৩-৪. প্রফেসর অন্তর্ধান

০৩. প্রফেসর অন্তর্ধান

সিমি রিমি ভেবেছিলো চট্টগ্রাম পৌঁছার আগেই প্রফেসরকে হাতকড়া পরতে হবে। ব্যাটম্যান-এর কমিক পড়া বন্ধ রেখে রিমি নিবিষ্ট মনে বসেছিলো হাত কড়া নিয়ে পুলিস অফিসারদের আসার অপেক্ষায়। প্রফেসর সত্যি সত্যি ঘুমিয়েছেন না ঘুমের ভান করছেন ও বুঝতে পারছিলো না। কমিক বইটার আড়াল থেকে ও কড়া নজর রেখেছিলো প্রফেসরের ওপর।

চট্টগ্রাম পৌঁছার আধ ঘণ্টা আগে পুলিসের অফিসার দুজন এলেন। প্রফেসরকে ঘুম থেকে তুলে বললেন, আপনাকে একটু আসতে হবে আমাদের সঙ্গে।

আমার ব্যাগ? ব্যগ্র হয়ে জানতে চাইলেন প্রফেসর।

ব্যাগ পাবেন। আপাতত আমাদের সঙ্গে চলুন।

প্রফেসরকে নিয়ে পুলিস অফিসাররা বেরিয়ে গেলেন। রিমি উত্তেজিত গলায় সিমিকে বললো, দেখলি তো আপু, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হলো!

সিমি চিন্তিত গলায় বললো, আমার মনে হচ্ছে প্রফেসরের কথাই ঠিক। আগের কামরা থেকে ভুল করে কোনো স্মাগলারের ব্যাগ তুলে এনেছিলেন।

স্মাগলাররা বুঝি ওদের সোনাভর্তি ব্যাগের ওপর নজর রাখবে না?

এমনও তো হতে পারে ওরা টের পেয়েও চুপ করে ছিলো। ভেবেছে ট্রেন থেকে নামার সময় বদলে নেবে। প্রফেসরের কাছে ওদের ব্যাগ থাকলে পুলিস হয়তো সন্দেহ নাও করতে পারে।

সিমির কথায় যুক্তি আছে। তবু রিমি বললো, চিটাগং-এ খোঁজ নিতে হবে ইউনিভার্সিটিতে এ নামের কোনো ভুলো মনের প্রফেসর আছেন কি না।

প্রফেসরকে নিয়ে যাবার মিনিট পনেরো পর রাশভারি চেহারার পুলিস অফিসারটি আবার এলেন সিমিদের কামরায়। বললেন, কিছু মনে করো না, তোমাদের পরিচয় জানতে পারি?

সিমি ওদের নাম বলে বাবার পরিচয় দিলো। অফিসারের মুখ থেকে গাম্ভীর্যের মুখেশটি টুপ করে খসে পড়লো। একগাল হেসে বললেন, তোমরা আফজাল সাহেবের মেয়ে! খুব ভালো করে চিনি তোমাদের বাবাকে। উনি যখন যশোরের এসপি ছিলেন আমি তখন মহেশপুর থানার চার্জে। বল তো মা প্রফেসর কি আমাদের সত্যি কথা বলেছেন?

সিমি বললো, আমার মনে হয় সত্যি কথা বলেছেন।

রিমি গম্ভীর হয়ে বললো, আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখুন তিনি সত্যি সত্যি চিটাগং ইউনিভার্সিটির প্রফেসর কিনা। একজন প্রফেসর নিশ্চয় স্মাগলারদের দল করবে না।

তাঁর পরিচয়পত্র দেখেছি। তবে আজকালকার দিনে কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। চিটাগং কার কাছে যাচ্ছো তোমরা?

বাবার বন্ধু আতিক কাকুর কাছে। স্টেশনে আমাদের নিতে আসবেন।

খুব ভালো। ওঁর ঠিকানাটা বলো। তোমাদের সঙ্গে পরে হয়তো যোগাযোগ করতে হতে পারে।

সিমি ঠিকানা বললো। অফিসার মোটা নোট বইয়ে লিখে নিলেন। যদি কখনও কোনো দরকার হয় আমাকে খবর দিও। এই বলে অফিসারটি সিমিকে ওঁর কার্ড দিয়ে হেসে বিদায় নিলেন।

একটু পরেই ট্রেন এসে থামলো চট্টগ্রাম স্টেশনে। বাবা বার বার বলে দিয়েছিলেন ওরা যেন ভিড়ের ভেতর কামরা থেকে না নামে। দুজন দুটো জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে প্ল্যাটফর্মে ওদের আতিক কাকুকে খুঁজতে লাগলো। মিনিট পাঁচেকের ভেতরই রিমি ওঁকে দেখলো। চিৎকার করে ডাকলো, আতিক কাকু, আমরা এখানে।

ওদের বাবার সমবয়সী হলেও আতিক কাকু বেশ ভারি দেখতে, বাবার চেয়ে বয়স্ক মনে হয়, তবে খুবই হাসিখুশি চেহারা। মাথার অর্ধেকের বেশি চুল পেকে গেছে। পরনে দামী মোটা বিলেতি উলের কোট প্যান্ট। রিমির চিৎকার শুনে ছুটে এসে কামরায় উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরি হয়ে গেলো। তার ওপর শহরে একটার পর একটা মিছিল-ট্রাফিক জ্যামে পড়েছিলাম।

আতিক কাকুর পেছন পেছন ওঁর গাড়ির কম বয়সী ড্রাইভারও এসে ঢুকেছে কামরায়। এক হাতে সিমিদের স্যুটকেস নিয়ে অন্য হাতে হাত ব্যাগ দুটো নিতে চাইলো। ততক্ষণে সিমি রিমি নিজেদের ব্যাগ নিজেরাই কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছে।

স্টেশনের ভিড় ঠেলে গাড়িতে উঠে হাঁপ ছাড়লেন আতিক কাকু। বড় পাজেরো গাড়ি। পেছনে ওরা তিনজন আরামেই বসেছে। গাড়ি ছাড়ার পর কাকু বললেন, পথে তোদের কোনো অসুবিধে হয়নি তো মা।

কোনো অসুবিধে হয়নি। রিমি বললো, তবে দারুণ একটা কাণ্ড হয়েছে।

কী কাণ্ড!

