০৩. শার্লেমানের দুর্গের সন্ধানে
অক্টোবর ফেস্ট-এর বিশাল আয়োজন দেখে রনির চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। বার বার বলছিলো, বন-এ এরকম উৎসবের কথা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। উৎসবে যারা এসেছে। সবাই পরেছে পুরোনো দিনের জমকালো পোষাক। ছেলেদের অনেকের কোমরে তলোয়ার ঝোলানো। কেউ আবার হাতলে নকশার ভেতর রঙ বেরঙের পাথর বসানো লম্বা নলের পিস্তল গুঁজেছে কোমরের বন্ধনিতে। মেয়েরা ফোলানো ঝলমলে গাউন পরেছে, কারো টুপির ঝালর মুখটাকে করে তুলেছে রহস্যময়। কাছাকাছি গ্রাম থেকে ঘোড়ায় টানা গাড়িতে কাঠের পিপে ভর্তি বিয়ার এনে রাস্তায় ধারেই বিক্রি করতে বসে গেছে চাষী। পরিবার। সঙ্গে ঘরে বানানো কেকও আছে কয়েক রকম।
রনি জানতো না বলে প্যান্টের ওপর উলের সাধারণ জ্যাকেট পরে এসেছে। উৎসবের ঘটা আর পোশাকের বাহার দেখে ওর খুব লজ্জা লাগছিলো। স্বপন ওকে লম্বা পালক বসানো জিপসিদের একটা লাল রঙের টুপি কিনে দিয়েছে। ওতে অবশ্য ওর চেহারায় খানিকটা উৎসবের ছোপ লেগেছে।
ঘড়িতে তখন ঠিক বারোটা। ওরা বসেছিলো ইংলিশার গার্ডেন-এ। মিউনিখের সবচেয়ে বড় পার্ক এটা। উৎসবের জন্য পার্কের ভেতর ফাইবার গ্লাসের চেয়ার টেবিল পেতে বসার জায়গা করা হয়েছে। ওদের তিনজনের সামনে মগভর্তি বাভারিয়ান বিয়ার। ছোটদের জন্য বিশেষভাবে বানানো, একফোঁটা অ্যালকহল নেই অথচ বিয়ারের রঙ আর ফেনা ষোলআনাই আছে। গত দু ঘন্টায় ওরা দু মগ শেষ করেছে, এটা তৃতীয় মগ। স্বপনদের সবচেয়ে কাছের টেবিলে বসেছিলো দুই জার্মান যুবক। একজনের বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ হবে, আরেকজন তিরিশের কাছে। কম বয়সী যুবকটি খুবই সুন্দর দেখতে, ঠিক সিনেমার নায়কদের মতো। শীলাই ওকে প্রথম দেখে নিচু গলায় রনিকে বলেছে, আমাদের পাশের টেবিলে কমবয়সী লোকটাকে দেখ, ঠিক হিউবনারের মতো মনে হচ্ছে।
জার্মান ছবির অতি পরিচিত নায়ক হিউবনার। মেয়েরা ওর নামে পাগল। রনি এক ঝলক দেখে বললো, মতো কেন বলছো? আমার তো মনে হয় এই হিউবনার।
আমার তা মনে হয় না। এ যদি হিউবনার হতো এতক্ষণে অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য লম্বা লাইন পড়ে যেতো।
স্বপন বললো, হিউবনার যদি অক্টোবর ফেস্ট দেখতে আসে এখানে ওর থাকার কথা নয়। ওরা থাকবে হোটেল হিল্টন ইন্টারন্যাশনালে।
পাশের টেবিলের ওরা এতক্ষণ নিচু গলায় কথা বলছিলো। হঠাৎ সুদর্শনের গলা এক ধাপ ওপরে উঠলো–তোমাকে আগেই বলেছিলাম রেগেনবার্গে না পেলে আশে পাশে কোথাও আমাদের জন্য হোটেল বুক করো। এদ্দিন কুঁড়ের মতো বসে বসে সময় কাটিয়ে এখন বলছো হোটেল পাওয়া যাবে না। তোমার কাজে আমি খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছি রোমের।
একেবারে যাবে না তাতো বলিনি। বিব্রত গলায় ওর সঙ্গী রোমের বললো, তুমি আমাকে বলেছো দু সপ্তাহ আগে। এদিককার সব হোটেলে এ সময় এক মাস আগে বুক করতে হয়। রেগেনবার্গের এক গেস্ট হাউসে বলে রেখেছি তিন দিন পর দুটো ঘর পাওয়া যাবে।
মিউনিখে বসে এ তিন দিন কি আমি ইউনিটের লোকদের নিয়ে ঘোড়ার ঘাস কাটবো? বিদ্রূপভরা গলায় বললো সুদর্শন।
আমি দুঃখিত ডালমান।
ওদের কথা শুনতে শুনতে শীলা দুবার স্বপনের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলো। ও কী বলতে চায় স্বপন ঠিকই বুঝতে পারলো। রোমের দুঃখিত চেহারা নিয়ে ডালমানের রাগী চোখের সামনে বসেছিলো। স্বপন উঠে ওদের টেবিলে গিয়ে বললো, আপনার কথা আমি শুনে ফেলেছি বলে দুঃখ প্রকাশ করছি হের ডালমান। মনে হয় আপনি বাভারিয়ার বনের কাছে কোনো হোটেলের সন্ধান করছেন?
হ্যাঁ করছি। সামান্য রুক্ষ গলায় ডালমান বললো, আশা করি এতে তোমাদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। যে কোনো ট্যুরিষ্টই এ সময় বাভারিয়া বা বোহেমিয়ায় থাকার জন্য হোটেল খুঁজতে পারে।
এ ব্যাপারে আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি।
তুমি কে? কিভাবে সাহায্য করবে আমাকে?
আমার নাম স্বপন। ডেগেনডর্কে আমাদের একটা চমৎকার হোটেল আছে। আপনি ইচ্ছে করলে ওখানে থাকতে পারেন। রেগেনবার্গ থেকে বেশি হলে বিশ মিনিটের পথ।
ডেগেনডর্ফের কোন হোটেলের কথা বলছো? জানতে চাইলো রোমের।
হোটেল জেরানিয়াম। ডেগেনডর্ফের সবচেয়ে ভালো হোটেল।
হ্যাঁ, নাম শুনেছি। আসলে ডেগেনডর্ফের কথা আমার মনে ছিলো না। খুবই ছোট লোকালয়।
হোক ছোট। এটা তো স্বীকার করবেন ডেগেনডর্ফের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যে কোনো তুলনা নেই?
