১৬. স্টিয়ারিঙের ওপর ঝুঁকে

স্টিয়ারিঙের ওপর ঝুঁকে রয়েছে মুসা। যতটা সম্ভব গুলির নিশানা থেকে সরে থাকতে চাইছে। কয়েকটা মোচড় দিয়েই গাড়ির নাক ঘুরিয়ে ফেলল, ছুটল খোলা জায়গাটার দিকে। জোনসের চওড়া মুখে বিস্ময় দেখতে পেল সে।

তারপরই ছুটে আসতে লাগল বুলেট। বিধতে লাগল গাড়ির শরীরে। একপাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

এই, সবাই ঠিক আছ? চিত্তার করে জিজ্ঞেস করল মুসা।

আছি! চারটা কণ্ঠই জবাব দিল।

আরও একঝাঁক বুলেট এসে বিধল গাড়ির শরীরে। আরেক ঝাঁক ধুলো ওড়াল রাস্তায় লেগে। মাটির কণা লাফিয়ে উঠল। চাকা ফুটো করতে চাইছে।

বার্চ আর পাইন বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে সরু রাস্তাটা, সেটা ধরে ছুটেছে মুসা।

জোনসের পাশে এসে দাঁড়ালেন গভীর চেহারার মোড়ল, উত্তেজিত হয়ে কথা বলছেন। হাত তুলে গুলি থামানর নির্দেশ দিল জোনস। বেল্ট থেকে ওয়াকি-টকি খুলে নিয়ে কথা বলতে শুরু করল।

পাশ দিয়ে গাড়িটা ছুটে বেরোনর সময় এদিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল সে, রাগ দেখানর পরিবর্তে একটা হাসি দিল। রহস্যময়, শয়তানি হাসি। কারণটা বুঝতে পারল না মুসা। ওরা পালিয়ে যাচ্ছে। ধরে রাখতে পারছে না। তাহলে হাসল কেন লোকটা?

আমাদেরকে কিছু করছে না ওরা! চেঁচিয়ে সঙ্গীদেরকে জানাল মুসা।

আঁকাবাঁকা সরু পথ ধরে তীব্র গতিতে চলেছে গাড়ি। অ্যাক্সিলারেটর চেপে ধরে রেখেছে মুসা। গতিবেগ আর বাড়ানোর সাহস করতে পারছে না। রাস্তায় একটু পর পরই বাঁক, বিশ-পঁচিশ গজের বেশি দেখা যায় না মোড়ের জনে) রাস্তাও খারাপ। এপাশ ওপাশ ভীষণ দুলছে গাড়ি। গাছের ডালে ঘষা লাগছে।

এতক্ষণে জোনসের হাসির কারণটা বুঝতে পারল মুসা। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল।

কি হলো? চিৎকার করে উঠল কিশোর।

সামনে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে জোনস কোম্পানির বিশাল এক ট্রাক। হিলারি কিংবা অন্য কেউ চালান দিয়ে এসেছিল বোধহয়, তাকে রেডিওতে নির্দেশ দিয়েছে জোনস। মুসা যেটা চালাচ্ছে সেটাও অনেক বড় গাড়ি। ট্রাকটা যেভাবে। পথ জুড়ে রয়েছে, তাতে ছোট ফোক্সওয়াগেনকেও পাশ কাটিয়ে নেয়ার জো নেই। এটা তো অসম্ভব।ট্রাকের সামনে পেছনের বাম্পারের সঙ্গে গাছ ছুঁয়ে আছে।

ফাঁদে পড়েছি! চিৎকার করে জানাল মুসা।

স্কিড করে থেমে গেল গাড়ি। ট্রাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল হিলারি, হাতে এম-১৬, মুসার দিকে তাক করা। বেল্টে ঝুলছে ওয়াকি-টকি।

জানালার কাছে উঠে এল গাড়ির ভেতরের চারজন।

 এবার? গুঙিয়ে উঠল রবিন।

 নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে আরম্ভ করেছে কিশোর।

অ্যাই, ঘটে যদি কিছুটা বুদ্ধিও থাকে, চেঁচিয়ে আদেশ দিল হিলারি, আর খেপামি কোরো না। ভালয় ভালয় নেমে এসো। তোমাদেরকে মারতে মানা করেছে। বস্, বেঁচে গেলে। তাই বলে গোলমাল সহ্য করব না।

দলবল নিয়ে এখুনি চলে আসবে জোনস, মিলফোর্ড হুঁশিয়ার করলেন।

একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। আমি হিলারির নজর সরিয়ে রাখি, তোমরা সব সারি দিয়ে নেমে একেকজন একেকদিকে পালাও…

অ্যাই, কথা কানে যায় না! ধমক দিয়ে বলল হিলারি। জলদি নাম!