প্রফেসর জাকারিয়ার ঘটনাটা আদ্যপান্ত বলে রিমি মন্তব্য করলো, আমার মনে হয় প্রফেসরও স্মাগলারদের লোক।

আতিক কাকু বললেন, ছি মা, ভালো মতো না জেনে কারও সম্পর্কে এমন কথা বলতে হয় না।

প্রথমে ভেবেছিলাম স্মাগলারদের দলে কোনো প্রফেসর থাকতে পারেন না। পুলিস অফিসার বললেন, আজকাল নাকি কাউকে বিশ্বাস করা যায় না।

পুলিসের ধারণা ওরা ছাড়া সবাই বুঝি খারাপ লোক।

স্মাগলারদের দলে একজন প্রফেসর তো থাকতেই পারেন।

তা পারেন। তবে প্রফেসর জাকারিয়া নামটা আমার পরিচিত মনে হচ্ছে, তাঁকে সন্দেহ করা তোর উচিত হচ্ছে না।

আতিক কাকুরা থাকেন পাঁচলাইশে, কাছে। গাড়ি আবার ট্রাফিক জামে আটকা পড়েছে। সিমি গাড়ির জানালা দিয়ে দূরে মিছিল দেখছিলো। স্মাগলারদের নিয়ে রিমির সঙ্গে আতিক কাকুর আলোচনা ওর পছন্দ হচ্ছিলো না। অযথা একটা নিরীহ আপনভোলা বুড়ো মানুষকে রিমি ক্রিমিনাল বানাচ্ছে। প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য ও আতিক কাকুকে জিজ্ঞেস করলো, শহরে এত মিছিল কিসের?

সকালে ইউনিভার্সিটিতে জামাতে ইসলামীর ছাত্ররা বিএনপির ছাত্রদলের একটা ছাত্রকে খুন করেছে। বিএনপি আর ছাত্রদল বিক্ষোভ মিছিল বের করেছে।

সিমি নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ে। রাজনীতি সম্পর্কে অনেক কিছু ও জানে। কাকুর কথায় অবাক হয়ে বললো, জামাতের ছেলেরা কেন বিএনপির ছেলেকে মারবে? জামাতীরা তো সব সময় বিএনপিকে সাপোর্ট দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ নয় পাঁচ দলের কারও ছেলেকে মারলে না হয় কথা ছিলো।

রাজনীতি আতিক কাকুর প্রিয় বিষয়। নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে জামাতীরা হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা আর বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে বলে এদের দুচোখে দেখতে পারেন না। সিমির কথা শুনে তিনি রাজনীতি বোঝাবার একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন। মহা উৎসাহে বলতে লাগলেন, বিএনপির সঙ্গে জামাতীরা বাইরে খাতির রাখলেও ভেতরে ভেতরে ওরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি কাউকেই পছন্দ করে না। বিএনপিতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে। ইলেকশনের পর এদের সম্পর্কে জামাতীরা কী বলেছিলো মনে নেই?

সিমি একটু হেসে বললো, আওয়ামী লীগকে ওরা বড় শয়তান আর বিএনপিকে ছোট শয়তান বলেছিলো।

তাহলেই বুঝে দেখ! ছোট হোক আর বড়ই হোক–শয়তান তো! সুযোগ পেলে জামাতীরা বিএনপিওয়ালাদেরও ছাড়বে না। চাটগাঁয় ওদের ছাত্র শিবিরের সঙ্গে ছাত্রদলের মারপিট লেগেই আছে।

তারপরও তো জামাতকে কিছু বলছে না বিএনপি।

বিএনপিতে মুক্তিযোদ্ধা যেমন আছে, জামাতের দালাল রাজাকারও কম নেই। বিএনপির রাজাকাররা তো সব সময় জামাতকে তোয়াজ করে চলবে!

আর ওদের ছেলেরা শিবিরের ছেলেদের কাছে মার খেতেই থাকবে।

ছেলেরা বেশিদিন সহ্য করবে না। ছাত্রদের ভেতর এখনও বিএনপির ছেলেই বেশি।

রাজনীতি সম্পর্কে সিমি যতটুকু উৎসাহী, রিমি তার চেয়ে বেশি নিরুৎসাহী। বিরক্ত হয়ে সিমিকে ও বললো, বড়দের মতো সারাক্ষণ পলিটিক্স নিয়ে বকবক করিস না তো আপু!

তবে কি যত ক্রিমিনাল, গুণ্ডা, বদমাশ আর স্মাগলারদের নিয়ে কথা বলবো? সিমি হেসে বললো, তাহলে তোকে এ-ও বলি–জামাতের দলে খুনী, স্মাগলার আর নানান ধরনের ক্রিমিনাল কম নেই। খুনের কথা বলতে গেলেও অনেক সময় জামাতীদের নাম এসে পড়ে।

এ নিয়ে কথা না বাড়িয়ে রিমি আতিক কাকুর কাছে জানতে চাইলো, আমরা রাঙ্গামাটি কবে যাচ্ছি?

আতিক কাকু হেসে বললেন, তোমাদের অপেক্ষাতেই ছিলাম মা। আজ আসবে শুনে তোমাদের চাচী ঠিক করেছেন কাল যাবে।

সোয়া একটার দিকে আতিক কাকুর নতুন কেনা পাজেরো এসে থামলো তাঁর পাঁচলাইশের বাড়িতে। সিমি রিমি এর আগে কখনও এ বাড়িতে আসেনি। বাড়ি আর তার চারপাশের বাগান দেখে ওরা মুগ্ধ হয়ে গেলো। বিচিত্র সব মরসুমি ফুল লাগানো হয়েছে বাগানে। শুধু চন্দ্রমল্লিকাই ফুটেছে ছয় রঙের। সাইজও টেনিস বলের মতো। কিছু ফুল আছে ওরা নামই জানে না।

গাড়ির শব্দে চাচী, জয় আর ওদের অ্যালসেশিয়ান কুকুর নিকি এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। জয় এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। দেখে মনে হয় হঠাৎ করে লম্বা হয়ে যাওয়ায় ও বেশ লজ্জিত। লাজুক হেসে ওদের অভ্যর্থনা জানালো, কেমন আছো সিমি আপু? রিমি ভালো আছিস।

নিকি আদুরে গলায় ওদের অভ্যর্থনা জানালো–ঘোউ-উ বলে। রিমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

সিমি অবাক হয়ে জয়কে বললো, তুই যে দেখছি আতিক কাকুর চেয়ে লম্বা হয়ে গেছিস।

রিমি হেসে বললো, শুকিয়ে একটা খ্যাংরা কাঠি হয়েছে। চাচী, ওকে বুঝি খেতে টেতে দেন না?

