৩. পেছনের দরজাটা খুলে

একটানে পেছনের দরজাটা খুলেই লাফিয়ে বাইরে নামল কিশোর। ছুটল চতুর ধরে, ভয় খাওয়া ঘোড়াটার দিকে। ঘ্যাচ করে ব্রেক কষল গাড়িটা।

ঘোড়াটার কাছে চলে এল কিশোর। জিন আঁকড়ে ধরতে গেল। মাথা ঝাড়া দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল ওটা, চাবুকের মত শপাং করে এসে ওর মুখে বাড়ি লাগতে যাচ্ছিল ঘোড়ার মুখের লাগাম। সময়মত হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল ওটা। লুক বোলান। ধমকে উঠল কিশোরের উদ্দেশ্যে, সরো! সরে যাও!

তীক্ষ্ণ ডাক ছাড়ল হারিকেন। লাফিয়ে উঠল পিছনের পায়ে ভর দিয়ে। চোখে বন্য দৃষ্টি।

দৌড়ে আসছে ব্রড জেসন। লিলি কোথায়, লিলি? যেন ঘোড়াটাকেই জিজ্ঞেস করছে সে। কাছে এসে হারিকেনকে সামলাতে লুককে সাহায্য করল সে।

কে জানে, কোথায়! লুক বলল।

আরেকবার সাদা গাড়িটার দিকে তাকাল কিশোর। দুজন লোক বেরিয়ে এল। একজনকে চিনতে পারল, খাট ফিলিপ নিরেক। লম্বা অন্য লোকটাকে চিনল না।

দৌড়ে আসছেন কেরোলিন। এই, লিলিকে খুঁজতে যাও না কেউ! কিশোরের কাছে এসে দাঁড়ালেন। এমন ভঙ্গিতে তাকালেন, যেন চাইছেন কিশোরই যাক। অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। এরকম করে তো কখনও বাইরে থাকে না মেয়েটা! র‍্যাঞ্চে ইদানীং বড়ই গোলমাল চলছে। কিশোর, রবিনের আম্মা তোমাদের কথা সবই বলেছে আমাকে। সে জন্যেই তোমাদেরকে পাঠাতে বলে দিয়েছিলাম ওকে। প্লীজ, লিলিকে খুঁজে আন!

চেষ্টা করব। হারিকেনকে নিয়ে কোথায় গিয়েছিল লিলি, আন্দাজ করতে পারেন?

মাথা নাড়লেন কেরোলিন। জোরে জোরে হাত ডলতে লাগলেন। জানলে তো ভালই হত। অনেক জায়গা আছে এখানে যাওয়ার, ডজনখানেক পথ আছে। কোনটা দিয়ে কোথায় গেছে কে বলবে?

বেশ, তাহলে এক কাজ করি, ঝড়ের গতিতে চলছে কিশোরের মগজ। একটার পর একটা উপায় বের করার চেষ্টা করছে। টর্চ আর ঘোড়া নিয়ে কয়েকজন চলে যাই আমরা। বনের ভেতরে খুঁজব। কয়েকজন যাক গাড়ি নিয়ে। মাঠ আর অন্যান্য খোলা জায়গাগুলোতে খুঁজবে। কোথাও হয়তো পিঠ থেকে ফেলে দিয়ে এসেছে তাকে ঘোড়াটা। হাত-পা ভেঙে পড়ে আছে, আসতে পারছে না।

ওহ, গড! প্রায় কেঁদে ফেললেন কেরোলিন।

আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এসে কিশোরের শেষ কথাগুলো শুনেছে লুক। বারান্দায় জমায়েত হওয়া মেহমানদের দিকে তাকাল একবার। কিশোরকে বলল, তোমরা মেহমান। এসব তোমাদের কাজ নয়। আমরাই যাচ্ছি খুঁজতে। ফিলিপ নিরেকের ওপর চোখ পড়তে উদ্বিগ্ন হল সে।

