১৪. রাগত গলায় বলল কণ্ঠটা

তোমরা! রাগত গলায় বলল কণ্ঠটা, তোমরা এখানে কি করছ?

জন, তুমি? কিশোর বলল।

আমরা এখানে কি করে জানলে? জিজ্ঞেস করল রবিন।

আরও রেগে যাচ্ছে জন। বেরোও! বাইরের লোকের এখানে ঢোকা নিষেধ! এটা আমাদের পবিত্র জায়গা। কেউ ঢোকে না এখানে।

ভুল করছ, কিশোর বলল, এস, দেখাচ্ছি, কিসে তোমাদের অসুস্থ করে –তুলছে।

দ্বিধা করল জন। তারপর ভেতরে এসে ঢুকল।

ড্রামগুলো দেখাল কিশোর। একটা ড্রামের তলা ফুটো হয়ে গিয়ে ভেতরের আঠাল পদার্থ চুঁইয়ে পড়ছে মেঝেতে। তীব্র রাসায়নিক গন্ধ।

চুপচাপ দেখল জন। তারপর কিশোর আর রবিনের সঙ্গে চুপচাপ বেরিয়ে এল। বাইরে, খোলা হাওয়ায়, যেখানে ঠিকমত শ্বাস নেয়া যায়।

ড্রামগুলোতে কি আছে বলল কিশোর।

 রাসায়নিক বর্জ্য! জন বলল, আমাদের বাতাস আর পানি দুষিত করছে!

করছে। তোমার চোখ লাল হয়ে গেছে, রবিন বলল। আমাদেরও হয়েছে। এটাও এই বর্জ্যের কারণেই।

দুজনের চোখের দিকে তাকাল জন। তাহলে তো ট্রয়কের পানি খাওয়া নিরাপদ নয় আমাদের জন্যে। ওটার মাছও নিশ্চয় বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে।

বনের জানোয়ারও। নদীতে পানি খেতে আসে ওরা।

এই গুহাটাতে তো গন্ধ কমই, কিশোর বলল। অন্যগুলোর কাছে যাওয়া যায় না, এতই বেশি। ওগুলোতে নিশ্চয় বোঝাই হয়ে আছে ফুটো হয়ে যাওয়া ড্রামে। বর্জ্যের ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করছে তোমাদের পবিত্র উপত্যকাকে।

কঠিন হয়ে গেছে জনের মুখ। ভাবছে রাসায়নিক বর্জ্যের ভয়াবহতার কথা। রাগে আগুন হয়ে ফুঁসে উঠল, আমাদের পবিত্র জায়গার এই সর্বনাশ কে করছে?

ফ্র্যাঙ্কলিন জোনস। জোনস ট্র্যাকিং কোম্পানির মালিক। চেনো?

নিশ্চয়। আমাদের মোড়ল মাঝে মাঝে গিয়ে তার কাজ করে। আমাদের অনেক সাহায্য করেন মিস্টার জোনস…

সেটা কাছাকাটি থাকার জন্যে, রবিন বলল। এই এলাকায় ঢুকতে যাতে সুবিধে হয়। জোনসই আমার বাবাকে কিডন্যাপ করেছে। কোথায় রাখবে, আন্দাজ করতে পারো?

না। এদিকটায় এর আগে আসিইনি আমি। তবে চেষ্টা করলে খুঁজে বের করে ফেলতে পারব।

গোলাকার জায়গাটার দিকে হাঁটতে হাঁটতে কিশোর জিজ্ঞেস করল, আমাদেরকে বের করলে কি করে? পায়ের ছাপ দেখে?

