১২. ভারি পায়ের শব্দ

লুকিয়ে থেকে কিশোর আর রবিনের কথা সবই শুনতে পেল মুসা। একটু পরেই ভারি পায়ের শব্দ ছুটে চলে গেল তার পাশ দিয়ে।

মুসার কল্পনায় ভেসে উঠল, ভয়ঙ্কর এম-১৬ রাইফেলের চেহারা, যেগুলো বহন করছে জোনস আর তার সহকারীরা। দুই বন্ধুর জন্যে ভাবনা হতে লাগল। তার। জোর করে ঠেলে সরাল মন থেকে দুশ্চিন্তা। ভাবলে কাজ কিছু হবে না। এখন তাকে যা করতে হবে, তা হলো ডায়মণ্ড লেকে পৌঁছানো। নিজেদের কাঁধে। বিপদ নিয়ে তাকে মুক্ত করে দিয়েছে কিশোর আর রবিন, মস্ত ঝুঁকি নিয়েছে, এখন সে যদি কিছু করতে না পারে, সবই বিফলে যাবে।

সারাদিনে অনেক পরিশ্রম করেছে। বিশ্রাম নিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু সময় নেই। আর এই মুহূর্তে আলস্যকে প্রশ্রয় দিলে পস্তাতে হবে। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। পায়ের শব্দ আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার সময় দিল। তারপর চলতে শুরু করল একটা বিশেষ ভঙ্গিতে, লাফ দিয়ে দিয়ে, এভাবে চললে গতিও বাড়বে, ক্লান্তও হবে কম। দুর্গম অঞ্চলে টিকে থাকার জন্যে ট্রেনিং নেয়ার সময় এটা শেখানো হয়েছে ওকে।

ঠাণ্ডা হয়ে আসছে আবহাওয়া। বাতাস বাড়ছে। শরশর কাঁপন তুলছে গাছের পাতায়।

 জন্তুজানোয়ার চলার সরু একটা পথ ধরে এগোল সে। তৃণভূমিতে বেরিয়ে ওটার ধার দিয়ে এগোল পাহাড়ের দিকে। সাবধান থাকল। দেখেছে, ডক আর হিলারি ছাড়া জোনসের সঙ্গে আর কোন সহকারী নেই, তবু বলা যায় না। খোলা জায়গায় বেরোল না কিছুতেই, গাছের আড়ালে আড়ালে থাকল।

পাহাড়ের কাছে পৌঁছেই ওপরে উঠতে শুরু করল। নিচে থাকার চেয়ে এখন ওপরে থাকা নিরাপদ। নির্জন মালভূমিটার ওপরে উঠে হাঁপ ছাড়ল। দম নিতে নিতে তাকিয়ে দেখল নিচে কোথাও কিছু দেখা যায় কিনা। এখানেই কোথাও রবিনের বাবার ক্যাপটা পড়ে ছিল। সম্ভবত এখান থেকেই ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু কেন? জবাব খুঁজে পেল না।

বনে ছাওয়া পর্বতের ঢালের দিকে তাকাল সে। বাতাসের বেগ আরও বেড়েছে। এত ওপরে এমনিতেই বেশি থাকে। পাতলা টি-শার্ট ভেদ করে যেন। ছুরির ফলার মত বিধতে লাগল। জ্যাকেট কোমরে জড়ানো রয়েছে, স্পেস ব্ল্যাঙ্কেটটা পকেটে। দুটোই লাগবে, তবে পরে। রবিনের কাছ থেকে বোতলটা না এনে ভুল করেছে। মনে পড়েছে অনেক দেরিতে। ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না। তখন আর। খাবার বলতে সাথে রয়েছে কিছু ক্যাণ্ডি, তবে এটুকু আছে যে এর জন্যেই ধন্যবাদ দিল ভাগ্যকে।

উত্তরে ঘুরল সে। কাঁধে আর পিঠে পড়ছে রোদ। লক্ষ্য রাখতে হবে এটা। এখন সূর্যই তার একমাত্র কম্পাস।

ঘন হয়ে জন্মে থাকা কতগুলো গাছের কাছে উঠে গেছে পাহাড়ের একটা চূড়া। সেখানে উঠে এল সে। পথ খুঁজতে লাগল। কিছুই নেই, কোন পথই চোখে পড়ল না। শেষে গাছের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে চলল উত্তরে।

