৩. কতটা বেশি ঠাণ্ডা

কতটা বেশি ঠাণ্ডা পড়বে এখানে? বাবাকে জিজ্ঞেস করল রবিন।

উষ্ণ রোদে আরাম করে বসে আছ দুজনে। কিশোর আর মুসা পানি রাখার জন্যে একটা পাত্র পাওয়া জায় কি-না খুঁজে দেখতে গেছে বিমানের ভেতরে। মেডিক্যাল কিটও দরকার।

 আবহাওয়া এখন ততটা খারাপ হবে না, মিলফোর্ড বললেন। আগস্ট মাস তো, ঠাণ্ডায় জমে মরার ভয় নেই। রাতে তাপমাত্রা চল্লিশের নিচে নামবে বলে মনে হয় না।

চল্লিশ! ভুরু ওপর দিকে উঠে গেল রবিনের। ঠাণ্ডাই তো!

তা একরকম ধরতে পারো, হাসলেন মিলফোর্ড। হাজার হোক ক্যালিফোর্নিয়া…

হ্যাঁ, ক্যালিফোর্নিয়া তো বটেই, মুসা বলল। বিমানের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে এগোনোর সময় মিলফোর্ডের কথা কানে গেছে তার। যত সব গণ্ডগোলের আখড়া। আবহাওয়ার কোন ঠিকঠিকানা নেই। মুসার হাতে একটা ধাতব বাক্স।

শীত সহ্য করার মত শরীর নয় আমাদের, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল রবিন সে-ই জানে।

মুসার পেট গুড়গুড় করে উঠল। ক্ষুধা সহ্য করার মতও নয়। ভাবছিলাম, ডায়মণ্ড লেকে গিয়ে পেট পুরে ভেড়ার কাবাব খাব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাত নাড়ল সে। গেল সব!

একমত হয়ে মাথা জাঁকালেন ফিলফোর্ড আর রবিন। খিদে তাঁদেরও পেয়েছে।

ডায়েট কন্ট্রোল করা ছাড়া আর কিছু করার নেই আপাতত, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রবিন।

দেখো, কিশোর কি বলে? করুণ হাসি ফুটল মুসার ঠোঁটে। কিছু একটা আবিষ্কার করেই ফেলবে–মনে নেই, প্রশান্ত মহাসাগরের মরুদ্বীপে…

হ্যাঁ, তা তো আছেই। পিঁপড়ের ডিম আর শুয়াপোকা খাওয়াবে আর কি শেষে… বিমান দুর্ঘটনা।

বাধা দিয়ে মিলফোর্ড বললেন, অতটা নিরাশ হচ্ছ কেন? বেরিয়ে যাওয়ার একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই। আমাদের মে-ডে কারও কানে যেতেও পারে। ওয়ান টোয়েন্টি ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ মেগাহার্টজে এখন ব্রডকাস্ট চলছে।

আপনি শিওর? ভরসা করতে পারছে না মুসা। সত্যিই চলছে রেডিওটা?

চলার তো কথা। ব্যাটারিতে চলে। জোরে ধাক্কা কিংবা বাড়ি খেলেই আপনাআপনি চালু হয়ে যায়। এমনও শোনা গেছে, হাত থেকে টেবিলের ওপর। পড়ে গেলেও চালু হয়ে যায়।

নীল আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। অনেক ওপরে ধোয়ার হালকা একটা সাদা রেখা চোখে পড়ছে। একটা জেট বিমান যাওয়ার চিহ্ন। সেদিকে তাকিয়ে থেকে মিলফোর্ড বললেন, ওখান থেকে আমাদেরকে দেখতে পাবে না, ঠিক, তবে আমাদের এস ও এস শুনতে বাধা নেই।

অনেক দূরে চলে গেছে বিমানটা। ছোট হয়ে এসেছে, মিলিয়ে যাবে যে কোন মুহূর্তে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল রবিন। অনেকটা স্বস্তি পাচ্ছে এখন। পরিস্থিতি খারাপ সন্দেহ নেই, কিন্তু তার বাবা এমন সহজ ভঙ্গিতে কথা বলছে, হতাশা অনেকটাই কেটে গেছে ওর। আশা হচ্ছে এখন, ওদেরকে উদ্ধার করতে আসবেই কেউ না কেউ। মুসার হাতের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি ওটা?

