৭. প্রায় এক ঘণ্টা পরে

প্রায় এক ঘণ্টা পরে সুদেষ্ণা নিজেই কফি নিয়ে এল। সে বলল, আপনি না ডাকলেও টের পাচ্ছিলাম, আপনার কফির তেষ্টা পেয়েছে।

বললাম, কর্নেল যাঁদের স্নেহ করেন, তাঁদের সঙ্গে টেলিপ্যাথিক পদ্ধতিতে যোগাযোগ করেন।

সুদেষ্ণা হেসে ফেলল। ঠিক তা-ই যেন।

কর্নেল বললেন, শুনেছি সূক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণ যারা, তাদের সঙ্গে এভাবে নাকি যোগাযোগ সম্ভব।

সুদেষ্ণা কফি তৈরি করে কর্নেলের হাতে তুলে দিয়ে বলল, আচ্ছা কর্নেল, আপনি কি টেলিপ্যাথিতে বিশ্বাস করেন?

তুমি করো নাকি?

সুদেষ্ণা আমাকে কফি দিয়ে বলল, বইয়ে পড়েছি। কখনও প্রমাণ পেলে বিশ্বাস করব।

কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ। প্রমাণ। ঠিক বলেছ। অনেক তত্ত্ব আছে, এখনও যে সবের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে কিছু মানুষের অনুভূতি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, এটা অস্বীকার করা যায় না।

কর্নেল কিছুক্ষণ এইসব নিয়ে বকবক করে গেলেন এবং সুদেষ্ণা খুব মন দিয়ে ওঁর বক্তৃতা শুনল। তারপর উনি হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, তুমি কখনও এ বাড়ির ওই মন্দিরে ঢুকেছ?

সুদেষ্ণা একটু হকচকিয়ে গেল। হ্যাঁ। ছোটবেলায় তো প্রতিদিন ভোরে ফুল রেখে আসতাম রাধাকৃষ্ণের পায়ে। মন্দির সবসময় খোলা থাকত।

তোমার বড়মামার মৃত্যুর পর কখনও ঢুকেছ?

না। তার কত আগে বিগ্রহ কলকাতার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

মন্দিরের তালার চাবি কার কাছে আছে?

 জানি না। ছোটমামার কাছে থাকতে পারে।

মন্দিরের পেছন দিকে একটা ছোট্ট দরজা আছে জানো?

সুদেষ্ণা অবাক হয়ে গেল। দরজা? মন্দিরের পেছনে? জানি না তো! কে বলল আপনাকে?

আমি পেছনের পাহাড় থেকে বাইনোকুলারে দেখেছি।

তা হলে হয়তো ছোটমামা শর্টকাটে রুহা ফলসে স্নান করতে যাওয়ার জন্য দরজা করেছেন।

কিন্তু উনি যান গেটের বাইরে দিয়ে অন্য একটা পথে।

ও, হ্যাঁ। বুঝেছি! সঙ্গে টমকে নিয়ে যান তো! তাই অন্য পথে যান। কুকুর নিয়ে মন্দিরের ভেতর ঢোকা উচিত নয়। বিগ্রহ না থাকলেও মন্দির ইজ মন্দির। তাই না?

ঠিক বলেছ।

সুদেষ্ণা ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু ভাবল। তারপর বলল, কর্নেল! আমি শুধু এক্স ফাইল-এর কথাটা ভাবছি। ওটা কী হতে পারে?

তোমার ছোটমামা নিশ্চয় জানেন।

আমার ধারণা, ওটা বড়মামার উদ্ভাবিত কোনও সায়েন্টিফিক ফরমুলা। জয়ন্তবাবুকে কথাটা বলেছি। তাই না জয়ন্তবাবু?

