৭. মুসার কণ্ঠ

কিশোর! কিশোর! বহুদূর থেকে যেন ভেসে এল মুসার কণ্ঠ।

চোখ মেলার চেষ্টা করল কিশোর। তীক্ষ্ণ ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল মাথার একপাশে। দুর্বল কণ্ঠে বলার চেষ্টা করল, মুসা, আমি এখানে! স্বর বেরোল না। চোখ মেলল। আস্তাবলের একধারে উজ্জ্বল আলোর নিচে পড়ে আছে সে, মুখের ওপর ঝুঁকে আছে মুসা আর রবিন।

যাক, খুলেছে, মুসা বলল। কি হয়েছিল, কিশোর?

 মাথার পেছনটা ডলতে ডলতে কিশোর বলল, কে জানি বাড়ি মেরেছে।

 কে? জানতে চাইল রবিন।

চোখ কুঁচকাল কিশোর। মাথা ঝাঁকাল। জানি না। কেবল একটা রুপার বাস দেখেছি। হারিকেনের স্টলের সামনে ছিলাম। দরজা খুলে গেল। ভেতরে পড়ে গেলাম।

মুসা বলল, দরজাটা এখন লাগানো। ঘোড়াটাও ভেতরেই রয়েছে।

 যে মেরেছে তাহলে সেই টেনে সরিয়ে এনেছে।

তার মানে খুন করার ইচ্ছে ছিল না, বিড়বিড় করল রবিন। ঠিক আছে, থাক, আমি ডাক্তার কাপলিংকে ডেকে আনি।

না, লাগবে না। আমি ভাল হয়ে যাচ্ছি। মিথ্যে বলেনি কিশোর। চোখে। আলো সয়ে আসতেই মাথার দপদপানিটা কমতে লাগল। কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে বসল। আরও পরিষ্কার হয়ে এল মাথার ভেতরটা।

সত্যি লাগবে না? ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন।

 না। মাথার ব্যথাটা থাকবে কিছুক্ষণ, বুঝতে পারছি। এক-আধটা ট্যাবলেট খেয়ে নিলেই সেরে যাবে।

ডাক্তারে দেখলে অসুবিধে তো কিছু নেই? জোর করতে লাগল রবিন। কিছুতেই কিশোরকে রাজি করাতে না পেরে উঠে গিয়ে আলো নিভিয়ে দিল। তিনজনে বেরিয়ে এল আস্তাবল থেকে। বিকেলের বাতাস একগোছা কোঁকড়া চুল উড়িয়ে এনে ফেলল কিশোরের মুখে। সরানর চেষ্টা করল না সে। বাতাসটা ভাল লাগছে। বলল, কেন মারা হলো আমাকে বুঝতে পারছ তো? কেউ একজন চাইছে না, আমরা তদন্ত করি। হয়ত সূত্রটুত্র রয়ে গেছিল, সরিয়ে ফেলতে এসেছে।

কে? মুসার প্রশ্ন।

সেটা তো আমারও জিজ্ঞাসা। ব্রড জেসন নয়। ক্যানু রেসের জোগাড় করতে লেকে চলে গেছে সে।

কিন্তু গেছে যে দশ মিনিটও হয়নি, রবিন জানাল। আমাদেরকে অপেক্ষা করতে বলে গেছে।

কেন? ভুরু কুঁচকে তাকাল কিশোর।

বাঙ্কহাউসে গিয়েছিল কিছু সেফটি ইকু্যইমেন্ট আনার জন্যে। কেউ পানিতে পড়লে নিরাপত্তার ব্যবস্থা। বাড়তি লাইফ প্রিজারভার আর প্লেয়ারও নিয়েছে। সাথে গিয়েছিল বেনি আর ওর বাবা। ওরা অবশ্য এখন চলে গেছে।

চমৎকার, দাঁড়িয়ে গেছে কিশোর। লুকের খবর কি?

মাথা নাড়ল মুসা। কেরোলিনের আন্টির সঙ্গে বসে তাড়াহুড়ো করে এক কাপ কফি খেয়ে বেরিয়ে গেল, জরুরী কাজ নাকি আছে। এক প্লেট পাই সাধাসাধি। করলাম, নিল না। তাকালই না বলতে গেলে।

আরও চমৎকার। ওরকম করে দেখতে গেলে সবাইকেই সন্দেহ করতে হবে। কাউকে বাদ দেয়া চলবে না। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর। তারমানে অনেক বেশি জটিল করে তুলছে রহস্যটা সবাই মিলে।

কিশোর, হেসে বলল রবিন, গোয়েন্দাগিরি যে কঠিন কাজ তোমার চেয়ে বেশি তো কেউ আর জানে না। আর যত জটিল হয় রহস্য ততই মজা, তুমিই বল?