খাড়া হয়ে আসছে ঢাল। চলার গতি আপনাআপনিই কমে গেল ওর। দিগন্তের দিকে দ্রুত নেমে চলেছে সূর্য। খাড়াই বেয়ে ওঠার পরিশ্রমে ঘামে ভিজে গেছে ওর শরীর।

একটা জায়গায় এসে সমান হয়ে এগিয়ে গেল কিছুদূর পথ, তারপর আবার। উঠে গেল। _ একটা শৈলশিরায় এসে পড়ল মুসা। দাঁড়িয়ে গেল। তাকিয়ে রয়েছে নিচের দিকে।

অবাক কাণ্ড! অলৌকিক ব্যাপার মনে হচ্ছে ওর কাছে।

পুবে-পশ্চিমে চলে গেছে একটা কাঁচা রাস্তা, ইনডিয়ানদের পথটার দ্বিগুণ চওড়া। মনে হয় এটাই সেই রাস্তা, কাঠ চালান করার জন্যে তৈরি করা হয়েছে, মালটি যেটার কথা বলেছিল।

শৈলশিরা থেকে নেমে এসে পথের ওপর দাঁড়াল মুসা। একটা কাজের কাজ হয়েছে পথটা পেয়ে গিয়ে। দারুণ খুশি লাগছে ওর। অন্ধের মত আর বনের ভেতরে পথ হাতড়ে মরতে হবে না। এখন একটা গাড়ি যদি পেত, ইস্…

হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে গেছে। যেতে হবে আরও অনেক দূর। পঁচিশ তিরিশ মাইলের কম না। হাইওয়েতে পৌঁছে একটা গাড়ি পেলে বেঁচে যেত।

পশ্চিমে চলতে লাগল সে। ডুবন্ত সূর্যের শেষ আলোর উজ্জ্বল বর্শাগুলো এসে লাগছে চোখেমুখে। হাঁটতে হাঁটতেই কোমর থেকে খুলে নিল জ্যাকেটটা। দ্রুত নেমে যাচ্ছে তাপমাত্রা।

ডুবে গেল সূর্য। দেখা দিল ভরা চাঁদ। একটা পুলের কাছে পৌঁছল সে। দুটো সরু নদী পরস্পরকে ক্রসের মত কেটেছে যেখানে, ঠিক তার ওপরে তৈরি হয়েছে পুল। ঠাণ্ডা বাতাসে কুয়াশার মত এক ধরনের বাষ্প উড়ছে। পাইনের গন্ধে বাতাস, ভারি। পানি দেখে পিপাসা টের পেল, কিন্তু খাওয়াব সাহস করতে পারল না।

পুলের অন্য পাশে এসে থামল সে। চাঁদের আলোয় মনে হলো, মূল রাস্তাটা থেকে আরেকটা রাস্তা নেমে চলে গেছে। ভাল করে তাকাতে বুঝল, রাস্তাই। হবে। হয়তো ফরেস্ট সার্ভিসের ফায়ার রোড। নিচের দিকে নেমে গিয়ে এগিয়ে গেছে নদীর ধার ধরে। ঘুরতে আসা মানুষকে ঠেকানোর জন্যেই বোধহয় একটা গেট তৈরি করা হয়েছে এক জায়গায়, নতুন খিল লাগানো, চাঁদের আলোয় চকচক করছে ওটার রূপালি রঙ। সরু রাস্তা আর নদীটা পাশাপাশি এগিয়ে গিয়ে ঢুকেছে। পাহাড়ের মাঝের একটা গিরিপথের মত ফাঁকের ভেতরে।

রাস্তাটা উত্তেজিত করে তুলল মুসাকে। আশা হলো। তবে সেটা মিলিয়ে গেল অচিরেই, যখন মনে পড়ল, এসব জায়গায় ফরেস্ট সার্ভিসের লোক সব সময় থাকে না। ক্বচিত কদাচিৎ দেখতে আসে, সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা। এসব রাস্তা তৈরি করে রাখা হয়েছে দাবানল লাগলে নিভাতে যাওয়ার জন্যে। জরুরী অবস্থা না দেখলে ফরেস্ট সার্ভিসের কর্মীদের এখানে আসার কোন কারণ নেই।

যা করছিল তা-ই করতে লাগল মুসা। আবার এগিয়ে চলা। চলতে চলতেই ক্যাণ্ডি খেয়ে নিল সে। ক্লান্তি বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে ঠাণ্ডা। পর্বতের দিক থেকে ভেসে আসছে কয়োটের ডাক, মন ভারি করে দেয় ওই শব্দ। ভীষণ নিঃসঙ্গতা বোধ চেপে ধরে যেন।

.