আমি ওদিকে কখনও যাইনি।
তুমি না গেলে কি ডেগেনডর্ফের সৌন্দর্যে ভাটা পড়বে? সুদর্শন যুবক ডালমান বিরক্তি মেশানো গলায় বললো, দয়া করে যদি হোটেল জেরানিয়ামে তিনটে কামরা বুক করো আমি বাধিত হবে।
তোমাদের হোটেল কি টেলিফোনে বুক করা যাবে? স্বপনের কাছে জানতে চাইলো রোমের।
যাবে। খুশিভরা গলায় স্বপন বললো, ইচ্ছে করলে আপনারা আমাদের সঙ্গে যেতে পারেন। সন্ধ্যায় বাজি পোড়ানো শেষ হলেই আমরা ডেগেনডর্ফ যাবো। ততক্ষণ আনন্দ করুন।
আনন্দ করার এতটুকু সময় আমার হাতে নেই। এখনই হোটেলে গিয়ে স্ক্রিপ্ট নিয়ে বসতে হবে। ভালো কথা, তোমাদের হোটেলে গাড়ি পাওয়া যাবে তো? নাকি এখান থেকে যেটা নেবো সেটা রেখে দিতে হবে?
আমাদের নিজেদের দুটো গাড়ি আছে। দরকার হলে অতিথিরা আমাদের গাড়ি ভাড়া করেন। কিছু যদি মনে না করেন, এ এলাকায় আপনারা কতদিন থাকবেন?
কাজের ওপর নির্ভর করছে। শার্লেমানের আমলে এদিকে বেশ কিছু দুর্গ বানানো হয়েছিলো। মূলত এসবের সন্ধান করতেই আমরা এখানে এসেছি। জার্মান টেলিভিশনের জন্য একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাচ্ছি আমি।
তাহলে আপনি ঠিক জায়গাতেই এসেছেন। বাভারিয়ার পাহাড়ে বেশ কয়েকটা পুরোনো দুর্গ আছে।
স্বপনের কথা শুনে ডালমানের মুখে হাসি ফুটলো–তুমি নিজে দেখেছো সে সব দুর্গ?
আমাদের হোটেল থেকে মাইল দশেক দূরে একটা ভাঙা দুর্গ আছে। জানি না ওটা শার্লেমানের কিনা। তবে অনেক পুরোনো। ছোটবেলায় ওখানে গিয়েছি। একটা পুল পেরোতে হতো ওখানে যেতে। চার বছর আগে একবার প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছিলো। তখন পাহাড়ী স্রোতের তোড়ে পুলটা ভেঙে গেছে। এরপর আর যাইনি।
তোমাকে ধন্যবাদ স্বপন। যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে স্বপনের সঙ্গে হাত মেলালো ডালমান। তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি খুব খুশি হয়েছি। বড় রকমের একটা দুশ্চিন্তা থেকে আমাকে বাঁচিয়েছো তুমি। তোমরা ফেরার পথে আমাদের হোটেলে এসো। আমরা ম্যাক্সমিলিয়ন স্টুবেন-এ আছি। সবাই মিলে একসঙ্গে যাবো।
ডালমান আর রোমের চলে যাওয়ার পর রনি প্রশংসাভরা গলায় বললো, ভালো। ব্যবসা শিখে ফেলেছো স্বপন। হোটেল নিয়ে চাচাকে আর মাথা ঘামাতে হবে না।
স্বপন লাজুক হাসলো–এ বছরের টুরিষ্ট সিজনটা অন্য সব বছরের মতো জমজমাট ছিলো না। নইলে এভাবে গায়ে পড়ে কাউকে বলতাম না।
শীলা বললো, ঘর তো মাত্র দুটো খালি। আরেকটা ঘর কোথায় পাবো?
পাঁচ নম্বরের ম্যাডাম লিসবেথ আজ সন্ধ্যায় চলে যাবেন। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো স্বপন।
ডালমানকে আমার খুব হিংসা করতে ইচ্ছে হচ্ছে। উদাস গলায় বললো রনি।
কেন? জানতে চাইলো স্বপন।
যে কদিন ও জেরানিয়াম-এ থাকবে, শীলার আদর যত্ন সব ওর কপালেই জুটবে।
কক্ষণো নয়; আপত্তি জানালো শীলা –ডালমানদের যত্ন নেয়ার জন্য মিস মাথাই যথেষ্ট।
স্বপন বললো, একটা বাজতে আর বেশি দেরি নেই, চলো গাড়ির কাছে যাই।
ততক্ষণে গোটা মিউনিখ শহর উৎসবের আনন্দে মেতে উঠেছে। যদিও আসল প্যারেড হবে বিকেলে, যেখানে দেড়শ বছর আগের যুবরাজ লুডভিগ আর রাজকুমারী থেরেসা সাজবে উৎসবের সবচেয়ে সুন্দর দুই তরুণ তরুণী; আর সবাই হবে সভাসদ, সহচর, সৈন্য সামন্ত। গাইয়ে, নাচিয়ে, বাজিয়ে সবাই মিলে দারুণ জমজমাট বিশাল মিছিল নিয়ে মিউনিখের বড় রাস্তা ঘুরে পার্কে জড়ো হয়। সন্ধ্যার পর শুরু হয় বাজি পোড়ানোর উৎসব।
গাড়ি রাখার জায়গায় এসে স্বপনরা দেখলো বাবা মা আগেই এসে গেছেন। বাবার বন্ধু উলরিখও আছেন সঙ্গে। চেহারা দেখেই মনে হয় প্রচুর পান করেছেন তিনি। অকারণে হাসছেন, চেঁচিয়ে কথা বলছেন, বলতে গিয়ে হাত পা ছুঁড়ছেন, অবশ্য কেউ এতে কিছু মনে করছে না, কারণ বেশির ভাগ বাভারিয়ানই মনে করে মদ খেয়ে মাতাল না হলে উৎসবের অর্ধেক আনন্দই মাটি।
স্বপনকে দেখে উলরিখ হইচই করে উঠলেন–এই যে রাজকুমার লুডভিগ; ভাই বোন দুটিকে সঙ্গে নিয়ে কোন রাজকুমারীর খোঁজে গিয়েছিলে।এই বলে শীলা আর রনিকে নেশাজড়ানো চোখে ভালো করে দেখে বললেন, বোনটিকে রাজকুমারী মনে হলেও ভাইটিকে সাধারণ প্রজা বলে মনে হচ্ছে ইভা! ছোট ছেলেটাকে তুমি অবহেলা করছো!