ইমারজেন্সি কিট। অনেক জঞ্জালের ভেতর থেকে বের করেছি। দেখো না, কি ধুলো লেগে আছে।

হু।

বাক্সটা খোলা হলো। ভেতরে রয়েছে অ্যাসপিরিন, বায়োডিগ্রেডেবল সোপ, ব্যাণ্ডেজ, মসকুইটো রিপেলেন্ট, স্কিন অ্যানটিবায়োটিক, পানি পরিশোধিত করার আয়োডিন পিল, এক বাক্স দিয়াশলাই, আর ছয়টা হালকা স্পেস ব্ল্যাঙ্কেট। চকচকে এক ধরনের জিনিস দিয়ে এত পাতলা করে বানানো, ভাঁজ করে নিলে খুব অল্প জায়গার ভেতরে ভরে রাখা যায়।

দিয়াশলাই! খুশি হয়ে উঠেছে রবিন, যাক, আগুনের ব্যবস্থা হয়ে গেল।

আয়োডিন পিল আছে যখন, মিলফোর্ড বললেন, খাবার পানিও পেয়ে যাব।

এগুলো দেখে তো মনে হচ্ছে মহাকাশচারীদের কাজে লাগে, একটা স্পেস ব্ল্যাঙ্কেট খুলল মুসা। একটা ধার ঢুকিয়ে দিল টি-শার্টের গলা দিয়ে। ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি মনে হয়? রক স্টারের মত লাগছে?

জবাব দিল না রবিন। ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাবার কপালের জখমটায় পরিষ্কার করে ব্যাণ্ডেজ বাধল। কাটাটা খুব বেশি না, তবে বাড়িটা লেগেছে বেশ জোরেই। অনেকখানি উঁচু হয়ে ফুলে গেছে। বেগুনী রঙ।

 ফোলা মাংসে আঙুল দিয়ে চাপ দিল রবিন। উহ করে উঠলেন মিলফোর্ড। বেশি ব্যথা লাগছে? জিজ্ঞেস করল রবিন। বেশি খারাপ লাগলে শুয়ে পড়ো। মাথায় বাড়ি লাগা ভাল না! বমি বমি লাগছে? মাথা ঘোরে…

একেবারে ডাক্তার হয়ে গেলি যে রে! হেসে বললেন মিলফোর্ড। রেড ক্রসের ট্রেনিং নিয়ে ভালই হয়েছে…।

আমারও তাই বিশ্বাস। এখন চুপ কর তো! খারাপ লাগলে শুয়ে পড়।

ব্ল্যাঙ্কেটটা আবার আগের মত ভাজ করে রেখে দিল মুসা। তারপর রওনা। হলো তৃণভূমির কিনারে, আগুন জ্বালানোর জন্যে লাকড়ি জোগাড় করতে। প্রথমে। যেখানটায় আশ্রয় নিয়েছিল, বিমান বিস্ফোরিত হলে আত্মরক্ষার জন্যে, সেখানটায় এসে জড় করল কাঠকুটো। আগুন যদি জ্বালতেই হয়, জ্বালবে বিমান আর ট্যাঙ্কের পেট্রোল থেকে দূরে। সাবধান থাকা ভাল।

সেসনার ভেতরে রয়েছে এখনও কিশোর। একটা পানির পাত্র খুঁজছে। আচমকা চিৎকার উঠল, অ্যাই, শুনছ তোমরা, একটা গোলমাল হয়ে গেল!

