১৩. লোকটার মুখে টর্চের আলো

লোকটার মুখে টর্চের আলো ফেলল কিশোর। ব্রড জেসন।

কে তুমি? বলতে বলতেই হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল ব্রড। কিশোর? সত্যি সত্যি অবাক মনে হলো তাকে। এখানে কি করছ?

হারিকেনের মেজাজ যে খারাপ করানো হয়েছে তার প্রমাণ খুঁজছি।

আবার? তা তো খুঁজবেই। গোয়েন্দা যে তুমি একথাটা ভুলেই যাই।

টিটকারিটা গায়ে মাখল না কিশোর। চাবুকটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস কর, এটা নিয়ে এখানে কি কাজে এলেন?

রাগ কিছুটা গলে গেল ব্রডের। তুমি ঢুকেছ, বুঝতে পারিনি। ভাবলাম, ব্যানারদের চোরটা ঢুকেছে। চুপি চুপি ঢুকতে দেখলাম তো। তবে, বাড়ি লাগাতে চাইলে ঠিকই লাগাতে পারতাম। মিস করেছি ইচ্ছে করেই। সেটা প্রমাণ করার জন্যেই আলোটা নিভিয়ে দিল সে। আরেকবার হিসিয়ে উঠল চাবুক। বন্ধ হয়ে গেল মেডিসিন কেবিনেটের দরজা।

আবার আলো জ্বেলে বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে দাঁড়াল মাইক। তুমি জানলে আসতাম না। কিন্তু অযথা খুঁতখুঁত করছ। ঘোড়াটা চুরি হয়নি।

হয়নি? লোকটার চোখে চোখে তাকিয়ে এক কদম আগে বাড়ল কিশোর, তাহলে ইউনিকর্নের কি হয়েছে বলে আপনার ধারণা?

পালিয়েছে।

আপনি কিছু করেননি?

শক্ত হয়ে গেল ব্রডের চোয়াল। তার মানে আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না তুমি। ভাবছ, যেহেতু একসময় চুরি করতাম, স্বভাবটা এখনও ভাল হয়নি। অকাজ। কুকাজ এখনও করে বেড়াই। ভুল করছ। আর দশজন সৎ কর্মীর মতই কাজ করি। আমি এখানে। ইউনিককেও চুরি করিনি, হারিকেনকেও ওষুধ খাওয়াইনি। কেনই বা করব এসব কাজ?

লিলি যাতে রোডিও জিততে না পারে, সেজন্যে।

কিসের জন্যে? ভুরু কুঁচকে গেল ব্রডের। তোমার কথা বুঝতে পারলাম না। আমি তো চাই লিলি জিতুক।

তাতে যদি বেনি হেরে যায় তাহলেও?

জ্বলে উঠল ব্রডের চোখ। আঙুল শক্ত হলো চাবুকের হাতলে। তুমি ভাবছ লিলিকে স্যাবটাজ করছি আমি?

করছেন না? বেনির জন্যে?

দেখো, অনেক ভুল করেছি জীবনে, আর করতে চাই না। বেনির জন্যে দুর্বলতা আছে আমার, অস্বীকার করছি না। কিন্তু জিততে হলে বেনিকে নিজের ক্ষমতায় জিততে হবে। নিজের বুকে থাবা দিয়ে বলল ব্রড, আমিও রোডিও রাইডার। আমি বিশ্বাস করি, ষড়যন্ত্র করে এসব খেলায় কিছু হয় না। যদি ক্ষমতা থাকে, লিলিকে হারাতে পারবেই বেনি।

বেনিও কি তাই মনে করে?

ওকে নিয়ে আলোচনা করতে চাই না আমি। আরেক দিকে তাকিয়ে বলল ব্রড।

দরজার কাছে চলে এল কিশোর। বেনির জন্যে ইনডিপেনডেন্স ডের রোডিও কতটা জরুরী?