মুসা যখন বনের ভেতরে ঢুকে ঘাপটি মেরে ছিল, রবিন আর কিশোর তখন ছুটছে। পেছনে ধাওয়া করছে ভারি পায়ের শব্দ। ওরা যত জোরে ছুটছে, পেছনের লোকগুলো আরও জোরে ছুটছে। না ধরে আর ছাড়বে না।

ওই শব্দ শোনার ভাল দিকও আছে, মন্দ দিকও আছে। ভাল দিকটা হল, লোকগুলো মুসাকে দেখতে পায়নি। আর মন্দ দিকটা হলো ধরা পড়তে যাচ্ছে দুজনে, যদি ওদের চোখে ধুলো দেয়ার কোন ব্যবস্থা এখনই করতে না পারে।

নদীর কাছে পৌঁছে গেল ওরা, ইনডিয়ানদের টুয়ক। নদীর ধার ধরে উজানের দিকে ছুটল। শেষ বিকেলের জোরাল বাতাস নদীর পানি ছুঁয়ে এসে ঝাঁপটা মারছে ওদের মুখে। সালফারের গন্ধ জ্বালা ধরাচ্ছে চোখে।

আগে আগে ছুটছে রবিন। আগের দিন যে পাথুরে পথটা ধরে গিয়েছিল, যতটা সম্ভব সেটাকে এড়িয়ে থাকতে চাইছে। দম ফুরিয়ে গেছে ওদের। ক্লান্তিতে পা আর চলতে চাইছে না। সগর্জনে ঝরে পড়ছে জলপ্রপাত, অনেকগুলো নালা দিয়ে গড়িয়ে চলেছে পানি, রোদ পড়ে চিকচিক করছে।

বাআহ, চমৎকার! প্রপাতের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর, এখানেই ধসের কবলে পড়ে মরতে বসেছিলে নাকি?

হ্যাঁ, ভাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে রবিন। ওই যে, আসছে!

কিশোরও তাকাল সেদিকে। প্রায় আধ মাইল দূরে বড় একটা পাথরের চাঙড়– ঘুরে আসছে তিনজন লোক। সবার আগে রয়েছে জোনস। কাঁধে ঝোলানো এম ১৬ রাইফেল। ওপরের দিকে তাকিয়েই দেখে ফেলল গোয়েন্দাদের। ডক বোধহয় বলল কিছু, এতদূর থেকে তার কর্কশ কণ্ঠ শোনা গেল না, কেবল মুঠি পাকিয়ে নাড়াচ্ছে যে সেটা দেখা গেল।

আর এখানে থাকা চলবে না! কিশোর বলল।

দ্রুত আবার জঙ্গলে ঢুকে পড়ল রবিন। পেছনে রইল কিশোর। কিছুদূর এগিয়ে থামল রবিন। পাহাড়ের খাড়া দেয়ালের দিকে মুখ। হাত বাড়িয়ে একটা খাজ চেপে ধরল। আরেকটা খাজে পা রাখল। বেয়ে উঠতে লাগল সে।

কিশোরও রবিনের মত একই ভাবে এক খাজে আঙুল বাধিয়ে আরেক খাঁজে পা রেখে উঠতে শুরু করল। ককিয়ে উঠল। সারাদিনের দৌড়াদৌড়ির পর এখনকার এই পরিশ্রমটা অসহনীয় লাগছে। কপালের ঘাম চোখের পাতায় পড়ে অস্বস্তি লাগছে, মুখেও ঘাম। হাতের তালু ঘামছে। আঙুল পিছলে না গেলেই হয় এখন।

