৩. কর্নেলের কথায়

কর্নেলের কথায় একটু চমকে উঠেছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কুমোরটুলি–মানে বংশীবাবুর কাছে?

হ্যাঁ। বলে কর্নেল টুপি খুললেন টাকে হাত বুলোতে থাকলেন। কী ভ্যাপসা গরম পড়েছে। এ সময়টা একটু-আধটু বৃষ্টি হওয়া উচিত। কী বলো জয়ন্ত?

আমার অন্য কথা বলার আছে, বস।

 বেশ তো। বলো।

আপনি দত্তসায়েবের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। দত্তসায়েব বা তার স্ত্রী অবাক হননি?

মেমসায়েব তাঁর বেডরুমে–দোতলায়। গেটে আর ভেতরে পুলিশ গার্ড দিচ্ছিল। আমার নেমকার্ড পাঠালে দত্তসায়েব ছুটে এলেন। নিচের তলায় ড্রয়িং রুমে আমাকে বসালেন। সবিস্তারে সব বললেন। তারপর হা–জিজ্ঞেস করলেন, নিকুঞ্জবাবু আমাকে নিতে যাননি? আমি বললাম, যোধপুর পার্কে আমার এক বন্ধু হঠাৎ শেষ রাতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অগত্যা ছুটে আসতে হয়েছিল। ওঁরা স্বামী-স্ত্রী একটা ফ্ল্যাটে থাকেন। ছেলেরা বিদেশে। তো তাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করে তার স্ত্রীকে পৌঁছে দিতে এসেছিলাম। ফেরার সময় ভাবলাম, আপনার সঙ্গে দেখা করে কথাটা বলে যাই।

আপনি নিশ্চয় নিজস্ব পদ্ধতিতে তদন্ত-টদন্ত করেছেন?

কর্নেল হাসলেন। মিঃ দত্ত নিজেই আমাকে ঘটনাস্থল দেখালেন। গুলির চিহ্নও দেখলাম। পুলিশ পাঁচিল থেকে বুলেট-নেল খুবলে তুলে নিয়ে গেছে। আর মনে হল, গুলি ছোঁড়া হয়েছিল গেটের পাশে একটা ঝোপের আড়াল থেকে। দত্তসায়েব বল কুড়োতে বেরুনোর পরই আততায়ী ঢুকে পড়েছিল।

দত্তসায়েবের তাকে পালাতে দেখা উচিত!

না। মিসেস দত্ত গেটের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বলটা তার র‍্যাকেটের ঘা খেয়ে পাঁচিলের ওধারে যেখানে পড়েছিল, সেখান থেকে গেট দিয়ে কারও ঢোকা চোখে পড়বে না। তাছাড়া বলটা খুঁজতেও সময় লেগেছিল।

মিঃ দত্ত গুলির শব্দ শুনেছিলেন বললেন!

শুনেছিলেন। কিন্তু তার মন ছিল বলের দিকে।

আততায়ীকে কেউ পালাতে দেখল না, এতে অবাক লাগছে কিন্তু!

একজন দেখেছে। পোর্টিকোর ছাদ থেকে মিসেস দত্তের পরিচারিকা বীণা একটা লোককে পালিয়ে যেতে দেখেছে। প্রোগ্রাম ছিল, মিসেস দত্ত ওপেনিংয়ের পর চেতনাউদ্যানে আজ একঝাক পাখি উড়িয়ে দেবেন। সেই পাখিভর্তি খাঁচা সে ওখানে নিয়ে এসেছিল। দানাপানির ব্যবস্থা করছিল। গুলির শব্দ শোনার পর সে উঠে দাঁড়ায়। একটা লোক গেট ঠেলে চলে যাচ্ছিল। খানিকটা দূরে ভোরের কম আলোতে তাকে বীণা স্পষ্টভাবে দেখতে পায়নি।

একটু পরে বললাম, কিন্তু বংশীবাবুর কাছে যাচ্ছেন কেন?

 কর্নেল ঘড়ি দেখে শুধু বললেন, চলো তো!

 আচ্ছা কর্নেল?

