১৫. মুখের কাপড় টেনে

প্রথমেই মুসা আর মিলফোর্ডের মুখের কাপড় টেনে বের করা হলো।

বাবা, ঠিক আছ তুমি?

এখন হলাম, মলিন হাসি ফুটল মিলফোর্ডের ঠোঁটে। কপালের জখমটার ফোলা কমেনি, আরও লাল হয়েছে। ডাক্তার ছাড়া হবে না। এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েই আগে ডাক্তার ডাকবে, কোমল গলায় বাবাকে কথা দিল রবিন।

তোমাকে ধরল কি করে, মুসা? বাঁধন খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

নেতিয়ে রয়েছে সহকারী গোয়েন্দা। গাধা যে আমি, মাথায় গোবর পোরা, সে জন্যেই ধরেছে! বনের ভেতর দিয়ে কোন শর্টকাট রয়েছে, ডক চেনে, আমার অনেক আগেই এসে ওর ট্রাকগুলো বের করে নিয়েছে।

বাঁধনমুক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন মিলফোর্ড আর মুসা। হাত-পা ঝাড়া দিয়ে, ডলে ডলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে লাগলেন।

থ্যাঙ্কস, বলতে বলতেই হাত বাড়িয়ে রবিনের মাথা থেকে নীল ক্যাপটা নিয়ে মাথায় চাপালেন মিলফোর্ড। কিছু মনে করলে না তো?

আরে না না, কি যে বলো। তোমার জন্যেই তো রেখেছিলাম, হাসতে হাসতে বলল রবিন। এতদিন পর খুশির হাসি ফুটেছে তার মুখে। তারপর মনে পড়ল জনের সঙ্গে বাবার পরিচয় নেই। পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার।

দ্রুত সেরে উঠল মুসা। হাত-পা ঝাড়া দিয়ে, কয়েকটা লাফ দিয়ে, শরীরের আড়ষ্টতা বিদেয় করে দিয়ে এগিয়ে গেল গাড়িতে রাখা রেফ্রিজারেটরের দিকে। খিদেয় মরে যাচ্ছি আমি। ডালা খুলে বের করল মাখন, রুটি আর ফলের রস।

সবাই গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল খাবারের ওপর।

ভেতরে জায়গা বেশি নেই, জিনিসপত্রে ঠাসাঠাসি, তারই ভেতরে কোনমতে হেঁটে বেড়াতে লাগলেন মিলফোর্ড। মাথা ঘুরে উঠল। টলে পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনমতে তাক ধরে সামলালেন। ধপ করে বসে পড়লেন আবার চেয়ারে। তোমাদেরকে দেখে খুশি লাগছে। আমি যখন ছিলাম না তখন কি কি ঘটেছে বলো তো?

সব কথা খুলে বলল রবিন। শেষে বলল, হ্যারিস হেরিং মারা গেছে, বাবা। জোনস তাকে খুন করেছে।

আদেশ দিয়েছে জোনস, মিলফোর্ড বললেন, আর কাজটা সেরেছে ডক। হেরিঙের পিছে লেগে ছিল, জেনে গিয়েছি সে আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। হিলারি সেসনার ইলেকট্রিক্যাল সিসটেমে গোলমাল করে দিয়েছিল আমাকে খুন করার জন্যে। কেবিনের ফায়ার ওয়ালের পেছনে জট পাকিয়ে থাকা একগাদা তারের মধ্যে ছোট একটা বোমা রেখে দিয়েছিল। স্বীকার করেছে সব।

ইলেকট্রনিক ফিউজ ব্যবহার করেছিল নিশ্চয়, মুখভর্তি খাবারের ফাঁক দিয়ে কোনমতে বলল কিশোর। ফলে মাটিতে থেকেই ওটা ফাটাতে পেরেছে জোনস।

তা-ই করেছে। এমন জায়গায় নামাতে চেয়েছে আমাকে, যেখানে নির্ঘাত মারা পড়ব। আর যদি ক্র্যাশ ল্যাণ্ড করে মারা না-ও যাই, আমাকে হাতে পেয়ে যাবে সে। খুন করতে পারবে। তাতে বরং সুবিধে বেশিই তার, মারার আগে জেনে নিতে পারবে খবরটা আর কে কে জানে। তারপর দেখল, প্লেনে অনেক লোক ঢুকে বসে আছে। ভয় পেয়ে গেল সে। ভাবল, বুঝি আমরা চারজনেই খবরটা জানি। এটা তার জন্যে খুবই খারাপ। পুরো পাঁচ লাখ ডলারের মামলা, কিছুতেই এটা হাতছাড়া করতে চাইল না। দরকার হলে সবাইকে খুন করবে, তবু যেন কোন রকম তদন্ত না হয় এখানটায়।