রবিনের অতটা কষ্ট হচ্ছে না। পাহাড় বেশ ভালই বাইতে পারে সে। ছোট বেলা থেকে এই অভ্যেস। পাহাড়ে চড়তে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে পা-ও ভেঙেছে। তার। পরেও লোভটা ছাড়তে পারে না সে। তবে এই মুহূর্তে ভাল না লেগে বরং বিরক্তিই লাগছে। কোন ব্যাপারে বাধ্য করা হলে যা হয় আর কি মানুষের।

নিশ্চিত ভঙ্গিতে উঠে চলেছে রবিন। একটি বারের জন্যে আঙুল ছুটছে না, পা ফসকাচ্ছে না।

কিশোর অতটা সহজ ভাবে পারছে না। অনেক নিচে রয়ে গেছে সে।

খাড়া দেয়াল বেয়ে প্রপাতের ওপরে উঠে গেছে রবিন। এর ওপাশেই রয়েছে। ইনডিয়ানদের প্রাচীন সমাধি উপত্যকা।

হাত-পা ভীষণ ভারি লাগছে কিশোরের। টনটন করছে। থরথর করে কাঁপছে হাত। মনে হচ্ছে অবশ হয়ে যাবে। এখন হাত অবাধ্য হয়ে গেলে…আর ভাবতে পারছে না সে। গালাগাল করছে নিজেকে, এই পাহাড়ে চড়া আরম্ভ করেছিল বলে। বাঁচতে চাইলে উঠতেই হবে এখন, হাল ছেড়ে দেয়ার আর কোন উপায় নেই।

ঠিক এই সময় ডান পা পিছলাল তার। এতই আচমকা, বুঝতেই পারেনি এরকমটা ঘটবে। মাটি থেকে পঞ্চাশ ফুট ওপরে রয়েছে, প্রপাতের পানির কণা উড়ে এসে আশপাশের পাথরকে ভিজিয়ে বরফের মত পিচ্ছিল করে রেখেছে। ডান পা-টাকে তুলে আনার চেষ্টা করতেই পিছলে যেতে শুরু করল ডান হাত।

মরিয়া হয়ে আঙুলগুলোকে আটকে রাখতে চাইল সে। বুকের খাঁচায় পাগল হয়ে গেছে যেন হৃৎপিণ্ডটা, ধড়াস ধড়াস করে লাফ মারছে, বেরিয়ে আসার ষড়যন্ত্র! অনেক চেষ্টা করছে কিশোর, কিছুতেই আটকে থাকছে না আঙুলগুলো। হাতের দিকে তাকাল একবার। ছুটে গেল আঙুল।

সময় যেন স্থির হয়ে গেছে।

 জায়গামত রয়েছে কেবল এখন ওর বাঁ হাত আর বাঁ পা।

নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে শরীর। ভয়ে দেয়ালের উঁচুতে একপাশের কজা খুলে যাওয়া দরজার পাল্লার মত ঝুলছে সে। এইবার আর আমার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারল না, ভাবল। নিচের পাথরে পড়ে ছেচে ভর্তা হয়ে যাব!

কিশোর! ওর অবস্থা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে রবিন।

 সাদা হয়ে গেছে কিশোরের মুখ।

জলদি মুখ চেপে ধর দেয়ালে! চিৎকার করে বলল রবিন। নিচের দিকে তাকাবে না! ভয় যেন অক্টোপাসের বাহু দিয়ে জড়িয়ে চাপ দিচ্ছে ওর বুকে। কিশোরকে বাঁচাতেই হবে। ডান কাঁধটা নাড়াও! ডান পা সরিয়ে নিয়ে যাও দেয়ালের দিকে। খুব আস্তে।

কিন্তু নড়লও না কিশোর।

কি ব্যাপার? শুনতে পায়নি নাকি? আরও জোরে চিৎকার করে ডাকল রবিন, কিশোর! সাড়া পেল না এবারেও। সাহায্য করতে হলে ওর কাছে যেতে হবে। নামতে শুরু করল সে।

রবিন যে আসছে বুঝতে পারল কিশোর। তবে দেখতে পাচ্ছে না। মৃদু খসখস কানে আসছে। নিজে তো বিপদে পড়েছেই, আরেকজনকেও বিপদে ফেলতে যাচ্ছে মনে হতেই বিদ্রোহী হয়ে উঠল মন। ধমক দিল নিজেকে, এই গর্দভ! ভয় দূর কর। এভাবে মরার কোন অর্থ হয় না!