 বলো।

কাল রাতে আপনি বলেছিলেন চেতনা দেবী–মানে মিসেস দত্ত নিজের প্রোটেকশনের ব্যবস্থা নিজেই করবেন বা হয়তো করেও ফেলেছেন। দেখা। যাচ্ছে, আপনার ধারণা–

কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, আমার ধারণা সবসময় সত্য হয় না। আমি তো অন্তর্যামী নই।

হেসে ফেললাম। আমার মনে হচ্ছে, হালদারমশাই মিসেস দত্তকে জোর আশ্বাস দিয়ে থাকবেন বলে প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোকের ক্যারিকেচার করলাম। চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। আমি থাকতে কোন হালায় আপনার ক্ষতি করে?

সাবধান জয়ন্ত! স্টিয়ারিঙের দিকে মন দাও।

 ওঃ বস! আমার গাড়িতে চাপলেই আপনি বড্ড ভীতু হয়ে পড়েন।

পড়ি। তার কারণ তুমি ট্রাফিক আইন মেনে চলো। কলকাতায় ট্রাফিক আইন না মানলে তবেই দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কমে যায়। যত গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটে, তার বেশির ভাগ কিন্তু সুবোধ বালক প্রাইভেট কারের। ট্যাক্সি দুর্ঘটনা তার তুলনায় কম। হ্যাঁ। ট্যাক্সি মানুষ চাপা দিয়ে বা ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়। কিন্তু ট্যাক্সি চিড়েচ্যাপ্টা হয় কদাচিৎ।

কর্নেল এবার কলকাতার ট্রাফিক নিয়ে বকবক শুরু করলেন। ট্যাক্সিচালকদের প্রশংসায় আমার কান ঝালাপালা হচ্ছিল।…..

কুমোরটুলি এলাকায় পৌঁছুতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। ঘিঞ্জি গলির মুখে একখানে গাড়ি রেখে কর্নেলের নির্দেশে নামলাম। গাড়ি লক করে ওঁকে, অনুসরণ করলাম। বংশীবাবুর ওয়ার্কশপ কাছেই একটা টালির ঘরে। সাইনবোর্ডে লেখা আছে : কলাভবন। বললাম, কী অদ্ভুত! রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন থেকে নাম চুরি!

কর্নেল বললেন, ওই দেখ রবীন্দ্রনাথের স্ট্যাচু। এটা বংশীবাবুর ভক্তির পরিচয়।

একেবারে ছবি থেকে নিখুঁত কপি। মনে হচ্ছে, প্যাটপ্যাট করে তাকিয়ে– আছেন জলজ্যান্ত বিশ্বকবি।

হুঁ। প্রকৃত অর্থে ম্যানিকিন বলতে পারো।

ঘরভর্তি নানারকম মূর্তি উল্টো-সিধে-কাত হয়ে ছড়ানো, কোনওটাই আস্ত নেই। কোণের দিকে একটা জলচৌকিতে প্রতিমূর্তির মতোই বসেছিলেন বংশীবাবু। কর্নেলকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য! আসুন! আসুন!

কর্নেল এবং আমাকে বসার জন্য দুটো মোড়া দিলেন বংশীবাবু। একটা বেরঙা সিলিং ফ্যান অদ্ভুত শব্দে ঘুরছিল। আমরা বসলাম। বংশীবাবু বললেন, আগে চায়ের ব্যবস্থা করি।

কর্নেল বললেন, ধন্যবাদ বংশীবাবু! আপনি বসুন। দুটো কথা জিজ্ঞেস করেই চলে যাব।

বংশীবাবু জলচৌকিতে বসে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলেন।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, ২৬ আগস্ট যে ভদ্রলোক ডামির অর্ডার দিতে এসেছিলেন, তার চেহারা কি আপনার মনে আছে?

বংশীবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, স্পষ্ট মনে পড়ছে না। তবে চল্লিশ বেয়াল্লিশ বছর বয়স মনে হয়েছিল। গোঁফ ছিল। চিবুকে একটুখানি দাড়ি ছিল। বেশ শক্তসমর্থ গড়ন। প্যান্টশার্টনা! শার্ট ছিল না। ছবি-আঁকা গেঞ্জি ছিল। আজকাল সবাই যা পরছে-টরছে। আর হা–চোখে কালো চশমা ছিল। সানগ্লাস।

আর কোনও বৈশিষ্ট্য?

