে কোথাও হয়তো আটকে রেখেছে।
মনে হয় না। টুটুলের বাবার ততক্ষণে খাওয়া হয়ে গেছে। গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বললেন, গুণ্ডারা ধরে তো টাকার জন্যে। ওরা খোঁজ খবর নিয়েই ধরে। ওদের নজর হচ্ছে বড়লোকদের ওপর। আমার মনে হচ্ছে ক্লাসের কারো হয়তো পরীক্ষার ফল খুব ভালো হয়েছে। সবাই কোথাও বসে মজা করছে।
দাদি শুকনো গলায় বললেন, তাই যদি করে বুঝতে হবে ছেলে তোমার লায়েক হয়েছে। এতদিন আমাকে না বলে কোথাও যায় নি।
বাবা ভেবেছিলেন পরদিন সকালে টুপুল এসে যাবে। নটার সময় তিনি দোকানে যান। তখনও টুপুলকে ফিরতে না দেখে হাবুলকে বললেন, তুই একবার ওদের স্কুলে যা। হেডমাস্টার আর ক্লাস টিচারের কাছে খোঁজ নে। আমি ছুটি নিয়ে দুপুরে চলে আসবো।
দাদি বললেন, পুটির মা এলে আমি দুপুরের দিকে নারিন্দার হুজুরের কাছে যাবো।
দুটো নাগাদ টুপুলের বাবা বাড়ি ফিরলেন। দাদি আর হাবুল তার আগেই ফিরে এসেছিলো। টুপুলের বাবার কাছে কোনো খবর আসেনি শুনে তিনি আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন–টুপুল রে বলে।
তাঁর কান্না থামাবার জন্যে টুপুলের বাবা জিজ্ঞেস করলেন, নারিন্দার হুজুর তোমাকে কি বললেন?
কি আর বলবেন, সবর করতে বলেছেন। পানিপড়া দিয়েছেন। তিনদিনের ভেতরে না ফিরলে আবার যেতে বলেছেন।
হুজুর যখন সবর করতে বলেছেন তখন আর কান্নাকাটি করো না। এই বলে টুপুলের বাবা একটু থামলেন। তারপর হাবুলকে বললেন, তুই বলছিস টুপুলের সঙ্গে জয়ও আছে?
তাই তো মনে হচ্ছে। ওদের দুজনকে স্কুলের দপ্তরি হেনরি বারোটা পর্যন্ত একসঙ্গে দেখেছিলো।
আরেকবার জয়দের বাড়ি গিয়ে দেখবি কোনো খোঁজ খবর এলো কি না?
আপনি যান। ওর বাবা ভীষণ বদমেজাজি।
ঠিক আছে। আমিই যাচ্ছি। বলে ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়লেন টুপুলের বাবা।
হাবুলের মনে পড়লো সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ নেয়া হলেও টুপুলদের ক্লাবে ও যায়নি। যদিও টুপুল গত কয়েকদিন যাবৎ ক্লাবে কম যাচ্ছে তবু গিয়ে একবার দেখা দরকার –এই ভেবে হাবুল গেলো কাগজিটোলা ক্লাবে।
জয়ের বাবা অক্ষয়কুমার সরকার জজকোর্টের পেশকার। অনেক ছেলেমেয়ে তাঁর। কারো কোনো বেচাল দেখলে পিঠে বেত ভাঙেন। টুপুলের বাবার সঙ্গে মুখ-চেনা সম্পর্ক। সেদিন তিনি কোর্টে যাননি। বাইরের ঘরে বেতের চেয়ারে বসে খড়কে কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছিলেন। টুপুলের বাবাকে দেখে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে নির্বিকার গলায় বললেন, জোড়মানিকের কোনো খোঁজ পেলেন?
টুপুলের বাবা শুকনো গলায় বললেন, না। থানা, হাসপাতাল, বন্ধুদের বাড়ি সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। ভাবলাম আপনারা কোনো খোঁজ পেলেন কি না!
আপনার মতো থানা পুলিশ করবার অতো সময় নেই আমার। গিন্নি তো সকাল থেকে শয্যা নিয়েছেন কুটোটি মুখে তুলছেন না। ওকে অনুমানেই বলেছি, আপনি সব জায়গায় গিয়েছিলেন। খোঁজ পেলে আসবেন।
জয়ের কোনো আত্মীয়বাড়ি নেই, যেখানে ওরা যেতে পারে?