ঢোক গিলল ব্রড। অনেক।

কেন?

 সেটা তোমার জানার দরকার নেই।

আছে। একটা নোট এসেছে লিলির কাছে। তাতে লেখা হয়েছে সে ওই দিন। রোডিওতে যোগ দিলে ইউনিকর্ন মারা যাবে।

নিরেকের কাজ হতে পারে। কিংবা পাইকের। দুটো শয়তানই তো মেয়েটাকে জ্বালিয়ে মারছে, বলতে সামান্যতম দ্বিধা করল না ব্রড।

মাথা নাড়ল কিশোর। ওরা আমার ব্যাগে সাপ রাখতে যায়নি। সাপ। নাড়াচাড়া করতে পারে কিনা ওরা সে ব্যাপারেও আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। গাড়ির নিচে বাজি রাখার সুযোগও ওরা পায়নি।

কিন্তু বেনিই বা কি ভাবে…? থেমে গেল ব্রড। কাঁধ ঝুলে পড়ল। তুমি হভাবছ আমি করেছি? তোমাকে খুন করার চেষ্টা করেছি?

বেনিকে সাহায্য করার চেষ্টা করছেন।

অবাক কথা শোনালে।

তাহলে বোঝান, বেনির জন্যে এই রোডিও কেন এত জরুরী?

বড় বড় হয়ে গেল ব্রডের নাকের ফুটো। বেশ। তাহলে বাপের থাবা থেকে বেরিয়ে যেতে পারবে, মুক্তি পাবে। বিজ্ঞাপনে, সিনেমায় অভিনয় করতে পারবে। রোডিও পুরস্কার হিসেবেই পাবে অনেক টাকা। কেন জরুরী, সেটা বোঝা কি এতই শক্ত?

 বাবার সঙ্গে বেনির সম্পর্ক খারাপ নয়, কিশোর অন্তত সে রকম কিছু দেখেনি, সে কথা ভেবেই বলল, টাকার কি দরকার? বাপের তো অনেক টাকা আছে। একমাত্র সন্তান হিসেবে বেনিই সব পাবে।

পাবে তো ঠিক, পুতুল হয়েও থাকতে হবে। যা করতে বলবে কুপার, তাই করতে হবে ওকে। নিজের কোন ইচ্ছে থাকবে না, ভালমন্দের বিচার থাকবে না। এভাবে কি গোলামি করা যায় নাকি?

আপনাকে নিয়েও নিশ্চয় বেনির নিজস্ব ইচ্ছে আছে?

 অবশ্যই আছে।

বাপের থাবা থেকে বেরোতে নিশ্চয় সব করতে রাজি বেনি? রেসের ঘোড়া

সব নয়, কিশোর, ভুল করছ। নিজের এবং বাপের সুনাম নষ্ট হয় এরকম কিছুই করবে না সে। তুমি কি ইঙ্গিত করছ বুঝতে পারছি। বিশ্বাস না হলে বেনিকেই গিয়ে জিজ্ঞেস কর। এই তো, মিনিট দশেক আগেও আমার সাথে ছিল।

 অবাক হলো কিশোর। উদ্বিগ্নও। যত বার বেনি ডাবল সিতে ঢুকেছে, একটা না একটা অঘটন ঘটেছে। কোথায়?

লেকের ধারে। চুরি করে আমার সাথে দেখা করতে আসে। আমার সাথে ওর মেলামেশা কুপারের পছন্দ নয়। অনেক বলা হয়েছে, আর বলার ইচ্ছে নেই, একথা ভেবেই যেন গটমট করে কিশোরের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল ব্রড। বাইরের খোয়ায় তার বুটের চাপে খচমচ শব্দ হলো।

 আলো নিভিয়ে দিয়ে এল কিশোর। দরজা দিয়ে বাইরে তাকাতে চোখে পড়ল। আকাশ ঢেকে গেছে মেঘে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। জ্যাকেটের কলার তুলে দিয়ে দৌড় দিল সে, লেকের দিকে। ওখানে পৌঁছে বেনিকে পেল না।

ফিরে এল আবার। বাড়ির পেছনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওপরে, লিলির ঘরে। বালিশে পিঠ দিয়ে বসে আছে লিলি। পকেট থেকে ছোট শিশিটা বের করল কিশোর। অর্ধেক ভরা। এটা হারিকেনকে খাওয়ালে কি ঘটবে বলুন তো?