গলার স্বর কেমন খসখসে। মানে হেঁপো রুগির মতো। শুধু এটুকুই মনে পড়ছে।

যে লোকটা মাপ দিতে এবং পরে পোশাক দিতে এসেছিল, তার চেহারা মনে আছে?

সে তো একটা ছোকরা। রোগা পাঁকাটি গড়ন। চুলে খুব কেতা ছিল বটে। তবে তাকে দেখলেই চিনতে পারব। মোস্ট অর্ডিনারি চেহারা। বয়স বড়জোর কুড়ি-একুশ হবে।

ডামিটা কোথায় রেখেছিলেন?

বংশীবাবু উঠে গিয়ে দেয়ালের কাছে দাঁড়ালেন। ঠিক এইখানে। ওই যে দেখছেন প্লাইউডের ফস্ সিলিঙ। তিন দিকে ফাটা জায়গাটা দেখতে পাচ্ছেন তো?

পাচ্ছি।

ওই অংশটা ধারালো কিছু দিয়ে কেটে চোর ব্যাটাচ্ছেলে নেমেছিল।

 দেয়ালের বাইরে একটা সরু গলি আছে দেখলাম।

কানাগলি। মোটে হাত তিনেক চওড়া। চোর ডামি নিয়ে ওখান দিয়েই নেমেছিল।

আপনি তো পেছনদিকে থাকেন?

 থাকি মানে, পাখির খাঁচায় বাস। কমন বাথরুম।

কর্নেল উঠে গেলেন। ফল্স সিলিঙের সেই অংশটা দেখতে দেখতে বললেন, আপনি মেরামত করেছেন দেখছি।

জায়গায় জায়গায় পিসবোর্ডের ফালি মেরে পেরেক ঠুকে তাপ্পি দিয়েছি।

কর্নেল পায়ের কাছে তাকিয়ে বললেন, এখানটা কি পরিষ্কার করেছিলেন?

হ্যাঁ। নোংরা কুলকালি পড়েছিল। টালির কুচি। আর হ্যাঁ, আসল কথাটা বলাই হয়নি। কাঠের পাটা থেকে ডামির দুটো পা উপড়ে নিয়েছিল। পাটাখানা দেখাচ্ছি।

বংশীবাবু তাঁর জলচৌকির তলা থেকে কাঠের পাটা বের করলেন। ছোট্ট টুলের মতো গড়ন। তার ওপর নকল জুতোর একটুখানি শুকতলা আটকে আছে। কর্নেল পাটার তলা পরীক্ষা করে বললেন, কংক্রিট?

আজ্ঞে হ্যাঁ। ওজনদার করার জন্য বালি-সিমেন্ট-পাথরকুচি মিশিয়ে কংক্রিট করে দিয়েছিলাম। পাটা ভারী না হলে ডামি খাড়া থাকবে না। কাত হয়ে পড়ে যাবে।

ডামি উপড়ে নিয়ে গেছে চোর। বাহ! বুদ্ধি আছে চোরের!

বংশীবাবু ফিসফিস করে বললেন, এ দুজনের কাজ! বুঝলেন? একজন নেমেছিল। অন্যজন চালে বসেছিল। পাটা থেকে না ওপড়ালে ডামি তুলে নেওয়া সহজ হত না। পাটার ওজন দেখুন।

আমি বললাম, কিন্তু ডামির জুতো তাহলে আস্ত থাকার কথা নয়। কর্নেল সম-১১/১৪

নয়ই তো। একগাদা কালো রঙ মাখানো প্লাস্টার অব প্যারিসের টুকরো পড়েছিল। ঝেটিয়ে ফেলে দিয়েছি। বংশীবাবু খিকখিক করে হেসে উঠলেন। ভাড়াকরা চোর। পায়ের তলাভাঙা ডামি যে দাঁড় করানো যায় না, ব্যাটারা তা। বোঝেই না।

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। চলি বংশীবাবু।

বংশীবাবু দরজার কাছে বিদায় দিতে এসে বললেন, ব্যাপারটা আমার পক্ষে খুব অপমানজনক। আমি রাষ্ট্রপতির পদকপ্রাপ্ত আর্টিস্ট। পুলিশ আমাকে গ্রাহ্যই করল না। তাই অগত্যা আপনার শরণাপন্ন হয়েছিলাম। এর একটা প্রতিকার। হওয়া উচিত কর্নেলসায়েব। এখনও রাগে-দুঃখে মাথা খারাপ অবস্থা।..

কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে দেখি, প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই নেতিয়ে বসে আছেন। কর্নেলকে দেখামাত্র সোজা হয়ে বসলেন। উত্তেজনায়। ওঁর গোঁফ তিরতির করে কাঁপতে থাকল।

কর্নেল বললেন, ভেবেছিলাম আপনি ভবানীপুরে সূর্যবাবুর বাড়ির আনাচে কানাচে ওত পেতে আছেন।

ছিলাম। হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে বললেন। দত্তসায়েবের প্রথম পক্ষের পোলারে দেখলাম।

আলাপ-পরিচয় হল?

নাহ্। মারুতি কার হাঁকাইয়া বাইরাইল। তবে ক্রিমিন্যাল টাইপ ফেস। পাশে একটা মাইয়া ছিল। গার্লফ্রেন্ড ছাড়া আর কেডা হইব?

আপনার লাঞ্চ হয়েছে?

কখন। সেইজন্য চিন্তা করবেন না। হালদারমশাই চাপা গলায় বললেন, এখানে আইয়া ম্যাডামরে ফোন করছিলাম। ওনার মেড সারভ্যান্ট বলল মেমসায়েব অসুস্থ। জিগাইল, কে আপনি? বললাম, কে কে হালদার। ওনারে আমার নাম বলো আর্জেন্ট কথা আছে ওনার লগে। কিন্তু বজ্জাত মাইয়াড়া। কইয়া দিল, মেমসায়েব অসুস্থ। ডাক্তার ওনাকে ডিস্টার্ব করতে নাকি নিষেধ করেছেন।

আমি বললাম, বড্ড টায়ার্ড কর্নেল। এবারে কেটে পড়ি।

কর্নেল চোখ কটমট করে বললেন, খাদ্য নষ্ট করা পাপ। ষষ্ঠীকে বলে গিয়েছিলাম, আজ তোর দাদাবাবুর নেমন্তন্ন।

ষষ্ঠীচরণ পর্দা তুলে উঁকি দিল। সব রেডি বাবামশাই।….

খাওয়ার পর ড্রয়িং রুমে ঢুকে দেখি, হালদারমশাই সোফায় শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন। আমার ভাত-ঘুমের অভ্যাস। কিন্তু জায়গা দখল হয়ে গেছে। অন্য পাশে ডিভান জুড়ে কর্নেলের বইপত্র ছড়িয়ে আছে। সেদিকে এগোচ্ছি দেখে কর্নেল। বললেন, উঁহু। এই চেয়ারটাতে বসে একটু রেস্ট নাও। আধঘণ্টা পরে বেরুব।

অগত্যা চেয়ারে বসতেই হল। বললাম, চেতনাউদ্যানের দিকে পাড়ি দেবেন তো?

নাহ্। দুটো বাজে। প্রায় একশো চল্লিশ কিলোমিটার দূরত্ব।

তাহলে কোথায় বেরুবেন?

একটু জিরিয়ে নাও তো।

হালদারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললাম, মক্কেলের কথা ভুলে গিয়ে গোয়েন্দামশাই কেমন দিবানিদ্রা দিচ্ছেন দেখুন!

মক্কেলের ওপর চটে গেছেন সম্ভবত। ওঁকে ডিসটার্ব করা উচিত হবে না। বলে কর্নেল টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। একটু পরে বললেন, আমি মিঃ রায়ের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।…মিঃ রায়? আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। ইলিয়ট রোড থেকে বলছি।…হ্যাঁ। জানি আপনি অসুস্থ। কিন্তু একটু সময় আপনি দিন। প্লি-ই-জ!..খুব জরুরি কথা।…না না, মিঃ রায়। ফোনে বলা যাবে না।…ঠিক আছে। চারটেতেই হাজির হব রাখছি।

কর্নেল ফোন রেখে হেলান দিলেন। চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে স্বগতোক্তি করলেন, অস্বাভাবিক গরম। কেন যে বৃষ্টি হচ্ছে না।

আপনি কি সূর্যনারায়ণ রায়ের সঙ্গে কথা বললেন?