মা বিব্রত গলায় বললেন, উলরিখ, ও হচ্ছে রনি। বাংলাদেশ অ্যাম্বাসির কাউন্সিলরের ছেলে। আজ সকালেই মিউনিখ এসেছে। এই উৎসবের কথা জানতো না।
এই যাঃ, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। শফিক তো বলেছিলো ওর বন্ধুর ছেলে। ইভা, আমি কি এরই মধ্যে মাতাল হয়ে পড়লাম? এখনও তো সূর্য ডুবতে অনেক দেরি!
উলরিখের কাঁধে হাত রেখে মৃদু হেসে বাবা বললেন, কিছুটা তো মাতাল হয়েছে। এর বেশি হলে তোমাকে সামলানো যাবে না। চলো, দুপুরের খাবারটা সেরে ফেলি।
ঠিক বলেছো। আমি খিদের জ্বালায় আবোল তাবোল বকছি। হের প্রিন্স লুডভিগ, আশা করি আমার কথায় তোমরা কিছু মনে করোনি।
উলরিখের কথা শুনে স্বপন একটু অস্বস্তি বোধ করছিলো। তবু হেসে বললো, না আঙ্কল, কিছু মনে করবো কেন? আমরা আসলে একটা ব্যবসায়িক আলোচনায় সময় কাটিয়েছি।
ওর কথা শুনে বাবা মা দুজনই অবাক হলেন। উলরিখ বললেন, উৎসবে এসে ব্যবসার আলাপ কেন বাছা?
হামবুর্গ থেকে একটা ফিল্ম ইউনিট এসেছে। বাভারিয়া আর বোহেমিয়ার পাহাড়ে পুরোনো দুর্গের ছবি তুলবে। থাকার জায়গা পাচ্ছিলো না। আমি গিয়ে আমাদের হোটেলে থাকার আমন্ত্রণ জানালাম। ওরা রাজী হয়েছে।
ফিল্ম ইউনিট মানে তো অনেক লোক! মা বললেন, আমাদের হোটেলে এত লোক জায়গা দেবো কোত্থেকে? মাত্র দুটো ঘর খালি আছে।
ওরা তোক বেশি না মা। তিনটা ঘর দরকার। ম্যাডাম লিসবেথ তো আজ সন্ধ্যায় চলে যাবেন। তখন ওঁর ঘরটা ওদের দেয়া যাবে । ওরা আমাদের সঙ্গেই যাবে।
ম্যাডাম লিসবেথ আজ যেতে পারেন, যাবেনই এটা নিশ্চিত নয়।
সেক্ষেত্রে আমার ঘরটা আমি ছেড়ে দিতে পারি। শীলা, রনি, আমি এক ঘরে থাকবো।
ট্যুরিস্ট সিজনে অনেক সময় লোকজন বেশি এলে স্বপন ওর ঘর ছেড়ে দেয়। তবে এবার সঙ্গে রনি থাকাতে মা ইতস্তত করলেন–শীলার ঘর ছোট, রনির অসুবিধে হবে।
রনি ব্যস্ত গলায় বললো, আমার জন্য মোটেও ভাববেন না চাচী। আমরা সবাই একসঙ্গে থাকলে বেশি মজা হবে।
বাবা খুশিভরা গলায় বললেন, আমাদের স্বপন তাহলে সাবালক হয়ে গেছে! একা একা একটা ব্যবসায়িক আলোচনা সারলো।
একেবারে প্রফেশনালদের মতো কথা বলেছে চাচা। রনি মন্তব্য করলো, আমার মনে হয় না আপনি ওদের স্বপনের মতো পটাতে পারতেন।
স্বপন লজা পেয়ে প্রসঙ্গ পাল্টালো–আমার পেটের ভেতর নেকড়ের আঁচড় অনুভব করছি। আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত।
আমিও। বললেন উলরিখ–চলো সবাই, রাস্তার ধারে বসে হাঁসের রোস্ট আর বাভারিয়ান সালাদ খাবো।
গ্রাম থেকে আসা চাষী পরিবারগুলো ঘরে বানানো মদের সঙ্গে খাবারও পরিবেশন করছিলো। ওরা সবাই চীনা হাঁসের রোস্ট খেলো মজা করে। সঙ্গে ছিলো আলু, মটরশুটি, ফুলকপি, ক্যাপসিকাম আর দু তিন রকম ডালের অঙ্কুরের সঙ্গে হোয়াইট সস মেশানো দারুণ মজার এক সালাদ। খিদে শুধু স্বপন আর উলরিখের নয়, সবারই লেগেছিলো। দুটো আস্ত হাঁসের রোস্ট অল্প সময়ের ভেতর হাওয়া হয়ে গেলো। ঘরে বানানো লাল ময়দার রুটি আর মাখন ছিলো পর্যাপ্ত । উলরিখ একা একতাল মাখনের সঙ্গে আস্ত রুটি সাবাড় করলেন।
খাবার শেষ করে সবাই যোগ দিলো ফ্যাশন প্যারেডের হুল্লোড়ে। কালো ভেল ভেটের আলখাল্লার মতো একটা গায়ে দিয়ে দুটো নকল দাঁত আর হাতে লম্বা নখ লাগিয়ে উলরিখ ড্রাকুলা সেজেছেন। মহিলারা একজন নাদুশনুদুশ ড্রাকুলা দেখে হেসে খুন হলো। স্বপন কয়েকবারই লক্ষ্য করেছে কম বয়সী বেশ কয়েকটা মেয়ে মুগ্ধ চোখে ওকে দেখেছে। শীলা রনির সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত ছিলো বলে দেখতে পায় নি। তবে ন্যাড়া মাথা তিনটে পাঙ্ক পাশ দিয়ে যাবার সময় ইচ্ছা করেই স্বপনকে ধাক্কা দিয়েছে। বাবা সঙ্গে থাকাতে ও কিছু বলতে পারলো না। একবার একা একটা স্কীনহেড ওর সঙ্গে লাগতে এসেছিলো। ওর দুটো কড়া পাঞ্চ খেয়ে বেচারা দু চোখে অনেকগুলো তারা দেখতে দেখতে ভেগেছে।
সন্ধ্যার পর পুরো চল্লিশ মিনিট আতশ বাজির উৎসব দেখে আটটায় ওরা গাড়ি নিয়ে ম্যাক্সমিলিয়ন স্ট্রাসেতে ডালমানের হোটেলে এলো। ডালমান আর তার তিন সঙ্গী বাক্স প্যাটরা নিয়ে লাউঞ্জে অপেক্ষা করছিলো। স্বপনকে দেখে বললো। তোমার দেরি দেখে আমি ভাবছিলাম ভুলে গেলে কিনা!