.

পরদিন সকাল সকাল বিছানা ছাড়ল কিশোর। গোসল সেরে নিয়ে এসে নীল জিনস পরল, গায়ে চড়াল টি-শার্ট, পায়ে রানিং শু। নাস্তা করতে চলেছে, এই সময় দেখা হয়ে গেল লিলির সঙ্গে।

আমাকে ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছেন ডাক্তার, লিলি জানাল। আর বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে না।

ভাল খবর।

আবার প্র্যাকটিস শুরু করতে পারব, উজ্জ্বল হাসিতে বেরিয়ে পড়ল ওর ঝকঝকে সাদা দাঁত।

একসাথে নিচে নামল দুজনে। সামনের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল লিলি, বলল, যাবে নাকি? শ্রমিকদের কাজ দেখবে।

যাব।

গোলাঘরের কাছে এল ওরা। গরুঘোড়াগুলোকে ঠিকমত খাওয়ানো হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করে জেনে নিল লিলি। আরেক দিকে চলল। চোখেমুখে রোদ লাগছে, আপনাআপনি কুঁচকে গেল কিশোরের চোখ। ইতিমধ্যেই গরম হয়ে। উঠেছে সকালটা। ঘোড়ার ওষুধপত্র কোথায় রাখেন? জিজ্ঞেস করল সে।

বেশির ভাগই ট্যাক রুমে, লিলি বলল। এককোণে একটা আলমারি আছে।

কি কি রাখেন?

সব ধরনের ওষুধ, জন্তু জানোয়ারের জন্যে যা যা লাগে–ভিটামিন, অয়েন্টমেন্ট, লিনিমেন্ট, ব্যাণ্ডেজ, আরও অনেক জিনিস। জখম হলে যা দরকার, সবই আছে। সবুজ চোখের তারা স্থির হল কিশোরের মুখে। কেন বলো তো?

ভাবছি, হারিকেনের এই যে মেজাজ বদলে গেল, ওষুধের জন্যে নয় তো? ড্রাগ?

হেসে উঠল লিলি। আমার তা মনে হয় না। একাজ করতে যাবে কেন?

যাবে আপনি যাতে রোডিও খেলায় যোগ না দিতে পারেন।

আমার তা মনে হয় না। এতবড় পাষণ্ড হবে না কেউ, আমাকে ঠেকানোর জন্যে ঘোড়ার সর্বনাশ করবে।

মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। আর সেই লোকই হয়তো চুরি করে নিয়ে গেছে ইউনিকর্নকে।

চুরি? কে বলল? সে তো পালিয়েছে। ব্রড নিজের চোখে দেখেছে।

না দেখেনি, শব্দ শুনেছে। আমি যখন পিছু নিলাম, বনের মধ্যে ওর পিঠে মানুষ দেখলাম বলে মনে হলো।

অন্ধকার ছিল। তোমার ভুলও হতে পারে।

সেজন্যেই তো জোর দিয়ে বলতে পারছি না কিছু।

মাথা ঝাঁকি দিল লিলি। ছড়িয়ে পড়ল লাল চুল। রোদে ঝিকমিক করে উঠল। এই কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না, কিশোর। ইউনিকের পিঠে কোন। মানুষ চড়তে পারে না। চল, নাস্তাটা সেরে নিই। তারপর পাহাড়ে যাব। কোন জায়গায় হারিয়েছে ঘোড়াটা, দেখব।

.

শৈলশিরার নিচে দিয়ে বয়ে যাওয়া, নদীটাকে এই দিনের বেলাতেও রুপালিই লাগছে। খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে লিলি আর তিন গোয়েন্দা।

তুমি বলছ, গোল গোল হয়ে গেছে রবিনের চোখ, ঘোড়াটা এখান থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়েছে? জখম হয়নি?

তা হতে পারে, জবাবটা দিল লিলি। স্টেটসন হ্যাট মাথায় দিয়েছে। কানার নিচে কাছাকাছি হল ভুরুজোড়া। তবে ওর আন্দাজ খুব ভাল। হুঁশিয়ার হয়ে পা ফেলে। আজ পর্যন্ত ওকে উল্টোপাল্টা পা ফেলতে দেখিনি। কিন্তু গেল কোথায়? মাথা ঠাণ্ডা হওয়ার পর তো ফিরে আসার কথা। যত বদমেজাজীই হোক, বাড়ি ছেড়ে থাকার কথা নয়।

ফিরত, যদি চুরি না হত, কিশোর বলল।

কিন্তু কেন চুরি করবে?