বিমানের কাছে দৌড়ে এল মুসা আর রবিন। ওদের পেছনে এলেন মিলফোর্ড।

যন্ত্রটা, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর, কাজ করছে না। মে-ডে পাঠানোর কথা যেটার।

কেন? জানতে চাইলেন মিলফোর্ড।

বাক্সটা খুলল কিশোর। লাল একটা আলো জ্বলে-নিভে সঙ্কেত দেয়ার কথা। ওটা দেখে বোঝা যায় যে, সঙ্কেত দিচ্ছে যন্ত্রটা। তারটার আর কানেকশনগুলো। ঠিকই আছে। গোলমালটা ব্যাটারির। মনে হয় ডেড।

ডেড? হতাশার ভঙ্গিতে প্রতিধ্বনি করল যেন রবিন।

তার মানে সাহায্য চেয়ে সিগন্যাল পাঠাচ্ছে না? মুসাও খুব হতাশ। বড় বড় হয়ে গেছে চোখ।

ব্যাটারি না থাকলে পাঠাবে কি করে? প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করল কিশোর।

খাইছে! হাতের আঙুলগুলো মুঠোবদ্ধ হয়ে গেল মুসার। বেড়ে যাচ্ছে। হৃৎপিণ্ডের গতি, অ্যাড্রেনালিন পাম্প করতে আরম্ভ করেছে। কি সাংঘাতিক বিপদে পড়েছে বুঝতে পারছে।

প্রথমে গেল ইলেকট্রিক সিসটেম, আনমনে মাথা নাড়ছে রবিন, এখন ব্যাটারি! অসুস্থই বোধ করছে সে।

গেলাম তাহলে আমরা! মুসা বলল।

ইলেকট্রিক্যাল সিসটেম মাঝে মাঝে খারাপ হয়, মিলফোর্ড বললেন, যদিও খুব রেয়ার। কানেকশনে গোলমাল থাকলে হয়। তবে ব্যাটারি খারাপ হয় না, ফুরিয়ে যায়। বদলে নিলেই হয়। আসলে, চেক করেনি, নতুন ব্যাটারিও আর লাগায়নি। ভুলের জন্যেই এটা ঘটল।

আর এই ভুলের কারণেই মরতে বসেছি আমরা, তিক্ত কণ্ঠে বলল মুসা।

কিন্তু কিছু করার নেই। পাইনের বন থেকে শিস কেটে বেরিয়ে আসছে বাতাস, বয়ে যাচ্ছে বিশাল ঘেসো প্রান্তরের বুকে ঢেউ খেলিয়ে। ওদের পেছনে ঝকঝকে পরিষ্কার নীল আকাশে মাথা তুলে রেখেছে পর্বতের চূড়া।

বেহশত, আবার আনমনে মাথা নাড়তে লাগল রবিন সেদিকে তাকিয়ে।

দেখেই মজে যাওয়ার কোন কারণ নেই, সাবধান করলেন মিলফোর্ড। শোননি, স্বর্গেও সাপ থাকে।

আমি মজিনি, কিশোর বলল। এখানে কি কি থাকতে পারে, ভাল করেই জানি। বিষাক্ত সাপ, হিংস্র মাংসাশী জানোয়ার, ভূমিধস, দাবানল, বজ্রপাত, আর আরও হাজারটা বিপদ ওত পেতে আছে। ফল ধরে থাকতে দেখা যাবে গাছে গাছে, দেখলেই খেতে ইচ্ছে করবে, কিন্তু খেলেই মরতে হবে, এতই বিষাক্ত।

আচ্ছা, হঠাৎ যেন আশার আলো দেখতে পেল রবিন, বাবা, ডায়মণ্ড লেকে যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ, সে কি করবে? সময়মত তুমি না পৌঁছলে কিছু করবে না?

হয়তো করবে। ফোন করবে আমার অফিসে। ও না করলে আর কেউ করবে না। বাড়িতে বলে এসেছি আমরা সবাই, দিন তিনেক লাগতে পারে। তিন। দিন না গেলে কেউ খবর নেয়ার কথা ভাববেই না।

বাহ, চমৎকার! বিড়বিড় করল মুসা।

মুসা, অত ভেঙে পড়ছ কেন? এ রকম পরিস্থিতিতে অনেক পড়েছ তোমরা। দুর্গম জায়গায় আটকা পড়েছ, বেঁচে ফিরেও এসেছ। এসব অবস্থায় প্রথমে কি করা উচিত?