আমি দুঃখিত হের ডালমান। স্বপন বিনীত গলায় জানতে চাইলো; আপনারা কি অনেকক্ষণ এখানে অপেক্ষা করছেন?
মিনিট পঁচিশেক হবে। আমরা কি এখন রওনা দিতে পারি?
নিশ্চয়, আমার বাবা মা ভাই বোন বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করছে। আপনাদের গাড়ি রেডি আছে।
আমাদের জিনিষপত্র বেশি। একটা মাইক্রোবাস নিয়েছি। এই বলে ডালমান সঙ্গীদের দিকে তাকালো–চলো যাওয়া যাক।
ডালমান যে বেশ রাগী মানুষ এটা স্বপন শীলারা দুপুরে পার্কে বসেই টের পেয়েছে। স্বপন মনে মনে উদ্বিগ্ন ছিলো ওদের জেরানিয়াম যদি ওর পছন্দ না হয়! শীলাকে ও ডেগেনডর্ফ আসার পথে গাড়িতে বলেছে, ওদের লাউঞ্জে বসিয়ে কফি খাওয়াতে খাওয়াতে মার্থাকে নিয়ে ঘর দুটো ভালোভাবে গুছিয়ে ফেলবি।
ঘর সাজাবার ব্যাপারে শীলা জাদু জানে। রুক্ষ মেজাজী ডালমান পর্যন্ত ঘর দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো বাহ, চমৎকার ঘর! একরম একটা গেঁয়ো জায়গায় এত সুন্দর হোটেল আমি আশা করিনি। এই বলে পুব দিকের জানালা খুলে কুয়াশাভেজা হেমন্তের জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাওয়া বাভারিয়ার পাহাড় আর বন দেখে মন্তব্য করলো, ঠিক এরকম একটা জায়গা আমি মনে মনে খুঁজছিলাম।
ডালমানরা আপাতত দুটো ঘরে থাকতে আপত্তি করেনি। ম্যাডাম লিসবেথ যাবেন দুদিন পর। তখন ওদের তিনটে ঘর দেয়া হবে। ডালমানদের এক মাস থাকার প্ল্যান আছে। সকালে নাশতা করার জন্য ওরা যখন নিচে নেমেছিলো তখন টমাস জেনে নিয়েছে কদিন থাকবে। নাশতা খেয়েই মাইক্রোবাস নিয়ে বেরিয়ে গেছে ডালমান। সঙ্গে ছোট বড় নানা সাইজের সাত আটটা বাক্স। রনি একবার স্টুডিওতে গিয়ে দেখেছিলো কিভাবে সিনেমার সুটিং হয়। শীলাকে বললো, ওদের সঙ্গে যাবে নাকি স্যুটিং দেখতে?
শীলার ইচ্ছা ছিলো। তবে স্যুটিং দেখবো বলাটা ভালো দেখায় না। তাই ডালমানকে ঘুরিয়ে বললো, আপনারা পুরোনো দুর্গ খুঁজছিলেন। আমরা কি সঙ্গে আসবো পথ দেখাবার জন্য।
মিষ্টি হেসে ডালমান বললো, না, দরকার হবে না। টমাসের কাছ থেকে আমরা পথ জেনে নিয়েছি।
ডালমানরা চলে যাওয়ার পর স্বপন বললো, স্যুটিং দেখার জন্য ওদের সঙ্গে যেতে হবে কেন? আমরা আমাদের মতো ঘুরতে যেতে পারি। ঘুরতে ঘুরতে স্যুটিং দেখা হয়ে যাবে।
রনি খুশিভরা গলায় বললো, দারুণ হবে স্বপন! শার্লেমানের পুরোনো দুর্গ দেখা, সেই সঙ্গে ছবির শুটিং দেখা–খুবই ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।
.
০৪. বিপদের হাতছানি
শুটিং-এর দলবল আর জিনিসপত্র নিয়ে ডালমান বেরিয়েছে সকাল নটার দিকে। হোটেলের ম্যানেজার টমাসকে বলে গেছে ওরা কেউ দুপুরে খাবে না। ফিরবে একেবারে রাতে। ওদের বেরিয়ে যাওয়ার ঘন্টা খানেক পর স্বপন, শীলা আর রনিও সারাদিনের জন্য বেরিয়ে পড়লো ছোট একটা ফক্স ভাগেন নিয়ে। পনেরোশ সিসির এ গাড়িটা স্বপন নিজে চালায়। অবশ্য শীলাকে স্কুল থেকে আনা-নেয়ার কাজটাও ওকে করতে হয়।
ডালমানরা কোথায় যাচ্ছে সে খবর টমাসই দিয়েছে স্বপনদের। টিটলিঙের পুরোনো দুর্গে বছর পাঁচেক আগেও ওরা বেড়াতে গিয়েছিলো। কিছুটা তখন পর্যন্ত মোটামুটি দাঁড়িয়ে থাকলেও বেশির ভাগ অংশ বয়সের ভারে ভেঙে পড়েছে। টমাসের অবশ্য ধারণা ওটা শার্লেমানের আমলে বানানো হয়েছিলো। জার্মানির দক্ষিণে, পুবে আর ফ্রান্সের উত্তরে বারোশ বছর আগে তখনকার ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিমান রাজা শার্লেমান জার্মান সাক্সেনদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে অনেকগুলো দুর্গ বানিয়েছিলেন। নিজেকে তিনি মনে করতেন খৃস্টধর্মের একজন রক্ষক হিসেবে। উত্তর স্পেনের সীমানা থেকে শুরু করে ইটালি, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি আর চেকোশ্লোভাকিয়ার একটা বড় অংশ জুড়ে ছিলো তাঁর রাজত্ব।
স্কুলে ইউরোপের ইতিহাসের ক্লাসে শার্লেমানের ওপর পড়তে হয়েছে স্বপনদের। নিষ্ঠাবান খৃস্টানরা এখনও ভক্তির সঙ্গে তাঁর নাম স্মরণ করে। জার্মানির আচেন গির্জায় শার্লেমানের নিরাভরণ মার্বেল পাথরের সিংহাসন রাখা আছে। যে কারণে আচেন পরিণত হয়েছে তীর্থস্থানে। স্বপনরা খবরের কাগজে দেখেছে এতকাল বুড়ো খৃস্টানরাই বেশি যেতো গির্জা আর অন্য সব তীর্থস্থানে। ইদানীং তরুণদেরও ভিড় হচ্ছে সেখানে। বলা বাহুল্য এরা সব নব্য নাৎসি, যারা মনে করে কমিউনিজমের নাম নিশানা পৃথিবী থেকে মুছে ফেলতে হলে খৃস্টধর্মকে চাঙ্গা করতে হবে।
গাড়িতে যেতে যেতে রনি বললো, ডালমান লোকটাকে রহস্যময় মনে হচ্ছে। শার্লেমানের ব্যাপারে ওর এত উৎসাহ কেন?