ওই সাংঘাতিক কেমিক্যাল জমিয়ে রেখে এত টাকা আয় করবে সে? মুসা অবাক।

হ্যাঁ। ছোট ব্যবসায়ী সে, এত টাকার লোভ সামলাতে পারল না। এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি বহু কোম্পানিকে জরিমানা করেছে। কেন করেছে জান? বর্জ্য পদার্থ বৈধ উপায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসাটা অনেক খরচের ব্যাপার। কাজেই অনেক কোম্পানিই টাকাটা বাঁচাতে অসৎ পথ ধরে। তারপর ধরা পড়ে জরিমানা দেয়। হপ্তা দুই আগে ইপিএ একটা কোম্পানিকে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল। ওরা এতই বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল, শহরের নর্দমায় বর্জ্য ঢেলে দিতেও দ্বিধা করেনি।

 সর্বনাশ! আঁতকে উঠল কিশোর। ভয়ানক ব্যাপার ঘটে যেত তো তাহলে! নর্দমার মুখ বন্ধ, সিউয়ারেজু শ্রমিকের মৃত্যু, চাষের খেতের ক্ষতি, সবই হতে পারত। টাকার জন্যে এতটা নিচে নামতে পারে মানুষ!

এর চেয়েও নিচে নামে। যা-ই হোক, ওই ঘটনার পর সম্পাদক সাহেব আমাকে একটা বিশেষ দায়িত্ব দিলেন। বর্জ্য পদার্থ কোথায় কোথায় ঢালা হয় তার ওপর সচিত্র প্রতিবেদন করতে হবে, ধারাবাহিকভাবে ছাপা হবে ওটা। হ্যারিস হেরিং কাগজকে টেলিফোন করে বলেছে একজন সাংবাদিক পাঠাতে, কথা বলতে চায়। প্রথমে তো নামই বলতে চায়নি আমাকে, এতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওর আশঙ্কা ছিল, নাম ফাঁস হয়ে গেলে ওকে খুন করে ফেলা হবে। শুধু বলল, একটা। অটো কোম্পানিতে চাকরি করে। খরচ কমানর জন্যে বেআইনী ভাবে বর্জ্য সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে কোম্পানিটা। জোনসের ট্রাকের পিছু নিয়ে কোথায় বর্জ্য ফেলা হয়, দেখেও এসেছে হেরিং। সেটা গোপনে সংবাদপত্রকে জানিয়ে দিয়ে জনসাধারণকে হুশিয়ার করে দিতে চায়।

দরজার গায়ে হেলান দিয়ে কথা শুনছিল জন। মিলফোর্ড থামলে বলল, আমাদের উপত্যকাটার সর্বনাশ করে দিয়েছে ব্যাটারা! মাটি নষ্ট করেছে, পানি নষ্ট করেছে, মাছ জন্তুজানোয়ার খাওয়ার অযোগ্য করে দিয়েছে, বিষাক্ত করে দিয়েছে বাতাস, শ্বাস নিতে পারি না আমরা। অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমার চাচাকে খুন করেছে ওরা।

বিষাক্ত বর্জ্যের ব্যাপারে অনেক কথাই যেতে আরম্ভ করেছে সরকারের কানে, মিলফোর্ড বললেন। ব্যবস্থা একটা করবেই। তবে তোমার চাচার ব্যাপারে কোন কথা কানে আসেনি আমার। বুঝতে পারছি না ওরাই করেছে কিনা কাজটা।

গাড়ির সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারের আসনে বসল কিশোর। বলল, আঙ্কেল, আপনার প্রতিবেদনের জন্যে যথেষ্ট তথ্য জোগাড় হয়ে গেছে?

