২. আসন্ন সন্ধ্যার হিম

আসন্ন সন্ধ্যার হিম এবং সুদেষ্ণার তাড়ায় আমাদের উঠতে হলো। সেনসায়েব দোতলায় পোর্টিকোর ছাদের মুখোমুখি যে ঘরটাতে আমাদের বসালেন, সেটা একাধারে স্টাডি এবং ড্রইংরুম। দেয়ালে ভূতত্ত্ববিদ পি কে সেনের প্রকাণ্ড পোর্ট্রেটে ফুলের মালা এখনও তাজা হয়ে আছে। কর্নেল ছবিটার কাছে একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর সোফায় বসলেন। সেনসায়েব বললেন, এটা ছিল দাদার স্টাডি এবং ল্যাব। ল্যাবের সরঞ্জাম পাশের ঘরে যত্ন করে রেখে দিয়েছি। আমি ওয়েস্ট জার্মানিতে মাইনিং নিয়ে পড়াশুনা করেছি। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি আছে। অনেক বছর সিন্ড্রিতে সরকারি চাকরিও করেছি। কিন্তু তন্ময়ের মায়ের মৃত্যুর পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। শেষে দাদার পরামর্শে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের একটা কারবার খুলেছিলাম। মাইনিং প্রজেক্টে নানা ধরনের যন্ত্রাংশ সাপ্লাই করতাম। তারপর তন্ময় বড় হয়ে উঠল। এখন সেই কারবারটা চালিয়ে যাচ্ছে।

কর্নেল বললেন, আপনার দাদার কথা জানতে ইচ্ছে করছে।

দাদা বিয়ে করেননি। এই বাড়িতেই থাকতেন। তবে ওঁর ওই ভূতত্ত্ববিদ্যার বাতিক। সরকারি চাকরির অফার অনেকবার পেয়েছিলেন। নেননি। দেশবিদেশের সেমিনারে ওঁর ডাক পড়ত। বিশেষজ্ঞ হিসেবে সরকারি-বেসরকারি নানা সংস্থার উপদেষ্টা ছিলেন। হাতা থেকে দাদার মোটামুটি ভালো রোজগার হতো। কান্দ্রা এরিয়ায় ইউরেনিয়াম খনি থাকার সম্ভাবনা দাদাই সরকারকে জানিয়েছিলেন। পরে তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।

সুদেষ্ণা ও বনশ্রী আরেকদফা কফি আনল। তারপর সুদেষ্ণা বলল, ছোটমামা! তখন তুমি কর্নেলসায়েব সম্পর্কে আমাকে খুলে বলতে বলছিলে। বড়মামার মৃত্যুর ঘটনাটা বরং ওঁকে খুলে বলো। কারণ তোমার মুখেই তো শুনেছি, বড়মামার মৃত্যুর মধ্যে নাকি একটা রহস্য আছে।

সেনুসায়েব কিছু বলার আগে সৌমিত্র বলে উঠল, যেটুকু অনুমান করেছি, তাতে আমার ধারণা কর্নেলসায়েব একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। সরি! জয়ন্তবাবু বলছিলেন, ডিটেকটিভ বললেন উনি রাগ করেন। বরং প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার বলছি।

কর্নেল সাদা দাড়ি থেকে কী একটা ঝেড়ে ফেলে কফিতে চুমুক দিলেন। তারপর সেনসায়েব তার দিকে তাকিয়ে আছেন লক্ষ্য করে গলার ভেতর বললেন, রহস্য জিনিসটা আমাকে টানে। আমার এ-ও একটা বাতিক বলতে পারেন।