আমার ধারণা বাছাধন পরীক্ষায় ফেল মেরেছে। বলেছি পনেরোর ভেতর থাকতে না পারলে যেন বাড়িমুখো না হয় । গিন্নির কান্নাকাটিতে বড় ছেলে বিক্রমপুর গেছে। খবর পেলে জানাবো। এই বলে জয়ের বাবা আবার দাঁত খোঁচাতে লাগলেন।
টুপুলের বাবা বাড়ি ফিরে দেখেন বসার ঘরে একজন তরুণ পুলিশ অফিসার বসে আছে। তিনি ঘরে ঢুকতে অফিসারটি উঠে দাঁড়ালো–আমি সূত্রাপুর থানা থেকে আসছি, এস আই নজরুল ইসলাম। আপনারা থানায় দুটি ছেলে সম্পর্কে মিসিং রিপোর্ট করেছেন?
টুপুলের বাবা ঢোক গিলে বললেন, হ্যাঁ, কোনো খোঁজ পেয়েছেন?
এস আই ইতস্তত করে বললেন, আজ সকালে আরিচা রোডে ভয়ানক এক বাস অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। ষোলজন মারা গেছে। এর ভেতর চৌদ্দ-পনেরো বছরের দুটি ছেলে আছে। চেহারা চেনা যাচ্ছে না। কাপড়-চোপড় দেখে মনে হয় ভদ্র ফ্যামিলির। আইডেন্টিফাই করার জন্যে আপনাকে একবার হাসপাতালে আসতে হবে।
টুপুলের বাবা কোনো কথা বলতে পারলেন না। এস আই-এর সঙ্গে কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে পুলিশের জীপে উঠলেন। খবর পেয়ে পাড়ার মহিলারা এসেছেন। টুপুলের দাদির সঙ্গে দেখা করতে। হাবুল তখনও ক্লাব থেকে ফেরেনি।
হাসপাতালের মর্গে ঢুকে টুপুলের বাবা এমনই ভেঙে পড়লেন যে, এস আই এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললো, মন শক্ত করুন। এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না।
দুর্ঘটনার খবর শোনার পর থেকেই টুপুলের বাবার মনে হচ্ছিলো মর্গে গিয়ে তাঁকে তার ছেলের লাশ সনাক্ত করতে হবে। ডোম যখন ঠাণ্ডা মর্গে খড়খড় করে লোহার দেরাজ টানছিলো, মনে হচ্ছিলো তার বুকের ওপর দিয়ে রেলগাড়ির চাকা গড়িয়ে যাচ্ছে। শক্ত হাতে তিনি আঁকড়ে ধরলেন পুলিশ অফিসারকে।
মুখ ছাড়া শরীরের আর কোথাও জখমের কোনো দাগ নেই। মুখের বাঁ দিকটা উড়ে গেছে। ডান দিক অক্ষত। মনে হয় গভীর প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে আছে ছেলেটা। টুপুলের বাবার বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেলো–আহা রে, কোন্ বাবা-মার কোল খালি করে এভাবে চলে গেলো! কথাটা মনে হতেই তাঁর দুচোখ বেয়ে টপটপ করে কান্না গড়িয়ে পড়লো।
পুলিশ অফিসার নজরুল ব্যস্ত গলায় জানতে চাইলেনা–আপনার ছেলে?
না। ধরা গলায় ফিস ফিস করে বললেন টুপুলের বাবা, জোরে কথা বললে বুঝি ঘুম ভেঙে যাবে যাবে ছেলেটার আমার ছেলে নয়। মনে মনে বললেন, আমার মত হতভাগ্য কারো ছেলে।
টুপুলের বাবা একেবারেই ভেঙে পড়েছেন। তাঁর ভয় হলো টুপুল হয়তো অন্য কোনো শহরে অন্য কোনো হাসপাতালে এভাবে মর্গে পড়ে আছে। এস আই নজরুল তাঁকে জীপে বসিয়ে থানায় নিয়ে এলো।
সুত্রাপুর থানার মোটাসোটা ওসি নির্লিপ্ত গলায় টুপুলের বাবাকে বললেন, আপনি অযথা উতলা হচ্ছেন। আজকালকার ছেলেদের তো চেনেন। বাড়িঘর, বাপ-মা কিছুই কেয়ার করে না। দেখবেন দুদিন পর ঠিকই সুড়সুড় করে ঘরে এসে ঢুকছে।
টুপুলের বাবা ভাঙা গলায় বললেন, আমার ছেলে ওরকম নয়।
আপনার ছেলে অন্যরকম হতে পারে। বন্ধুবান্ধব তো আর ওর মতো নয়। নিশ্চয় কারো পাল্লায় পড়েছে।
আপনারা কি অন্য কোনো শহরের থানা বা হাসপাতালে খবর নিতে পারেন না?