পৌঁছে গেল রবিন। কিশোরের ফ্যাকাসে মুখে বেপরোয়া ভাব দেখতে পেল সে। তাকিয়ে রইল রবিন। বুঝতে পারল, আবার চালু হয়ে গেছে কিশোরের খুলির ভেতরে সাংঘাতিক সজাগ ক্ষুরধার মগজটা। এইবার ঠিকমত শ্বাস নিতে পারল রবিন। আশা হল, বেঁচে যাবে এযাত্রা ওর বন্ধু।

হঠাৎ ঝটকা দিয়ে আগে বাড়ল কিশোরের মুখ। কেঁপে উঠল ডান, কাঁধটা, আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে শুরু করল দেয়ালের দিকে। তারপর এগোতে শুরু করল ডান পা।

ডান হাতটা নড়ে উঠল। পাথরের গা হাতড়ে হাতড়ে আঁকড়ে ধরার জায়গা। খুঁজছে। পেলও। পা-টা ঢুকিয়ে দিল আরেকটা খাজে। দেয়ালে বুক ঠেকিয়ে বিশ্রাম নেয়ার চেষ্টা করল, যদিও এই অবস্থায় বিশ্রাম হয় না।

হয়ে গেছে, কিশোর, পেরেছ! আনন্দে চোখ দিয়ে পানি এসে যাওয়ার জোগাড় হলো রবিনের। আর ভয় নেই। এসো, ওঠো আমার পিছে পিছে। ওপরে চ্যাপ্টা একটা জায়গা আছে, ঝোপ আছে, লুকিয়ে থাকতে পারব। আমাদেরকে দেখতে পাবে না ওরা। এসো, কিশোর, আর বেশি ওপরে নেই।

শক্ত হয়ে গেছে যেন বাঁ হাত। নড়াতে পারবে না আর কোনদিনই, পাথরের সঙ্গে থেকে থেকে পাথরই হয়ে গেছে। দুত্তোর বলে জোর করে হাতটা সরিয়ে নিয়ে এল কিশোর। ওপরে বাড়াল। ধরল আরেকটা খাঁজ। আত্মবিশ্বাস বাড়ল। আবার উঠতে লাগল।

ওপরে ওপরে উঠছে রবিন। অবশেষে উঠে গেল সরু একটা শৈলশিরায়। শিরার কিনারে গজিয়ে আছে কাঁটাঝোপ। মাথা কাত হয়ে আছে নিচের দিকে। ওই ঝোপের ওপাশে কোনমতে চলে যেতে পারলেই হল, লুকিয়ে বসতে পারবে, নিচে থেকে দেখা যাবে না ওদেরকে।

এসে গেছে ওরা! বলল রবিন, আরেকটু তাড়াতাড়ি করো!

পারল না কিশোর। সেই একই রকম শামুকের গতি। হাত-পা যে আর ফসকাচ্ছে না, এতেই খুশি সে। তাড়াহুড়া করার ক্ষমতাই নেই। দীর্ঘ অনেকগুলো যুগ পার হয়ে যেন অবশেষে রবিনের কাছে উঠে আসতে পারল সে। ওপরে উপুড় হয়ে শুয়ে নিচের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল রবিন। কিশোরের একটা হাত চেপে ধরে তাকে শৈলশিরায় উঠতে সাহায্য করল।

যাক, পারলে শেষ পর্যন্ত! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রবিন।

কিছু বলল না কিশোর। গড়িয়ে গড়িয়ে কোনমতে ঢুকল ঝোপের ভেতর। চুপ করে বসে চোখ মুদল।

কতটা কাছে এল? খসখসে গলায় জিজ্ঞেস করল সে।

অনেক কাছে, রবিন জানাল। দেখো না।

প্রপাত থেকে ওঠা শীতল বাষ্প উড়ছে বাতাসে। উপত্যকার দিক থেকে আসা বাতাসের ঝাঁপটায় উড়ে চলে যাচ্ছে, সেই জায়গায় ঠাই নিচ্ছে নতুন বাষ্প। চোখ মেললেই জ্বালা করে। তবু জোর করে তাকিয়ে রয়েছে জোনস আর তার সঙ্গীদের। দিকে। প্রপাতের কাছে প্রায় পৌঁছে গেছে ওরা।

শয়তানগুলো গেল কোথায়? ফোঁস করে উঠল জোনস। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তাকাতে লাগল পাহাড় আর বনের দিকে।

প্রপাতের গর্জনকে ছাপিয়েও তার কথা শোনা যাচ্ছে। চিৎকার করে বলল, তোমাদের দোষ! গাধা কোথাকার! আটকাতে পারলে না!