লেবেল পড়ে লিলি বলল, ঘুমিয়ে পড়বে। এটা ডিপ্রেসেন্ট। খুব কমই। ব্যবহার করতে হয়। কোন কারণে ঘোড়া খেপে গেলে কিংবা ব্যথায় অস্থির হয়ে উঠলে খাইয়ে দেয়া হয়। শান্ত হয়ে যায় তখন।

বোধহয় কিশোরের সাড়া পেয়েই ঘরে ঢুকল মুসা। এত দেরি করলে। আমি আর রবিন তো ভাবনায়ই পড়ে গিয়েছিলাম। আর পাঁচ মিনিট দেখতাম, তারপর খুঁজতে বেরোতাম। ওর হাতে একটা আপেল। গেঞ্জিতে সেটা মুছে নিয়ে কামড় বসাল।

উজ্জ্বল হয়ে গেল কিশোরের চোখ। চিৎকার করে বলল, মুসা, এক্কেবারে ঠিক সময়ে আপেলটা নিয়ে হাজির হলে!

বোকা হয়ে গেল মুসা। মানে?

আপেলে করেই ওষুধ খাওয়ান হয়েছে ইউনিকর্নকে। আধ খাওয়া একটা আপেল দেখেছি ওর স্টলে। পরদিন গিয়ে দেখি ওটা নেই।

আরে বুঝিয়ে বল না! হাত তুলল মুসা। চোখের কোণ দিয়ে দেখল রবিনও ঢুকছে। বলছ তো উল্টো কথা। ইউনিকনের মেজাজ খারাপ হয়নি, হয়েছে। হারিকেনের। ইউনিকর্ন চুরি হয়েছে।

 প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাঁপছে তখন কিশোর। একটা ভুল করেছি আমি। ইউনিকর্ন চুরি হয়নি, হয়েছে হারিকেন। কেউ একজন বেরোতে সাহায্য করেছে। ঘোড়াটাকে। তারপর তার পিঠে চেপে চালিয়ে নিয়ে গেছে। ইউনিকর্নের পিঠে কেউ চাপতে পারে না, কিন্তু হারিকেনের পারে। সে রাতে এই ওষুধ খাওয়ানো। হয়েছিল ইউনিকর্নকে, শিশিটা দুই সহকারীকে দেখাল কিশোর।

কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে যেন লিলির চোখ। তারমানে আমি সে রাতে। ইউনিকর্নের পিঠে চড়েছিলাম! এই জন্যেই ফেলে দিয়েছিল ঝাড়া মেরে!

হ্যাঁ, হঠাৎ করে হারিকেনের মেজাজ খারাপ দেখা যাওয়ার জবাবও এটাই, মাথা দুলিয়ে বলল রবিন।

কিশোর বলল, আমার বিশ্বাস বেনিই একাজ করেছে, লিলির দিকে তাকাল সে, আপনাকে থামানোর জন্যে অদলবদল করে রেখেছিল ঘোড়াদুটোকে, একটার স্টলে আরেকটাকে ঢুকিয়ে রেখেছিল।

বেনি? বিড়বিড় করল লিলি, বিশ্বাস করতে পারছি না!