স্বপন মন্তব্য করলো, হয়তো নব্য নাৎসিদের দল রিপাবলিকার তরফ থেকে ওকে শার্লেমানের গির্জার ছবি করার দায়িত্ব দিয়েছে।
লোকটার ওপর নজর রাখা দরকার। গম্ভীর গলায় বললো রনি।
কোন দরকার নেই। শীলা হেসে বললো, ভদ্রলোক শুটিং করতে এসেছেন। আমাদের হোটেলের একজন বোর্ডার যদি টের পান ওঁর ওপর আমরা গোয়েন্দাগিরি করছি, নিশ্চয় আমাদের সম্পর্কে ধারণা ভালো হবে না।
নব্য নাৎসিদের দু চোখে দেখতে পারে না রনি। একবার স্কুল থেকে ফেরার পথে ওদের পাল্লায় পড়েছিলো। চার পাঁচজন মিলে মনের সুখ মিটিয়ে ওকে পিটিয়েছে। অপরাধ একটাই, ও জার্মান নয়। নাৎসিদের দাবি হচ্ছে জার্মানিতে জার্মান ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবে না। রনির মার খাওয়ার ঘটনা নিয়ে কূটনীতিকদের মহলে বেশ হইচই হয়েছিলো। কয়েকজন নাৎসিকে পুলিস গ্রেফতারও করেছিলো। রনি কাউকে চিনতে পারেনি। ওকে পেটানোর সময় ওরা মুখোশ পরা ছিলো। মুখোশ মানে কালো মুজোর ভেতর পুরো মাথা ঢোকানো, চোখের জায়গায় শুধু দুটো ফুটো করা। জেনে শুনে স্বপনরা ওদের হোটেলে নাৎসিদের থাকতে দেবে এটা ওর পছন্দ হচ্ছিলো না। অবশ্য ডালমান যে নাৎসি এর কোনো প্রমাণ ওর কাছে নেই।
টিটলিঙের ভাঙা দুর্গে যাওয়ার পথ খুব একটা সুবিধের নয়। ঘন জঙ্গল আর পাহাড়ের কিনার ঘেঁষে অনেক কাল আগের পাথরে বাঁধানো রাস্তায় চিহ্নটুকু আছে। বেশির ভাগ পাথরই উধাও হয়ে গেছে। শক্ত মাটির উঁচু নিচু রাস্তা স্বপনকে খুবই ধীরে চালাতে হচ্ছিলো। ছোট হলেও গাড়িটা খুব শক্ত। পথে দুটো ছোট গ্রাম পড়েছে, প্রথম চার মাইলের ভেতর। তারপরই টিটিলিঙ গ্রাম। এখানকার জাদুঘরের বেশ নাম আছে। এর পর শুধু বন। ওক আর চেস্টনাট গাছের শুকনো পাতায় বোঝাই হয়ে আছে সারাটা পথ। স্বপনদের ভাগ্য ভালো বলতে হবে, ভেঙে যাওয়া কাঠের পুলটা আবার মেরামত করা হয়েছে। নইলে পাহাড়ী ঝর্ণার এপাশে গাড়ি রেখে দুমাইল পথ হেঁটে যেতে হতো। গাড়ি চালাতে চালাতে স্বপন বললো, ডালমানরা বোধ হয় এ পথে আসেনি।
শীলা একটু অবাক হলো–পথ তো এই একটাই। এ পথে না এসে আর কোন পথে আসবে।
পথ ভুল করে অন্য কোনো দিকে চলে যেতে পারে।
জাহান্নামে যাক ডালমান। রনি বললো, এতটা পথ যখন এসেছি ভাঙা দুর্গটা দেখেই যাবো। কে জানে রাজা শার্লেমানের কোনো গুপ্তধন দুর্গের কোথাও লুকোনো আছে কিনা।
রনির কথা শুনে শীলা হাসলো–গুপ্তধন পেলে তুমি ওটা নিতে পারবে না। এখানকার আইনে আছে মাটির নিচের সমস্ত সম্পদের মালিক সরকার।
নিশ্চয় ভাঙা দুর্গে আইনের লোকরা পাহারা দিচ্ছে না?
যা পাবে অর্ধেক আমার। রনি আর শীলার কথার মাঝখানে মন্তব্য করলো স্বপন।
অর্ধেক নয়, তিন ভাগের এক ভাগ। গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলো রনি–আমরা তিনজন আছি, ভুলে যেও না।
শীলা হেসে বললো, শার্লেমানের গুপ্তধনের ওপর আমার কোনো লোভ নেই। আমি এসেছি ডালমানের শুটিং দেখার জন্য।
সেই সঙ্গে ছবিতে যদি একটা পার্ট জুটে যায় তাহলে তো কথাই নেই।
পার্ট করার ইচ্ছে থাকলে তোমার মতো ফুলবাবু সেজে আসতাম।
অন্য সব দিনের চেয়ে স্বপনের চেহারা আর পোষাক সেদিন একটু বেশি চকচক করছিলো। শীলার কথায় লজ্জা পেয়ে প্রসঙ্গ পাল্টালো–আমার ধারণাই ঠিক হলো। ডালমানরা এখানে আসে নি।
সামনে খাড়া পাহাড়ের বুকের ভেতর ভাঙা গির্জাটা কয়েক শ বছরের ইতিহাসের ছাপ গায়ে জড়িয়ে এখনও কোন রকমে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক একেবারে চুপচাপ । ডালমানের গাড়ি বা লোকজনের নাম নিশানা কোথাও নেই।
গাড়িটা পাহাড়ের নিচে একটা পুরোনো ওক গাছের নিচে রেখে ওরা এক এক করে নামলো। শীলা বললো, যার যার খাবার সঙ্গে নিয়ে নাও।
স্বপন মাথা নাড়লো–অযথা বোঝা বয়ে লাভ কী! দুপুরে খিদে পেলে এখানে এসে খাবো।
রনি ওর কাঁধ ব্যাগে একটা চাদর আর ক্যামেরা এনেছিলো। মিনারেল ওয়াটারের একটা বোতল ওর ব্যাগে ঢুকিয়ে বললো, দুপুর পর্যন্ত খিদে না পেলেও তেষ্টা নিশ্চয় পাবে।
দুর্গের পাহাড়টা খুব বেশি উঁচু নয়। পাহাড়ের গা পেঁচিয়ে সরু একটা রাস্তা উঠে । গেছে ওপরের দিকে। নিচে থেকে দেখলে মনে হয় গির্জাটা খুব বেশি হলে একশ ফুট উঁচুতে। ঘোরানো পথ দিয়ে ওপরে ওঠার সময় রনি ভেবেছিলো আট দশ মিনিটের ভেতর বুঝি দুর্গে পৌঁছে যাবে। মহা উৎসাহে একটানা পনেরো মিনিট হাঁটার পরও যখন মনে হলো দুৰ্গটার সঙ্গে ওদের দূরত্ব এতটুকু কমেনি তখন খানিকটা দমে গেলো। বললো, এটা কি ভূতুড়ে দুর্গ?