সেনসায়েব একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, গতবছর সেপ্টেম্বরে দাদা আমাকে শিগগির আসতে লিখেছিলেন। চিঠি পেয়ে একটু অবাক হয়েছিলাম। আমার বরাবর কুকুর পোষার শখ আছে। দাদা লিখেছিলেন, সঙ্গে যেভাবেই হোক, যেন আমার অ্যালসেশিয়ান টমকে নিয়ে আসি। অগত্যা গাড়ি নিয়ে রওনা হয়েছিলাম। পৌঁছে দেখি, দাদাকে কেমন যেন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলে বললেন, একটা পোড়ো খনির মুখ আটকানো ছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার সময় হঠাৎ খনি-মুখের পাথরের ফাটল দিয়ে বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে আসে। উনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। ভাগ্যিস একটা গভীর গর্তে জলের ওপর পড়েছিলেন। তাই জলের ঝাঁপটায় জ্ঞান ফিরে আসে। অতি কষ্টে বাড়ি ফিরে আসেন। রাম সিং তখনই ডাক্তার ডেকে এনেছিল। কান্দ্রা রিসর্টে বাড়ি করেছিলেন একজন নামী ডাক্তার। তখন প্রায় সত্তর বছর বয়স ছিল তার। যাই হোক, তিনি এসে দাদার চিকিৎসা করেন। কিন্তু গ্যাসটা কী, দাদা বা তিনি কেউই বুঝতে পারেননি।

জায়গাটা কত দূরে?

প্রায় দু-কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে। কান্দ্রা লেকের একটা অংশ ওদিকে বেঁকে গেছে।

তারপর?

তারপর দাদা একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। কিছুদিন থেকে বাড়িতে নাকি চোরের উৎপাত হচ্ছে। রাম সিং তার ভাই হরি সিংকে এনে পালাক্রমে রাত জেগে পাহারা দিত। তবু কোন ফাঁকে চোর এসে তাঁর এই ল্যাবে হানা দিত। দাদা টের পেতেন। কিন্তু তন্নতন্ন খুঁজে কাকেও দেখা যেত না। তাই অ্যালসেশিয়ান কুকুর নিয়ে আসতে বলেছিলেন। কুকুরটা ছাড়া থাকত। আমার লাইসেন্স করা বন্দুক আছে। কুকুরটা রাতবিরেতে গর্জন করলেই বন্দুকে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করতাম।

কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, ইন্টারেস্টিং। তারপর?

তারিখটা মনে আছে। ২৩ সেপ্টেম্বর। দাদা সেদিন বেশ সুস্থ আর ভালো মেজাজে ছিলেন। রাত দশটায় দুজনে খাওয়াদাওয়া করে শুতে গেলাম। দাদা শোওয়ার আগে কিছুক্ষণ ল্যাবে থাকতেন। আমি ওই ঘরটায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। টমি অভ্যাসমতো ওপরে-নিচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একসময় টমির গর্জনে ঘুম ভেঙে গেল। কুকুরটা আমার ঘরের দরজায় আঁচড় কেটে ডাকাডাকি করছিল। তখনই আলো জ্বেলে বন্দুক নিয়ে দরজা খুললাম। টমি লেজ গুটিয়ে আমার ঘরে ঢুকে গেল। একটু খটকা লাগল। বাইরের আলো নিভে গেছে। সেই আলোর সুইচ দাদার ল্যাবে। আর ওই যে দেখছেন, যে ঘরে দাদার ল্যাবের জিনিসপত্র রেখেছি, ওটা ছিল দাদার শোওয়ার ঘর। ল্যাবের দরজা খোলা মনে হলো। অমনি টর্চ নিয়ে এলাম আমার ঘর থেকে। তারপর টর্চের আলোয় দেখি ল্যাবের মেঝেয় দাদা কাত হয়ে পড়ে আছেন। রাম সিং আমার ডাকাডাকিতে ওপরে উঠে এল। সে থাকে নিচের ঘরে। তখন তার বউ ছেলেমেয়ে হরি সিংয়ের সঙ্গে তাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। সেনসায়েব জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, রাম সিং খুব সাহসী লোক। তখন রাত প্রায় সওয়া বারোটা। ডাক্তার কেতনলাল পাণ্ডেকে ডাকতে গেল। অবস্থা চিন্তা করুন।

সেনসায়েব হঠাৎ চুপ করলেন। কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছে।

