৪. ঘরে পিনপতন নীরবতা

ঘরে পিনপতন নীরবতা। হাতের কাগজটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন অলিংগার হাত দিয়ে ডলে সমান করতে লাগলেন অস্বস্তিভরে। ঘরের কারও মুখে কথা নেই।

কি লিখেছে? অবশেষে জিজ্ঞেস করল একজন।

টাকা চায়, জবাব দিলেন অলিংগার। অনেক টাকা। নইলে খুন করল বেচারা ডিলনকে।

কত টাকা? জানতে চাইলেন রিডার।

বলেনি। নিজেরাই দেখ। কাছে বসেছেন লেখক। উঠে নোটটা তার দিকে ঠেলে দিলেন প্রযোজক। হাতে হাতে ঘুরতে লাগল ওটা। সব শেষে এল রিডারের হাতে। তিনি সেটা পড়ে মুসাকে না দেখিয়েই আবার ফিরিয়ে দিলেন অলিংগারকে। ডেস্কের ড্রয়ারে রেখে দিলেন প্রযোজক।

ডিলন কিডন্যাপ হয়েছে! কথাটা ভীষণ চমকে দিয়েছে মুসাকে। যদিও এরকমই একটা কিছু ঘটেছে ভেবে খুঁতখুঁত করছিল তার মন। কি লিখেছে। নোটটাতে…

খাম থেকে একটা ফটোগ্রাফ টেনে বের করলেন অলিংগার। সর্বনাশ!

সবাই উঠে হুড়াহুড়ি করে ছুটে গেল দেখার জন্যে। মুসা এক পলকের বেশি। দেখতে পারল না, ছবিটা ড্রয়ারে রেখে দিলেন প্রযোজক।

ফোনের দিকে হাত বাড়াল কালো চুল মহিলা, পুলিশকে ফোন করা দরকার।

ওর হাত চেপে ধরলেন অলিংগার। না না! পুলিশকে জানালে খুন করে। ফেলবে ওকে! ওগুলো মানুষ নয়, জানোয়ার। নিশ্চয় রসিকতা করেনি!

রসিকতা যে করেনি তাতে মুসারও সন্দেহ নেই।

মিস্টার অলিংগার, বলল সে, আমরা কি কিছু করতে পারি? এসব কাজ…

না! মানা করে দিলেন প্রযোজক, পুলিশও দরকার নেই, গোয়েন্দাও না!

বুঝতে পারছেন কি বলছেন? রিডার বললেন।

 পারছি। এক গাদা টাকা যাবে আরকি আমার!

তা তো যাবেই। আমি বলছি ছবিটার কথা। সব কাজ বন্ধ করে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে এখন আমাদের। শ্রমিকদের জানাতে হবে। আমি পারব না! মাথায় বাড়ি মারতে আসবে ওরা! কিছুদিন কাজ বন্ধ থাকছে এটা জানান প্রযোজকের দায়িত্ব।

ক্লান্ত দৃষ্টি রিডারের ওপর স্থির হয়ে রইল কয়েক সেকেণ্ড, তারপর মাথা। ঝাঁকালেন অলিংগার। ঠিক আছে, দায়িত্ব যখন, জানাব। চলো, সেটে যাই।

ডেস্কটার দিকে তাকাল মুসা, যেটাতে নোট আর ছবি রাখা হয়েছে।

প্রথমে এগোলেন অলিংগার, পেছনে রিডার, এবং তার পেছনে অন্যেরা। মুসা ইচ্ছে করে রয়ে গেল পেছনে। সবাই বেরোলেও সে বেরোল না। দরজা লাগিয়ে কয়েক লাফে চলে এল ডেস্কের কাছে। ড্রয়ার খুলে নোটটা বের করল।

খবরের কাগজের অক্ষর কেটে আঠা দিয়ে লাগিয়ে লিখেছেঃ আমরা বেন ডিলনকে নিয়ে গেছি। ফেরত চাইলে অনেক টাকা খরচ করতে হবে। পুলিশকে জানালে তাকে আর জ্যান্ত দেখার আশা নেই। পরবর্তী নির্দেশ আসছে।

