১১. মিনমিন করে বলল কিশোর

এই, এসো তোমরা, মিনমিন করে বলল কিশোর, মিস্টার জোনসের মাথা গরম করে দিয়ে লাভ নেই। পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলল সে।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে তার এই আচমকা পরিবর্তনে অবাক হয়ে গেল রবিন আর মুসা। কি করতে চাইছে? ভাল অভিনেতা কিশোর পাশা। ছোট বেলায় মোটোরামের অভিনয় করে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল। অভিনয় যে করছে বোঝাই মুশকিল, মনে হয় এক্কেবারে স্বাভাবিক। তবু, যেহেতু চেনে ওকে, দুই সহকারীর মনে হলো, এই মুহূর্তে অভিনয়ই করছে সে।

হাঁট! শীতল কঠিন গলায় আদেশ দিল সোনালিচুল লোকটা।

হাঁটতে লাগল রবিন আর মুসা। পেছনে রাইফেল তাক করে ধরে এগোল জোনস।

মিস্টার মিলফোর্ডের কাছেই নিয়ে যাচ্ছেন তো আমাদের? ফিরে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করল কিশোর।

চুপ! ধমক দিয়ে বলল জোনস, কোথায় নিয়ে যাব সেটা আমার ব্যাপার। একদম চুপ!।

আপনিই তাহলে আমার বাবাকে কিডন্যাপ করেছেন? বিশ্বাস করতে পারছে না রবিন। কেন করলেন?

তোমাদের মতই ছোঁক ছোঁক করছিল, বিশেষ করে তোমার ওই বন্ধুটির মত, কিশোরকে দেখিয়ে বলল জোনস। সেজন্যেই আটকাতে হল। লাভ হয়নি কিছুই। একটা কথাও বের করতে পারিনি মুখ থেকে।

নীরবে পশ্চিমমুখো হেঁটে চলল ওরা। পাহাড়ে চড়ার জন্যে একটা সুবিধেমত জায়গা খুঁজছে। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে কিশোর, জিভ বের করে ফেলবে, যেন কুকুরের মত। এত জোরে হাঁটাবেন না আমাদেরকে, প্লীজ! অনুনয় করে বলল।

হাঁট! আবার ধমক লাগাল জোনস। আস্তে যাওয়া চলবে না!

হাউফ! করে মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ল কিশোর। শেওলায় ঢাকা একটা পাথরে পা ফেলল ইচ্ছে করেই, সড়াৎ করে পিছলে গেল পা, চিত হয়ে পড়ে গেল রবিনের গায়ে।

টলে উঠল রবিন। তাল সামলাল কোনমতে।

চোখ মিটমিট করল মুসা। পরক্ষণেই বুঝে ফেলল কি চালাকি করেছে কিশোর আর রবিন।

ভ্রূকুটি করল জোনস। দ্বিধায় পড়ে গেছে।

একটা মুহূর্তের দ্বিধা। সেটাই কাজে লাগাল মুসা। পাই করে ঘুরল। কারাতের প্রচুর প্র্যাকটিস চিতার মত ক্ষিপ্র করে তুলেছে ওকে। চোখের পলকে সোজা হয়ে গেল ভাজ করা কনুই, থাবা লাগল রাইফেলে। কারাতের হাইশু-ইউঁকি। জোর। থাবা খেয়ে একপাশে সরে গেল ভারি রাইফেলের নল।

ভাগ! ভাগ! চিৎকার করে বলল রবিন আর কিশোরকে।

পলকে যেন পায়ে হরিণের গতি চলে এল দুই গোয়েন্দার। তৃণভূমির ওপর দিয়ে ছুটল পশ্চিমের বনের দিকে।