 সাবধান! মিলফোর্ড বললেন।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর। দরজার হাতল ধরে দ্বিধা করল। তারপর লম্বা দম নিয়ে টান দিয়ে খুলে ফেলল পাল্লা। দুহাতে মাথা চেপে ধরে প্রচণ্ড মাথা ব্যথার অভিনয় শুরু করল। ওওওহ! ওওওহ! ককাতে লাগল সে। মাটিতে নেমে টলতে টলতে এগোল হিলারির দিকে। মরে যাচ্ছি! ব্যথায় মরে যাচ্ছিরে বাবা!

ভুরু কুঁচকে ফেলেছে হিলারি। মোরগের মত গলা লম্বা আর মাথা কাত করে তাকিয়ে রয়েছে। চোখে সন্দেহ। কিশোরের দিকে তাক করেছে এখন রাইফেল।

আমি মরে যাচ্ছি! টলতে টলতে আরও দুই পা আগে বাড়ল কিশোর। বাঁচান আমাকে! মরে গেলাম!

সরো! চেঁচিয়ে উঠল হিলারি।

আরেকটু এগোল কিশোর। টলে পড়ে যাচ্ছে যেন এরকম ভঙ্গি করে প্রায় পায়ের ওপর গিয়ে পড়ল হিলারির। ধরে সামলানর জন্যে চেপে ধরল ওর রাইফেল ধরা হাত। ঠেলে রাইফেলের নল সরিয়ে দিল আরেক দিকে।

তাকিয়েই ছিল মুসা। লাফিয়ে নামল মাটিতে। পেছনে রবিন, জন আর মিলফোর্ড।

জুডোর এক প্যাঁচে হিলারিকে মাটিতে ফেলে দিল কিশোর। শরীর দিয়ে চেপে ধরল।

সরো! সরো! চেঁচাতে লাগল হিলারি।

পালাচ্ছে! পেছন থেকে জোনসের চিৎকার শোনা গেল! ধরো ওদেরকে!

দলবল নিয়ে ছুটে আসতে লাগল সে।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। বনের দিকে দৌড় দিয়েছে রবিন আর মিলফোর্ড। মুসা যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে বনে ঢোকার মুখটার দিকে। সেদিকেই ছুটল গোয়েন্দাপ্রধান। ঝড়ো হাওয়ার মত ছুটছে জন, জোনস কোম্পানির একটা ট্রাকের দিকে।

মোড়লও ছুটছেন, কিশোরকে ধরার জন্যে। জনের চেয়ে কম ছুটতে পারেন না। দ্রুত কমছে দুজনের মাঝের দূরতু। সাঁ করে ঘুরে গিয়ে গুহার দিকে ছুটল কিশোর। আরেকটা বুদ্ধি করেছে। একটু আগে জোনসের ওপর কতটা রেগে গিয়েছিলেন মোড়ল, দেখেছে। সেই রাগটাকেই কাজে লাগাতে চায়।

সব চেয়ে কাছে যে গুহাটা রয়েছে সেদিকে ছুটল কিশোর। পেছনে তাড়া করছেন মোড়ল।

ঢুকে পড়ল কিশোর।

চিৎকার করে ডাকলেন মোড়ল, বেরোও! জলদি বেরোও! ওটা পবিত্র জায়গা! তোমাদের ঢোকার অধিকার নেই।

তাহলে জোনস আর তার লোকেরা ঢুকল কি ভাবে? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

ওরা আমাদের মানুষকে সাহায্য করে। ঈশ্বর সেটা বুঝবেন। আমাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে উঠেছিল। মিস্টার জোনস আসাতে বেঁচেছি।

বাঁচলেন আর কই? অসুখে তো মরতে চলেছেন।

 সেটা মিস্টার জোনসের দোষ নয়। বেরোও!