বললাম, হ্যাঁ। আমি আপনাকে বলেছি, টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন।

 কর্নেল! আপনি কিন্তু এটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, নিশ্চয় দিচ্ছি। সেনসায়েব ফিরে এলে তার কাছে কথাটা তুলব।

বনশ্রী এল এতক্ষণে। বলল, বাহ্ তিতি! তুমি এখনই আসছি বলে এখানে দিব্যি আড্ডা জমিয়েছ।

সুদেষ্ণা বলল, আড্ডা নয়। সিরিয়াস আলোচনা হচ্ছে। ওদের ডেকে আনি।

বনশ্রী হাসল। ওরা দুজনে বিছানায় ফ্ল্যাট হয়ে আছে। উঁকি মেরে দেখে এলাম।

খুলেই বলো না বাবা! ধকল সামলাতে ড্রিঙ্ক–সরি! বলে সুদেষ্ণা থেমে গেল।

কর্নেল বললেন, বসো বনশ্রী! তোমার ডিনারের আয়োজন শেষ?

বনশ্রী কর্নেলের বিছানার পায়ের দিকে বসল। তারপর বলল, তত কিছু আয়োজন নয়। আসলে ভরদ্বাজসায়েব আর সিনহাসায়েবের জন্য আলাদা রান্না করতে হলো। ওঁরা দুজনে নিরামিষ খান।

আচ্ছা বউদি! সুদেষ্ণা ওর পাশে বসে চাপাস্বরে বলল, তুমি কি জানো আমাদের মন্দিরের পেছনে একটা ছোট্ট দরজা করা হয়েছে?

বনশ্রী অবাক হয়ে বলল, তাই নাকি? জানি না তো!

 কর্নেল পেছনদিকে পাহাড়ের ওপর থেকে বাইনোকুলারে দেখেছেন।

তা হলে শ্বশুরমশাই শর্টকার্টে ফলসে স্নানের জন্য দরজা করে রেখেছেন।

আমিও কর্নেলকে তা-ই বললাম। সঙ্গে কুকুর নিয়ে যান বলে–

বনশ্রী তার কথার ওপর বলল, আজ শ্বশুরমশাই মন্দিরের তালা খুলে হরি সিংকে নিয়ে ভেতরে ঢুকেছিলেন। দোতলা থেকে দেখেছি। ভাবলাম, মন্দিরের ভেতরটা পরিষ্কার করাচ্ছেন।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, কখন?

স্নান করতে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে।

সুদেষ্ণা হাসতে হাসতে বলল, হরি সিংকে নিয়ে আমি ছড়া বেঁধেছিলাম। হরি সিং পালোয়ান। এক কিলো ছাতু খান। ওর গায়ে সত্যি হাতির জোর আছে। পাঁচিলের ধারে রাধাচূড়া গাছের তলায় যে পাথরগুলো বেদির মতো সাজানো আছে, সেগুলো হরি সিং বয়ে এনেছিল পাহাড় থেকে। প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড পাথর।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, সেনসায়েব হয়তো পুলিশফোর্স নিয়েই লাখানপুর থেকে ফিরবেন।

সুদেষ্ণা বলল, এবং পাহাড়-জঙ্গলে চিরুনিতল্লাশ শুরু হবে। জয়ন্তবাবু! এই চিরুনিতল্লাশ কথাটা আপনাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় পড়েছি। কম্বিং অপারেশনের বাংলা। তাই না?

বনশ্রী উঠে দাঁড়াল। আমি ওপরে যাই। দুই বন্ধুর অবস্থা দেখি।

সে চলে গেল। সুদেষ্ণা উঠে বারান্দায় উঁকি মেরে বলল, ছোটমামা সকালে বলছিলেন, দোতলার চারদিকে স্পটলাইটের ব্যবস্থা করবেন। কী বিচ্ছিরি অন্ধকার!

কর্নেল বললেন, আচ্ছা তিতি! ডাক্তার পাণ্ডেকে তুমি নিশ্চয় দেখেছ?

হ্যাঁ। বড়মামার সঙ্গে গল্প করতে আসতেন। ছোটমামা এলে তো ঘনঘন আসতেন। ছোটমামার দাবা খেলার নেশা আছে। ডাক্তার পাণ্ডেরও ছিল।

ডাক্তার পাণ্ডে তো মারা গেছেন। ওঁর বাড়িতে এখন কে আছে?