এক লাফে সামনে চলে এল মুসা। শক্ত ঘুসি লাগাল জোনসের পুরু বুকে, কারাতের ওই-জুকি।

 টলে উঠল যেন পাহাড়। পিছিয়ে গেল জোনস। ভারসাম্য হারাল। হাত থেকে রাইফেল ছাড়ল না।

বনের দিকে দৌড় দিল মুসা।

শট শট করে গাছে বিধল একঝাঁক বুলেট। বাতাসে উড়তে লাগল পাইনের নীড়ল, বাকল আর ধুলো। ভয়ে চিৎকার করে, আকাশে উড়ল পাখি। ঝাঁপ দিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা। বুকে হিঁচড়ে চলে এল ঝোপের ভেতর।

ডক! হিলারি! চেঁচিয়ে ডাকল জোনস। কোথায় গেলে? আলসের দল! জুলদি বেরোও! ধর ব্যাটাদের! পালানর চেষ্টা করছে!

মাথা তুলল মুসা। তৃণভূমিতে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা জোনসকে দেখতে পাচ্ছে। লোকটার হাতে বেরিয়ে এসেছে একটা ওয়াকি-টকি। সেটাতেই কথা বলে আদেশ দিচ্ছে।

ডক সেই দুজনের একজন, রবিন বলল ফিসফিসিয়ে, যারা বনের ভেতর তাড়া করেছিল আমাদের। গলা খুবই কর্কশ।

তাহলে হিলারি নিশ্চয় অন্য লোকটা, কিশার অনুমান করল। ওরা আমাদের খেদিয়ে নিয়ে গিয়ে জোনসের মুখে ফেলেছিল। তখনই বোঝা উচিত ছিল আমার, এত সহজে পিছ ছেড়ে দিল দেখেই। জোনসের সিগারেট আর প্যাকিং বাক্সের গায়ে লেখা নাম বিশ্লেষণ করে কি বের করেছে, দুই সহকারীকে জানাল সে।

অসম্ভব, মানতে পারল না রবিন। পিকআপটাকে স্যাবোটাজ সে করেনি। ছিলই না গাঁয়ে, কি করে করবে?

আমার বিশ্বাস, মুসা বলল, শয়তানীটা মোড়লের।

আপাতত ওসব চিন্তা বাদ, কিশোর বলল, পরে ভাবা যাবে। চলো, চলো।

 বাবার কি হবে? রবিন জিজ্ঞেস করল।

একটা ব্যাপারে আমরা এখন শিওর, কিশোর বলল, জোনসের কথা থেকে। আঙ্কেল জীবিতই আছেন। আগে আমাদের এই বিপদ থেকে মুক্তি পেতে হবে। তারপর খুঁজে বের করব তাকে।

তুণভূমির দিকে তাকাল তিনজনেই। বনের দিকে তাকিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে জোনস।

গুলি বাঁচাচ্ছে ব্যাটা, কিশোর বলল। আমাদের না দেখে শিওর না হয়ে গুলি করবে না।

আস্তে করে উঠে দাঁড়াল তিনজনে। মাথা নিচু করে পা টিপে টিপে এগোল বনের দিকে।

ওই যে! ওই তো! ডকের কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল।

 ছয় কদম দৌড়ে গিয়ে যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল গোয়েন্দারা।

তাকিয়ে রয়েছে আরেকটা এম-১৬ রাইফেলের দিকে।

এবার রাইফেল তাক করেছে কালো চুল, রোদে পোড়া চামড়া, নীল চোখওয়ালা একটা লোক। নলের মুখ ঘোরাচ্ছে একজনের ওপর থেকে আরেকজনের ওপর। ধীরে ধীরে হাসি ফুটল ঠোঁটে, ঠোঁটেই রইল, মুখে ছড়াল না হাসিটা।

ধরেছি, বলল লোকটা। ওর কণ্ঠস্বরেই বুঝতে পারল গোয়েন্দারা, হিলারি।

বাঁ দিক থেকে বেরিয়ে এল আরেকজন। তার হাতেও একটা এম-১৬।

পালিয়ে বাঁচতে আর পারলে না, তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বলল ডক। ছোটখাট শরীর, খাটো করে ছাঁটা বাদামী চুল, ঘন ভুরু। মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি তেমন নেই ছেলেগুলোর। বেপরোয়া, এই যা।