রিমির কথা শুনে চাচীও হাসলেন, সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। খাওয়ার কথাও মনে থাকে না, খেলাধুলার ধারে কাছেও যায় না।

আতিক কাকু বললেন, জয়, সিমি রিমিকে ওপরে ওদের ঘরে নিয়ে যাও।

চাচী বললেন, তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে খেতে এসো। সকালের পর থেকে নিশ্চয় তোমাদের পেটে কিছু পড়েনি!

দোতালায় ওঠার সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে রিমি বললো, দিদু অনেক খাবার দিয়েছিলো। দুপুরে না খেলেও চলবে।

বললেই হলো! চাচী রাগ দেখিয়ে বললেন, তাজা রূপচাদার ফ্রাই আর মুরগির দোপেয়াজি করলাম তবে কাদের জন্য?

রূপচাদার নাম শুনে রিমি দোতালায় ওঠার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ঢাকায় যে বরফ দেয়া রূপচাদাতে বুয়া টমেটো দিয়ে ভাজি করে, টেবিলে ওটা থাকলে রিমির আর কিছু লাগে না। ওর এই পছন্দের কথা মার কাছ থেকে চাচীও শুনেছেন।

পনেরো মিনিটের ভেতর সিমি রিমি মুখ হাত ধুয়ে পরনের কাপড় জামা পাল্টে জয়ের সঙ্গে নিচে এসে দেখে ড্রইং রুমে অচেনা এক তরুণের সঙ্গে আতিক কাকু কথা বলছেন। জয় বললো, আরে সুমন ভাই, তুমি। কথা থামিয়ে সিমি রিমির কানে কানে বললো, বড় মামার ছেলে, চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় অনার্স পড়ছেন। হলে থাকেন।

শুকনো মুখে সুমন বললো, ইউনিভার্সিটিতে ভীষণ গণ্ডগোল লেগেছে। শুনিনি শিবিরের ছেলেরা ছাত্রদলের একটা ছেলেকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে?

জয় সকাল থেকে বাড়ি থেকে বেরোয়নি। বললো, কখন মারলো?

সকালে, দশটার দিকে। ছাত্ররা আগামীকাল শহরে হরতাল ডেকেছে!

আতিক কাকু বললেন, হ্যাঁ, মিছিলও দেখলাম কয়েকটা।

সুমন বললো, এবার ভালো রকমই গণ্ডগোল লাগবে। এতদিন ছাত্রলীগ ছিলো শিবিরের টার্গেট। ছাত্রদলের কর্মী মেরে ওরা নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়েছে।

চাচী খাবার ঘর থেকে ডাকলেন, তোমরা খেতে এসো সবাই।

সুমনের সঙ্গে সিমি রিমির পরিচয় করিয়ে দিলো জয়। খাবার টেবিলে বসে রিমি বললো, আপনাদের ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর জাকারিয়া খান বলে কাউকে চেনেন?

সুমন একটু অবাক হয়ে বললো, বোটানির প্রফেসর তো? নাম শুনেছি। কেন বলতো?

রহস্য হেসে রিমি বললো, কারণ আছে।

সিমি জিজ্ঞেস করলো, কাল কি সারাদিন হরতাল হবে?

না বারোটা পর্যন্ত। জবাব দিলো সুমন।

রিমি চাচীর কাছে জানতে চাইলো কাল তাহলে কি রাঙ্গামাটি যাওয়া হবে না?

চাচী চিন্তিত গলায় বললেন, গণ্ডগোল না হলে আমরা দুপুরে বেরুতে পারি। স্পিড বোট বলা আছে। সন্ধ্যার আগে পৌঁছে যাবো।

আমরা কি স্পিড বোটে যাবো?

আতিক কাকু বললেন, গাড়িতে রাঙ্গামাটি যাবো। সেখান থেকে বোটে করে হিরণছড়ি।

জয় বললো, গত মাসে আমি গিয়েছিলাম। দারুণ সুন্দর জায়গা। আমাদের ওখান থেকে লুসাই পাহাড় শুরু হয়েছে।

চাচী বললেন, ইউনিভার্সিটি যখন বন্ধ হয়ে গেছে সুমন তো আমাদের সঙ্গে যেতে পারিস।

জয় বললো, হ্যাঁ সুমন ভাই, চলো না। খুব মজা হবে।

সুমনের মন ভালো ছিলো না। বললো, বাড়িতে সবাই চিন্তা করবে।

সুমনের বাবা মা কুমিল্লায় গ্রামের বাড়িতে থাকেন। আতিক কাকু বললেন, চিন্তা করবেন কেন! একটা টেলিগ্রাম করে দিলেই তো হয়।

সুমন কথা না বাড়িয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ খেতে লাগালো। সকালে ইউনিভার্সিটিতে শিবিরের ছেলেরা যেভাবে হকি স্টিক, কুড়াল, তলোয়ার আর পিস্তল নিয়ে অন্যদের ধাওয়া করেছে অল্পের জন্য ও প্রাণে বেঁচেছে। রাজনীতির খোঁজ খবর রাখলেও নিজে কোনো দল করে না। নাটক, আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান–এসব নিয়েই মেতে থাকে। প্রথমে ও ভেবেছিলো ওরা বুঝি ছাত্রলীগ আর ছাত্রদলের ছেলেদের ধাওয়া করছে। পরে যখন দেখলো আলাওল হলের একটা নিরীহ ছেলে ওদের হকিস্টিকের বাড়ি খেয়ে পড়ে গেছে তখন ও পালিয়ে এসেছে। শিবিরের দুটো ছেলে স্টেশন পর্যন্ত ওকে ধাওয়াও করেছিলো। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা শহরমুখী ট্রেনটা সময় মতো না ছাড়লে যে কী হতো ভাবতেই ওর গা শিউরে উঠছিলো।

আতিক কাকুদের বাড়িটা বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় অনেক বড়। ভেতরে কামরা বেশি নেই। দোতালায় তিনটা আর নিচে চারটা। দোতালায় বড় একটা বারান্দা আছে, অর্ধেক ছাদে ঢাকা, অর্ধেক খোলা। ওপরের এক কামরায় জয় থাকে। বাকি দুটো মেহমানদের জন্য, যার একটায় এখন থাকছে সিমি রিমি, আরেকটায় সুমন। আতিক কাকু আর চাচীর শোবার ঘর নিচে। খাবার ঘর, বসার ঘর আর লাইব্রেরি ঘরও নিচে। বসার ঘরের পাশে চমৎকার সাজানো লাইব্রেরি ঘরে বইয়ের পরিমাণ দেখে সিমি রিমির চোখ কপালে উঠে গেছে। শুধু জয় নয়। আতিক কাকু নিজেও বইয়ের পোকা।