স্বপন বললো, এমন কথা তো আগে শুনিনি! ভূতুড়ে হতে যাবে কেন?
এই যে এতক্ষণ ধরে হাঁটছি। তার পরও মনে হচ্ছে দুর্গটা সমান দূরেই রয়ে গেছে। যেন আমরা এগুচ্ছি আর দুর্গটা পিছিয়ে যাচ্ছে। ম্যাকবেথের ডাইনিরা বলেছিলো বন হাঁটবে। এখানে দেখছি দুর্গ হাঁটে।
শীলা বললো, পাহাড়ে আগে ওঠোনি বলে এরকম মনে হচ্ছে। আর মিনিট দশকের ভেতর আমরা দুর্গে পৌঁছবো।
সামনে পাহাড়ের একটা উঁচু খাড়ির পাশে রাস্তাটা মেয়েদের চুলের কাটার মতো তিনশ চল্লিশ ডিগ্রি বাঁক নিয়েছে। কাছাকাছি আসতেই ওপর থেকে ঘড় ঘড় করে ভারি কিছু গড়িয়ে নিচে আসার শব্দ হলো। স্বপন চিৎকার করে বললো, কিনারে সরে এসো। পাথর গড়াচ্ছে।
স্বপনের বলার সঙ্গে সঙ্গে সবাই পাহাড়ের গায়ের দিকে সরে এসে সামান্য উঁচু একটা জায়গায় দাঁড়ালো। একটু পরেই বড় বড় তিনটা পাথরের টুকরো একের পর এক গড়িয়ে এসে ওদের গা ঘেঁষে নিচে নেমে গেলো। পাথরের টুকরোগুলো আকার আর গতি দেখে ওরা সভয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। স্বপনের কথা মতো সরে না এলে পাথরের ধাক্কা খেয়ে হাড়গোড় ভেঙে নিচে ছিটকে পড়তো ওরা। শুকনো মুখে রনি বললো, কী সাংঘাতিক! আর একটু হলেই ছাতু হয়ে যেতাম।
শুনেছি ভূমিকম্প হলে পাহাড়ের ওপর থেকে আলগা পাথর এভাবে গড়িয়ে আসে। ঢোক গিলে বললো স্বপন।
এ পাহাড়ে আলগা পাথর আসবে কোত্থেকে? অবাক হয়ে স্বপনকে প্রশ্ন করলো শীলা।
দুৰ্গটা পাথরের বানানো। তারই কোনো অংশ ভূমিকম্পের জন্য গড়িয়ে আসতে পারে।
ভূমিকম্প হলে আমরা ওপরে উঠছি কেন? ভয় পাওয়া গলায় বললো রনি–চলো, ফিরে যাই।
না ভূমিকম্প নয়। শীলা বললো, ভূমিকম্প হলে পাখিরা এত চুপচাপ গাছে বসে থাকতো না। মানুষের আগে পশুপাখিরা ভূমিকম্পের কথা টের পায়।
তাহলে পাথর এভাবে গড়িয়ে এলো কেন?
ওপরে গেলেই বোঝা যাবে।
রনি আর স্বপন শীলার কথা মানতে বাধ্য হলো। বয়সে ছোট হলেও স্বপন জানে শীলা নানা বিষয়ে ওর চেয়ে অনেক বেশি পড়াশোনা করেছে। ওর আই কিউও খুব শার্প। মুখে অবশ্য এ কথা কখনও স্বপন স্বীকার করে না।
আরও মিনিট দশেক হাঁটার পর ওরা দুর্গের সামনে উপস্থিত হলো। এককালে উঁচু ফটক ছিলো। গাছের গুঁড়ি কেটে বানানো ভারি দরজা ছিলো। প্রহরীদের থাকার জায়গা ছিলো। এখন তার কোনো চিহ্ন নেই। উঁচু দুটো পাথরের ঢিবির মাঝখান দিয়ে চওড়া রাস্তা চলে গেছে দুর্গের আঙিনায়।
দুর্গের দুদিকেই উঁচু খাড়া পাহাড়। মনে হয় পাহাড় কেটে দুৰ্গটা খাঁজের ভেতর বসিয়ে দেয়া হয়েছে। পাহাড়ের গায়ের অংশ এখনও পুরো ভেঙে পড়েনি। বাইরে থেকে বোঝা যায় অনেকগুলো কামরা এখনও অক্ষত আছে।
ফটকের পাশে পাথরের যে প্রাচীর ছিলো সেটাও অনেক জায়গায় ভেঙে গেছে। কোথাও কোথাও সূচোলো পাতার পাইন গাছের শক্ত শেকড়ে আটকা পড়েছে বলে প্রাচীর পুরোপুরি ভাঙেনি। শীলা আঙুল তুলে প্রাচীরের ভাঙা অংশের দিকে স্বপন আর রনির দৃষ্টি আকর্ষণ করলো ওখানে দেখ, অনেক আলগা পাথর। ওখান থেকে পড়লে সোজা রাস্তায় গড়িয়ে যাবে।
রনি বললো, পাথর আপনাআপনি গড়াতে যাবে কেন? কেউ নিশ্চয় ঠেলে দিয়েছে।
পাথর ঠেলার জন্য এখানে কে আসবে? রনির কথা শুনে স্বপন একটু অবাক হলো।
শালেমানের প্রাচীন দুর্গে কত অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে তার কি হিসেব আছে?
শীলা মৃদু হেসে বললো, আত্মাদের শরীর তো বাতাস দিয়ে বানানো। ওদের গায়ে এত জোর আছে নাকি পাথর গড়িয়ে দেবে?
কেন হরর মুভিতে দেখনি রাগী আত্মারা কিভাবে মাটি খুঁড়ে কবরের পাথর সরিয়ে বেরিয়ে আসে?