আসুন ভেতরে, ডাকল কিশোর। দম নিয়ে দেখুন, কেমন নাক আর গলা জ্বালা করে। মারাত্মক বিশাক্ত বর্জ্য পদার্থ রয়েছে এই ড্রামগুলোতে।

ড্রামগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লেন মোড়ল, না, তা হতে পারে না। মিস্টার জোনস বলেছেন, এগুলোতে বিস্ফোরক রয়েছে। আমাকে রেখেছেন পাহারাদার। এখানে বাইরের কেউ ঢোকার চেষ্টা করলে তাকে জানাতে বলেছেন। ব্যবসায় প্রতিযোগিতা এখন বেশি, অনেক প্রতিযোগী আছে তার। ওরা তার ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। সে জন্যেই সব কথা বাইরের লোকের কাছে গোপন রাখতে বলেছেন। ওয়াকি-টকি দিয়েছেন যোগাযোগ করার জন্যে। জায়গাটার ভাড়া দেন। তিনি, সেই টাকায় গাঁয়ের লোকে.দরকারী জিনিস কিনতে পারে। এখানে জিনিস রাখার অধিকার তার আছে। যা খুশি রাখুক, আমাদের নাক গলানর কিছু নেই। থামলেন মোড়ল। বিষণ্ণ স্বরে বললেন, ভাড়ার টাকাটা এখন আমাদের খুবই দরকার। গাঁয়ের দুঃসময় যাচ্ছে।

কিন্তু বিষাক্ত বর্জ্য যে অসুস্থ করে ফেলছে আপনাদেরকে একথাটা ভেবেছেন?

কিশোরের চারপাশে একপাক ঘুরলেন মোড়ল। রাইফেলের নল নেড়ে আদেশ দিলেন, বেরোও!

জোনস হল সেই বিদেশী ডাইনী, যার কথা বলেছেন শামান, গুহামুখের দিকে এগোতে এগোতে বলল কিশোর। আবার রোদের মধ্যে বেরিয়ে বলল, আপনি আসলে ভয় দেখাচ্ছেন আমাকে। আমি জানি, গুলি করতে পারবেন না।

দ্বিধা করলেন মোড়ল। তারপর রাইফেলের নল কিশোরের পিঠে ঠেসে ধরে ঠেলে নিয়ে চললেন জোনসরা যেখানে অপেক্ষা করছে সেখানে।

বনের ভেতরে রবিন আর মিলফোর্ডের পিছু নিয়েছে নিওমো।

ডকের সঙ্গে নদীর কিনারে লড়ছে মুসা। এম-১৬টা কেড়ে নিতে চায়।

ভাতিজা! চিৎকার করে জনকে ডাকলেন মোড়ল।

ট্রাকের ড্রাইভিং সিটে চেপে বসেছে জন। ইঞ্জিন স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করছে।

 খোলা দরজার কাছে গিয়ে তার দিকে রাইফেল তাক করল হিলারি।

ভাতিজা, বোকামি কোরো না! আবার বললেন মোড়ল। নেমে এস!

আটকা পড়েছে সবাই, বুঝতে পারছে কিশোর। যে কোন মুহূর্তে এখন। ওদেরকে গুলি করে মেরে ফেলার আদেশ দিতে পারে জোনস। ওদের বাঁচিয়ে রাখার আর কোন কারণ নেই।

ওদেরকে সরিয়ে দেয়ার পর নিশ্চিন্তে আবার এই উপত্যকার রাজা হয়ে বসবে। জোনস। বাধা দেয়ার কেউ থাকবে না। দুষিত করতে থাকবে উপত্যকার পরিবেশ, অসুস্থ হতে থাকবে গাঁয়ের লোক। মরবে। ডাইনী খোঁজা চালিয়ে যাবে ইনডিয়ানরা, কিন্তু খুঁজে আর পাবে না। ঠেকাতেও পারবে না। গান গাওয়া উৎসব চালিয়ে যেতে থাকবে ওরা, একের পর এক মেসেজ পাঠাতে থাকবে ঈশ্বরের কাছে, লাভ হবে না কিছুই।

মেসেজ! অনুষ্ঠানের সময় জনকে দিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছে গান গাওয়া ডাক্তারঃ ডাইনী যা চায়, তাকে তাই দিয়ে দাও, ধ্বংস হয়ে যাবে সে!