শেষ বিকেলে বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে রিমি সকালে ট্রেনের ঘটনাটা একটু রঙ চড়িয়ে বলছিলো সুমন আর জয়কে। সিমি ওর শেষ না হওয়া বইটা সামনে মেলে ধরলেও রিমির গল্পের জন্য মন বসাতে পারছিলো না। রিমি উত্তেজিত গলায় চোখ গোল গোল করে বলছিলো ব্যাগটা যেই না উপুড় করলো, ঝুর ঝুর করে পড়তে লাগলো সোনার বিস্কুট পিস্তল আর ড্যাগার। ড্যাগারটার হাতলে আবার দামী পাথর বসানো । দেখে তো প্রফেসর জাকারিয়ার মুখ শুকিয়ে কিসমিস হয়ে গেছে। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে পুলিস অফিসাররা অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেলেন ওকে।

সিমি বললো, পিস্তল আর ড্যাগার কোথায় দেখলি রিমি?

একটু বিরক্ত হয়ে রিমি বললো, ছিলো, তুই দেখিসনি আপু। সারাক্ষণই তো প্যানপ্যানে প্রেমের উপন্যাস পড়লি, তুই দেখবি কখন!

সুমনের সামনে এভাবে বলাতে সিমি লজ্জা পেলো ভারি ফাজিল হয়েছিস তুই। আমি সব দেখেছি।

জয় গভীর আগ্রহ নিয়ে রিমির গল্প শুনছিলো। বললো, তারপর কী হলো বল না রিমি।

আর কী হবে! পুলিস অফিসাররা আমাদের জেরা করলেন। আমরা যা দেখেছি সব বললাম। তারা নোট-ফোট নিলেন। আমাদের বললেন, খুব সাবধানে থাকতে, শত্রুরা হামলা করতে পারে।

তোদের আবার শত্রু কারা? অবাক হয়ে জানতে চাইলো জয়।

কারা আবার, ওই স্মাগলারের দল! ওরা তো জানে আমাদের জন্য ওদের প্রফেসর ধরা পড়েছে। পুলিস অফিসাররা বলেছেন সন্দেজনক কোনো কিছু দেখলেই যেন ওদের জানাই। ওদের নেমকার্ডও দিয়েছেন।

ঠিক তখনই চাচী এসে বললেন, সিমি রিমি, তোমরা একটু নিচে যাও। একজন পুলিস অফিসার এসেছেন তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে।

কথাটা শুনে রিমি অর্থপূর্ণদৃষ্টিতে জয় আর সুমনের দিকে তাকালো বলতে না বলতেই এসে হাজির। চল, আপু, আবার কী ঝামেলা বাধলো–!

সিমি রিমি নিচে বসার ঘরে এসে দেখলো আতিক কাকু চা খেতে খেতে সকালের সেই রাশভারি অফিসারটির সঙ্গে কথা বলছেন। ওদের দেখে অফিসার হেসে বললেন, তোমরা ঠিকঠাক আছে কিনা খোঁজ নিতে এলাম। তোমাদের বাবা এসপি সাহেবকে ফোন করেছিলেন।

আতিক কাকু বললেন, আফজালের সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। দুপুরে খেয়ে উঠেই তো ওকে ফোনে সব বললাম। এত চিন্তার কী আছে!

অফিসার বললেন, দুটো বাচ্চা মেয়ে একা এতটা পথ আসছে–চিন্তা তো হবেই। শুনেছেন তো ট্রেনে কি হয়েছে।

বাচ্চা মেয়ে বলাতে রিমির একটু রাগ হলো। আবার অফিসারকে দেখে কৌতূহলও চেপে রাখতে পারছিলো না। জানতে চাইলো স্মাগলার সবাই কি ধরা পড়েছে।

প্রফেসরের ব্যাগ পাওয়া গেছে, তবে কেউ ধরা পড়েনি। সোনাভর্তি ব্যাগটার কেউ মালিক হতে চাইলো না।

প্রফেসর নিশ্চয় বলতে পারতেন কোত্থেকে ব্যাগটা তুলেছেন? তাঁকে অ্যারেস্ট করেন নি?

অ্যারেস্ট করবো কিভাবে? ব্যাগ তো এরকম বদল হতেই পারে। তিনি এমনই বেখেয়াল মানুষ ব্যাগটা কোন কামরা থেকে এনেছেন সেটাই মনে করতে পারলেন না।

আমার তো মনে হয় স্মাগলারদের দলের সঙ্গে প্রফেসরের যোগাযোগ আছে। ভুলে যাওয়ার ভান করেছেন আমাদের ধোকা দেয়ার জন্য। তাকে ধরে ভালো মতো জেরা করুন।

রিমির কথা বলার ভঙ্গিতে চমৎকৃত হয়ে অফিসার বললেন, তুমি ঠিকই বলেছো মা। প্রফেসরের বাড়িতে গিয়েছিলাম আজ বিকেলে। শুনলাম তিনি তখনও বাড়ি ফেরেন নি।

নিশ্চয় বাড়ির পথ হারিয়ে ফেলেন নি?

হতে পারে মিটিং মিছিল দেখে ঘাবড়ে গিয়ে স্টেশনের কাছাকাছি পরিচিত কারও বাড়িতে রয়ে গেছেন।

আপনারা জেরা করতে পারেন, সে ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন।

হতে পারে। তবে তাকে খুঁজে বের করতে হবে আগে।

আতিক কাকু এতক্ষণ চুপচাপ রিমির কথা শুনছিলেন। বললেন, তুই দেখি পাকা ডিটেকটিভ হয়ে গেছিস।

রিমি লাজুক হাসলো। সিমি বললো, সব সময়ে খুনোখুনি আর ডিটেকটিভ বই পড়ে ও নিজেকে শার্লক হোমস মনে করে।

রিমি ওর কথার জবাব না দিয়ে সামান্য হাসলো শুধু।

.