হুঁ।

ওঁর ফোন নাম্বার কী করে পেলেন?

 ডাইরেক্টরিতে।

 তা হলে সূর্যবাবু একটা প্রাইভেট নম্বরে আলাদা ফোন রেখেছেন কেন?

জিজ্ঞেস করলে আশা করি সদুত্তর পেয়ে যাব।..

আমরা বেরিয়ে পড়লাম পৌনে তিনটেতে। গোয়েন্দাপ্রবর তখনও সমানে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। কর্নেল ওঁকে জাগাতে নিষেধ করেছিলেন।

নিচের লনের পাশে পার্কিং জোনে আমার গাড়ি ছিল। কর্নেল গাড়িতে উঠে বললেন, লিন্ডসে স্ট্রিট।

বললাম, তার মানে ফ্যান্সি টেলার্সে।

কর্নেল কোনও কথা বললেন না। নিউ মার্কেটের সামনাসামনি গাড়ি পার্ক করে আমরা সেই দর্জিখানা খুঁজে বের করলাম। বনেদি দর্জিখানা বটে! বেশ লম্বা-চওড়া ঘর। দেয়ালে দেয়ালে বিবিধ ফ্যাশানের পোশাক পরা সায়েবদের কাটআউট। বাঁদিকে সুদৃশ্য কাউন্টার। গোলগাল ফর্সা রঙের এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক গদিআঁটা চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। কর্নেলকে দেখে কাগজ ভাঁজ করে রেখে অভ্যর্থনা জানাতে ব্যস্ত হলেন।

কর্নেলের সায়েবি চেহারা আর ব্যক্তিত্বই এর কারণ। আমরা ওঁর মুখোমুখি বসলাম। তারপর কর্নেল বললেন, গত ৪ অক্টোবর আপনাদের এখান থেকে একপ্রস্থ পোশাক ডেলিভারি দেওয়া হয়েছিল–মানে, প্যান্ট-শার্ট-কোট ইত্যাদি পুরো স্যুট। এমন কি নেকটাই পর্যন্ত। আপনারা টাইও বিক্রি করেন দেখতে পাচ্ছি। তো—

ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে বললেন, চৌঠা অক্টোবর? কেন স্যার? ফিটিংয়ে তো গণ্ডগোল হবার কথা নয়। ট্রায়াল না দিয়ে আমরা ডেলিভারি দিই না। যাই হোক, স্যুটটা কি সঙ্গে এনেছেন?

না। দোসরা অক্টোবর যে ছেলেটি মাপ আনতে গিয়েছিল, সে একটু গণ্ডগোল করার জন্য ফিটিং ঠিক হয়নি। আসলে যার জন্য স্যুট তৈরি, সে থাকে বিদেশে। মানে–আবুধাবিতে। সেখান থেকে লিখে পাঠিয়েছে।

ভদ্রলোক বললেন, এমন তো হবার কথা নয়। বিনা ট্রায়ালে আমরা স্যুট তৈরি করি না। তাছাড়া দোসরা অক্টোবর মাপ নিয়ে এসে চৌঠা অক্টোবর ডেলিভারি দেওয়াও অসম্ভব।

আপনি চৌঠা তারিখের ক্যাশমেমো দেখুন না!

ভদ্রলোক ব্যস্তভাবে একটা মোটা বাঁধানো খাতা বের করে পাতা ওল্টাতে থাকলেন। বললেন, দোসরা অক্টোবর মাপ নিয়ে এসেছিল বললেন? কী নাম?

আমাকে অবাক করে কর্নেল বললেন, এস এন রায়। ভবানীপুর এরিয়া।

নাহ। ওই নামে তো কোনও অর্ডার ছিল না।

চৌঠা অক্টোবরের ক্যাশমেমোতে তাহলে নামটা পেয়ে যাবেন। কারণ যাকে পাঠিয়েছিলেন, সে নাম ভুল করতেই পারে।

ভদ্রলোক হাসলেন। স্যার! আমরা তিন পুরুষের টেলার। চেনাজানা অ্যারিস্টোক্র্যাট ফ্যামিলি ছাড়া কোথাও আজকাল আর মাপ নিতে লোক পাঠাই না। তাছাড়া দুদিনে স্যুট তৈরি–উইদাউট ট্রায়াল? কী বলছেন?