মিসটিরিয়াস। যাই হোক, ডাক্তার পাণ্ডে খুব সজ্জন মানুষ ছিলেন। ওই বয়সেও তাঁর স্বাস্থ্য চমৎকার ছিল। নিজে ড্রাইভ করে এলেন। দাদাকে পরীক্ষা করে দেখে বললেন, হার্ট অ্যাটাক। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছেন। আর কিছু করার নেই। সেনসায়েব জোর শ্বাস ছেড়ে ফের বললেন, ডাক্তার পাণ্ডে বেঁচে থাকলে তার মুখেই ঘটনাটা শুনতেন।

কোনও চেয়ার উল্টে গিয়েছিল? মানে যে চেয়ারে বসে থাকতেন–

নাহ্। সম্ভবত চেয়ার থেকে উঠে কোনও কারণে দরজা খুলেছিলেন। আর, বন্ধ করতে পারেননি। বডি পড়ে ছিল ঠিক এখানে।

কর্নেল দেখে নিয়ে বললেন, অন্তত ফুট পাঁচেক দূরত্বে।

তন্ময় বলে উঠল, বাবা! সেই দুর্গন্ধটার কথা বলো!

সেন সায়েব বললেন, আমার ঘর থেকে বেরুনোর সময় একটা দুর্গন্ধ টের পেয়েছিলাম। মাত্র এক মিনিটের জন্য। তবে তখন ও নিয়ে মাথা ঘামাইনি। পরে মনে পড়েছিল।

কর্নেল বললেন, ডাঃ পাণ্ডে বডির পোস্টমর্টেমের কথা বলেননি?

নাহ। কারণ তার আগে দুবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। থার্ড অ্যাটাকেই তো রোগী মারা পড়ে।

রাম সিং দরজার কাছে এসে একটু কাশল। সেনসায়েব তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সব রেডি?

হাঁ সাব!

কর্নেল সরকার! আপনারা ক্লান্ত। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিন। মোটে পৌনে সাতটা বাজে। ঘণ্টা দুই পরে আমরা আবার বসব। আপনাকে কষ্ট করে নিচের একটা ঘরে যেতে হবে। ওপরে তেমন কোনও বাড়তি ঘর নেই। তবে নিচের ঘরটা ভালোই। দক্ষিণে বারান্দা আছে। এক ঘণ্টা পরে চাঁদ উঠবে। বারান্দায় বসে লেকের জলে জ্যোৎস্না দেখতে আপনার আশা করি ভালো লাগবে। আপনি প্রকৃতি-প্রেমিক।

সুদেষ্ণা বলল, একেই বলে সত্যিকার অ্যাডভেঞ্চারার। দুজনের মাত্র দুটো ব্যাগ। রাম সিং! তোমার বয়ে নিয়ে যাবার মতো কিছু নেই। তুমি ভাগো! আমি এঁদের নিয়ে যাচ্ছি।

বনশ্রী বলল, চলো তিতি! রাম সিং নিজে ঘরটা গোছায়নি–আমি সিওর। ওর বউকে হুকুম করেছে। দেখি কী অবস্থা!

সিঁড়িতে নামবার সময় টমির হাঁকডাক শোনা গেল। সুদেষ্ণা তার উদ্দেশে ধমক দিয়ে বলল, খুব হয়েছে। থামো! বড়মামাকে অ্যাটাক করার সময় লেজ গুটিয়ে ঘরে ঢুকেছিলে কেন?

কর্নেল আস্তে বললেন, অ্যাটাক বলছেন?

বলছেন-টলছেন নয়। তুমি বললে আরও খুশি হব। আমি আপনার ফ্যান। সরি জয়ন্তবাবুর ফ্যান।

দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটা দেখে পছন্দ হলো। দুপাশে দুটো সিঙ্গল খাট। দেয়ালের দুদিকে দুটো ল্যান্ডস্কেপ। দুটো চেয়ার আর একটা টেবিল। বনশ্রী ও সুদেষ্ণা আবার বিছানা দুটো ঝেড়ে পেতে দিল। বনশ্রী বাথরুম দেখিয়ে দক্ষিণের দরজা খুলে বিচ্ছিরি অন্ধকার! বলে বন্ধ করে দিল।

কর্নেল তার ব্যাগ টেবিলে রেখে বললেন, তিতির মতে তাহলে হার্ট অ্যাটাক নয়? শুধু অ্যাটাক?