০৪. বিপদের পদধ্বনি

পরদিন বিকেলে রাঙ্গামাটিতে বনবিভাগের বাংলোর কাঠের বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে আতিক কাকু চিন্তিত গলায় বললেন, ফরহাদ এখনও কেন এলো না বুঝতে পারছি না।

আতিক কাকুর সামনে বসেছিলেন চাচী, পাশে সুমন আর সিমি। জয় আর রিমি বাংলোর প্রশস্ত লন-এ নিকির সঙ্গে ফ্রিসবি ছুঁড়ে খেলছিলো। কয়েক হাত উঁচুতে লাফিয়ে শরীর বাঁকিয়ে নিকি যেভাবে ফ্রিসবির হালকা চাকতিটা দাঁতে চেপে ধরছিলো সেটা রীতিমতো ছবি তুলে রাখার মতো।

ওরা সবাই রাঙ্গামাটি পৌঁছেছে আড়াইটার দিকে। চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়েছিলো বারোটায়। একটানা এলে অবশ্য দেড় ঘণ্টার ভেতরই পৌঁছে যেতো। পথে দুটো আর্মি চেকপোস্টে ওদের থামতে হয়েছে যদিও আতিক কাকুকে দেখে গাড়ি চেক না করেই ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু সামনের অন্য সব গাড়ি চেক করার জন্য ওদের এক জায়গায় দশ মিনিট, আরেক জায়গায় পনের মিনিট দেরি হয়ে গেছে। আতিক কাকু নিয়মিত যাতায়াত করেন, চেকপোস্টের ঝামেলা তার অভ্যাস হয়ে গেছে। সিমি রিমি আর জয় এই ফাঁকে নানা রঙের ক্ষুদে ক্ষুদে পাহাড়ী ল্যানটানা ফুলের গোছা তুলে এনে চাচীকে দিয়েছে। চাচী বলেছেন, এসব পাহাড়ে আবার ফুল কোথায়। আমাদের হিরণছড়ির পাহাড়ে গাছে গাছে কত রকমের আর্কিড ফুটেছে গিয়ে দেখিস।

রাঙ্গামাটিতে স্পিড বোট নিয়ে রাবার বাগানের তরুণ ম্যানেজার ফরহাদের আসার কথা ছিলো। ওর কথা আতিক কাকু সিমিদের বলেছেন। বাপ মা নেই, ছোটবেলা থেকে তাঁর কাছে মানুষ হয়েছে। বোটানিতে মাস্টার্স করেছে, খেলাধুলোতেও নাকি ভারি নাম ছিলো। ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে বেরোনোর পর আতিক কাকু ওকে বলেছেন, অন্য কোথাও চাকরি নেয়ার কি দরকার। আমাদের রবার প্রজেক্টে জয়েন কর। নিজের বাগান মনে করে থাকবি। ফরহাদ এতে খুশিই হয়েছ। আতিক কাকু আর চাচীকে ও বাবা মা বলে ডাকে।

ওর আসতে দেরি দেখে আতিক কাকু ক্রমশ বিরক্ত হচ্ছিলেন। চাচীকে বললেন, আমার তো ধারণা ছিলো ছেলেটার সময় জ্ঞান আছে। ওর এখানে থাকার কথা বারোটায় অথচ এখন বাজে সাড়ে চারটা।

চাচী আরেক কাপ চা বানিয়ে আতিক কাকুকে দিয়ে বললেন, আমার মনে হচ্ছে কোনো ঝামেলায় পড়েছে।

ঝামেলা হলে আমাদের খবর দেবে না?

খবর দিতে হলেও রাঙ্গামাটি আসতে হবে। হিরণছড়ির জঙ্গল থেকে টেলিফোন তো করা যাবে না!

যাই বলো, আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। এখন এলেও তো হিরণছড়ি যেতে পারবো না। পথে রাত হয়ে যাবে।

তাতে অসুবিধে হচ্ছে কোথায়? আমি তো বাংলোর বাবুর্চিকে বলে দিয়েছি রাতের খাবার তৈরি করতে।

সুমন কোনো কথা না বলে মুখ ভার করে বসেছিলো। ওদের চা শেষ হওয়ার পর সিমি বললো, সুমন ভাই, চলুন বাগান থেকে ঘুরে আসি।

চাচী সুমনকে বললেন, এত ভাবছিস কেন? বাড়িতে এতক্ষণে টেলিগ্রাম পৌঁছে গেছে।

সুমন তখনও আগের দিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা সামলে উঠতে পারে নি। ওর ফুপুকে কোনো কথা না বলে সিমির সঙ্গে বাগানে গেলো। ওদের দুজনকে বাগানে ঘুরতে দেখে রিমি জয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো। জয় কিছু না বুঝে অবাক হয়ে একবার বাগানের দিকে, আরেকবার রিমির দিকে তাকালো। তোর মাথায় গোবর! বলে রিমি ওর দিকে ফ্রিসবি ছুঁড়ে দিলো।

ওটা লুফে নিয়ে চট করে মাথায় হাত বুলিয়ে জয় বললো, আমাকে বোকা পেয়েছিস! মাথায় গোবর কোত্থেকে আসবে?

হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়লো রিমি–গোবর ওপরে নয় ভেতরে।

কী যা তা বলছিস? জানিস এবারও আমি ক্লাসে সেকেন্ড হয়েছি। রিমির কথায় বিরক্ত হলো জয়। যদিও কথাটা অন্য কারও সামনে বলে নি, তবু একটা পুঁচকে মেয়ে ওর সম্পর্কে যাচ্ছেতাই মন্তব্য করবে এটা মেনে নেয়া যায় না।

রিমি হাসতে হাসতে বললো তুই ভিসিআর-এ হিন্দি ছবি দেখিস না?

হিন্দি ছবি আমার ভালো লাগে না। আমি বেশি দেখি ওয়েস্টার্ন আর সায়েন্স ফিকশন।

ওসব ছবিতে নায়ক নায়িকা থাকে না বলে তুই বুঝিস নি।

কী বুঝিনি?

ওদিকের বাগানে নায়ক নায়িকা দেখতে পাচ্ছিস না?

সিমি আপু আর সুমন ভাই তো!

বোম্বের ছবির নায়ক নায়িকার মতো লাগছে না?

সিমির পরনে সাদা কালো পলকা ডট-এর সালোয়ার কামিজ, গায়ে কালো কার্ডিগান, চুলগুলো খোলা। সুমনের পরনে নীল জিনস-এর প্যান্ট, গায়ে মোটা উলের নীল-সাদা, লাল বরফি ডিজাইন করা পুলোভার। ওর চেহারাও দেখতে ভালো। রিমি কী বোঝাতে চাইছে এতক্ষণে সেটা বুঝতে পেরে জয়ের মুখ লাল আপেলের মতো হয়ে গেলো। চাপা গলায় বললো, কী বাজে কথা বলছিস! একদিন মাত্র কথা হলো–নায়ক নায়িকা হতে যাবে কেন?