এখানেই কোথাও আছে ওরা, বসো! হিলারি বলল।

বের করে ফেলব! বলল ডক।

তাহলে করছ না কেন? খেঁকিয়ে উঠল জোনস। কিছুতেই পালাতে দেয়া চলবে না। ওই খুঁতখুঁতে সাংবাদিকটাকে আটকেই ভেবেছিলাম সব ঠিক হয়ে। যাবে। ছেলেগুলো যে এতটা বিচ্ছু কল্পনাই করতে পারিনি!

সাংবাদিক কথাটা শুনে পরস্পরের দিকে তাকাল দুই গোয়েন্দা।

মনে হচ্ছে, ফিসফিস করে বলল কিশোর, কোন কিছুর তদন্ত করে রিপোর্ট লিখতে এসেছিলেন আংকেল, সে জন্যেই তাকে আটকানো হয়েছে। ডায়মণ্ড লেকের গল্পের সঙ্গে এসবের কোন সম্পর্ক আছে।

ভাবছি, হেরিং লোকটা কে? কি জানে?

এমন ভাবে সারতে হবে, জোনস বলছে, যাতে মনে হয় অ্যাক্সিডেন্ট।

তা করা যাবে। হেরিংকে যা করেছি তা-ই করব। পাথরে মাথা ঠুকে আগে বেহুশ করে নেব। তারপর ফেলে দিলেই হবে, ডক বলল।

আবার একে অন্যের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। খুব চমকে গেছে। জোনসের লোকেরা খুন করেছে হেরিংকে!

না, একই কাজ করতে গেলে সন্দেহ করবে পুলিশ, জোনস বলল। ধরে নিয়ে গিয়ে প্লেনের ভেতরে ভরতে হবে সব কটাকে। ধাড়িটাকে সহ। তারপর দেবে আগুন লাগিয়ে। যাতে মনে হয় ল্যাণ্ড করার সময় পুড়ে মরেছে। আরেকটা অ্যাক্সিডেন্ট। কেউ ধরতে পারবে না।

তা পারবে না, প্রতিধ্বনি করল যেন ডক।

আগে ধর ওদের, জোনস বলল। ডক, তুমি চলে যাও। বিচ্ছুগুলোকে ধরতে সময় লাগবে মনে হচ্ছে। আজ রাতে আরেকটা চালান আসবে। ওটা তুমি সামলাও গিয়ে।

আমি! হতাশ হয়েছে মনে হল ডক।

হ্যাঁ, তুমি। ছেলেগুলোকে ধরে আনব আমরা। তারপর ইচ্ছে হলে আগুন লাগানোর কাজটা তুমিই করো।

উজ্জ্বল হলো ডকের মুখ। ঠিক আছে। ঘুরে জোর কদমে নদীর দিকে রওনা হয়ে গেল সে।

কিসের চালান? রবিনের প্রশ্ন।

হবে কোন কিছু, কিছু ভাবছে কিশোর, রবিনের কথায় মন নেই।

চলো, হিলারি, সঙ্গীকে বলল জোনস, এই প্রপাতের ওপাশে একটা উপত্যকা আছে। ওখানে লুকানোর কথা ভাবতে পারে ছেলেগুলো।

দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করল সে।

হাসল হিলারি, বেরিয়ে পড়ল বেকাতেড়া কুৎসিত দাঁত। কাঁধে ঝোলানো এম-১৬টা একবার টেনেটুনে দেখে বসের পিছু নিল সে-ও। উঠতে আসতে লাগল রবিন আর কিশোর যেখানে লুকিয়েছে।

পাথর হয়ে গেল যেন দুই গোয়েন্দা। লোকগুলো উঠে এলেই দেখে ফেলবে ওদেরকে।