ওর মোটিভ আছে, সুযোগও ছিল। ক্যাম্পিং করেছি যে রাতে সে রাতে বনের মধ্যে ব্রডের সঙ্গে দেখেছি ওকে। সাপটা নিশ্চয় সে-ই এনে ছেড়ে দিয়েছিল আমার। ব্যাগে। ব্যানারদের জিনিস যেদিন চুরি হয় সেদিনও বেনি এখানে এসেছিল।

বারবিকিউতেও ছিল, মুসা বলল।

আজও ব্রডের সাথে দেখা করতে এসেছিল। দরজার নিচে নোটটা ফেলে রেখে যেতে পারে সে, রবিন বলল।

কিন্তু বাজি রেখে গাড়ি পোড়াতে পারে না, প্রশ্ন তুলল লিলি।

ব্রড তাকে সাহায্য করে থাকতে পারে, মুসা বলল। আর বেনিরও না পারার কোন কারণ তো দেখি না।

তোমরা তাহলে এখনও সন্দেহ করো তাকে?

না করার কোন কারণ নেই, কিশোর বলল। বরং করার পক্ষেই যথেষ্ট কারণ আছে।

ঠিক, রবিন বলল। কিশোর, একটা ব্যাপার বুঝলাম না। তুমি বলছ, হারিকেন আর ইউনিকর্নকে বদল করে ফেলা হয়েছে। তাহলে তফাতটা বুঝলাম না কেন আমরা? হারিকেনের খুরের কাছে না সাদা লোম আছে?

ওরকম সাদা সহজেই করে দেয়া যায়, হাসল কিশোর। পারঅক্সাইড ওষুধ। খাইয়ে ইউনিকর্নকে শান্ত করেছে বেনি, তারপর তার পায়ের লোম সাদা করেছে। সেজন্যেই ঘোড়াটার স্টলের কিছু কিছু খড় সাদাটে লেগেছে। ঘোড়ার পায়ে ঢালতে গিয়ে খড়ে পড়ে গিয়েছিল পারঅক্সাইড।

তার পর, কিশোরের মনের কথাগুলোই যেন পড়ছে রবিন, হারিকেনকে বের করে নিয়ে গিয়ে ওর স্টলে ঢোকানো হয়েছে ইউনিকর্নকে।

এবং সবাই মনে করেছে, যোগ করল কিশোর, হারিকেনেরই মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।

বেশ, চলো, বালিশ সরিয়ে বিছানা থেকে নামল লিলি। আমি দেখলেই বুঝব, সত্যিই আসল সাদা, না পারঅক্সাইড দিয়ে করা হয়েছে।

চলুন, কিশোর বলল। শিওর হয়ে নিয়ে বেনির সঙ্গে গিয়ে কথা বলব। আমার ধারণা, ডাবল সির আশেপাশেই কোথাও আছে সে।

চলো। এসব সত্যি হলে বেনিকে আমি ছাড়ব না। জ্বলে উঠল লিলির সবুজ চোখ।

পেছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে চত্বরে বেরোল চারজনে। বাতাস বেড়েছে। ফোঁটা, ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে।

আকাশের এক প্রান্ত চিরে দিয়ে গেল বিদ্যুতের শিখা। বিকট শব্দে বাজ পড়ল। পাহাড়ের মাথায়। আস্তাবলের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল লিলি। সুইচ টিপে আলো জ্বালল। হারিকেনের স্টলের দিকে তাকিয়েই থমকে গেল। অস্ফুট একটা শব্দ বেরোল মুখ থেকে।

স্টলটা খালি!

 পাক দিয়ে উঠল কিশোরের পেট।

এবার? রবিনের জিজ্ঞাসা।

স্টলের কাছে দৌড়ে গেল কিশোর। তার ওপাশের আস্তাবল থেকে বেরোনোর দরজাটা খোলা। জোর বাতাসে দড়াম করে বাড়ি খেল পাল্লা। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল আবার। বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির ছিটে এসে ভিজিয়ে দিতে লাগল কংক্রীটের মেঝে।

এই দরজা দিয়েই ইউনিকর্নকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বুঝতে অসুবিধে হলো না কারও।