ছবিটা দেখল মুসা। ধাতব একটা ফোল্ডিং চেয়ারে বসিয়ে তোলা হয়েছে। হাত মুচড়ে পেছন দিকে নিয়ে গিয়ে বাধা হয়েছে। মুখে চওড়া সাদা টেপ লাগান। পা বাঁধা হয়েছে গোড়ালির কাছে। ডিলনের বিখ্যাত নীল চোখজোড়ায় আতংক, যেন সামনে মূর্তিমান মৃত্যু দাঁড়ানো।

দেরি করল না মুসা। নোট আর ছবিটা পকেটে নিয়ে রওনা হলো হলের দিকে, সেখানে ফটোকপি মেশিন আছে, আসার সময় লক্ষ্য করেছিল। কপি করে রাখবে দুটোরই।

নোট এবং ছবিটার কয়েকটা করে কপি করে অলিংগারের অফিসে ফিরে এল আবার। সেক্রেটারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কৈফিয়ত দিল, একটা জিনিস ফেলে এসেছি। মেয়েটা বিশ্বাস করল, মাথা ঝাঁকিয়ে তাকে যেতে দিল, নিজে সঙ্গে এল না। আগের জায়গায় জিনিসগুলো রেখে দিল মুসা।

এবার কি? শুধুই রহস্য নয় আর এখন, অপহরণ কেস, একজনের জীবন মরণ সমস্যা। কাজটা একা করার যতই আগ্রহ থাকুক, ঝুঁকি নেয়াটা আর ঠিক হবে না কোনমতেই। একটাই করণীয় আছে এখন, এবং সেটাই করল সে। রিসিভার তুলে ডায়াল করল।

কিশোর? মুসা। কোথাও যেও না। থাক। জরুরী কথা আছে। আমি আসছি। রিসিভারটা নামিয়ে রাখতে না রাখতেই দরজা খুলে গেল।

মুসার দিকে তাকিয়ে রয়েছে অলিংগারের সেক্রেটারি। চোখে সন্দেহ। কি করছ?

জরুরী একটা ফোন। সরি। পকেট থেকে জাগুয়ারের চাবির গোছাটা বের করে ডেস্কে রাখা একটা বাক্সে ছুঁড়ে দিয়ে দ্রুত দরজার দিকে এগোল মুসা। সেক্রেটারির দিকে তাকাল না আর।

গাড়ি নেই। সিনেমার একজন কর্মীর গাড়িতে লিফট নিয়ে রকি বীচে এল সে। বাড়িতে পৌঁছে নিজের গাড়িটা বের করে নিয়ে চলে এল ইয়ার্ডে। গাড়ি থেকে নেমে ওঅর্কশপের দিকে ছুটল। দরজায় হাত দেয়ার আগেই কিশোরের কণ্ঠ শোনা গেল, মুসা, সবুজ টি-শার্ট, নীল জিনস, আর বাস্কেটবল শু পরেছ।

কি করে জানলে?

ট্রেলারের দরজা খুলে দিয়ে রবিন বলল, ওপরে দেখো।

ছাতে বসান হয়েছে একটা ভিডিও ক্যামেরা। পুরানো টেলিস্কোপ সর্বদর্শনটা যেখানে ছিল সেখানে। এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরছে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশপাশের সব কিছু দেখে চলেছে। ক্যামেরার চোখ। এটা কিশোরের নতুন সিকিউরিটি সিসটেম। এটার নামও সর্বদর্শনই রাখা হয়েছে। পুরানো পদ্ধতি সরে গিয়ে নতুনকে ঠাই করে দিয়েছে জিনিসটা, কিশোরের সামনে ডেস্কে রাখা আছে মনিটর।

খুব ভাল করেছ, হেডকোয়ার্টারে ঢুকে বলল মুসা। শোন, যে জন্যে থাকতে বলেছিলাম। খবর আছে। বেন ডিলন কিডন্যাপ হয়েছে তার মালিবু বীচের বাড়ি থেকে। একটু আগে সাফোকেশন টু ছবির পরিচালক অলিংগারের সঙ্গে মিটিঙে বসেছিলাম। তখনই এল র‍্যানসম নোট।

সময় নষ্ট না করে ভাল করেছু, কিশোর বলল। খুলে বলো।

রভিন মনিটরটা একপাশে ঠেলে সরিয়ে ডেস্কের ওপরই উঠে বসল মুসা। জিনসে হাত ডলছে, অস্বস্তিতে। ইয়ে…সব কথা তোমাদের ভাল লাগবে না। রেগে যাবে আমার ওপর। আসলে, সময় অনেকই নষ্ট করেছি। কারণ…

আরে দূর! অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়ল রবিন, অত ভণিতা করছ কেন? বলে ফেলো না।

ডিলন সম্ভবত তিন দিন আগে কিডন্যাপ হয়েছে।

তিন দিন আগে হয়েছে, কিশোর বলল, আর তুমি জেনেছ খানিক আগে?