সুদেষ্ণা একটু হাসল। ছোটমামা যে দুর্গন্ধ টের পেয়েছিল, সেটা কিসের? একবার কোন পোড়োখনির মুখ থেকে হঠাৎ বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে বড়মামাকে অজ্ঞান করে দিয়েছিল।

বনশ্রী চাপাস্বরে বলল, শ্বশুরমশাই নিজেও এ বাড়িতে কয়েকবার ছায়ামূর্তি দেখেছেন। আজ নাকি রাজেনবাবুও লেকের ধারে কাকে দেখতে পেয়েছেন।

কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, রাজেনবাবু কে?

উনি একজন রিটায়ার্ড জজসায়েব। পুরো নাম রাজেন্দ্রলাল দ্বিবেদী। মাথায় একটু ছিট আছে অবশ্যি। কিন্তু

তাকে থামিয়ে সুদেষ্ণা বলল, দেয়ালের কান আছে। এসব কথা এখন থাক কর্নেলসায়েব!

কর্নেল দ্রুত বললেন, জয়ন্ত আমাকে শুধু কর্নেল বলে। তুমি–তোমরাও বলতে পারো।

সুদেষ্ণা হাসল। আমি আপনার কাছেও যখন তিতি হয়ে গেছি, তখন জয়ন্তবাবুর মতো শুধু কর্নেল বলতে বাধবে না।

বললাম, উনি কিন্তু নর-নারী নির্বিশেষ প্রিয়জনদের ডার্লিং বলেন।

জানি, জানি! আর একটু পরেই ডার্লিং শুনতে পাব। আচ্ছা। চলি! রেস্ট নিন আপনারা।

তোমাদের বরাতে রেস্ট নেই ডার্লিং! আর এক পেয়ালা কফি খাব। এখনই নয়, আধঘণ্টা পরে। বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন।

দুজনে চাপা হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বললাম, কর্নেল! দুর্গন্ধ নয়, ঝাঝালো সুগন্ধ পাচ্ছি। তাই না?

কর্নেল ব্যাগের চেন খুলতে খুলতে বললেন, বনশ্রী বিবাহিতা মেয়ে, জয়ন্ত! বিবাহিতা মেয়েদের সুরভিতা হয়ে থাকাই নিয়ম। যাই হোক, আগে তুমি বাথরুম সেরে পোশাক বদলে ফেলো। ততক্ষণ আমি চুরুটটার সদগতি করি।

কিছুক্ষণ পরে দক্ষিণের দরজা খুলে বারান্দায় দুটো চেয়ার নিয়ে আমরা বসলাম। সুদেষ্ণা বলছিল, বিচ্ছিরি অন্ধকার। কিন্তু দোতলা এবং নিচের এই ঘরের আলোর ছটায় অন্ধকার কাছাকাছি নেই। দূরে সরে গিয়ে থমথম করছে। আমার কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। বললাম, এই বারান্দায় আলো থাকা উচিত ছিল।

কর্নেল বললেন, আছে। আমাদের ঘরেই তার সুইচ থাকা সম্ভব। কিন্তু আলো জ্বালার দরকার কী? তুমি কি ভূতের ভয়ে আলোয় থাকতে চাইছ?

নাহ। আপনার কাছে বসে থেকে ভূতপ্রেত দেখতে মন্দ লাগবে না।

কর্নেল একটু পরে আস্তে বললেন, ভূতত্ত্ববিদ ডঃ পি কে সেন দিল্লির সেই সেমিনারে যে পেপার পড়েছিলেন, তার একটা কপি আমি রেখে দিয়েছিলাম। জানতাম না দৈবাৎ তার বাড়িতে এসে পড়ব। জানলে সঙ্গে নিয়ে আসতাম।

ওঁর পেপারের বিষয়টা কী ছিল?