প্রথমে দেখা দরকার, কি কি জিনিস আছে আমাদের কাছে। আমার কাছে আছে গায়ের এই পোশাক।

মুসার পরনে জিনস, পায়ে টেনিস শু, গায়ে কালো টি-শার্ট, বুকে সোনালি অক্ষরে বড় বড় করে লেখাঃ পিঙ্ক ফ্লয়েড। একটা জ্যাকেট আছে, একটা ছোট ছুরি আছে, সুটকেসে আরও কিছু কাপড় আছে। রবিন আর কিশোরকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের কাছে কি আছে?

আমার কাছেও এইই, রবিন বলল। ওর জিনসে রয়েছে ক্যালভিন ক্লেইন, আর টি-শার্টে ব্যানানা রিপাবলিক মিনিস্টার অভ কালচার-এর মনোগ্রাম। ছুরিটা বাদ।

আমার কাছেও ছুরি নেই, মিলফোর্ড বললেন। তার পরনে জিনসের প্যান্ট আর শার্ট, মাথায় ক্যাপ।

ক্যাম্পিঙের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহ একটা ব্যাকপ্যাক থাকলে এখন খুবই ভাল হত, ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। তবে মনে হয় তিনটে দিন কাটিয়ে দিতে পারব কোনমতে। প্রতিকূল পরিবেশ, খাওয়াও তেমন জুটবে বলে মনে হয় না, তবু…

তেমন জুটবে, না মানে? কথাটা ধরল রবিন। তার মানে কিছু খাবার তোমার কাছে আছে?

মাথা নাড়ল কিশোর, না, খাবার আমার কাছে নেই, তবে…

তবে কি? তর সইছে না মুসার। জলদি বল!

যে ভাবে বলছ, কিশোর বলল, ধরেই নিয়েছ, খাবার আছে আমার কাছে।

না হলে বললে কেন?

 হ্যাঁ, বাবাআ, মিলফোর্ডও অধৈর্য হয়ে উঠছেন, থাকলে বের কর না!

শ্রাগ করল কিশোর। আসছি, বলে গিয়ে ঢুকে পড়ল বিমানের ভেতরে।

এত দেরি কেন? বাইরে থেকে ডেকে বলল মুসা, মাইক্রোওয়েভে খাবার তৈরি করছ নাকি?

একটা ডাফেল ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর। টকটকে লালের ওপর সাদা সাদা ডোরা। চট করে চোখে পড়বার জন্যে বেশ কায়দা করে লেখা রয়েছেঃ আই কেম ফ্রম, পিজা হ্যাঁভেন, ই। কাগজে মোড়া কিছু হালকা খাবার আর ক্যাণ্ডি বের করল সে।

দাও দাও, জলদি দাও! হাত বাড়াল মুসা। আর পারি না…

খাবারগুলো ভাগাভাগি করে নিল ওরা। সাধারণ জিনিস, এখন সেগুলোই রাজকীয় মনে হলো।

এগুলো আনতে গেলে কেন? ক্যাণ্ডিতে কামড় বসিয়ে জিজ্ঞেস করল রবিন।

মনে করলাম, কিশোরের জবাব, প্লেনে যদি খিদে লাগে। নিয়ে নিলাম।

খুব ভাল করেছ, মুসা বলল। জীবনে যে কটা সত্যিকারের ভাল কাজ করেছ, তার মধ্যে এটা একটা।

তার কথার ধরনে হাসলেন মিলফোর্ড। হ্যাঁ, বি থাকলে বুদ্ধিটাও খোলে।

সেটা খোলানর জন্যেই যেন খাওয়া শেষ করার পর বিমানের গায়ে হেলান দিয়ে চোখ মুদে ভাবতে শুরু করল কিশোর।

 নিজের ভাগের খাবার চেটেপুটে খেয়ে মিলফোর্ড বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ, কিশোর। খাবার যা বাকি আছে, যত্ন করে রেখে দাও। তিনদিন ধরে অল্প অল্প। করে খেতে হবে। বলা যায় না, তিনদিনের বেশিও থাকতে হতে পারে আমাদের।