বাড়িতে মিসেস পাণ্ডে মাঝে মাঝে এসে থাকেন। একজন কেয়ারটেকার আছে।

ডাক্তার পাণ্ডে নাকি ৭০ বছর বয়সেও স্বাস্থ্যবান ছিলেন। তোমার বড়মামার মৃত্যুর কত পরে উনি মারা যান?।

সুদেষ্ণা একটু ভেবে নিয়ে বলল, বেশিদিন পরে নয়। বড়মামার মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি, তন্ময়দা আর বউদি এখানে এসেছিলাম। আমরা এখানে থাকার সময় উনি মারা যান। মর্নিং ওয়াক করার অভ্যাস ছিল। বৃষ্টি হয়েছিল রাত্তিরে। পা পিছলে গিয়ে একটা পাথরের স্ল্যাবে পড়ে যান। মাথায় চোট লেগেছিল। ইন্টারন্যাল হেমারেজে মারা যান। আমরা খবর পেয়েই ওঁকে হেথ সেন্টারে দেখতে গিয়েছিলাম। অজ্ঞান অবস্থায় মৃত্যু হয়। খুব হাসিখুশি মানুষ ছিলেন। শুধু একটাই বদনাম ছিল।

কিসের?

সুদেষ্ণা হাসল। যত খাতিরই থাক, টাকার ব্যাপারে ভীষণ প্রফেশনাল। আমাদের সঙ্গে অত ভাব। কিন্তু কারও অসুখ হলে, ফেলো কড়ি মাখো তেল। সুদেষ্ণা হাসল। গভমেন্ট কোলিয়ারিতে একসময় ডাক্তারি করতেন শুনেছি। রিটায়ার করে এখানে বাড়ি করেন। সেই সঙ্গে প্র্যাকটিস।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, যাই হোক, তোমার ছড়াটা বেশ। হরি সিং পালোয়ান/এক কিলো ছাতু খান।

সুদেষ্ণা বলে উঠল, হরি সিং-ই তো দেখতে পেয়ে ওঁকে দুহাতে তুলে হেলথ সেন্টারে নিয়ে গিয়েছিল। রাস্তাটা তো দেখেছেন। একেবারে নিরিবিলি। ওখানে পড়ে থাকতেন। দৈবাৎ কারও চোখে পড়লে তবে ওঁর বাড়িতে খবর দিত।

কর্নেল তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। দৃষ্টিটা অদ্ভুত লাগল আমার। সুদেষ্ণার দিকে অমন করে তাকিয়ে আছেন কেন?

সুদেষ্ণার দৃষ্টি বারান্দার দিকে। এতক্ষণে আমার মনে পড়ল, বারান্দায় একটা আলো আছে। উঠে গিয়ে সুইচ টিপে আলোটা জ্বেলে দিলাম। সুদেষ্ণা বলল, কী আশ্চর্য! আলোটার কথা আমার মনেই ছিল না।

দোতলা থেকে বনশ্রীর ডাক শোনা গেল, তিতি! শুনে যাও।

সুদেষ্ণা বিরক্তি প্রকাশ করে চলে গেল।

কর্নেল মিটিমিটি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে ছড়াটা আওড়ালেন, হরি সিং পালোয়ান/এক কিলো ছাতু খান। ডার্লিং! এই লোকটি সম্পর্কে সাবধান।

চাপাস্বরে বললাম, আপনি সুদেষ্ণার দিকে অমন করে তাকিয়ে ছিলেন কেন?