ঠিক তা নয়। আমি তিন দিন আগেই সন্দেহ করেছি, মুসা বলল। দেখল, কিশোরের ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে আস্তে আস্তে গোল হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাদেরকে জানাবই না। একা একাই কেসটার সমাধান করে তাক, লাগিয়ে দেব। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে আমার।

ঠোঁট দিয়ে ফুট ফুট শব্দ করল কিশোর। শ্রাগ করে বলল, তাতে আমি মাইণ্ড করিনি। বরং আগেই কিছু তদন্ত সেরে ফেলে ভাল করেছ।

মুখ তুলে তাকাতে পারল না মুসা। লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, মাইণ্ড করবে, এখুনি। আমি ব্রাউন অলিংগারকে বলেছি তিন গোয়েন্দার হেড হলাম আমি। আর তোমরা দুজন আমার সহকারী। তোমাদেরকে ডাকব কিনা জিজ্ঞেস করেছিলাম।

হো হো করে হেসে উঠল রবিন। নতুন কার্ডে গোয়েন্দা প্রধান কে লেখা নেই। বলেই সুযোগটা নিতে পেরেছ।

শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল কিশোর, র‍্যানসম নোটটা দেখেছ?

কপি করেই নিয়ে এসেছি। পকেট থেকে নোট আর ছবির কপি বের করে দিল মুসা।

ছবিটা দেখে আফসোস করে বলল রবিন, আহারে, বেচারার বড়ই কষ্ট।

ডিলনের কষ্টের কথা বলছ? কিশোর বলল, অযথা দুঃখ পাচ্ছ। ভাল করে দেখ, বুঝতে পারবে। যতটা সম্ভব খারাপ অবস্থা দেখানর ইচ্ছেতেই এরকম ভঙ্গিতে রেখে ভোলা হয়েছে এই ছবি। হাতটা কতটা পেছনে নিয়ে গেছে দেখ। এই অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বেহুশ হয়ে যেতে বাধ্য। ওকাজ কিছুতেই করতে যাবে না কিডন্যাপাররা। যদি সত্যিই ডিলন ওদের কাছে দামি হয়ে থাকে।

আরেকটা ইনটারেসটিং ব্যাপার, নোটটা দেখতে দেখতে রবিন বলল, খবরের কাগজ থেকেই কাটা হয়েছে অক্ষরগুলো, তবে লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস কিংবা হেরাল্ড এক্সামিনার থেকে নয়। অন্য কোন কাগজ। অক্ষর দেখলেই আন্দাজ করা যায়।

তোমার ধারণা, মুসা জিজ্ঞেস করল, লস অ্যাঞ্জেলেসের বাইরে কোথাও থেকে পাঠানো হয়েছে নোটটা?

সূত্র তো তাই বলে, জবাব দিল কিশোর।

এক এক করে রবিন আর কিশোরের দিকে তাকাতে লাগল মুসা। স্বীকার করল, আসলেই আমি গোয়েন্দাপ্রধান হওয়ার অনুপযুক্ত। বার বার দেখেছি। এগুলো, অথচ কিছুই বুঝতে পারিনি।

পারতে, কিশোর বলল, তুমিও পারতে, মাথা ঠাণ্ডা করে দেখলে। যাকগে। আর কিছু?