ওঠা যাক এবার, মুসা বলল। বসে থাকলে হবে না। ঘুরে দেখে আসা। দরকার, আশেপাশে ঘরবাড়ি, আছে কি-না। রেঞ্জারের কেবিন থাকতে পারে। কিংবা ক্যাম্পগ্রাউণ্ড, কিংবা রাস্তা। পানিও লাগবে আমাদের। লাকড়ি কুড়ানোর সময় পানির শব্দ শুনছিলাম। কাছেই কোথাও ঝর্না আছে। হাত তুলে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে দেখাল সে। ঝর্নার ধারেই করা হয় ক্যাম্পগ্রাউণ্ডগুলো, কাজেই…

..থাকলে ওদিকটায় থাকতে পারে, কথাটা শেষ করে দিল কিশোর। বিমানের ভেতর থেকে দুই কোয়ার্টের একটা প্লাস্টিকের বোতল বের করে এনে মুসাকে দিয়ে বলল, এটা নিয়ে যাও। পানি আনতে পারবে।

কমলার রস ছিল বোতলটায়, এখন খালি। আগ্রহের সঙ্গে সেটা হাতে নিয়ে মুসা বলল, গুড। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল ওটা, ফুটোটুটো আছে কিনা। নেই। রবিনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, নাও। সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে তারপর পানি ভরবে। আয়োডিন পিল ফেলে দেবে ভেতরে, যাতে নিশ্চিন্তে খাওয়া যায়।

বোতলটা নিল রবিন। তুমি কি করবে?

দক্ষিণে হাত তুলল আবার মুসা। ওদিকে বনের ভেতরে একটা পায়েচলা পথ। ঢুকে গেছে দেখেছি। বুনো জানোয়ার চলার পথ হতে পারে। বলা যায় না, কপাল। খুলেও যেতে পারে। হয়ত মানুষেই তৈরি করেছে ওটা।

ভাল বলেছ, মিলফোর্ড বললেন। যাও, দেখ গিয়ে। আমি ওটাতে চড়ব। তৃণভূমির উত্তর ধার দিয়ে চলে যাওয়া গ্র্যানিটের দেয়ালটা দেখলেন তিনি। একপাশে বেশ ঢালু, চূড়ায় চড়া সহজ। ওপর থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাবে। কি আছে না আছে দেখতে পারব।

পারবে? রবিন বলল, ভাল লাগছে কিছুটা?

 পারব।

কিশোর কি করবে সেটা জানার জন্যে তার দিকে তাকাল তিনজনে।

প্রশ্ন করতে হলো না, কিশোর নিজে নিজেই বলল, আ-আমার মনে হয়…আমার এখানে থাকাই ভাল। কেউ যদি চলে আসে, তাকে বলতে হবে তো আমরা আছি এখানে, চলে যাইনি।

আরও লাকড়ি দরকার আমাদের, মুসা বলল। ভেজা লাকড়ি। বেশি করে জমিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলে অনেক ধোয়া বেরোবে। সঙ্কেত দিতে পারব। স্মোক সিগন্যাল। এই কাজটা তুমি করতে পার, প্লেনের কাছ থেকে দূরে যাওয়া লাগবে না। আরও একটা কাজ, আমাদের সবার সুটকেস থেকেই কিছু কাপড় বের করে তিন-চারটা গাছের মগডালে পতাকার মত উড়িয়ে দিতে পার। আরেক ধরনের সিগন্যাল হয়ে যাবে।

মুসার কথা কিশোর শুনছে বলে মনে হলো না, বিমানের গায়ে হেলান দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে শূন্য দৃষ্টিতে কাজ করার ইচ্ছে নেই, না গভীর চিন্তায় ডুবে গেছে, বোঝা গেল না। মুসা বলেই চলেছে, তারপর, পাথর টেনে মাঠের মাঝে সেগুলো সাজিয়ে এস ও এস লিখবে, যাতে ওপর থেকে কোন প্লেনের চোখে পড়লে বুঝতে পারে এখানে গোলমাল হয়েছে।

গুঙিয়ে উঠল কিশোর। কাঠ দিয়ে একটা কেবিন বানানোর কথাটা আর বাকি রাখলে কেন?