কাঁধ সামান্য কুঁজো করে হাঁটছে জন। নজর নিচের দিকে। চাকার দাগগুলো দেখছে। দাদা, আমাকে আজ সকালে গান গাওয়া অনুষ্ঠান থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তোমাদের জন্যে চিন্তা করছেন তিনি। আমার চাচীর গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে। পড়লাম। রাস্তায় দেখলাম তোমাদের যে পিকআপটা দেয়া হয়েছিল সেটা নষ্ট হয়ে। পড়ে আছে। তোমাদের জুতোর ছাপ অনুসরণ করে আসাটা কিছুই না। প্রথমে চোখে পড়ল দুই জোড়া জুতোর ছাপ তোমাদের পিছু নিয়েছে, তারপর তিন জোড়া। তাড়া করেছিল তোমাদের। তোমরা দৌড়ে পালিয়েছ, দুবার লড়াই করেছ, এক জায়গায় মুসার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছ। বুটের দাগ শুধু তোমাদের পিছু নিয়েছে তারপর থেকে, মুসার পিছু নেয়নি।

এত কিছু বলতে পারলে শুধু চিহ্ন দেখেই? অবাক হয়ে বলল কিশোর।

এ-তো সহজ কাজ। আমি বনের ছেলে, এমনিতেই বন আমার পরিচিত। তার ওপর ট্র্যাকিং শিখেছি চাচার কাছে। সাংঘাতিক ভাল ট্র্যাকার ছিল আমার চাচা।

ট্র্যাকিং করে অনুমান করতে পেরেছ আমাদের পিকআপটাকে কে স্যাবোটাজ করেছে?

কি বললে? চমকে গেল জন।

বোল্টটা করাত দিয়ে কেটে কিভাবে ওদেরকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল বলল কিশোর।

মাথা নোয়াল জন। এরকম একটা কাজ কে করল? মুখ তুলল। তোমরা বেঁচে আছ দেখে খুব ভাল লাগছে আমার। মুসা নিশ্চয় ওস্তাদ ড্রাইভার।

একসাথে মাথা ঝাঁকাল রবিন আর কিশোর।

কিশোর, দেখাও না…, কিশোরের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করল রবিন।

অ্যাঁ, হ্যাঁ! ইঙ্গিতটা বুঝতে পারল কিশোর। প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ দেয়াটা কঠিন। তবু সত্যি কথাটা জানাতেই হবে। পকেট থেকে রূপার বাকলসটা বের করে জনকে দেখাল সে, দেখ তো, চিনতে পার কিনা?

হাত বাড়িয়ে জিনিসটা নিল জুন। সে যেটা পরেছে অবিকল সেটারই মত দেখতে। আমার চাচার। মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কোথায় পেলে?

উপত্যকায়, হাত তুলে একটা দিক দেখাল কিশোর। একটা কঙ্কালের পাশে। আসার পথে নিশ্চয় হাড়গুলো দেখে এসেছ?

চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকাল জন। শক্ত হয়ে গিয়ে আবার ঢিলে হয়ে গেল চোয়াল।

এইবার আমি বুঝতে পেরেছি, আমার ভিশন কোয়েস্টের মানে কি ছিল? কি বোঝাতে চেয়েছেন ঈশ্বর! ঠিক জায়গায়, কিন্তু আশীর্বাদ ছাড়া। ঠিক জায়গায়, অর্থাৎ ইনডিয়ানদের পবিত্র এলাকাতেই রয়েছে, কিন্তু তার আত্মা অশান্তই থেকে গেছে, পরপারের ঠিক জায়গায় যেতে পারেনি।

একটা মুহূর্ত নীরব হয়ে রইল তিনজনে।

 হাড়গুলো দেখার জন্যে থেমেছিলে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।

না। তোমাদের জন্যে ভাবনা হচ্ছিল।

আরও খারাপ খবর আছে তোমার জন্যে। খুলিটাতে বুলেটের ফুটো দেখেছি।

গুলি করা হয়েছে? কে করল? কেন করল?