তোমাকে বরাবর বলেছি জয়ন্ত, আমরা অনেক সময় জানি না যে আমরা কী জানি। সুদেষ্ণা জানে না যে, সে কী জানে।

কোনও-কোনও মেয়ে বয়স যতই বাড়ুক, খুকি থেকে যায়।

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, সুদেষ্ণার মধ্যে নিষ্পাপ সারল্য আছে। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছে। দাদু-দিদিমার স্নেহে বড় হয়েছে। দুই মামাও ওকে খুব স্নেহ করেন। এ ধরনের মেয়েরা কারও কাছে স্নেহ পেলে মন খুলে কথা বলে।

কিন্তু সুদেষ্ণা জানেটা কী?

মুখটি বুজে থাকো। ওসব কথা এখন নয়।

প্রায় আধঘণ্টা পরে সুদেষ্ণা এসে বলল, ছোটমামা ফিরে আসছেন। ওপর থেকে গাড়ির আলো দেখতে পেলাম। আমি গিয়ে দেখি কী ব্যাপার।

কর্নেল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর লনে নামলেন। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটু পরে গেটের দিকে জোরালো হর্নের শব্দ হলো। তারপর সেনসায়েবের গাড়ি আলোর ছটায় দক্ষিণের লন ঝলসে দিতে দিতে পূর্বে পার্টিকোর তলায় এসে থামল। গাড়ির পেছন থেকে দুজন টাইস্যুটপরা ভদ্রলোক নামলেন। রাম সিং সেলাম দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সুদেষ্ণা ছোটমামার বন্ধুদের অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে গেল। সেনসায়েব গাড়ি ঘুরিয়ে গ্যারাজের দিকে নিয়ে গেলেন। রাম সিং তাঁর গাড়ির পেছনে হন্তদন্ত ছুটে গেল।

কর্নেল ফিরে এসে বারান্দায় উঠলেন। বললাম, সেনসায়েব আপনাকে গাড়ির আলোয় দেখতে পেয়েও ভদ্রতা করে বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন না। গাড়ি গ্যারাজে রাখতে গেলেন।

এখন ওঁর ভদ্রতারক্ষার মতো মেজাজ নেই। বলে কর্নেল ঘরে ঢুকে চুরুট ধরালেন। চেয়ারে বসে উনি আমাকে ডাকলেন, জয়ন্ত!

বলুন!

অমন হ্যাংলার মতো দাঁড়িয়ে থেকো না। ভেতরে এস।

আমাদের পাশের ঘরে সাড়াশব্দ শুনে বুঝলাম, সেনসায়েবের বন্ধুরা ওই ঘরে থাকবেন। কর্নেল চুপচাপ বসে চুরুট টানছে। আমিও চুপচাপ বসে পড়লাম।

কিছুক্ষণ পরে টমের চাপা গর্জন কানে এল। সেনসায়েবের গলা শোনা গেল। তিতি! আমি ওপরে যাচ্ছি। ওঁদের জন্য কফি-টফির ব্যবস্থা করো। আমি এখনই আসছি।

কুকুরটা সমানে গজরাতে থাকল। বিরক্তিকর। আজ কুকুরটা বড্ড বেশি গজরাচ্ছে। একটু পরে ভেতরের দরজায় উঁকি মেরে সুদেষ্ণা বলল, কর্নেল! কফি খাবেন তো?

কর্নেল সহাস্যে বললনে, না। আমি তত বেশি কফি খাই না। জয়ন্ত একটু বাড়িয়ে লেখে।

সুদেষ্ণা চলে গেল। তার মুখটা কেমন যেন গম্ভীর। অথবা আমার চোখের ভুল।

কতক্ষণ পরে সেনসায়েবের আবির্ভাব ঘটল। ঘরে ঢুকে কর্নেলের বিছানায় বসে বললেন, আজ আমার জীবনের একটা সাংঘাতিক দিন গেল। ইতিমধ্যে কর্নেলসায়েব সম্ভবত ঘটনাটা শুনেছেন?

কর্নেল বললেন, শুনেছি। আপনারা লাখানপুরে পুলিশ সুপারের কাছে গিয়েছিলেন–

সেনসায়েব দ্রুত বললেন, যেতে পারলে তো? পাহাড়ি রাস্তা। হঠাৎ দেখি, রাস্তার ওপর আস্ত গাছ পড়ে আছে।

বলেন কী! তারপর?