হেসে উঠল অন্য দুজন, রবিন আর তার বাবা।

লাকড়ি কুড়াতে রাজি আছি আমি, নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল কিশোর। আর কিছু পারব না।

তাহলে অনেক বেশি করে আনতে হবে, মুসা বলল। কম হলে চলবে না। অনেক বড় ধোয়া হওয়া চাই…

আসলে আমার বসে থাকাটা সহ্য করতে পারছ না তুমি…

কিছু বলতে যাচ্ছিল মুসা, হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে রবিন বলল, মুসা, তুমি আসল কথাটাই ভুলে যাচ্ছ। আমাদেরকে খাইয়েছে ও। কাজেই এখন ওর কাজগুলো ভাগাভাগি করে আমাদেরই করে দেয়া উচিত। না কি বলো?

তাই তো। এতক্ষণে যেন টনক নড়ল মুসার। চুপ হয়ে গেল। মাথা চুলকে আমতা আমতা করতে লাগল, ইয়ে…মানে…ইয়ে…

হেসে ফেলল এবার কিশোর। মুসাও হাসল। চলি।

হুঁশিয়ার করলেন মিলফোর্ড, চিহ্ন দিয়ে দিয়ে যেও কিন্তু। নইলে বনের ভেতর পথ হারিয়ে ফেলবে।

তৃণভূমির কিনারে এসে আলাদা হয়ে গেল রবিন আর মুসা। দক্ষিণ-পশ্চিমে ঘুরে পাইন বনে ঢুকে পড়ল রবিন। পানির মৃদু শব্দ কানে আসছে তার। সেদিকেই চলল। মুসা ঢুকল দক্ষিণ-পুবের সরু পায়ে চলা পথটা ধরে।

মা বাবার কথা মনে আছে রবিনের। চিহ্ন রেখে যাওয়া দরকার। আশপাশে কোথায় কি আছে না আছে ভাল করে দেখে দেখে চলতে হয়, বনে চলার এটাই নিয়ম, বিশেষ করে অপরিচিত এলাকায়। একটা ট্রিপল পাইন চোখে পড়ল তার। একই জায়গা থেকে তিনটে চারাগাছ গজিয়েছিল, একই গোড়া থেকে, গায়ে গায়ে লেগে সেগুলো এখন একটা হয়ে গেছে। এটা একটা ভাল চিহ্ন। ওরকম ট্রিপল পাইন খুব কম দেখা যায়। তারপর সে পেরোল একটা চ্যাপ্টা পাথর, মাঝখানটা। গামলার মত, বেশ বড়। আদিম ইণ্ডিয়ানরা সম্ভবত পাথর দিয়ে ওখানে কোন ধরনের বাদাম গুড়ো করে আটা তৈরি করত। আরও কিছু চিহ্ন মনে গেঁথে রাখল। সে। অবশেষে খুঁজে পেল পথটা। দেখেটেখে মনে হল জানোয়ারই চলাচল করে। সেই পথ ধরে এগোল সে। কানে আসছে পানির শব্দ, বাড়ছে ক্রমেই।

তারপর হঠাৎ করেই চোখে পড়ল ওটা, বিশ ফুট চওড়া অগভীর একটা নদী। পানিতে বড় বড় পাথর আর ডালপালার ছড়াছড়ি, নদীর বুকে বিছিয়ে রয়েছে নুড়ি। যেখানটায় রোদ পড়ছে চকচক করছে পানি, আর বনের ভেতর দিয়ে যেখানে গেছে, গাছপালার ছায়া পড়েছে, কালো হয়ে আছে সেখানে। টলটলে পরিষ্কার পানি, নিশ্চিন্তে খাওয়া যায় মনে হয়।

বায়োডিগ্রেডেবল সাবান দিয়ে কমলার রসের বোতলটা ভালমত ধুয়ে নিল রবিন। ঝাড়া দিয়ে ভেতরের পানির কণা যতটা সম্ভব ফেলে দিয়ে পরে রোদে শুকিয়ে নিল। পানি ভরে তাতে আয়োডিন পিল ফেলে দিল।

উঠে দাঁড়িয়ে পাহাড়ী নদীর এপাশ ওপাশ ভাল করে দেখতে লাগল সে। লোকজন কি আছে? ক্যাম্পগ্রাউণ্ড থাকলে নদীর পাড়েই কোথাও আছে। কোথায়? উজানে, না ভাটিতে?