হ্যারিস হেরিং-এর দুর্ঘটনার কথা বলল কিশোর। তিন গোয়েন্দা আর রবিনের বাবাকে খুন করে যে দুর্ঘটনার মত করে সাজাতে চায়, সেকথাও বলল।

তুমি বোঝাতে চাইছ, জন বলল, তোমাদের মতই চাচাও কিছু সন্দেহ করেছিল, এই জায়গাটা দেখে ফেলেছিল বলেই তাকে মরতে হয়েছে?

হতে পারে।

চুপ করে ভাবল জন। বলল, অনুষ্ঠানে দাদা জেনেছেন, বিদেশী ডাইনী এসে আমাদের অসুস্থ করে তুলেছে। ডাইনীর লোভ খুব বেশি, সে যা চায় সেটা দিয়ে দিলেই কেবল তাকে ধ্বংস করা সম্ভব।

তাহলে জোনসই সেই ডাইনী।

কিন্তু যা চায় সেটা দিয়েই ধ্বংস করতে হবে, এর মানে কি? বুঝতে পারছে না রবিন।

জানি না, হাত ওল্টাল জন। চাচার বাকলসটা পকেটে রেখে দিল। চলো, খুঁজে বের করি। চওড়া একটা চাকার দাগ দেখিয়ে বলল, এটা মিস্টার জোনসের উইনিব্যাগোর দাগ। এসো। দাগটাকে অনুসরণ করে দুলকি চালে ছুটতে আরম্ভ করল সে।

ওর পেছনে ছুটল কিশোর আর রবিন। জনের ট্র্যাকিঙের ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হয়েছে। সরু রাস্তা ধরে এসে বার্চ আর পাইনের জঙ্গলে ঢুকল ওরা। গতি কমাল জন। সতর্ক হয়ে চলতে লাগল এখন থেকে।

বাতাসে পাইনের সুগন্ধ বেশিক্ষণ খাঁটি থাকতে পারল না, ভেজাল ঢুকে নষ্ট হয়ে গেল, গুহার কাছে যে দুর্গন্ধ পেয়েছে, সেই একই দুর্গন্ধ এখানেও।

এ থেমে গেল জন। পাওয়া গেছে। মিস্টার জোনসের উইনিব্যাগো। ওটা নিয়েই আমাদের গাঁয়ে যায়, খাবার, গুলি, দিয়ে আসে। বাচ্চাদের জন্যে খেলনা নিয়ে যায়।

পথের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দামি অনেক বড় গাড়িটা। গুহার কাছ থেকে সরিয়ে এনে বর্জ্য পদার্থের বিষক্রিয়া-সীমানার বাইরে এনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। গাছপালার ভেতরে।

ওটার দিকে পা বাড়াতে গেল জন।

দাঁড়াও! ওর হাত ধরে ফেলল কিশোর। ভেতরে লোক থাকতে পারে। ওদের কাছে রাইফেল আছে।

মাটিতে জুতোর ছাপ দেখাল জন। সোলের নিচে চারকোনা খোপ খোপ করা। সেই ছাপ পড়েছে ধুলোতে। গাড়ির দিকে এগিয়ে গেছে।

চিনতে পেরেছ? জিজ্ঞেস করল সে।

মাথা নাড়ল কিশোর আর রবিন। পারিনি।

মুসা। ওকে রেখে সবাই চলে গেছে। এই যে দেখো, বুটের দাগ।

মুসাকে ধরে ফেলেছে! গুঙিয়ে উঠল কিলোর।

জনের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকাল দুই গোয়েন্দা। এসো, পা বাড়াল আবার জন।

সাবধানে যাও, হুঁশিয়ার করল কিশোর। জোনস কাছাকাছিই থাকতে পারে।

পা টিপে টিপে গাড়ির কাছে চলে এল তিনজনে। জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। দুজন মানুষকে দেখা গেল ভেতরে। ধাতব কিচেন চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে। মুখে কাপড় গোঁজা। একজন মুসা। আরেকজন…

বাবা! চিৎকার করে উঠল রবিন।