রিমি হাসতে হাসতে বললো, আমার বোনকে তুই চিনিস না। সারাক্ষণ সুনীল, হুমায়ূন আর মিলনের উপন্যাস পড়বে আর নিজেকে নায়িকা ভেবে ফোৎ কোঁৎ করে কাঁদবে। মনে হয় সুমন ভাইর সঙ্গে উপন্যাসের কোনো নায়কের মিল খুঁজে পেয়েছে।

বড়দের মতো শাসনের গলায় জয় বললো, তুই ভারি ফাজিল হয়েছিস রিমি। ওরা শুনলে কী ভাববে?

রিমি কী যেন বলতে যাচ্ছিলো, হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে জয় চেঁচিয়ে উঠলো–আরে ফরহাদ ভাই! তোমার এত দেরি হলো যে?

জয়ের চিৎকার শুনে আতিক কাকু আর চাচী বারান্দা থেকে উঠে এলেন। ফরহাদের চুল এলোমেলো। মুখ শুকনো, পরনের কোট প্যান্টের ভাঁজও ঠিক নেই–দেখে চাচী উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, কী হয়েছে বাবা, কোনো খারাপ কিছু ঘটে নি তো?

শুকনো গলায় ফরহাদ বললো, আমাদের অ্যাকউনটেন্ট রাজেনকে আজ সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। পাহাড়ে অনেক খুঁজেছি। কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। বরকল থানায় রিপোর্ট করে আসতে আসতে দেরি হয়ে গেলো।

কী সর্বনেশে কথা! ভালো করে খুঁজেছো তো। পাহাড়ে কোথাও সাপের কামড় টামড় খেয়ে পড়ে নেই তো?

না মা। আমাদের অস্টেটের কোনো জায়গা বাদ রাখিনি। চারটা সার্চ পার্টি নিয়ে খুঁজেছি।

আতিক কাকু বললেন, ক্যাশ ঠিক আছে? টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে যায় নি তো!

ফরহাদ আহত গলায় বললো, না বাবা। রাজেন ওরকম ছেলেই নয়। ক্যাশ ঠিক আছে।

চাচী আতিক কাকুকে বললেন, ওকে আর এখন জেরা কোরো না। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন কিছু খায়নি। এরপর তিনি ফরহাদের পিঠে হাত দিয়ে ওকে কাছে টেনে নিলেন, তুমি মুখ হাত ধুয়ে আগে একটু দুধ খেয়ে নাও বাবা। আমি বাবুর্চিকে বলছি চট করে দুটো পরোটা আর ডিম ভেজে দিতে!

ফরহাদকে নিয়ে চাচী বাংলোর ভেতর গেলেন। আতিক কাকু চিন্তিত মুখে বারান্দায় পায়চারি করতে লাগলেন। রিমি চাপা উত্তেজিত গলায় জয়কে বললো, আমার মনে হচ্ছে রাজেনকে কেউ কিডন্যাপ করেছে।

রিমির কথা জয়ের মনঃপুত হলো না–গভীর জঙ্গলের ভেতর কে যাবে রাজেনদাকে কিডন্যাপ করতে। বেচারা গরিব মানুষ, তিনকূলে কেউ নেই। তাঁকে কিডন্যাপ করে কার কী লাভ!

রিমি গম্ভীর গলায় বললো, স্পটে গিয়ে আগে তদন্ত করে দেখতে হবে। তারপর বলা যাবে কে কেন কিডন্যাপ করেছে।

একটু পরে ফরহাদ মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় এসে বসলো। রিমি জয়কে বললো, আপুর জন্য একটু ঝামেলা হয়ে গেলো।

কিসের ঝামেলা?

সুমন ভাইর চেয়ে ফরহাদ ভাই বেশি হ্যান্ডসাম। ফিগারটা দারুণ না?

জয় হেসে বললো, তোর যদি ফরহাদ ভাইকে পছন্দ হয় চল আলাপ করিয়ে দিই।

রিমি গম্ভীর হয়ে গেলো ভালো করেই জানিস ছেলেদের সঙ্গে প্যান প্যানে কথা বলা আমি মোটেই পছন্দ করি না।

তুই তোর মতো বলবি! রহস্য করে বললো জয়।

রিমি একটু ভেবে বললো, কেসটা যদি আমি টেক আপ করতে চাই তাহলে অবশ্য ফরহাদ ভাইর সঙ্গে আমাকে কথা বলতে হবে।

কিসের কেস? অবাক হয়ে জানতে চাইলো জয়।

তোদের রাজেনদার কিডন্যাপিং কেস।

স্পটে না গিয়েই ধরে নিয়েছিস এটা কিডন্যাপিং কেস?

একটু অপ্রস্তুত হয়ে রিমি বললো, ঠিক আছে এখন কিডন্যাপিং বলবো না, মিসিং কেস বলবো।

মুখ টিপে হেসে জয় বললো, চল তাহলে ফরহাদ ভাইর সঙ্গে তোর পরিচয় করিয়ে দিই।

ততক্ষণে আতিক কাকু ফরহাদের মুখোমুখি বসে জেরা শুরু করে দিয়েছেন–রাজেনকে কাল শেষবার কে দেখেছে?

জেরার মাঝখানে এসে জয় আর রিমি কিছু না বলে চুপচাপ পাশাপাশি দুটো বেতের চেয়ারে বসে পড়লো। আতিক কাকুর প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ফরহাদ একটু ভাবলো তারপর বললো, কাল রাতে আমার অফিস কামরায় বসে রাজেন হিসেবের খাতা মিলিয়ে দেখছিলো। আমি রাত আটটা পর্যন্ত অফিসে ছিলাম। তারপর আমার ঘরে ফিরে যাই। রাজেন বলছিলো ওর কাজ শেষ হতে আরও ঘণ্টা দুয়েক লাগবে।

তার মানে তুমিই ওকে শেষ দেখেছো?

মনে হয় তাই অন্যরা যখন কিছু বলেনি।

থানার দারোগা কী বললেন?

ওদের তো গত্বাঁধা কথা একটাই। কিছু হলেই বলবেন এটা শান্তি বাহিনীর কাজ।

স্পটে কখন যাবেন?