ঠিক মনে পড়ছে না। তবে ভূগর্ভে কী কী গ্যাস থাকতে পারে, তার থেকে খনিশ্রমিকরা কীভাবে আত্মরক্ষা করতে পারে, এই ধরনের কোনও আলোচনা ছিল সম্ভবত। সেনসায়েব বিষাক্ত গ্যাসের কথা বলায় শুধু এটুকু মনে পড়ছে যেন। না–আমি সিওর নই। স্মৃতি অনেক সময় বড় প্রতারণা করে।

কর্নেল থেমে গেলেন। কুকুরটার গর্জন শোনা গেল। আমি একটু চমকে উঠেছিলাম। তারপর দেখলাম আমাদের বাঁদিকে লনের ওপর তন্ময় আর সৌমিত্র হেঁটে যাচ্ছে। দুজনের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। দুই বন্ধুতে কি সিগারেট খাওয়ার জন্য নেমে এসেছে? চাপা গলায় কথা বলতে বলতে ওরা এগিয়ে গেল।

তার একটু পরে সুদেষ্ণা একা কফির ট্রে আনল। বলল, বনশ্রী কিচেনে রাম সিংয়ের বউকে হম্বিতম্বি করছে। ম্যাগাজিন পড়ে ও দেশবিদেশের নানারকম রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করে। জানি না, আজ ডিনারে কেলেঙ্কারি বাধাবে কি না।

দু পেয়ালা কফি আমাদের হাতে তুলে দিয়ে সে একটা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। কর্নেল বললেন, প্রত্যেক মানুষের একটা-না-একটা হবি আছে। বনশ্রীর হবি রান্না। তোমার?

সুদেষ্ণা হাসল। আমার? কে জানে কী!

বললাম, আমি বলতে পারি। আপনার হবি ক্রাইমস্টোরি পড়া। বিশেষ করে গোয়েন্দা কাহিনী।

সে আর কে পড়ে না? বড়মামার মতো মানুষও গোয়েন্দাকাহিনী পড়তেন।

 কর্নেল বললেন, আমার ধারণা, তুমি এখনও ছাত্রী।

 কীভাবে বুঝলেন?

বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স নিয়ে পড়াশুনা করছ।

সুদেষ্ণা ভুরু কুঁচকে বলল, ছোটমামা কিংবা তন্ময়ের কাছে শুনেছেন বুঝি?

তুমি ছোটবেলা থেকে তোমার মামাবাড়িতে মানুষ হয়েছ।

আপনি এসেই গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছেন। সুদেষ্ণা অবাক হয়ে বলল। সত্যি কর্নেল, জয়ন্তবাবুর লেখায় আপনার আসল রূপ ফুটে ওঠে না।

কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, নাহ্। নিছক অঙ্ক। প্রথমত, ওপরের ঘরে তোমার মামাদের একটা ফ্যামিলি ফোটোগ্রাফ দেখেছি। তাতে তোমার বালিকা বয়সের ছবি আছে। তোমার দুই মামা এবং তোমার দাদামশাইয়ের চেহারার মিল সহজে চোখে পড়ে। তোমার দাদামশাইয়ের পাশের মহিলা তোমার দিদিমা। ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না। তোমার দুই মামা পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। তুমি আর তন্ময় দাদামশাই-দিদিমার মধ্যিখানে। পায়ের কাছে দুপাশে দুজন মহিলা। একজন সধবা, অন্যজন বিধবা। কাজেই–

সুদেষ্ণা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনার চোখ আছে তা জানি। মানে–যাকে বলে তৃতীয় নয়ন। কিন্তু আমি এখনও ছাত্রী, তা কী করে বুঝলেন?

কর্নেল হাসলেন। পড়াশুনা শেষ করে ফেললে চেহারা-হাবভাবে একধরনের গাম্ভীর্য এসে যায়। ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কিন্তু বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে এটা লক্ষ্য করেছি। ছাত্রজীবনে তারা সবসময় হাসিখুশি চঞ্চল থাকে।

বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কোর্স?