এস এন রায়– সূর্যনারায়ণ রায়। নদীয়ার এক বনেদি জমিদার পরিবারের মানুষ। আমি ওঁর বন্ধু। নাতির স্যুটের জন্য উনি আমাদের কাছে টেলিফোন করেছিলেন। আপনারা ওবাড়ির বরাবরকার বাঁধা টেলার।

একটু তফাতে এক রোগাটে গড়নের কর্মচারী দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলেন। তিনি বললেন, বড়বাবু! স্পেশাল অর্ডারের খাতা খুঁজুন। আমার যেন মনে পড়ছে, ট্রায়াল ছাড়া একটা স্যুট ডেলিভারি দেওয়া হয়েছিল। গফুর মিয়াকে ডেকে পাঠান না। স্পেশাল অর্ডারের সব কাজ তার ওখানে হয়।

ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, কিন্তু সায়েব বলছেন, সুট তো আরবমুলুকে।

কর্নেল হাসলেন। আমার বন্ধুর শরীরে জমিদারি রক্ত। তাই রেগে আগুন হয়ে গেছেন। এদিকে নিজেও অসুস্থ। তাই আমাকে এসে খোঁজ নিতে বললেন, কত টাকা চার্জ নিয়েছে এবং কার নামে ক্যাশমেমো করা হয়েছে। রায়সায়েবরা ফ্যান্সি টেলার ছাড়া অন্য কোথাও স্যুট করান না।

বড়বাবু স্পেশাল অর্ডারের খাতা খুলে চোখ বুলিয়ে বললেন, দোসরা অক্টোবর তো? এস এন রায় নাম না, স্যার। নেই।

৭৭/১ বসন্ত রায় রোড দেখুন। ওটা ঠিকানা। রায়সায়েবের নাম না। থাকতেই পারে।

নাহ্। ওই ঠিকানাও দেখছি না।

আচ্ছা, দেখুন তো স্পেশাল অর্ডারে ৪-এ গোস্বামী লেন আছে নাকি?

৪-এ গোস্বামী লেন? হা, হ্যাঁ, আছে। বি বি পাল নামে অর্ডার।

 এবার ক্যাশমেমো দেখুন প্লিজ। কত টাকা মেকিং চার্জ নেওয়া হয়েছিল?

বড়বাবু ক্যাশমেমো বই খুঁজে বের করলেন। বললেন, চৌঠা অক্টোবর তো?

 হ্যাঁ।

৪-এ গোস্বামী লেন, বি বি পাল। টোটাল চার্জ ২৫৮০ টাকা।

 হু। দামী কাপড়। কাজেই–

স্পেশাল অর্ডারের চার্জ, স্যার। স্যুটের মেকিং চার্জ ২২০০ টাকা। শার্টের কাপড়ের দাম ধরা আছে দেখছি। আমরাই দিয়েছিলাম। উইদ মেকিং চার্জ ৩০০ টাকা। সিল্কের বাটিক টাই ৮০ টাকা।

ধন্যবাদ। এবার একটা অনুরোধ। আপনাদের স্পেশাল অর্ডারের খাতায় স্যাম্পল হিসেবে কাপড়ের টুকরো আঁটা আছে দেখলাম। রায়সায়েব দেখতে চান, কী কাপড় ওঁর নাতির জন্য পালবাবু কিনেছিলেন। দরকার হলে ফেরত দিয়ে যাব। আমি কাছাকাছি থাকি। ইলিয়ট রোডে। এই নিন আমার কার্ড।

কার্ডটা দেখার পর একটু ইতস্তত করে বড়বাবু সেই নমুনা কাপড়টুকু দিলেন। ইঞ্চিটাক লম্বা, আধইঞ্চি চওড়া। কোনাকুনি কাটা কাপড়। শার্টের কাপড়ের নমুনাটুকুও কর্নেলের অনুরোধে খুলে দিলেন। কর্নেল আবার ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, রোগামতো একটা ছেলে মাপ আনতে গিয়েছিল। কুড়ি একুশের মধ্যে বয়স। সে কি আছে। তাকে একটা কথা বলার ছিল।

বড়বাবু বললেন, নিতাই! স্যার কার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না। আমাদের নিজস্ব স্টাফে তেমন তো কেউ নেই। গফুর মিয়ার ঘরে তেমন কেউ আছে জানিস?