অনেক কিছুই পেয়েছি, বললেন তিনি। শুরুটা ভালই হয়েছে। এখানে। জোনসের অনেক রেকর্ডপত্র রয়েছে, ড্রয়ারে, বের করে কেবল পড়ার অপেক্ষা। এই গাড়িটাই ওর অফিস। সব সময়ই ঘুরে বেড়ায়। সচল অফিস বলে ওকে সন্দেহ করে ধরাটা কঠিন হয়ে পড়েছিল।

এখন তো সহজ হয়ে গেছে, মুসা বলল। কিশোর, সরো ওখান থেকে। ব্যাটার অফিসটাই চালিয়ে নিয়ে চলে যাব।

আমি চালাব, চেয়ার থেকে উঠতে গেলেন মিলফোর্ড।

না, আপনার শরীর ভাল না। আমিই পারব।

রবিনও বাবাকে উঠতে দিল না। মুসা ঠিকই বলেছে, বাবা।

আমি ঠিকই আছি, আবার উঠতে গেলেন মিলফোর্ড। চক্কর দিয়ে উঠল মাথা। চেয়ারের পেছনটা খামচে ধরলেন। বসে পড়তে হল আবার। নাহ্, মনে। হচ্ছে সত্যিই খারাপ আমার শরীর।

চাবিগুলো কোথায়? পাচ্ছি না তো। মিলফোর্ডের দিকে তাকাল কিশোর, জানেন, কোথায় রেখেছে?

জোনসের কাছেই আছে বোধহয়।

নিরাশ হলো কিশোর। ড্রয়ারের চাবির কথা জিজ্ঞেস করেছে সে।

মুসা জিজ্ঞেস করল গাড়ির চাবিটার কথা। সেটা কোথায় তা-ও বলতে পারলেন না মিলফোর্ড। তবে তাতে একটুও দমল না সহকারী গোয়েন্দা। চাবি ছাড়াই কি করে স্টার্ট দিতে হয় জানা আছে তার। দরজার দিকে পা বাড়াল সে, হুড তুলে কিছু কাজ করতে হবে ইঞ্জিনের তারে।

দাঁড়াও! বদলে গেছে জনের কণ্ঠস্বর। মুসাকে দেখে সেদিন গাছের ছায়ায় যেমন অনড় হয়ে গিয়েছিল, সেরকম ভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে শব্দ শোনার চেষ্টা করছে। লোকের সাড়া পাচ্ছি।

হুড়াহুড়ি করে জানালার কাছে চলে এল গোয়েন্দারা। বাইরে তাকাল। ঠিকই বলেছে জন। গাছপালার ভেতরে নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে। ঝিক করে উঠল ধাতব কিছুতে রোদ লেগে। রাইফেলের নলে লেগেছে, একথা বলে দিতে হল না ওদেরকে।

অ্যামবুশ করেছে ওরা! নিঃশ্বাস ভারি হয়ে গেছে কিশোরের।

ঢোক গিলল রবিন।

জোনসকে দেখলাম মনে হল! মিলফোর্ডও জানালা দিয়ে তাকিয়ে রয়েছেন।

শয়তান ডকটাকেও দেখেছি! মুসা বলল।

ওই লোকটা সব চেয়ে বিপজ্জনক! রবিনের কণ্ঠে অস্বস্তি। খুন করতে ওর একটুও হাত কাঁপে না!

আরি, আমাদের মোড়লচাচাকেও দেখছি! চোখ বড় বড় হয়ে গেছে জনের। নিওমো কয়েলও আছে?

হালকাপাতলা লোকটার কথা মনে পড়ল কিশোরের, যে মালটিকে ইশারা করেছিল পিকআপ রেডি হয়েছে জানিয়ে। জিজ্ঞেস করল, নিওমো মোড়লের সহকারী, তাই না?

সব সময় না, জন বলল। মাঝে মাঝে কাজে সাহায্য করে। দুজনের। হাতেই ওয়াকি-টকি আছে। রাইফেল আছে! মোড়লচাচার হাতে রাইফেল থাকাটা মারাত্মক। নিশানা বড় সাংঘাতিক!

রাগার টেন বাই টোয়েন্টি টু হান্টিং রাইফেল! বিড়বিড় করল কিশোর। আতঙ্কিতই হয়ে পড়েছে প্রায়। এতগুলো লোক আর শক্তিশালী অস্ত্রের মুখ থেকে বেঁচে বেরোবে কি করে?

মালটি বলেছে, তোমাদের মোড়ল নাকি গাঁয়ের জন্য নানা রকম জিনিস কিনে নিয়ে আসে, রবিন বলল। মোটর ইঞ্জিনের পার্টসের মত দামি জিনিসও আনে। তার একটা নতুন গাড়ি দেখেছি, অনেক দামি। এখন বোঝা যাচ্ছে। জোনসের কাছ থেকে ভাল টাকা পায় সে, মুখ বন্ধ রাখার জন্যে।