আমি সাহায্য করতে চাই, কিশোর বলল।

দেখো, শোনো আমার কথা! কর্কশ হয়ে উঠল লুকের কণ্ঠ। এদিককার পাহাড়গুলো ভীষণ খারাপ। তোমরা আমাদের দায়িত্বে রয়েছ। কিছু একটা হয়ে গেলে জবাব আমাদেরকেই দিতে হবে। এই রিস্ক নিতে পারি না। আমরা এখানে অনেক লোক, আমরাই পারব। মেহমানদের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলল, আপনারা সব ভেতরে যান। দাবা আছে, তাস আছে, খেলুনগে। ব্রড ভাল গিটার বাজাতে পারে। বাজিয়ে শোনাবে আপনাদের।

মেহমানদের যাবার ইচ্ছে নেই, তবু এক এক করে ঢুকে গেল ভেতরে।

কিশোর দাঁড়িয়েই রইল। আমি সত্যিই সাহায্য করতে পারব।

এগিয়ে আসছে নিরেক। তার সঙ্গের লম্বা লোকটার চেহারাটা রুক্ষ। মাথায় রুপালি চুল।

আরেকটু হলেই গাড়ির ওপরই এসে পড়েছিল ঘোড়াটা! এখনও গলা কাঁপছে নিরেকের। লুকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, লিলি কোথায়?

নেই।

ঝুলে পড়ল ব্যাংকারের চোয়াল। নেই মানে? আমি আর পাইক তো ওর সঙ্গেই দেখা করতে এলাম…

লম্বা, কঠিন চেহারার লোকটার দিকে আবার তাকাল কিশোর। এই তাহলে হারনি পাইক। লিলির সম্পত্তি যে কেড়ে নিতে চায়।

আজ বিকেলেও ফোন করেছি, নিরেক বলল। ওকে মনে করিয়ে দেয়ার জন্যে।

বারান্দার রেলিঙে হেলান দিল লুক। অন্য সময় আসতে হবে তাহলে। খাট লোকটার ওপর থেকে লম্বাজনের ওপর সরে গেল তার নজর। লিলি নিখোঁজ।

নিখোঁজ! রেগে গেল নিরেক। আমাকে বিশ্বাস করতে বল একথা?

করলে করবেন না করলে নেই, আপনার ইচ্ছে।

আমাদের ফাঁকি দেয়ার জন্যেই লুকিয়েছে।

 কেন করবে একাজ? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

কিশোরের কথায় কানই দিল না নিরেক, তাকিয়ে রয়েছে লুকের দিকে। র‍্যাঞ্চটা যে শেষ, একথা আমার মতই তুমিও জানো৷ মিস্টার পাইক একটা লোভনীয় প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।

পরেও লোভটা দেখাতে পারবেন তিনি, ভোঁতা গলায় বলল লুক। মেয়েটার সঙ্গে গণ্ডগোল করবেন না আপনারা, বলে দিলাম। ভাল হবে না।

রাগ ঝিলিক দিল পাইকের চোখে, দরজা দিয়ে আসা আলোয় সেটা দেখতে পেল কিশোর। ভ্রূকুটি করল। অস্বস্তিভরে আঙুল বোলাল তার ওয়েস্টার্ন টাইতে। বলল, চল, ফিলিপ। এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই।

এই তো, ভাল কথা, লুক বলল। নিরেক কিছু বলার আগেই কিশোরের দিকে ফিরে বলল, যাও, ঘরে যাও। তোমার বন্ধুদের সঙ্গে খেলগে বসে। আমি লিলিকে খুঁজতে যাচ্ছি। লম্বা লম্বা পায়ে বাঙ্কহাউসের দিকে রওনা হয়ে গেল সে।

বনের ভেতর কোথায় কোন বিপদে পড়ে আছে লিলি, কে জানে! ঘরে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না কিশোরের। সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠেই কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকাল।

গাড়িতে উঠছে নিরেক আর পাইক। পাইকের খসখসে কণ্ঠ শুনতে পেল, ভেব না, ফিলিপ। নিজের কষ্টই কেবল বাড়াচ্ছে লিলি। কাজ হবে না এতে। র‍্যাঞ্চটা আমি দখল করবই।

 ডাইনিং রুমেই রবিন আর মুসাকে বসে থাকতে দেখল কিশোর। এখন ওদের সঙ্গে রয়েছেন কেরোলিন।