 দ্রুত চারপাশে তাকাল কিশোর। জোনস ডাইনী হয়ে থাকলে এখন সে চাইছে ওরা সবাই ধরা পড়ুক। আশার আলো উঁকি দিল তার মনে…মস্ত ঝুঁকি হয়ে। যাবে..কিন্তু আর কোন উপায়ও নেই।

জন! মুসা! রবিন! চিৎকার করে ডাকল কিশোর। সবাই চলে এস! ধরা দাও!

কক্ষণো না! বলেও শেষ করতে পারল না মুসা, ধা করে তার পেটে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাড়ি মারল ডক।

জনেরও নামার ইচ্ছে নেই। কিন্তু হিলারির রাইফেলের দিকে তাকিয়ে ইচ্ছেটা করতেই হল।

ঝোপের ভেতর থেকে মিলফোর্ডের কলার ধরে টেনে বের করে আনল নিওমো। রবিন বেরোল তার পাশে। বাধাও দিল না, কিছু করতেও গেল না।

এই, চলে এসো তোমরা! আবার ডাকল কিশোর। আর কোন উপায় নেই আমাদের!

অবাক হয়েছে সবাই। রেগে গেছে মুসা আর জন। কেবল রবিন বুঝতে পারছে, কোন ফন্দি করেছে কিশোর পাশা। ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে সবাই জোনস যেখানে দাঁড়িয়ে আছে।

আপনি জানেন, মোড়লকে বলল কিশোর, জোনস আমাদের মেরে ফেলবে!

না, মোড়লের এখনও ধারণা, কিশোর ঠিক কথা বলছে না, মারবে না। কেবল বের করে দেবে এই এলাকা থেকে।

বের করে দেয়ার জন্যেই কি আমাদের যে পিকআপটা দিয়েছিলেন, তার ব্রেক নষ্ট করে দিয়েছিল?

কি বললে? জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন মোড়ল, পিকআপটাকে পড়ে থাকতে দেখে এসেছি। কিন্তু… চৌকোনা গম্ভীর মুখটাতে এই প্রথম সন্দেহ ফুটল।

খোলা জায়গাটায় হাজির হলো সবাই। জোনের বাকসটা দেখিয়ে মোড়লকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, ওরকম বাকলস আর কে পরত, বলুন তো?

জনের চাচা, জবাব দিলেন মোড়ল।

জন, দেখাও, কিশোর বলল।

পকেট থেকে বাকলস বের করে মোড়লকে দেখাল জন। উপত্যকায় পেয়েছে। এটা কিশোর। একটা কঙ্কালের পাশে। কঙ্কালের খুলিতে গুলির ফুটো।

চমকে গেল ডক। জোনসের দিকে ফিরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, আমি বার বার বলছি এগুলোকে শেষ করে দেয়া দরকার, ওই বুড়ো ইনডিয়ানটার মত, নইলে গোলমাল করবেই! আপনি শুনছেন না! আমি আর এসবের মধ্যে নেই, চললাম!

ট্রাকের দিকে দৌড় দিল ডক।

এই, দাঁড়াও, গাধা কোথাকার! জোনস বলল।

থামল না ডক। জোনস আর কিছু বলার আগেই রাইফেল তুললেন মোড়ল। গুলির শব্দ হলো একবার।

হাত থেকে উড়ে চলে গেল ডকের এম-১৬। ওটাতেই গুলি করেছেন তিনি। ডকের দিকে ছুটল মুসা।

পাঁই করে ঘুরলেন মোড়ল। রাইফেল তাক করলেন জোনসের দিকে।

দাঁড়ান! দাঁড়ান! হাত থেকে রাইফেল খসে পড়ল জোনসের। পিছিয়ে গেল।

শয়তান! রাগে চেঁচিয়ে উঠলেন মোড়ল, এগিয়ে গেলেন জোনসের দিকে, তুমি আমার ভাইকে খুন করেছ! এখন এই ভাল মানুষগুলোকে খুন করতে যাচ্ছিলে! ধাম করে রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাড়ি মারলেন লোকটার পেটে।

ব্যথায় ককিয়ে উঠল জোনস। বাঁকা হয়ে গেল শরীর। থামলেন না মোড়ল। প্রচণ্ড এক ঘুসি মারলেন জোনসের চোয়ালে। একটা মুহূর্ত বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে রইল লোকটার চোখ। তারপরই বুজে এল চোখের পাতা। বেহুশ হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