নিতাইবাবু বললেন, গফুরের ঘরে কাজ হয়েছে। গফুর বলতে পারবে।

তুই স্যারকে নিয়ে যা। এর সঙ্গে যান স্যার। পেছনেই ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে।

নিতাইবাবু আমাদের নিয়ে চললেন। কর্নেলের কাণ্ডকারখানা দেখে বিরক্ত হয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না ডামির ব্যাপারটা নিয়ে ওঁর এত মাথাব্যথা কেন?

গফুর মিয়ার দর্জিখানা ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটা গলির মোড়ে। ছোট্ট ঘর। একদঙ্গল খুদে-মাঝারি বড় সাইজের কর্মী গিজগিজ করছে। কেউ বোতামঘর সেলাই করছে। কেউ কাপড় কাটছে। কেউ সেলাই মেশিন চালাচ্ছে। গফুর মিয়ার মাথায় টুপি, মুখে পাকা দাড়ি। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কঁচি দিয়ে কাপড় কাটছিলেন। নিতাইবাবুর মুখে সব শুনে হঠাৎ খাপ্পা হয়ে বলে উঠলেন, কমিন কমজাত। কুত্তাকা বাচ্চা। মেরা ঢাইশও রুপেয় লেকে ভাগা! হাম থানেমে এত্তেলা দিয়া।

নিতাইবাবু হেসে উঠলেন। তুমি মিয়াঁসায়েব আক্কেল সেলামি দিয়েছ। চব্বিশ ঘণ্টা তোমার কাজ চলছে তো চলছেই। আর যত অর্ডার পাচ্ছ, নিচ্ছ। বুঝলেন স্যার? রাস্তা থেকে ছেলে কুড়িয়ে এনে মিয়াসায়েব কাজ শেখায়। তারপর যেই কাজ শেখা শেষ, অমনি কেটে পড়ে।

কর্নেল বললেন, নাম-ঠিকানা জানেন গফুরসায়েব?

গফুর মিয়া বললেন, ছোটু নাম সাব! পিছেকে মহল্লেমে থা। সিরফ ঝোপড়িমে সাব। ছে মাহিনা কাম কিয়া। চার রোজ আগে ভাগ গেয়া হারামি বাচ্চে।

ছোটু? মালুম, ইয়ে পুরা নাম নেহি।

জি সাব। পুরা নাম জাহাঙ্গীর আলি। কেয়া? আপকা কুছু

হ্যাঁ। তো ঠিক হ্যায়।

বলে কর্নেল নিতাইবাবুকে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় দিলেন। পৌনে চারটে বাজে। গাড়িতে উঠে বললাম, ভবানীপুরে ঠিক চারটেয় পৌঁছুনোর গ্যারান্টি দিতে পারছি না বস্।

তুমি রেড রোড হয়ে চলো। তারপর ভিক্টোরিয়ার পেছন ঘুরে পি জি হসপিট্যালের দিকে। দশ মিনিটও লাগবে না।

স্টার্ট দিয়ে চৌরঙ্গি রোডে গিয়ে বললাম, বংশীবাবুর ডামি নিয়ে আপনার এত মাথা ঘামানোর কারণ বুঝতে পারছি না।

আমি নিজেও এখনও বুঝতে পারছি না কিছু। ইনটুইশন? জানি না কিন্তু তোমার কি মনে হচ্ছে না একটা ডামির জন্য ২৫৮০ টাকা প্লাস ৫০০ টাকা খরচ করা হল কেন? সেই ডামিই বা হঠাৎ ওভাবে চুরি গেল কেন? নাহ ডার্লিং। আমি গোয়েন্দা নই। হালদারমশাই প্রকৃত গোয়েন্দা। কিন্তু আমার কাছে কোনও কোনও ঘটনা রহস্যময় মনে হয়। সেই রহস্যভেদ না করা পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাই না।