সিনেমায় ওরকম হয়। কেউ কি পরীক্ষা করে দেখেছে আত্মার গায়ে কত জোর?
স্বপন বললো, রনি, সত্যি সত্যি আত্মা ফাত্মা বিশ্বাস করো নাকি?
অবিশ্বাস করার কী আছে? এ নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে। গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো রনি।
স্বপন আর শীলা ভূত প্রেত বিশ্বাস করে না। রনির কথা শুনে ওরা হাসলো। শীলা বললো, ঠিক আছে, আজ তাহলে আত্মা দেখে বাড়ি ফিরবো।
তার মানে এখানে রাত কাটাবে?
রাতে ছাড়া আত্মার দেখা পাবো কীভাবে?
শীলার কথা শুনে রনি ঘাবড়ে গেলো। বললো, বাড়িতে বলে আসিনি। তাছাড়া রাতে থাকার জন্য তৈরিও হয়ে আসিনি।
স্বপন হেসে বললো, শীলা তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে রনি। না বলে বাড়ির বাইরে রাত কাটালে বাবা কাউকে আস্ত রাখবে না।
হেমন্তের সূর্য তখন প্রায় মাথার ওপর উঠে এসেছে। পাহাড়ের নিচে ঘন সবুজ বন, এক চিলতে ডানিউব নদী, মাঝে মাঝে ছোট ছোট জনপদ ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মতো মনে হচ্ছিলো।
ওরা বসেছিলো একটা বুড়ো পাইন গাছের নিচে। স্বপন বললো, আমার খিদে পেয়ে গেছে শীলা। খাবারের প্যাকেটটা খোল।
স্বপনের কথা শুনে হাসলো শীলা খাবারের প্যাকেট আনতে তুমিইতো বরণ করলে। এখন খিদে পেলে হেমন্তের তাজা বাতাস খাও।
রনি বললো, শুকনো বাতাস খেতে অসুবিধে হলে আমার বোতলে পানি আছে।
নিজের বোকামি দেখে নিজের ওপরই রাগ হলো স্বপনের। অপ্রস্তুত হয়ে বললো, আমি রনির কথা ভেবে খাবারের কথা বলেছিলাম। ওর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে পাহাড়ে ওঠার অভ্যাস নেই।
রনি বললো, খিদে যে একবারে লাগেনি তা বলবো না। তবে এখনকার মতো পানি খেলেও চলবে।
শীলা মন্তব্য করলো, বাভারিয়ার বাতাসে ঘুরলে ঘন ঘন খিদে পায়।
রনির এক বোতল পানি ওরা তিনজনে সাবাড় করে ক্ষিদে দূর করলো। শীলা বললো, রনি দুর্গ দেখতে চেয়েছিলে। ভেতরে যাবে না?
শালেমানের দুর্গ এতটা ভূতুড়ে চেহারার হবে আশা করিনি। আমার ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না।
স্বপন মৃদু হেসে বললো, তুমি কি আশা করেছিলে প্রহরীরা কাঠের ফটক খুলে দিয়ে আমাদের ভেতরে ঢোকাবে, আর দুর্গপ্রধান এসে স্বাগত জানিয়ে সব ঘুরিয়ে দেখাবে?
তা আশা করিনি। তবে একজন গাইড তো থাকতে পারতো!
এই দুর্গম বনে গাইড দূরে থাক গত পাঁচ বছরে আমরা ছাড়া আর কেউ এসেছে বলে তো বোঝাও যাচ্ছে না।
শীলা হেসে বললো, রাত পর্যন্ত থাকলে রনির অতৃপ্ত আত্মাদের কাউকে বলতে পারি আমাদের গাইড হয়ে দুর্গটা ঘুরিয়ে দেখাতে।
কোনো দরকার নেই। শীলার কথা শুনে রনিও হাসলো–এর চেয়ে নিচে গিয়ে স্যান্ডউইচ খেতে বেশি ভালো লাগবে।
স্বপনের খিদে পেলেও এত সুন্দর জায়গাটা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিলো না। দুপুরের ঝকঝকে রোদ গায়ে মেখে মস্ত এক কার্পেটের মতো বিছানো রয়েছে বাভারিয়ার ঢেউ খেলানো বন। ঘন সবুজ কার্পেটের ভেতর মাঝে মাঝে কাঁচের টুকরোর মতো ছড়িয়ে রয়েছে ছোট বড় রূপোলি রঙের হ্রদ। দূরের ধূসর নীল পাহাড়গুলো মনে হচ্ছে দক্ষ শিল্পীর আঁকা জলরঙের ছবির মতো। আকাশে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ ছড়িয়ে আছে। হালকা বাতাসে শীতের আমেজ। শীলা আপন মনে বললো, এখানে কিছুক্ষণ থাকলে মনটাকে পবিত্র মনে হয়।
রনি বললো, কথাটা শহরের লোকজন শুনতে পেলে দলে দলে ছুটে আসবে মন পবিত্র করার জন্য।
স্বপনের হঠাৎ মনে পড়লো ডালমানের কথা। বললো, বেচারা ডালমান, কার দুর্গকে শার্লেমানের ভেবে স্যুটিং শুরু করে দিয়েছে কে জানে!
শীলা বললো ইচ্ছা করলে আমরা ফুর্সটেনেকের দুর্গটা দেখে আসতে পারি। কে জানে ডালমান হয়তো ভুল করে ওটাকেই শার্লেমেনের দুর্গ ভেবে বসে আছে!
আসলে ওটা কবেকার দুর্গ? জানতে চাইলে রনি।
তাও দুশ বছরের কাছে হবে।
তোমার দরকার মতো গাইডও পাওয়া যাবে ওখানে। এখান থেকে হেঁটেও যাওয়া যায়। যাবে নাকি?
কেন যাবো না? পুরোনো দুর্গ দেখতে আমার ভালো লাগে।
যদি না সেখানে আত্মাদের উৎপাত না থাকে!