অদ্ভুত আরও কতগুলো ঘটনা ঘটেছে। শুটিং স্পটে যাওয়ার পর থেকে যা যা ঘটেছে সব খুলে বলল মুসা। প্রথম সাফোকেশন ছবির শুটিঙের সময় যেসব গোলমাল হয়েছে শুনেছে, সেসবও বাদ দিল না। সব শেষে বলল পটার বোনহেডের দেয়া স্ফটিকটার কথা। বলল, আমাকে সাবধান করে দিয়েছে সে। তৃতীয় নয়নের মাধ্যমে নাকি দেখতে পেয়েছে আমার বিপদ। বলেছে, স্ফটিকের নির্দেশ আমার শোনা উচিত।

শোনা শুরু করলেই বরং বিপদে পড়বে, কিশোর বলল, মানসিক ভারসাম্য হারাবে।

কথা বলতে বলতে কখন যে রাত হয়ে গেল টেরই পেল না ওরা। আচমকা বলে উঠল মুসা, আমার খুব খিদে পেয়েছে।

ট্রেলার থেকে বেরিয়ে এসে ওর ভেগাতে উঠল তিনজনে। অন্ধকার রাত। এতক্ষণ ভূত-প্রেত, ডাইনী নিয়ে আলোচনা করে এখন সর্বত্রই ওসব দেখতে লাগল। ডাইনী, ভূত, কঙ্কাল….

অ্যাই, ভুলেই গিয়েছিলাম, মুসা বলল, আজকে হ্যালোউইন উৎসব।

 কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরে বেড়াল ওরা। স্কুলের কোন ছেলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় কিনা দেখল। দেখা গেল অনেককেই, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আছে। নানারকম সাজে সেজেছে ওরা। সাফোকেশন ছবির জোম্বি আর ভয়ঙ্কর ভূতপ্রেতগুলোর কথাই মনে করিয়ে দিল মুসার।

একটা পিজা শ্যাকে ঢুকে পিজা খেয়ে নিয়ে আবার বেরোল ওরা। একটা স্টপ। সাইনের কাছে এসে ব্রেক করল মুসা। চালু করে দিল উইণ্ডশীল্ড ওয়াইপার। এপাশ ওপাশ নড়তে লাগল ওয়াইপার আর কাঁচে লাগতে শুরু করল ঘন রক্ত।

এটা কি? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

অবিশ্বাস্য! রবিন বলল, ওই জাগুয়ারটার মত তোমার গাড়িতেও এই কাণ্ড করেছ?

হাসল মুসা। গাড়িটা ঘুরিয়ে কাচটা এমন ভঙ্গিতে রাখল, যাতে রাস্তায় চলমান। গাড়ির আলো এসে পড়ে আর চালকদের চোখে পড়ে সেই রক্ত। চমকে যেতে লাগল লোকে।

বহু মানুষকে ভয় পাইয়ে দিয়ে একসময় হেডকোয়ার্টারে ফিরে এল ওরা।

দেখো দেখো! চিৎকার করে বলল রবিন, ট্রেলারের দরজার অবস্থা!

শুধু দরজাই না, সতর্ক হয়ে উঠেছে কিশোর, জানালাগুলো ভেঙে দিয়ে গেছে!

তখনই বলেছিলাম, ট্রেলারটাকে জঞ্জালের নিচ থেকে বের করার দরকার নেই,মুসা বলল, এখন হলো তো! ঢুকল কি করে ব্যাটারা?

গেট বন্ধ হওয়ার আগেই হয়ত ঢুকে বসেছিল, অনুমান করল রবিন।

গাড়ি থেকে নেমে ট্রেলারের দিকে দৌড় দিল তিনজনে। ঢুকে পড়ল ভেতরে। মেঝেতে নামিয়ে স্কুপ করে রাখা হয়েছে তিন গোয়েন্দার ফাইলপত্র। ছড়িয়ে রয়েছে কাগজ।

ব্যাটারা এখানে কিছু খুঁজতে এসেছিল! রবিনের কণ্ঠে চাপা রাগ।

মুসার মনে হতে লাগল, দেয়ালটা বুঝি তার দিকে এগিয়ে আসছে। গুঙিয়ে। উঠল সে।

কি হলো, মুসা?

 দম আটকে আসছে আমার! শ্বাস নিতে পারছি না!

দেয়ালে টেপ দিয়ে লাগান রয়েছে মেসেজ। খবরের কাগজের অক্ষর কেটে সেই একই ভাবে লিখেছে, অলিংগারের কাছে যেভাবে নোট পাঠান হয়েছিল। এগিয়ে গেল কিশোর। পড়ে দুই সহকারীর দিকে ফিরে বলল, ডিলনের ব্যাপারেই লিখেছে!

এগিয়ে এল রবিন আর মুসা। ওরাও পড়ল মেসেজটাঃ বেন ডিলনের রক্তপাতের জন্যে তোমরা দায়ী হবে!