পেছন থেকে শোনা গেল জোনসের কথা, যাও, নিয়ে চল ওদের। অনেক পথ যেতে হবে।

কি বলল শুনলে তো? গোয়েন্দাদেরকে বলল ডক। হট।

শ্রাগ করল মুসা। চুপ করে রইল রবিন আর কিশোর। আদেশ পালন না করে আর উপায় নেই।

কি হলো! ধমকে উঠল ডক, দাঁড়িয়ে আছ কেন?

বলেই ভুলটা করল। মুসার পিঠে চেপে ধরল রাইফেলের নল।

গোড়ালিতে ভর দিয়ে পাক খেয়ে ঘুরে গেল মুসা। একপাশ থেকে থাবা দিয়ে ধরে ফেলল নল। ওভাবে ধরেই জোরে এক ঠেলা দিয়ে বাঁটের গুতো মারল ডকের। পেটে। হুক করে উঠল লোকটা। হা হয়ে গেছে মুখ। হাসফাস করছে বাতাসের জন্যে।

দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। পড়তে আরম্ভ করল।

রবিনও চুপ করে রইল না। ঝট করে পা সোজা করে অনেক উঁচুতে তুলে হফেলল। লাথি চালাল, কারাতের ইওকো-গেরিকিয়াজ হিলারির চোয়ালে লাগল লাথিটা। টলে উঠে পিছিয়ে গেল হিলারি। এক লাফে আগে বেড়েই আবার একই কায়দায় লাথি মারল রবিন। কাটা কলাগাছের মত ঢলে পড়ে গেল হিলারি।

 এক দৌড়ে পাইনের জটলায় ঢুকে পড়ল কিশোর। বনের প্রান্তে থাকা জোনসের ওপর তার জুডোর প্র্যাকটিসটা করার ইচ্ছে। তবে শেষ মুহূর্তে পরিকল্পনা বাতিল করে দিল সে। জুডো কারাত কোনটারই দরকার পড়ল না। গাছের আড়াল থেকে শুধু একটা পা হঠাৎ বাড়িয়ে দিল সামনে। কিছুই আন্দাজ করতে পারেনি জোনস, সতর্ক ছিল না, কিশোরের পায়ে হোঁচট খেল।

ততক্ষণে মুসাও পৌঁছে গেছে সেখানে। কনুই দিয়ে অতোশি হিজি-আতি মারল জোনসের ঘাড়ে। হাত-পা ছড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল মাটিতে বিশালদেহী। লোকটা।

মুহূর্ত দেরি করল না তিন গোয়েন্দা। এক ছুটে ঢুকে পড়ল জঙ্গলে।

পেছনে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল জোনস, ধর, ধর ওদেরকে! পালিয়ে গেল তো!

থামল না ছেলেরা। গাছের পাশ কাটিয়ে, পাথর ডিঙিয়ে ছুটে চলেছে দক্ষিণে। পেছনে শোনা যাচ্ছে ভারি জুতো পায়ে ছুটে আসার শব্দ।

ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ওরা। হতাশা বাড়ছে, যখন দেখছে জুতোর শব্দ থামছে না, কাছেই আসছে আরও।

পশ্চিমে ঘুরে একটা কাঁচা রাস্তা ধরে ছুটল মুসা। রাস্তাটা চিনতে পারল রবিন। ঝর্না থেকে পানি ভরতে এসেছিল সেদিন এই পথেই।

একটা বুদ্ধি বের করতে হবে,হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর। এভাবে চলে পারব না!