আপনি না বললেন, ও আপনার র‍্যাঞ্চের সব চেয়ে দামি সম্পদ?

 লিলির চোখের পাতা সরু হয়ে এল। তাতে কি? নাহয় নিয়ে যাওয়ার কুমতলব হলই কারও, কিন্তু নিয়ে গিয়ে তো সামলাতে পারবে না। ডাবল সির হাতে গোনা কয়েকজন মানাতে পারে ওকে। তাছাড়া ইউনিকের মত একটা জানোয়ারকে চুরি করে নিয়ে বেশিদিন লুকিয়ে রাখাও অসম্ভব।

নতুন কিছু দেখার নেই। লাঞ্চের জন্যে ফিরল ওরা।

দুপুরের খাওয়ার পর ঠিক করল কিশোর, কুপারের সাথে দেখা করতে যাবে। লুকের নিষেধ মানবে না। তাকে জিজ্ঞেস করবে, সত্যিই ঘোড়াটাকে দেখছে। কিনা। দুই সহকারীকে জিজ্ঞেস করল, যেতে চাও?

মুসা বলল, পরে গেলে হয় না? আমি আর রবিন ভাবছিলাম লেকে গিয়ে সাঁতার কাটব।

প্রস্তাবটা কিশোরের কাছেও লোভনীয় মনে হলো। এই গরমে লেকের ঠাণ্ডা পানিতে বেশ আরাম লাগবে। কিন্তু কাজটা আগে করা দরকার। একাই কুপারের র‍্যাঞ্চে চলল।

চত্বর দিয়ে যাওয়ার সময় দেখল গটমট করে দুজন মেহমান এগিয়ে যাচ্ছে একটা কোরালের দিকে, যেখানে একটা ঘোড়া নিয়ে প্র্যাকটিস করছে লিলি। লাল হয়ে গেছে ওদের মুখ। হাত নাড়ল রাগত ভঙ্গিতে।

হলটা কি, ভাবল কিশোর। জানার জন্যে এগোল কোরালের দিকে।

বেড়ার কাছে এসে দাঁড়াল লিলি, সে রয়েছে ভেতরে, বাইরের দিকে দাঁড়াল মেহমানরা। একজন বলল, তুমি কি করবে না করবে জানি না। তবে এই চুরির কথা পুলিশকে জানাবই আমরা।

চুরি?

হ্যাঁ, বলল আরেক মেহমান, সে মহিলা, আমার পার্স চুরি হয়েছে, আমার স্বামীর মানিব্যাগ চুরি হয়েছে।

সত্যি?

তো কি মিথ্যে বলছি নাকি! জ্বলে উঠল মহিলার চোখ। আজ সকালেও আলমারির ড্রয়ারে দেখেছি। নিশ্চয় তোমার কোন কাউবয় ঢুকে চুরি করে নিয়ে গেছে।

ছাই হয়ে গেল লিলির মুখ। মিসেস ব্যানার, একটা কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। এখানকার সবাই খুব ভাল মানুষ।

তাহলে কে নিল? প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মহিলা।

দরজা খোলার শব্দে ফিরে তাকিয়ে কিশোর দেখল, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আসছেন কেরোলিন। মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। এগিয়ে এসে হাতের জিনিসগুলো দেখিয়ে বললেন, এগুলো খুঁজছেন তো আপনারা?

হ্যাঁ, কেরোলিনের বাড়ান হাত থেকে ছোঁ মেরে পার্স আর মানিব্যাগটা নিয়ে নিল মিসেস ব্যানার। কোথায় পেলেন?

দ্বিধা করলেন কেরোলিন। অস্বস্তিভরে তাকালেন প্রথমে কিশোরের দিকে, তারপর লিলির দিকে। কিশোরের ঘরটা পরিষ্কার করছিলাম। বিছানায় রাখা ছিল ওর ব্যাগটা। সরাতে যেতেই কাত হয়ে গেল, আর ওটার ভেতর থেকে পড়ল এদুটো।

বলেন কি? চমকে গেল কিশোর।

 শয়তানটা তাহলে তুমিই! কিশোরের দিকে তাকিয়ে চোখে আগুন জ্বলে উঠল মিসেস ব্যানারের। এসব করে পার পাবে ভেবেছ? পুলিশকে অবশ্যই জানাব, যাতে তোমাকে ধরে নিয়ে যায়।