কারাতে-লাথি মেরে বসল রবিন, হিলারির চোয়ালে। মেরেই গোড়ালিতে ভর দিয়ে পাক খেল একবার, যে পা-টা ভোলা ছিল ভোলাই রইল, সোজা, টানটান। আরেকবার কারাতের মাই-গেরি লাথি খেল হিলারি, হজম করতে পারল না, টু শব্দটি না করে ঢলে পড়ল বসের পাশে।

ডকের হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে ঘুরিয়ে ফেলেছে মুসা। ভারসাম্য হারাল লোকটা। কনুই দিয়ে তার বুকে কষে এক মাই হিজি-আতি লাগাল সে। আরেকটা লাগাতে যাচ্ছিল, ত্রাহি চিৎকার শুরু করল ডক, থাম! থাম! দোহাই তোমার, আর মের না! আমার কোন দোষ নেই! জোনস যা করতে বলেছে, করেছি! কসম!

এত অনুনয় করলে আর মারে কি করে? লোকটাকে টেনে নিয়ে এল মুসা, ধাক্কা দিয়ে বসিয়ে দিল মাটিতে, বেহুশ বসু আর তার সহকর্মীর পাশে।

তোমাদের কাছে ঋণী হয়ে গেলাম, তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে বললেন মোড়ল ডুম সোবল। মিস্টার জোনস যে এত বড় শয়তান, কল্পনাই করতে পারিনি!

করবেন কি করে? মিলফোর্ড বলল। ভীষণ ধূর্ত লোক। আপনাদেরকে সাহায্য করছে বলে বলে ভুলিয়ে রেখেছিল। ঠেকার সময় উপকার পেয়েছেন, ফলে আপনারাও তার ওপর নরম ছিলেন।

আসলে, কিশোর বলল, ঋণী যদি হতে হয় কারও কাছে, গান গাওয়া ডাক্তারের কাছে হোন। শামানের মেসেজটা কি ভাবে কাজে লাগিয়েছে বুঝিয়ে বলল সে।

এদিক ওদিক তাকাতে লাগল জন। নিওমো কোথায়?

 নিঃশব্দে কখন বনে ঢুকে গেছে ইনডিয়ান লোকটা, খেয়ালই করেনি কেউ।

ওকেও টাকা খাইয়েছে জোনস, মোড়ল বললেন জনকে, টাকা খাইয়ে দলে নিয়ে নিয়েছে। ওই ব্যাটাই পিকআপের ব্রেকটা খারাপ করে রেখেছিল। আরেকটু হলেই মেরে ফেলেছিল বেচারাদের।

তাহলে তো পালানোর চেষ্টা করবে।

যাবে কোথায়? ধরবই আমি ওকে, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলেন মোড়ল। এগুলোকে বেঁধেছেদে এখন ট্রাকে তোলো…

জোনসের গাড়িটায় তুলতে হবে, মিলফোর্ড বললেন। ওটাতে জরুরী দলিলপত্র আছে। নিয়ে যাব পুলিশের কাছে। প্রমাণ এবং আসামী একসাথে পেয়ে গেলে পুলিশের সুবিধে হবে।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালেন মোড়ল। জন যাবে আপনাদের সাথে। কাছের থানাটা কোথায় দেখিয়ে দেবে।

নিওমোর কি হবে? জানতে চাইল মুসা।

আমাদের নিজেদেরও পুলিশ আছে, মোড়ল বললেন।

চাচা হলেন আমাদের পুলিশ প্রধান, বলল জন।

 আমেরিকান সরকারের সঙ্গে আমাদের যে চুক্তি হয়েছে, তাতে কিছু শর্ত দেয়া আছে, মোড়ল জানালেন। তার মধ্যে একটা হল, আমাদের সমাজে যেসব অপরাধ ঘটবে, সেগুলোর সাজা দেবার ভার আমাদের, পুলিশ নাক গলাতে আসবে না। আসামীদেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ক্ষমতাও আছে আমাদের।

দাদা হলেন আমাদের বিচারক, জানিয়ে দিল জন।

জোনস আর দুই সহচরের হাত-পা বেঁধে গাড়িতে ভোলা হলো। মোড়ল গিয়ে বড় ট্রাকটাকে রাস্তা থেকে সরালেন। গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসল মুসা। জানালা দিয়ে মুখ বের করে ফিরে তাকাল। বিদায় জানিয়ে হাত নাড়লেন ডুম। এই প্রথম তার গম্ভীর মুখে হাসি দেখতে পেল সে।

ঘুরে দাঁড়ালেন মোড়ল। হালকা পায়ে ঢুকে পড়লেন বনের ভেতর।

.