তখনও দিনের আলো আছে। সাড়ে চারটে বাজে। আমার সঙ্গে বন্দুক থাকলে কী হবে? ডাকাতদেরও শুনেছি বন্দুক থাকে। অগত্যা গাড়ি ব্যাক করে একটা জায়গায় ঘুরিয়ে নিয়ে কান্দ্রায় পুলিশ ফাঁড়িতে ফিরে এলাম। এখানকার পুলিশের কোনও ব্যাপারে মাথাব্যথা নেই। সকালে লাখানপুর যেতে পরামর্শ দিল। রাতে লাখানপুর থেকে পুলিশের পেট্রলকার বেরোয়। তারা গাছ-টাছ সরিয়ে ফেলবে। সেনসায়েব শ্বাস ছেড়ে বললেন, অগত্যা মাইনিং এরিয়ায় পি আর ওর কোয়ার্টারে গেলাম। ভদ্রলোক আমার পরিচিতি। ওঁর কোয়ার্টার থেকে রমেশ সিনহা লাখানপুরে এস পি-কে ট্রাঙ্ককল করল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য! উনি কোথায় বেরিয়েছেন। যে ফোন ধরেছিল, এখন সে যদি দয়া করে ওঁকে মেসেজটা দেয়, তাহলে আশা করি এস পি: কোন অফিসারকে পাঠাবেন।

কর্নেল বললেন, সেই চিঠিটা দেখাতে যদি আপত্তি না থাকে—

কোনও আপত্তি নেই। এই নিন।

সেনসায়েব পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা খামেভরা চিঠি কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল সেটা পড়ে দেখার পর ফেরত দিলেন। বললেন, এই এক্স ফাইল জিনিসটা কী?

সেনসায়েব মাথা নেড়ে বললেন, জানি না। আমি এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।

আপনার দাদার ল্যাবে এই নম্বরের কোনও ফাইল আছে কি না খুঁজে দেখা দরকার।

খুঁজব খন। এখন আমার যা মানসিক অবস্থা, কী করব কিছু বুঝতে পারছি না।

কর্নেল একটু পরে বললেন, আজ বিকেলে রুহা প্রপাতে গিয়েছিলাম। সেই খসে পড়া পাথরটা খুঁজে পেলাম। লালমাটি আর ঘাসের চাবড়া আটকে ছিল।

সেন সায়েব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। দেখেছেন? তা হলে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন কী সাংঘাতিক বাঁচা বেঁচে গিয়েছি!

তারপর ঘুরতে ঘুরতে রুহা গ্রামে গেলাম। গিয়ে শুনি এক অদ্ভুত ব্যাপার। কিছুদিন থেকে নাকি প্রপাত এলাকায় বনমানুষ জাতীয় কী একটা জানোয়ার দেখে আদিবাসীরা ওদিকে যাওয়া বন্ধ করেছে।

তা হলে রাম সিং যে গুজবটা শুনেছিল, তা সত্যি। বলে সেনসায়েব আবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। কাল রাতে তন্ময় আর সৌমিত্র কি সেই জানোয়ারটাকেই দেখতে পেয়েছিল?

হ্যাঁ। কারণ আজ ভোরে আমি পাঁচিলের গায়ে কয়েকটা লোম খুঁজে পেয়েছি। বলে কর্নেল আমাকে অবাক করে তার কিটব্যাগের ভেতর থেকে কাগজেমোড়া কয়েকটা লম্বাটে লোম দেখালেন।

সেনসায়েব তা দেখামাত্র বলে উঠলেন, সর্বনাশের ওপর সর্বনাশ। নাহ্, আর এ বাড়িতে থাকা যাবে না। বাড়িটা বেচে দিতে হবে। পূর্বপুরুষের স্মৃতি নিয়ে আর আমার মাথাব্যথা করে লাভ নেই।