লিলি ফেরেনি? জিজ্ঞেস করল মুসা।

মাথা নাড়ল কিশোর। না। আমাদের এভাবে বসে থাকাটা বোধহয় উচিত হচ্ছে না।

আমারও তাই মনে হয়, কেরোলিন বললেন। মেহমানদেরকে বলিগে। যারা যেতে রাজি হয়, যাবে।

আমি তো যাবই, মুসা বলল।

আমিও, বলল রবিন।

ঝটকা দিয়ে খুলে গেল সুইং ডোরের পাল্লা। ভেতরে ঢুকল লুক। চোখে। উল্কণ্ঠার ছায়া। কেরোলিনকে বলল, আমরা লিলিকে খুঁজতে যাচ্ছি। মেহমানরা যেন কেউ ঘর থেকে না বেরোয়। এরাও।

তিন গোয়েন্দাকে দেখাল সে। এমনিতেই যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় আছি। আবার কেউ কিছু করে বসুক…

কিন্তু এরা গোয়েন্দা…

  গোয়েন্দা-ফোয়েন্দা আমাদের দরকার নেই! রেগে উঠল লুক। এখানে খুন হয়েছে নাকি, যে তদন্ত করবে? এখন আমাদের দরকার ভাল ট্র্যাকার, যে বনের ভেতরে চিহ্ন দেখেই হারান মানুষকে খুঁজে বের করতে পারবে, গোয়েন্দা লাগবে না। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত কিশোরের দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর কেরোলিনকে। বলল, জন কয়েকজনকে নিয়ে দক্ষিণের পাহাড়ে চলে যাবে। আমি আর ব্রড বেরোব গাড়িতে করে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসব। কিশোরের দিকে আঙুল তুলল সে। তোমরা ঘরে থাক। সাহায্য যদি করতেই হয়, বসে থাক ফোনের কাছে। বলা যায় না, লিলির ফোনও আসতে পারে। বেরিয়ে গেল সে।

কয়েক মিনিট পরে একটা গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ শোনা গেল।

লুক যা-ই বলে যাক, মানতে রাজি নয় কিশোর। ওই লোকটার আদেশ শুনবে কেন সে? এখানে বসে বসে আঙুল চুষতে একেবারেই ভাল লাগছে না তার। দুই সহকারীর দিকে তাকাল।

বসেই থাকবে? রবিনের প্রশ্ন।

মাথা নাড়ল কিশোর। না। জেনারেলকে নিয়ে বেরিয়ে যাব পাহাড়ে খুঁজতে।

জানতাম, হাসি ফুটল রবিনের মুখে।

কিশোরও হাসল। বলল, তবে লুক একটা কথা ঠিকই বলেছে, ফোনের কাছে কাউকে থাকতে হবে।

কে থাকবে? হাসি মিলিয়ে গেল রবিনের।

তুমিই থাকো না?

হ্যাঁ, থাক, প্লীজ! অনুরোধ করলেন কেরোলিন। মেহমানদেরকেও সঙ্গ দেয়া। দরকার, মাতিয়ে রাখা দরকার, যাতে অহেতুক দুশ্চিন্তা না করে। একাজটা তোমার চেয়ে ভাল আর কেউ পারবে না।

কাঁধ ঝুলে পড়ল রবিনের। হতাশ হয়েছে। জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছাহ!

গুড বয়। উঠে গিয়ে প্যানট্রিতে ড্রয়ার ঘাটাঘাটি শুরু করলেন কেরোলিন। কয়েকটা পুরানো ম্যাপ এনে টেবিলে বিছালেন। আঙুল রেখে রেখে দেখিয়ে দিতে লাগলেন কোন কোন রাস্তা লিলির পছন্দ। শেষে বললেন, যে পথ ধরেই যাক, হট ম্প্রিঙের দিকেই যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ওদিকটাতেই যায়। গরম পানির ঝর্নাটার কথা বললেন তিনি।

দেখেছি ওটা আজকে, ম্যাপের দিকে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার। ভাবছে, ঠিক কোন জায়গাটায় হারিকেনকে নিয়ে গিয়েছিল লিলি?