ডায়মণ্ড লেকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল গোয়েন্দাদেরকে জন। এই রাস্তাটার কথাই তিন গোয়েন্দাকে বলেছিল তার বোন মালটি, মাত্র আগের দিন, অথচ ছেলেদের মনে হল সেটা হাজার হাজার বছর আগের কথা।

ডায়মণ্ড লেকে পৌঁছল ওরা। ছোট, সুন্দর একটা পার্বত্য শহর। চকচকে সুইমিং পুল পেরিয়ে এল ওরা, গল্ফ কোর্সের পাশ কাটাল। টেনিস কোর্ট, ঘোড়া রাখার জায়গা, ব্যাকপ্যাক কাঁধে পাহাড়ে ঘুরতে বেরোনো ভ্রমণকারী, ছবির মত সুন্দর দামি দামি বাংলো দেখল। ব্যক্তিগত বিমানবন্দরের ওপর ঘুরছে বড় একটা লিয়ারজেট বিমান।

যাক, জোরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল মুসা, এলাম শেষ পর্যন্ত।

আমার খিদে পেয়েছে, ঘোষণা করল কিশোর।

হায় হায়, আমার খিদেটা তোমার পেটে চলে গেল কি করে! হেসে বলল সহকারী গোয়েন্দা! খিদে খিদে তো কেবল আমি করতাম!

মিস্টার মিলফোর্ড বললেন, আমার একটা টেলিফোন দরকার প্রথমে। তারপর গোসল।

রবিন বলল, আমার ডাক্তার দরকার। বলে জানালা দিয়ে মুখ বের করতেই দেখল পথের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনটি সুন্দরী কিশোরী মেয়ে। ওর দিকে চোখ পড়তেই হাসল। হাত নাড়ল একজন। রবিনও তার জবাব দিল। শিস দিয়ে উঠল একটা মেয়ে।

জন তো অবাক। মেয়েরা শিস দেয়? উল্টো হয়ে গেল না ব্যাপারটা?

মুচকি হাসল মুসা। রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলল, তিন গোয়েন্দার অভিধানে উল্টো বলে কোন কথা নেই। এই তো, আমার খিদে কিশোরের পেটে চলে গেল, যে খেতেই চায় না। রবিনের দিকে তাকিয়ে মেয়েরা শিস দেয়, অথচ চিরকাল জেনে এসেছি মেয়েদের দিকে তাকিয়েই ছেলেরা শিস দেয়…

তোমরা আসলেই স্পেশাল, জন বলল। একটা কাজ করা দরকার। দাদাকে গিয়ে বলতে হবে, তোমাদের জন্যে যাতে একটা অনুষ্ঠান করে। তোমাদের ওপর অশুভ শক্তির নজর পড়েছে, সে জন্যেই এত বিপদ গেল। সেটা কাটানো দরকার। তোমরা যাবে তো?

নিশ্চয়ই! সাথে সাথে জবাব দিল মুসা। তোমাদের রান্না সত্যিই চমৎকার! আর তোমার বোন মালটি খুব ভাল মেয়ে!

কি ব্যাপার, মুসা, পেছন থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল রবিন। ঘটনাটা কি?

না, কিছু না! লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি বলল মুসা।

কিশোর তাকিয়ে রয়েছে সিয়েরা মাদ্রের বরফে ঢাকা নীলচে সাদা চূড়ার দিকে। স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে তার সুন্দর মায়াময় চোখ। বিড়বিড় করে আনমনে বলল, প্রেমে যদি সত্যিই পড়তে হয় কারও, তাহলে ওগুলোর…ওই বরফে ছাওয়া পাহাড়, রূপালি ঝর্না, নীল আকাশ, চিল…

অ্যাই, কি বিড়বিড় করছ? জিজ্ঞেস করল রবিন।

চমকে যেন স্বপ্নের জগৎ থেকে ফিরে এল গোয়েন্দাপ্রধান, অ্যাঁ!…না, কিছু না!…ও, থানা এসে গেছে?

‘ডায়মণ্ড লেক পুলিশ স্টেশন’ লেখা বাড়িটার ওপর চোখ পড়েছে তার।