স্বপনের কথা শুনে শীলা শব্দ করে হেসে উঠলো। রনির মনে হলো কোথাও বুঝি জলতরঙ্গ বেজে উঠেছে।
স্বপন উঠে দাঁড়িয়ে হাত পা মেলে কয়েকটা হালকা ব্যায়াম করে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিলো। রনিকে বললো, এমন তাজা বাতাস জার্মানির আর কোথাও পাবে না।
আমার এখন দরকার তাজা লাঞ্চ প্যাকেট। পেটের ভেতর কাঠবেড়ালি ছুটোছুটি করছে।
স্বপন মৃদু হেসে বললো, চলো তাহলে।
ওপরে উঠতে যত সময় লেগেছিলো নিচে নামতে অর্ধেক সময়ও লাগলো না। বলতে গেলে ওরা একরকম দৌড়েই নামলো। ওক গাছের নিচে গাড়িটার কাছে সবার আগে ছুটে গেলো স্বপন। গাড়ির ওপর নজর পড়তেই চমকে উঠলো ও। পরিষ্কার মনে আছে নিজের হাতে দরজা বন্ধ করেছিলো, অথচ এখন দরজা খোলা।
গাড়ির কাছে গিয়ে স্বপন চিৎকার করে ডাকলো, শীলা, রনি জলদি এসো।
স্বপনের ডাক শুনে ওরা দুজন ছুটে গেলো । গাড়ির ভেতর তাকিয়ে ওরাও হতবাক হয়ে গেলো। পেছনের সিটের ওপর ওদের তিনজনের জন্য ফয়েল পেপার দিয়ে যত্ন করে তিনটা লাঞ্চ প্যাক বানিয়ে দিয়েছিলো মার্থা । তিনটা প্যাকেটই কপূবের মতো হাওয়া হয়ে গেছে। ওরা তিনজন একে অপরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করলো। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারলো না। নিরবতা ভেঙে শীলা প্রথম বললো, কেউ চুরি করেছে আমাদের খাবার।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। স্বপনের গলায় তখনও বিস্ময়ের রেশ এখানে তো কারও থাকার কথা নয়।
রনি বললো, নিশ্চয় জিপসিদের কাজ। বোধহয় কাছে ধারে কোথাও ওরা তাঁবু গেঁড়েছে।
কবে কোন কালে এশিয়া থেকে জিপসিরা ইউরোপে গিয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তার কোনো হিসেব নেই। কোথাও স্থায়ীভাবে থাকে না। দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। নানারকম জাদু দেখিয়ে, হাত দেখে ভাগ্যের কথা বলে, কখনও ছোট খাট সার্কাস দেখিয়ে, নয়তো অদ্ভুত সব পাথর আর শেকড় বাকড় বিক্রি করে নিজেদের সংসার চালায়। মাঝে মাঝে জিপসিদের কেউ ছোট খাটো চুরি চামারিও করে। কয়েক শ বছর ধরে জার্মানিতে থাকলেও বেশির ভাগ জার্মান এদের দুচোখে দেখতে পারে না, জার্মানদের সঙ্গে মেলামেশা করতে গিয়ে রনিরও ধারণা জিপসিরা ছাড়া আর কেউ চুরি করে না।
শীলা জন্মসূত্রে জার্মান হলেও মায়ের প্রভাবে ওর স্বভাব সাধারণ জার্মানদের মতো নয় । রনির কথা শুনে গম্ভীর হয়ে বললো, জিসিরা লোকালয়ের আশে পাশে থাকে। এরকম গভীর বনে জিপসি থাকার কোনো কারণ নেই।
স্বপন বললো, প্যাকেটগুলো তাহলে নিলো কে?
গাড়ির দরজা খোলা ছিলো। বুনো কুকুর কিংবা শেয়াল নিতে পারে।
দরজা আমি নিজের হাতে বন্ধ করেছি।
এখন মনে হচ্ছে করেছো। আসলে হয়তো করোনি।
আমার পরিষ্কার মনে আছে আমি দরজা বন্ধ করেছি।
শীলা আর স্বপনের কথার মাঝখানে রনি বললো, দরজা বন্ধ করেছে কি করোনি এ নিয়ে তর্ক করলে ক্ষিদে যাবে না। তার চেয়ে তাড়াতাড়ি ফুর্সটেনেক চলো। ওখানে গিয়ে লাঞ্চ করবো।
কথা না বাড়িয়ে স্বপন গাড়িতে গিয়ে বসলো। রনি বসলো ওর পাশে আর শীলা পেছনে। চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট নিতে গিয়ে আরেক বিপত্তি। বার বার চেষ্টা করেও গাড়ির স্টার্ট নিতে পারলো না স্বপন। ইন্ডিকেটারে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো এ কি! এক ফোঁটা ফুয়েল নেই গাড়িতে!
শীলা এবার বিরক্ত হয়ে বললো, বাড়ি থেকে বেরোবার সময় তুমি ফুয়েল চেক করবে না?
পরশু সন্ধ্যায় আমি বাইশ লিটার ফুয়েল নিয়েছি। আমার হিসেব মতো এখন বারো লিটারের বেশি থাকরা কথা।
রনি বললো, ট্যাঙ্কের কোথাও লিক টিক কিছু করেনি তো?
স্বপন উঠে গাড়ির তলা দেখলো। তারপর ট্যাঙ্কের ঢাকনিটা আলগা দেখেই যা বোঝার বুঝে ফেললো। গম্ভীর হয়ে বললো, যে বা যারা আমাদের লাঞ্চ প্যাক নিয়েছে তার ট্যাঙ্ক খালি করে ফুয়েলও নিয়ে গেছে।
এমন বিরান জঙ্গলে কে আসবে খাবার আর গাড়ির ফুয়েল নেয়ার জন্য? চিন্তিত গলায় বললো শীলা।
যেই আসুক, লোক ভালো নয়। আমাদের বিপদে ফেলার মতলবেই এসব করেছে। স্বপনের গলায় বিরক্তির ঝঝ।
ফেলতে চাইলেই আমরা পড়বো নাকি। খুঁজে বের করতে হবে কারা এসব শয়তানি করছে।
রনি শুকনো গলায় বললো, তোমরাই বলছো এমন গভীর বনে কোনো মানুষজন আসতে পারে না। আমার ভয় হচ্ছে এসব হয়তো কোনো অশরীরী আত্মার কাজ।
আত্মারা কবে থেকে লাঞ্চ খাওয়া শুরু করলো রনি? অবাক হয়ে বললো শীলা, ফুয়েল দিয়েই ওরা কী করবে? আত্মারা নিশ্চয় ড্রাইভ করে না?
এ জায়গাটা আমার ভালো লাগছে না। দূর যখন বেশি নয় ফুর্সটেনেক তো আমরা হেঁটেই যেতে পারি। শীলার রসিকতা উপেক্ষা করলো রনি ।
হাঁটা ছাড়া উপায়ও নেই। অসহায় ভাবে হাসলো স্বপন।
গাড়ির দরজা লক করে ওরা তিনজন জঙ্গলের ভেতরের সরু রাস্তা ধরে ফুর্সটেনেকের পথে পা বাড়ালো।