তোমার ছোটমামার কারবার এখন তন্ময় চালাচ্ছে। তাই এটা আন্দাজে ঢিল ছোঁড়া। তুমি এই ফ্যামিলিরই একজন।

বললাম, কর্নেল! সৌমিত্রবাবু কী করে বলুন এবার।

কর্নেল চোখ বুজে বললেন, আমি গণক নই। তন্ময়ের সঙ্গে তার বন্ধুতার নানা সূত্র থাকতে পারে। একটু সিরিয়াস টাইপের যুবক। কথাবার্তা কম বলে। নিজের ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা আছে। এমন হতেই পারে, সে তন্ময়ের পরামর্শদাতার ভূমিকা নিতে ব্যর্থ এবং সেনসায়েবও তাকে স্নেহ করেন।

সুদেষ্ণা বলে উঠল, প্রায় ধরে ফেলেছেন কর্নেল! সৌমিত্র সদ্য একটা কনসাল্ট্যান্সি ফার্ম খুলেছে। অ্যামেরিকায় পড়াশুনা করে এসেছে।

আমি মনে মনে বললাম, এবং সুদেষ্ণার প্রেমপ্রত্যাশী।

ঠিক সেই সময় লনের পূর্বদিকে চিৎকার শোনা গেল, চোর! চোর! পাকড়ো! পাকড়ো! রাম সিং! তারপর রাম সিংকে ছুটে যেতে দেখলাম। তার হাতে টর্চ আর বল্লম। কেউ বুদ্ধি করে টমকে খুলে দিয়েছিল। টম লনের মাঝামাঝি গিয়ে হাঁকডাক জুড়ে দিল। কর্নেল তার পকেট থেকে খুদে টর্চ বের করে আস্তেসুস্থে নেমে গেলেন। দোতলায় সেনসায়েবের বন্দুক পর পর দুবার গর্জন করল।

কয়েক সেকেন্ডের ঘটনা! সুদেষ্ণা এতক্ষণে লনে নামল। তার পিছনে আমি।

তন্ময় এবং সৌমিত্র কর্নেলকে টর্চের আলো ফেলে দেখাচ্ছিল, কোথায় তারা চোরের দর্শন পেয়েছে। কাছে গিয়ে দেখি, পূর্বের বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে একটা ছোট্ট ঝোঁপ দুমড়ে মুচড়ে গেছে। তন্ময় হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ব্যাটাচ্ছেলে এখানে গুঁড়ি মেরে বসে ছিল। জাস্ট ইনটুইশন! কী মনে হলো, টর্চের আলো ফেলতেই দেখি, একটা কালো কুচকুচে লোক। মুখের গড়ন বীভৎস। একেবারে গরিলার মতো।

সৌমিত্র বলল, পাঁচিল ডিঙিয়ে পালানোর সময় আমার কিন্তু গরিলাজাতীয়  জন্তু বলেই মনে হলো।

কর্নেল তার টর্চের আলোয় জায়গাটা খুঁটিয়ে দেখে বললেন, এমন একটা পরিবেশ–তা ছাড়া সাইকোলজিক্যাল দিকটাও ধর্তব্য, মানুষকে জন্তু কিংবা জন্তুকে মানুষ মনে হওয়া বিচিত্র নয়।

তন্ময় জোর দিয়ে বলল, মানুষ। কিন্তু মুখটা কদাকার।

 পরনে কী ছিল লক্ষ্য করেছেন?

 না। জাস্ট দু-তিন সেকেন্ডের মধ্যে পালিয়ে গেল।

সেনসায়েব এবং তার সঙ্গে টম এল। সেনসায়েব সব শুনে বললেন, তোমাদের দেখার ভুল হতেও পারে। রাম সিং একবার

কর্নেল তাঁর কথার ওপর বললেন, না মিঃ সেন। সত্যিই কেউ এখানে এসে ওত পেতে বসে ছিল। পালানোর সময় তার পায়ের চাপে এই ঝোপটা দুমড়ে ভেঙে গেছে।

ঝোপটার ওপর আলো ফেলে সেনসায়েব বললেন, সত্যিই তো! আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কে এমন করছে? কেন করছে?…