বিমান থেকে দেখা উপত্যকাটার কথা ভাবল সে। তৃণভূমির পশ্চিমেই কোথাও রয়েছে। ওর অনুমান ঠিক হলে এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার উত্তরে থাকবে উপত্যকাটা। এত সুন্দর একটা জায়গায় ক্যাম্পগ্রাউণ্ড থাকাটা স্বাভাবিক।

উজানের দিকে রওনা হল রবিন। নদীর তীর ধরে। বড় পাথর আর গাছপালা পড়ছে মাঝে মাঝেই, ঘুরে ওগুলো পার হয়ে আসছে। কোথাও কোথাও জন্মে আছে কাটাঝোপ, কোথাও বা জলজ উদ্ভিদ পানি থেকে উঠে এসেছে পাড়ের ভেজা মাটিতে। যতই এগোচ্ছে পানির শব্দ বাড়ছে।

 কয়েকটা লাল ম্যানজানিটা গাছ জটলা করে জন্মে রয়েছে এক জায়গায়, সেটার পাশ ঘুরে একটুকরো খোলা জায়গায় বেরোল সে। নদীতে এখানে তীব্র স্রোত। ওপর থেকে অনেকটা জলপ্রপাতের মত ঝরে পড়ছে পানি।

অপরূপ দৃশ্য। কোটি কোটি মৌমাছির মিলিত গুঞ্জন তুলে পড়ছে পানি, অসংখ্য ঘূর্ণিপাক তৈরি করে ছুটে চলেছে ভাটির দিকে।

বাতাসে পানির কণা। ভেজা বাতাসে শ্বাস নিতে হচ্ছে রবিনকে। জলপ্রপাত থেকে ধীরে ধীরে ওপর দিকে দৃষ্টি ভুলতে লাগল সে। নাটকীয় ভঙ্গিতে প্রপাতের দুদিক থেকে উঠে গেছে উঁচু পাহাড়ের চূড়া। কঠিন পাথরে গভীর নালা কেটে দিয়েছে পানি।

বিমান থেকে দেখা প্রপাতটা যদি এটাই হয়, তাহলে উপত্যকাটা রয়েছে। পাহাড়ের ওই পাশেই। দেখতে হলে ওই পাহাড়ে চড়তে হবে, পাথরের দেয়াল বেয়ে। প্রশ্ন হলো, কোনখান থেকে শুরু করবে?

গ্র্যানিটের দেয়ালে একটা জায়গা দেখা গেল, যেখানে পাথরে চিড় ধরে আছে, পা রাখা যাবে ওখানটায়। পানির বোতলটা রেখে, পাথরের একটা স্তূপ পেরিয়ে চিড়টার কাছে চলে এল সে। উঠতে শুরু করল দেয়াল বেয়ে। পা লাগলেই খসে যাচ্ছে আলগা পাথর, ঠোকর খেতে খেতে নেমে যাচ্ছে নিচে। পা ফসকালে রবিনকেও ওভাবেই পড়তে হবে, কাজেই সাবধান রইল। খুব ধীরে, দেয়ালের গা থেকে বেরিয়ে থাকা শেকড় ধরে, পাথরের খাঁজে পা রেখেই উঠে চলল সে।

হঠাৎ করেই ঘটল ঘটনাটা।

ওপর থেকে কয়েকটা ছোট ছোট নুড়ি এসে পড়ল তার মাথায়। গুমগুম শব্দ কানে এল।

ওপরে তাকাল সে। বিশাল এক পাথর নেমে আসছে, সঙ্গে নিয়ে আসছে ছোট বড় আরও একগাদা পাথর, মাটি, ধুলো, ওর সামান্য ডানে।

ধস নেমেছে পাহাড়ে! ধেয়ে আসছে তাকে থেঁতলে দেয়ার জন্যে।