ধরো ফোন এল, কিংবা লিলি ফিরে এল, কি করব তখন? জিজ্ঞেস করল রবিন।

একজন র‍্যাঞ্চ হ্যাণ্ডকে বলবে ফাঁকা গুলি করতে। তাহলেই আমি আর মুসা বুঝব, লিলি নিরাপদে আছে। ফ্লেয়ার থাকলে ভাল হত, জ্বালতে পারতে।

আছে তো, কেরোলিন বললেন। এখানে ওঁসক জিনিসের দরকার হয়। তাই রাখি। ট্যাক রুমে আছে। ফাঁকা গুলি করার জন্যে অন্য কাউকে দরকার নেই, আমিই পারব।

হাসল কিশোর। তাহলে খুবই ভাল। হট স্প্রিঙের দিকেই যাব আমরা। চল, মুসা। চেয়ারের হেলানে ঝোলান জ্যাকেটটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে চলল সে।

চাঁদ উঠেছে। হলুদ আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। র‍্যাঞ্চের এখানে ওখানে বিচিত্র নীল আর ধূসর ছায়ার খেলা। দূরে লাল আলো নেচে নেচে এগিয়ে যেতে দেখা। গেল, নিশ্চয় লুকের গাড়ির। দক্ষিণের মাঠের দিকে চলেছে ও।

কয়েক মিনিটেই ঘোড়া বের করে জিন পরিয়ে ফেলল কিশোর আর মুসা, সকালে যে দুটো নিয়েছিল ওরা সেগুলোকেই নিল। ক্যাকটাসের পিঠে চড়ল মুসা। জিজ্ঞেস করল, ওরাতো গেছে দক্ষিণে। আমরা?

 উত্তরে, জবাব দিল কিশোর।

জেনারেলের পিঠে চড়ল সে। রাশ টেনে ইঙ্গিত দিতেই ছুটতে শুরু করল ঘোড়া। পিছু নিল ক্যাকটাস।

সকালে যে পথে গিয়েছিল ওরা সেপথেই এগোল।

ঠিক পথেই যাচ্ছি তো? মুসার প্রশ্ন। গাছপালার দিকে তাকাচ্ছে বার বার। রাতের বেলা এসব জায়গা ভাল না, শুনেছি…

দোহাই তোমার, মুসা, ভূতের কথা শুরু করো না আবার!

 চুপ হয়ে গেল মুসা।

তবে রাতের বেলা বনের চেহারাটা কিশোরেরও ভাল লাগছে না। টর্চের আলোয় কেমন ভূতুড়ে লাগছে পাইন গাছগুলোকে। ঠিক পথেই যাচ্ছি। সকালে এদিক দিয়েই গিয়েছিলাম।

ভাবতে ভাবতে চলেছে কিশোর। একসময় আনমনেই বলল, আশ্চর্য!

 কি? জিজ্ঞেস করল মুসা।

এখানে আসার পর থেকেই একটার পর একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। কাল রাতে ইউনিকর্নের কোরালের গেট কেউ খুলে রেখেছিল। এখন হারিয়ে গেল লিলি। হারনি পাইক এসে হুমকি দিয়ে গেল। লুক বোলান, এমনকি ব্রডও এমন আচরণ করছে, মনে হচ্ছে যেন কিছু লুকাতে চায়।

কিছু সন্দেহ করছ নাকি?

এই, কি হলো তোর? জেনারেলের ঘাড়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল কিশোর। কোন কারণে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে ঘোড়াটা।

কর্কশ একটা ডাক শোনা গেল। ডানা ঝাঁপটে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। বিরাট এক পেঁচা। মাথা ঝাড়ল জেনারেল, নাক দিয়ে শব্দ করল, লাফ দিল। সামনের দুপা তুলে। এক হাতে লাগাম ধরে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল কিশোর, আরেক হাতে টর্চ। হাত নড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোটাও সামনের পথের ওপর নড়তে লাগল।

কি হলো? মুসার ক্যাকটাসও অস্থির হয়ে উঠেছে।

বলতে গিয়েও বলতে পারল না কিশোর, গলা টিপে ধরা হয়েছে যেন, এরকম একটা শব্দ করল। সামনের পথের ওপর পড়ে রয়েছে একটা মূর্তি। নড়ছে না।