বরং চেতনাউদ্যানে গেলে জব্বর রহস্যের গন্ধ পেতেন। হালদারমশাই পেয়েছেন। সেই সঙ্গে আপনার পাখিটাখিও দেখা হত।

যাবখন। ওই ন্যাচারাল বার্ড স্যাংচুয়ারির কথা অনেক আগে শুনেছিলাম। যাওয়া হয়নি।

বসন্ত রায় রোডে রায়ভবনে কাঁটায়-কাঁটায় চারটেতে পৌঁছুলাম। পুরনো বনেদি বাড়ি। প্রাসাদ বলাই উচিত। হর্ন শুনে একটা লোক গেটে এসে দাঁড়াল। কর্নেল বললেন, রায়সায়েবকে বলে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার এসেছেন।

লোকটা সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিয়ে বলল, বড়সায়েব আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন, স্যার।

সেই একই ছাদের হলঘর। পুরনো আসবাব। দেয়ালে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড রঙিন পোর্ট্রেট। জীর্ণ পর্দা। এবং দশাসই অ্যালসেশিয়ান। একজোড়া।

রায়সায়েব মোটেও অসুস্থ নন। অন্তত চেহারা দেখে তা মনে হচ্ছিল না। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে নমস্কার করে বললেন, বসুন। কুকুর দুটো গজরানি বন্ধ করে ওঁর দুপাশে সামনেকার ঠ্যাং মুড়ে বসল।

কর্নেল বললেন, শুধু দুটো কথা জানতে এসেছি।

 বলুন।

আপনি কুমোরটুলিতে একটা ম্যানিকিনের অর্ডার দিয়েছিলেন কি?

রায়সায়েব নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকার পর বললেন, না। আপনার প্রশ্নটা খুব অদ্ভুত।

আপনার একটা প্রাইভেট ফোন আছে।

ছিল। আর কাজে লাগবে না বলে জানুয়ারি মাসে ফেরত দিয়েছি।

এখনও সেটা কিন্তু আপনার বাড়িতে কোথাও আছে।

রায়সায়েবের কণ্ঠস্বর ভরাট। হাঁক দিলেন, মন্টু। অমূল্যকে ডেকে আন।

সেই লোকটি ঘরে ঢুকে বললে, অমূল্যবাবু পরশু দেশে গেছেন বড়বাবু। টেলিগ্রাম এসেছিল। আপনি তখন ঘুমোচ্ছিলেন বলে ছোটবাবুকে জানিয়ে গেছেন। ছোটবাবু বলেননি আপনাকে?

না। কিন্তু– রায়সায়েব হঠাৎ থেমে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। তারপর বললেন, অনিকে ডেকে আন।

ছোটবাবু বেরিয়েছেন। ফিরতে রাত্তির হবে বলে গেলেন।

অমূল্যকে আমার একটা টেলিফোন ফেরত দিতে বলেছিলুম। এই ভদ্রলোক বলছেন–

বড়বাবু! সেই ফোনটা তো ছোটবাবু রেখেছেন। বলেননি আপনাকে?

রায়সায়েব প্রায় গর্জন করলেন। এসব হচ্ছে কী? আমি বাড়ির কর্তা, না অনি? বলে তিনি কর্নেলের দিকে ঘুরলেন। অনি–আমার নাতি অনিরুদ্ধ। আবার কি কোনও কেলেঙ্কারি বাধিয়েছে?

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, না, রায়সায়েব। অসংখ্য ধন্যবাদ। আর আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাই না। আমার একটা ম্যানিকিনের অর্ডার দেওয়া ছিল কুমোরটুলিতে। সেটা বদল হয়ে গেছে। তাই হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছি। বলে পকেট থেকে তার একটা নেমকার্ড বের করে রায়সায়েবকে দিলেন।

কার্ডটা নিয়ে রায়সায়েব স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন। আমরা বেরিয়ে এসে পোর্টিকোর নিচে রাখা গাড়িতে উঠলাম।……