বাবাকেও বাঁচাতে হবে! বলল রবিন।

পেছনে উত্তেজিত চিৎকার শোনা গেল।

 রাস্তাটা পেয়ে গেছে ব্যাটারা, মুসা বলল।

 রাস্তা ধরে ছুটলে ঠিক এসে আমাদেরকে ধরে ফেলবে, বলল রবিন।

পিকাপের কথা ভুলে যেতে হবে আমাদের, ছুটতে ছুটতেই বলল কিশোর। মুসা, জোনস যে রাস্তাটার কথা বলেছে সেটা খুঁজে বের করতে পারবে?

কাঠ নেয়ার রাস্তা, বিড়বিড় করল মুসা, হাইওয়েতে গিয়ে যেটা পড়েছে। মালটি বলেছিল অবশ্য ওটার কথা। ইনডিয়ানদের রাস্তাটা বোধহয় ওটাতেই পড়েছে।

হ্যাঁ, মাথা দোলাল কিশোর। বনের ভেতর কিভাবে বাঁচতে হয়, জানা আছে তোমার। ইস, কেন যে তোমার মত ট্রেনিংটা নিলাম না, কাজে লাগত! বাঁচলে ফিরে গিয়ে নিশ্চয় নেব এবার…

কি করতে হবে সেকথা বলো? বাধা দিয়ে বলল মুসা।

 তুমি বেশি দৌড়াতে পার। তোমার গায়ে শক্তি বেশি। বনে বেঁচে থাকার। ট্রেনিং আছে। ডায়মণ্ড লেকে গিয়ে কেউ যদি পৌঁছতে পারে, সেটা তুমি।

হয়তো পারব। কি বলতে চাও?

আমি বুঝেছি, রবিন বলল, জোনস আমাদের পিছে লেগে থাকুক, এই তো চাও?

হ্যাঁ,সায় জানাল কিশোর।

দ্রুত একবার হাত মিলিয়ে নিয়ে, গুড বাই আর সি ইউ এগেন বলে পথ থেকে সরে গেল মুসা। হারিয়ে গেল গাছপালার আড়ালে। জোনসের লোকেরা কিশোর আর রবিনকে তাড়া করে নিয়ে যাওয়ার পর আবার এসে পথে উঠবে সে, চলতে থাকবে ডায়মণ্ড লেকের উদ্দেশে।

ছুটে চলেছে কিশোর আর রবিন।

লুকিয়ে পড়ার জায়গা খোঁজা দরকার, কিশোর বলল।

উপত্যকায় চলে গেলে কেমন হয়? বিপদে পড়েছি আমরা, ইচ্ছে করে তো যাচ্ছি না। আশা করি ইনডিয়ানদের মরা দাদারা কিছু মনে করবে না।

ভাল বলেছ! ভীষণ হাঁপাচ্ছে কিশোর।

পথের একটা চওড়া জায়গায় এসে থামল রবিন। এবার আর জোনসও আসছে কিনা না দেখে যাচ্ছি না। আর গিয়ে ওর মুখে পড়তে রাজি নই।

হাসল কিশোর। তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, রবিন, আমি আর পারছি না! বসতে আমাকে হবেই!

তোমার তো সব সময়ই খালি বসা লাগে! চিৎকার করেই জবাব দিল রবিন। তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না! এরকম সময়েও…।

একটা ভুরু উঁচু হয়ে গেল কিশোরের। ভাবল, আসলেই বলছে না তো? অভিনয় বলে মনেই হলো না। বলল, পার আর না-ই পার, আমি বসছি!

চুপ হয়ে গেল দুজনে। কান পেতে রইল। তিনজনই আসছে, সন্দেহ নেই। দুপদাপ দুপদাপ শোনা যাচ্ছে ওদের পায়ের শব্দ।

সর্বনাশ হয়ে গেছে! বলে উঠল রবিন।

কী?

বোতলটা উঁচু করে ধরল রবিন।

ও, দেয়া হয়নি! না, মাথা নাড়ল রবিন। পানির অভাবেই শেষে মরে কিনা কে জানে!