ওসি গম্ভীর হয়ে বললেন, দেখুন হাবিব সাহেব, এ ধরনের কেস-এ আটচল্লিশ ঘন্টার আগে মুভ করবার নিয়ম নেই। এ বয়সের ছেলেরাই বাড়ি থেকে পালায়।
আমি বলছিলাম, একটু ইতস্তত করে টুপুলের বাবা বললেন, যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে! পালাতে গিয়ে অ্যাকসিডেন্ট তো হতে পারে!
তা পারে। স্বীকার করলেন ওসি–আমি কাল অয়ারলেসে খবর পাঠিয়ে দেবো। কাল বিকেলে আপনি একবার দেখা করে যাবেন। কে জানে, হয়তো এরই মধ্যে আপনার ছেলে ফিরে আসবে।
থানা থেকে বাড়ি ফিরে টুপুলের বাবা হাবুলের কাছ থেকে শুনলেন কলতাবাজারের সাদেকের কাছ থেকে টুপুল আর জয়ের টাকা নেয়ার ঘটনা। কাগজিটোলা ক্লাবে সাদেকের সঙ্গে হাবুলের দেখা হয়েছিলো। ঘটনার পুরো বিবরণ দিয়ে হাবুল বললো, শয়তান দুটো প্ল্যান করে পালিয়েছে। আসুক এবার, মজা টের পাওয়াবো।
টুপুলের দাদি এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিলেন। হাবুলের শেষের কথায় তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন, দ্যাখ ছোঁড়া, কালও তুই এরকম কথা বলেছিলি। লেখাপড়া সবার সমান হয় না। নিজে সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকিস। পাড়াপড়শির কোনো বিপদ হলে তোকে ত্রিসীমানায় দেখা যায় না। টুপুল আর জয় সবার আগে গিয়ে দাঁড়ায়। সকাল থেকে পাড়ার বউ-ঝিরা এসে ওদের অনেক কথা বলে গেলো। আমি নিজেও ছাই এতসব জানতাম না। তোকে বাছা শেষবারের মত সাবধান করে দিচ্ছি, ফের যদি কোনোদিন তোকে টুপুলের গায়ে হাত তুলতে দেখি তাহলে আমি গলায় দড়ি দেবো।
দাদির ধমক খেয়ে হাবুল মুখ কালো করে ওর ঘরে গিয়ে ঢুকলো। টুপুলের বাবারও মনে হলো, লেখাপড়ায় বড় ছেলের মতো মাথা পরিষ্কার নয় বলে ছোট ছেলেকে তিনি যথেষ্ট অবহেলা করেছেন। আজ সকালে ওর ঘরে গিয়ে প্রথম বারের মতো ওঁর চোখে পড়েছে দেয়াল-আলমারির তাক ভর্তি ছোট-বড় নানা সাইজের কাপ। লাল ফিতে বাঁধা মেডেলও রয়েছে কয়েকটা। এতসব টুপুল কখন পেয়েছে। তিনি জানেনও না। হয়তো লেখাপড়ায় ভালো হাবুলের ওপর ওঁর পক্ষপাত দেখে টুপুল অভিমান করে কখনও ওঁকে এসব দেখায়নি। টুপুলকে সাত বছরের রেখে ওর মা মারা গেছেন। বাবা ভাবলেন, মা মরা ছোট ছেলেটার ওপর তিনি অনেক অবিচার করেছেন। বছর দুয়েক আগে একটা ফুটবল চেয়েছিলো বলে তিনি টুপুলের কান মলে দিয়ে বলেছিলেন, পরীক্ষায় তো দশের ভেতর নাম দেখি না, সারাদিন খেলা নিয়ে পড়ে থাকলে বড় হয়ে কুলিগিরি করে খেতে হবে। এসব কথা ভাবতে গিয়ে টেরও পেলেন না কখন তাঁর দুচোখে পানি জমেছে।
টুপুলের বাবা পরদিনও অফিসে গেলেন না। হাবুলকে দিয়ে মালিককে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন, তিনদিনের ছুটি চেয়ে। সকালে জয়ের বাবাকে গিয়ে বলে এসেছেন সাদেকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওরা কোথাও গেছে। জয়ের বাবা আগের মতোই নির্বিকার যেখানেই যাক, দিনের পর দিন বসিয়ে খাওয়াবে এমন কোন কুটুম্ব কোথাও নেই । দেখবেন হাতের টাকা ফুরোলেই ফিরে আসবে।
বিকেলে থানায় যাওয়ার জন্যে যখন টুপুলের বাবা বেরোতে যাবেন তখনই মোটর সাইকেলে এস আই নজরুল এসে হাজির। ব্যগ্র হয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন খবর শোনার জন্যে। এস আই তাকে হতাশ করলেনা। এখনও কোন খবর পাইনি। বোঝেনই তো, বন্ধু-বান্ধব কারো বাড়িতে থাকলে খুঁজে বের করা অসম্ভব।
এস আই-কে ভেতরে এনে বসালেন টুপুলের বাবা। বললেন, আমি যদি জানতে পারতাম ওর কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়নি, তাহলে বন্ধুর বাড়িতে আছে জেনে নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম।
অ্যাকসিডেন্টের খবর থাকলে কাল সকালের ভেতর পেয়ে যাবো। এস আই একটু গম্ভীর হয়ে বললো, ইদানীং ওকে কি আপনারা অচেনা বা নতুন কোনো লোকজনের সঙ্গে মিশতে দেখেছেন?