কখন সুদেষ্ণা এসে দরজায় কাছে দাঁড়িয়েছিল, লক্ষ্য করিনি। সে বলল, ছোটমামা! কাল রাতে টম লেজ গুটিয়ে পালিয়ে এল কেন, এতক্ষণে তা বোঝা যাচ্ছে।

সেনসায়েব উঠে দাঁড়ালেন। ভরদ্বাজ এবং সিনহাকে ডেকে আনি। কর্নেলসায়েবের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। তারপর সবাই মিলে আলোচনা করে দেখা যাক।

সেনসায়েব বেরিয়ে গেলে সুদেষ্ণা কপট অভিমানের ভঙ্গিতে বলল, ওঃ কর্নেল! আপনি কিন্তু লোম কুড়িয়ে পাওয়ার কথা গোপন রেখেছিলেন। কেন? আমাকে বললে কি আমি তা নিয়ে হইচই বাধ্যতাম?

কর্নেল হাসলেন। জয়ন্তকেও বলিনি। আগেভাগে বললে পরে জয়ন্ত আজ আমার সঙ্গে রুহা প্রপাতের ওখানে কক্ষণো যেত না।

সুদেষ্ণা মুখে আত্মবিশ্বাসের ভাব ফুটিয়ে বলল, আমার সব থিওরি কারেক্ট।

সেনসায়েব তার দুই বন্ধুকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। আমাদের সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষ হওয়ার পর রমেশ সিনহা কর্নেলের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে এর আগে কোথায় যেন দেখেছি। মনে করতে পারছি না।

কর্নেল বললেন, সেনসায়েব বলছিলেন, আপনি বনে-পাহাড়ে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসেন। আমিও তা-ই। কাজেই কোথাও দেখা হতেই পারে।

এর পর যা শুরু হলো, সেটা আলোচনা নয়। যত রাজ্যের উদ্ভট গল্পগাছা। বক্তা শুধু রমেশ সিনহা। তুষারমানব ইয়েতি থেকে গরিলা, তারপর ভূতপ্রেত। কর্নেল, আমি এবং সুদেষ্ণা নীরব শ্রোতা। মাঝে মাঝে সুশীল ভরদ্বাজ এবং সেনসায়েব কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু রমেশ সিনহা তাঁর অ্যাডভেঞ্চারার জীবনের গল্প না শুনিয়ে ছাড়বেন না। বনশ্রী এসে একাকে বলে গেল, রাত দশটা বাজে। এখন খেয়ে নিলে ভাল হয়। তারপর সেনসায়েব ওঁদের দুজয়াকে তাড়া দিয়ে নিয়ে গেলেন।

সুদেষ্ণা বলল, কর্নেল! আপনারা আসুন। আমি আপনাদের ডিনার রেডি করছি।

কর্নেল আস্তে ডাকলেন, তিতি!

 সুদেষ্ণা অবাক চোখে তাকাল। বলুন।

 আমি তোমার একটু সাহায্য চাই।

সে এগিয়ে এসে বলল, বলুন কী করতে হবে?

আজ রাতে তুমি যেভাবে পারো, চুপিচুপি নিচে এসে টমকে বেঁধে রাখবে। পারবে তো?

খুব পারব। টম আমার আদর খেতে ভালবাসে।

কর্নেল হাসলেন। আর একটা কথা। কাল ভোরবেলা যদি দেখ, আমরা তোমাদের বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছি, অবাক হয়ো না। মুখ বুজে থেকো। আর আমার এই কার্ডটা রাখো। কলকাতায় ফিরে আমার সঙ্গে দেখা কোরো। আগে টেলিফোন করে যেও।

সে কী! রহস্যটা ফস না করেই চলে যাবেন?

কলকাতায় গিয়ে সব জানতে পারবে। ব্যস। আর কোনও কথা নয়। যাও, ডিনার রেডি করো। সুদেষ্ণা কর্নেলের দিকে একটু তাকিয়ে থাকার পর ভেতরে চলে গেল।