যাওয়ার কথা তো কিছু বললেন না। জানতে চাইলেন শান্তি বাহিনীর সঙ্গে এর ভেতর কোনো গণ্ডগোল হয়েছে কি না। আমি বলেছি না।

রিমি গম্ভীর গলায় বললো, কাকু, আমার মনে হচ্ছে এটা কিডন্যাপিং কেস।

ওর কথার ধরণ দেখে ফরহাদ অবাক হয়ে তাকালো। আতিক কাকু বললেন, ফরহাদের সঙ্গে তো পরিচয় নেই। এ হচ্ছে আমার বন্ধু আফজালের ছোট মেয়ে রিমি।

ফরহাদ রিমিকে বললো, তোমার বড় বোনেরও তো আসার কথা ছিলো।

এসেছে। রিমি একটু হেসে বললো, সিমি আপু আর সুমন ভাই বাগানে হাওয়া খাচ্ছে।

আতিক কাকু জয়কে বললেন, সিমিদের ডেকে আন। বাইরে হিম পড়ছে।

জয় চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগেই সিমিরা ঘরে এসে ঢুকলো। সিমির সঙ্গে এতক্ষণ সাহিত্য আলোচনা করে সুমনের মন ভালো হয়ে গেছে। সদ্য ক্লাস টেন-এ ওঠা একটা মেয়ে মাণিক বন্দোপাধ্যায় পর্যন্ত পড়ে শেষ করে ফেলেছে জেনে খুবই চমৎকৃত হয়েছে ও ।

আতিক কাকু সিমির সঙ্গে ফরহাদের পরিচয় করিয়ে দিতেই ও হাত তুলে ছোট্ট করে সালাম দিলো। ফরহাদ মৃদু হেসে মাথা নাড়লো। রিমি মনে মনে বললো, আপুটাকে আজ দারুণ সুন্দর লাগছে।

রাজেনের নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ আতিক কাকু সিমিদের বললেন। সব শুনে সিমি বললো, রাঙ্গামাটির এসপি হায়দার সাহেব বাবার পরিচিত। আমরা এখানে আসবো তিনি জানেন। তাঁকে কি এক বার ফোন করবো?

আতিক কাকু এতক্ষণ যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন। বরকল থানার ওসির কথা শুনে তিনি রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। সিমির কথা শুনে আশার আলো দেখতে পেলেন। বললেন, তাহলে তো খুবই ভালো হয় মা। আমি এখনই লাইন ধরে দিচ্ছি।

বাংলোর বসার ঘরে ছোট্ট একটা কাঁচ ঢাকা টেবিলে টেলিফোন রাখা ছিলো। আতিক কাকু ভেবেছিলেন এসপির নম্বরের জন্য অপারেটরকে বলবেন, দেখলেন টেবিলের কাঁচের নিচে রাঙ্গামাটির দরকারী টেলিফোনগুলোর নম্বর লেখা ডিসির নম্বর, তারপর এসপির নম্বর। নম্বর ঘুরিয়ে লাইন লাগিয়ে সিমিকে দিলেন। সিমি টেলিফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ভারি গলা শোনা গেলো, হায়দার আলী বলছি।

স্লামালাইকুম আঙ্কল! আমি সিমি বলছি। আমরা আজ রাঙ্গামাটি এসেছি।

প্রসন্ন গলায় এসপি বললেন, তোমরা ভালো আছো তো মা! কোথায় উঠেছে? কাল তোমার বাবা ফোন করেছিলেন।

আমরা ভালো আছি। ফরেস্টের বাংলোতে উঠেছি। আতিক কাকুরা একটু ঝামেলায় পড়েছেন। হিরণছড়িতে ওঁদের প্ল্যান্টের একজন স্টাফ রাজেন সরকারকে আজ সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। বরকল থানায় খবর দেয়া হয়েছে।

উদ্বিগ্ন গলায় এসপি বললেন, তোমরাও তো হিরণছড়ি যাচ্ছো?

জ্বি আঙ্কল।

তোমার আতিক কাকু আছেন ওখানে?

আছেন। টেলিফোন দেবো?

টেলিফোন দিতে হবে না। আমি এখনই আসছি।

টেলিফোনের রিসিভার রেখে সিমি সবাইকে এসপির আসার সংবাদ জানালো। চাচী হাঁফ ছেড়ে বললেন, এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হলাম। টেনশনে আমার বুক শুকিয়ে গিয়েছিলো।

এসপিকে টেলিফোন করার বাহাদুরিটা সিমি নেয়াতে রিমির একটু খারাপ লেগেছিলো। গম্বীর গলায় বললো, রাজেন সরকারকে খুঁজে বের না করা পর্যন্ত পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না চাচী।

চাচী একটু হেসে বললেন, খোদ এসপি যখন দায়িত্ব নিচ্ছেন তখন ঠিকই খবর পাওয়া যাবে।

বরকল থানার ওসির গা ছাড়া কথাবার্তা ফরহাদের একটুও ভালো লাগেনি। সিমি যেভাবে এসপিকে এর সঙ্গে জড়ালো দেখে ওর খুব ভালো লাগলো। সিমির দিকে তাকালো ও, চোখে ছিলো কৃতজ্ঞতা মাখানো। সিমিও ফরহাদকে একবার দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। ঠিক তখনই বাইরে এসপির জিপ-এর হর্ণ শোনা গেলো।

একটু পরেই হায়দারআলী এসে ঘরে ঢুকলেন। সিমির মনে হলো বাবার চেয়ে বয়স কমই হবে। হাশি-খুশি চেহারা। পরনে পুরোদস্তুর ইউনিফর্ম। সিমি দাঁড়িয়ে বললো, আসুন আঙ্কল।

আতিক কাকু নিজের পরিচয় দিয়ে হাত মেলালেন। অন্য সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। চাচী জিজ্ঞেস করলেন, কি খাবেন, চা না কফি।

হায়দার আলী হেসে বললেন, এমন সৃষ্টিছাড়া জায়গায় কফিও পাওয়া যায় নাকি!

আমি সঙ্গে এনেছি। আপনি বসুন। আমি এক্ষুণি আসছি, বলে চাচী কফি আনতে গেলেন। হায়দার আলী বেতের সোফায় বসে ফরহাদকে বললেন, আপনি তো প্রজেক্ট ম্যানেজার? বলুন তো কী হয়েছে!