টুপুলের বাবা বিব্রত গলায় বললেন, আমি সারাদিন দোকানে থাকি, ছেলেরা কাদের সঙ্গে মেলামেশা করে ঠিক বলতে পারবো না। তবে ওর বড়ভাই আর দাদিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওরা দুজনেই না বললো। আসলে ফুটবল খেলা ছাড়া টুপুল আর জয়ের অন্য কোনো শখ নেই।
এস আই আগের মত গম্ভীর গলায় বললো, এ বয়সী ছেলেদের স্মাগলাররা অনেক সময় ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে দলে ভেড়াতে চায়, টাকার লোভে অনেক অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেও স্বেচ্ছায় এ লাইনে আসে।
টুপুলের বাবা বললেন, আমরা অবস্থাপন্ন নই এটা সত্যি কথা, তবে আমার ছেলেরা টাকার জন্য যে কুপথে যাবে না–এ আমি হলফ করে বলতে পারি।
আমি তো বলিনি সবাই স্বেচ্ছায় যায়, কেউ কেউ যায়। অনেকে যেতে বাধ্য হয়।
বাধ্য কেন হবে?
বিশেষ কারণে হয়তো বেশ কিছু টাকার দরকার হলো। জানে বাড়িতে চাইলে পাবে না। কিংবা কোনো ছেলের এমন কোনো দুর্বলতার কথা ওরা জেনে ফেললো। তখন এ নিয়ে ব্ল্যাকমেলও করে।
টুপুলের বাবা পুলিশের যুক্তির কাছে দুর্বল হয়ে পড়লেন। তবু অসহায় গলায় বললেন, নজরুল সাহেব, নিজের ছেলে বলে বলছি না। পাড়ার লোকদের জিজ্ঞেস করুন। টুপুল খুবই ভালো ছেলে।
নিজের জন্যে না হোক, পরোপকারী ছেলে যখন, অন্য কারো টাকার দরকারেও তো ওদের সঙ্গে জুটে যেতে পারে। না না, এমনটা হয়েছে আমি বলছি না। শুধু সম্ভাবনাগুলো যাচাই করে দেখছি।
যদি তাই হয় আমরা কি করতে পারি?
আপনি আগামী কাল খবরের কাগজে ছবিসহ বিজ্ঞাপন দিন। লিখে দিন ওর দাদি মৃত্যুশয্যায়। সেই সঙ্গে সন্ধানদাতার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করতে পারেন। তাহলে লুকিয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
এস আই নজরুলের শেষে কথাটা টুপুলের বাবার পছন্দ হলো। বললেন, আমি গরিব মানুষ। তবু বলছি, কেউ যদি টুপুলকে এনে দিতে পারে আমি দশ হাজার টাকা দেবো তাকে।
এস আই হেসে বললেন, তাহলে ধরে নিন বিজ্ঞাপন বেরোনোর তিনদিনের ভেতর আপনার ছেলে ফিরে এসেছে।
টুপুলের দাদি নারিন্দার হুজুরের কাছে গিয়েছিলেন। ঘরে ঢুকতেই এস আই-এর কথাগুলো ওঁর কানে এলো। বললেন, বাছা তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ক।
টুপুলের বাবাও কিছুটা স্বস্তি বোধ করলেন। তাঁর মনে হলো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপা হলে কোনো অবস্থায় টুপুল নিজেকে বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারবে না। তাঁরা তখন কেউ অনুমানও করতে পারলেন না টুপুলরা কি ভয়ানক বিপদে পড়েছে।