কালো হয়ে গেছে জনের মুখ। বিশ্বাসই করতে পারছি না! এত ভাল একজন মানুষ…

গাড়ির ভেতরে টানটান উত্তেজনা।

এই ভাল মানুষদের নিয়েই সমস্যা, মিলফোর্ড বললেন। দেখে মনেই হয় না। এরা খারাপ কিছু করতে পারে। মোড়লকে ফাঁসানোর মত কোন প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। নিওমোকে ধরার মতও নেই।

তাহলে কে আমাদের ব্রেক নষ্ট করে দিয়ে মেরে ফেলেছিল আরেকটু হলেই? রেগে গিয়ে বলল মুসা।

ওর দিকে তাকিয়ে রইল জন। তারপর ঘুরে তাকাল আরেক দিকে, জানি না। এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না মোড়ল কিংবা নিওমো এরকম কাজ করতে পারে।

ওসব আলোচনার অনেক সময় পাব, আবার ড্রাইভারের সীটের দিকে রওনা হলো কিশোর। এখন একটাই কাজ, বেরিয়ে যেতে হবে এখান থেকে।

একটা ঝাড়ু রাখার আলমারি দেখিয়ে নিজেকেই যেন জিজ্ঞেস করল মুসা, ওর মধ্যে বন্দুক-টক আছে?

থাকলেও লাভ নেই, মিলফোর্ড বললেন, এম সিক্সটিনের বিরুদ্ধে বন্দুক দিয়ে কিছুই করতে পারবে না। তাছাড়া ওখানে কিছু রেখেছে বলেও মনে হয় না। অন্য উপায় করতে হবে আমাদের।

ড্যাশবোর্ডের নিচে হাতড়াচ্ছে কিশোর। ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে। মাথায়। মেরিচাচী প্রায়ই বলেনঃ সব রকম বিপদের জন্যে সব সময় তৈরি থাকলে মানুষের বিপদ অনেকটাই কমে যায়। কিশোরও মানে সেকথা। জোনসকে দেখে যা মনে হয়েছে, অনেকটাই মেরিচাচীর স্বভাব। সব কিছুর জন্যেই যেন তৈরি থাকে সব সময়। এই গাড়িটাকে যখন অফিস বানিয়েছে, অনেক কিছুর জন্যই তৈরি করে রেখেছে:হ্যাঁ, এই তো, যা ভেবেছিল। পেয়ে গেল জিনিসটা। হাতটা ড্যাশবোর্ডের নিচ থেকে বের করে এনে মুঠো খুলল। ছোট একটা ম্যাগনেটিক কেস, যার মধ্যে লোকে গাড়ির বাড়তি চাবি রাখে, একটা হারিয়ে গেলেও যাতে প্রয়োজনের সময় দ্বিতীয়টা পেয়ে যায়।

গাড়ির ভেতরের উত্তেজনা মুহূর্তের জন্যে সহজ হলো। হাসি-মুখে চাবিটা মুসার হাতে তুলে দিল কিশোর। প্রায় লাফ দিয়ে গিয়ে ড্রাইভিং সীটে বসল মুসা।

মুসা, দুর্বল কণ্ঠে বললেন মিলফোর্ড, তোমাকে যে রাস্তা দিয়ে এনেছে ডক, সেই রাস্তা দিয়েই চলে যাও। গুলি করে টায়ার ফাটিয়ে দিলেও থামবে না, বসা টায়ার নিয়েই চালাবে। মোট কথা, কোন কারণেই থামবে না। তোমার একমাত্র লক্ষ্য হবে, চালিয়ে যাওয়া। ডায়মণ্ড লেকে যাব আমরা!

বাবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। সহজে ভয় পান না তার বাবা। এখন পেয়েছেন। পরিস্থিতি খুবই খারাপ।

মুসা বলল, সবাই মাথা নামিয়ে রাখো। শক্ত করে ধরে থাকো কিছু।

মেঝেতেই শুয়ে পড়ল সকলে, মিলফোর্ড সহ। জন সতর্ক, সাংঘাতিক সতর্ক, গভীর দুর্গম বনে চলার সময় যেমন থাকে। রবিন ভাবছে, রকি বীচে আর কি কোনদিন ফিরে যেতে পারবে? যেতে পারবে ট্যালেন্ট এজেন্সি কিংবা পাবলিক লাইব্রেরিতে? বার দুই ঢোক গিলল কিশোর। মনে মনে বলছে, খোদা, এবার যেন। ফোর্ড পিকআপটায় চড়ার মত দুর্গতি না হয়।

আর মুসা, ভারি একটা দম নিয়ে আস্তে মোচড় দিল ইগনিশনে। জেগে গেল ইঞ্জিন।