আতিক কাকুকে যা বলেছিলো সেই কথাগুলো এসপিকেও বললো ফরহাদ। বরকল থানার ওসির ধারণার কথাও বললো। এসপি হায়দার আলী ওর কথা শুনে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, ওসির ধারণা সত্যিও হতে পারে। শান্তি বাহিনী এ ধরনের কাজ হর হামেশা করেই থাকে!

সিমি বললো, তবে যে খবরের কাগজে দেখি শান্তি বাহিনীর লোকরা এখন আর উৎপাত করছে না। যারা ইন্ডিয়া গিয়েছিল তারা ফিরে এসেছে।

অনেকে সারেন্ডার করেছে। সরকার ওদের জমি-টমিও দিয়েছে। তবে এখনও বেশ কিছু বিদ্রোহী রয়ে গেছে।

রিমি জানতে চইলো, ওরা কেন কিডন্যাপ করবে?

হায়দার আলী মৃদু হেসে বললেন, টাকার জন্য করবে।

তাহলে তো টাকা চেয়ে ওরা চিঠি পাঠাবে?

ওরা কিডন্যাপ করলে দুএক দিনের ভেতরই চিঠি পাবে।

চাচী সবার জন্য কফি আর পাপড়ভাজা নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। মশলা পাপড় দেখে হায়দার আলী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন–এমন চমৎকার জিনিস কোথায় পেলেন ভাবী? গত মাসে চাটগাঁ গিয়ে খুঁজেছিলাম, পাইনি।

চাচী হেসে বললেন, ধন্যবাদ জানাতে হলে সিমির মাকে জানাবেন। পাপড় তিনি পাঠিয়েছেন সিমিদের সঙ্গে।

কফির কাপে চুমুক দিয়ে হায়দার আলী জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা হিরণছড়ি কদিন থাকবেন?

আতিক কাকু ম্লান হেসে বললেন, ইচ্ছে তো ছিলো দশ বারো দিন থাকবো। নতুন বাড়ি বানিয়েছি। ছেলে মেয়েরা পাহাড়ের তাজা বাতাসে হেসে খেলে কটা দিন কাটাবে ভেবেছিলাম। সত্যি সত্যি যদি শান্তি বাহিনীর নজর পড়ে তাহলে তো তাড়াতাড়িই ফিরতে হবে।

হায়দার আলী জানতে চাইলেন, আপনার প্রজেক্টে সিকিউরিটি গার্ড কজন?

জনা দশেক হবে।

ফায়ার আর্মস আছে সবার?

তা আছে।

কাল আমি আপনাদের বাড়ি পাহারা দেয়ার জন্য দুজন পুলিস পাঠাবো। আমাদের এখানে তেমন ফোর্স নেই।

পুলিস না পাঠালেও চলবে। আতিক কাকু বললেন, রাজেনের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। নিরীহ একটা ছেলে।

ওকে খুঁজে বের করার জন্য যা কিছু করা দরকার আমরা করবো। বরকল থানার ওসিকে আমি রাতেই বলে দেবো কাল সকালে সার্চ পার্টি পাঠাবার জন্য।

আপনি যখন দায়িত্ব নিচ্ছেন তখন নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। শান্তি বাহিনী যদি ওকে টাকার জন্য কিডন্যাপ করে আমি টাকা দেবো। আমি চাই না রাজেনের কিছু হোক।

ঠিক আছে, আপনার কথা মনে থাকবে। তবে এভাবে টাকা দেয়া একবার শুরু করলে ওরাও পেয়ে বসবে।

ওদের সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করে কি এ এলাকায় রবারের চাষ করতে পারবো?

হায়দার আলী কাষ্ঠ হাসলেন–রবার চাষের জন্য ওদিকে বুঝি জায়গা পাননি?

আতিক কাকু গম্ভীর গলায় বললেন, গোটা হিল ট্র্যাক্ট-এ রবার চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা ওটা।

হায়দার আলী যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন–আমার এখনও মনে হয় না এটা শান্তি বাহিনীর কাজ। ওই এলাকায় ওদের উৎপাতের কথা কখনও শুনিনি। তবু সাবধানে থাকবেন। যে কোনো রকম দরকার হলে সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এই বলে সিমি রিমির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন–তোমরা ভালো থেকো মামণিরা।

হায়দার আলী চলে যাবার পর চাচীও উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। আতিক কাকু শোবার ঘরে ঢুকলেন। রিমি বললো, আমরা কি বারান্দায় গিয়ে বসতে পারি? সবার সঙ্গে আমার কিছু জরুরী কথা আছে।

সিমি আর জয়ের কাছে রিমির কথা অস্বাভাবিক মনে না হলেও সুমন আর ফরহাদ কিছুটা অবাক হলো। সবাই ওর পেছন পেছন বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারে গিয়ে বসলো।

ঘর থেকে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস ওদের গরম কাপড় ফুটো করে ভেতরে ঢুকে গেলো। আশে পাশে কোনো ঘরবাড়ি নেই। অসংখ্য ঝিঁঝি অবিরাম ডেকে চলেছে। সিমি ওর কার্ডিগানের ওপর একটা শাল জড়িয়েছে। ওটাকে ভালো মতো টেনে টুনে কান পর্যন্ত ঢেকে বললো, কি বলবি জলদি বল।

রিমি গম্ভীর হয়ে বললো, ফরহাদ ভাই বলার পর থেকে রাজেন সরকারের কেসটা নিয়ে আমি ভেবেছি। পুলিস পুলিসের মতো খুঁজুক। আমরা যদি নিজেদের মতো খুঁজি ফরহাদ ভাইর আপত্তি আছে?

ফরহাদ অবাক হয়ে বললো, না, আপত্তির কী আছে!

দরকার হলে আপনার সাহায্য পাবো?

নিশ্চয় পাবে। কী ধরনের সাহায্য চাও?

সেটা এলাকায় গিয়ে বলবো যদি দরকার হয়। সুমন ভাই, তুমি কি আমাদের দলে থাকবে?

রিমির কথা বলার ধরনে সুমন মজা পাচ্ছিলো ওর ছেলেমানুষি দেখে। বললো, থাকবো।

সিমি হেসে বললো, তুই ধরেই নিয়েছিস আমি তোর দলে থাকবো।

সুমন ভাই যখন থাকছে তোর না থাকার কারণ দেখি না। দেবো এক চড় ফাজিল মেয়ে! সিমি উঠে দাঁড়ালো। সিমির চড় মারার আগেই রিমি ছুটে পালালো ওদের ঘরে। ফরহাদ, সুমন আর জয় হো হো করে হেসে উঠলো।