১. সেবার অক্টোবরে কর্নেলের সঙ্গে

সেবার অক্টোবরে কর্নেলের সঙ্গে বুরুডি বনবাংলোয় দিনপাঁচেক কাটিয়ে ফিরে আসছিলাম। বনদফতরের জিপগাড়ি আমাদের স্টেশনচত্বরে নামিয়ে দিয়ে দ্রুত উধাও হয়ে গেল। কর্নেলের বখশিসের তোয়াক্কা করল না ড্রাইভার। বুঝতে পারলাম, এই অবেলায় বেচারাকে পনেরো কিলোমিটার দুর্গম রাস্তায় পাড়ি দিতে হবে। তাই এই ব্যস্ততা।

ছোট্ট রেলস্টেশনটির নাম রুহা। আপে আজমগড় থেকে ডাউনে লাখানপুর জংশন পর্যন্ত প্রায় তিরিশ কিলোমিটার এই ন্যারোগেজ রেলপথের সঙ্গে শিলিগুড়ি-দার্জিলিং রেলপথের তুলনা করা চলে। আমরা লাখানপুরে পৌঁছে হাওড়াগামী ট্রেন ধরব রাত ৯টা ৪০ মিনিটে। রুহায় আজমগড় থেকে ট্রেন আসার কথা ৫টা ২০ মিনিটে। এখন প্রায় চারটে বাজে। কাছাকাছি আদিবাসীদের একটা বসতি গাছপালার আড়ালে ঢাকা পড়েছে। সেশন নিঝুম জনহীন।

কর্নেল সারাপথ গম্ভীর ছিলেন। একটা ইংরেজি দৈনিকে বুরুডি জঙ্গলে এক বিশেষ প্রজাতির অর্কিডের সচিত্র প্রতিবেদন বেরিয়েছিল। স্থাননির্দেশও ছিল। কিন্তু উনি কদিন ধরে তন্নতন্ন খুঁজে তা আবিষ্কার করতে পারেননি। ওঁর শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো, আজকাল রঙিন বিজ্ঞাপনের জন্য খবরের কাগজে যে ক্রোড়পত্র বেরোয়, তাতে নানা রকমের লেখা দিয়ে বাকি জায়গা ভরাট করতে হয়। অতএব যিনি এটি লিখেছেন, তিনি বুরুড়ি না এসেই কোনও পুরনো বই থেকে পুরোটাই টুকেছেন–সম্ভবত কোনও বিদেশি পর্যটকের বই। আর ছবি? অর্কিডের রঙিন ছবির বই বাজারে মেলে।

গম্ভীর মুখে স্টেশনের বারান্দায় উঠেই কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন।

বললাম, কিছু ফেলে এসেছেন নাকি?

নাহ্। কপালে দুর্ভোগ আছে জয়ন্ত।

কেন বলুন তো?

কর্নেল স্টেশনঘরসংলগ্ন চায়ের দোকানটার ঝাঁপের দিকে আঙুল তুলে বললেন, দেখছ?

হেসে ফেললাম। চা-ফা খাওয়া যাবে না, এই তো? জংশনে গিয়ে খাবেন।

মনে হচ্ছে জংশনেও খাওয়া হবে না। বলে কর্নেল স্টেশনঘরের দরজায় গিয়ে উঁকি দিলেন। দেখলাম, পাশে একটা প্রকাণ্ড সিন্দুকের ওপর এক রেলকর্মী নাক ডাকিয়ে এই অবেলায় ঘুমোচ্ছে। প্ল্যাটফর্মে মানুষজন নেই।

কর্নেলকে দেখে ভেতর থেকে রেলকোটপরা স্টেশনমাস্টার বেরিয়ে এসে বললেন, গত রাতের বৃষ্টিতে আপে এক জায়গায় পাহাড়ের ধস ছেড়ে লাইনের ওপর পড়েছে। জংশন থেকে লোকজন গেছে। ধস সরাতে দুদিন লাগতে পারে। তিনদিনও লাগতে পারে।

ভদ্রলোক নির্বিকার মুখে কথাগুলি বলে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে দাঁড়ালেন। কর্নেল তুম্বো মুখে চুরুট ধরিয়ে তার কাছে গেলেন। বললেন, জংশন এখান থেকে সম্ভবত বেশি দূরে নয়।

স্টেশনমাস্টার বললেন, অন্তত ছ কিলোমিটার। তবে যদি পায়ে হেঁটে যাওয়ার কথা ভাবেন, আমি নিষেধ করব।

কেন?

দুধারে ঘন জঙ্গল। তাছাড়া বিকেলের দিকে মাঝেসাঝে বুনোহাতির দল। এসে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে।

কর্নেল বাইনোকুলারে ডাউনে কিছু দেখতে থাকলেন। আমি স্টেশনমাস্টারকে বললাম, হাতিরা নিশ্চয় সকালের দিকে রেললাইনে অবরোধ করতে আসে না।

স্টেশনমাস্টার একই ভঙ্গিতে বললেন, কিছু ঠিক নেই। তবে বিকেলেই ওদের উৎপাত বেশি।

তাহলে বরং রাত্তিরটা আমরা স্টেশনে কাটাতে পারি। তাই না?

প্রচণ্ড মশা। বাড়তি মশারি থাকলে দিতাম। নেই।

স্টেশনমাস্টার লোকটিকে রোবোট বলে মনে হচ্ছে। কথাবার্তা হচ্ছিল ইংরেজিতে। উচ্চারণ শুনে এবং কাছে থেকে খুঁটিয়ে দেখে এতক্ষণে মনে হলো উনি অ্যাংলা-ইন্ডিয়ান। গায়ের রঙ তামাটে, চোখের তারা ঈষৎ নীল। ওঁর সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য নাম জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি, কর্নেল বললেন, ওখানে কয়েকটা বাড়ি দেখলাম। ওটা কি কোনও টাউনশিপ?

স্টেশনমাস্টার বললেন, টাউনশিপ নয়। রিসর্ট এলাকা। নিচের দিকে একটা লেক আছে। নানা জায়গা থেকে ধনী, লোকেরা এসে ওখানে বাড়ি করেছে। আপনারা ওখানে গিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। বরাত ভালো হলে জংশনে পৌঁছানোর ব্যবস্থা হয়ে যেতেও পারে।

কর্নেল বললেন, এস জয়ন্ত।

রেললাইন ধরে দুজনে হেঁটে চললাম। প্রায় এক কিলোমিটার যাওয়ার পর দেখলাম, একটা সংকীর্ণ পিচরাস্তা রেললাইন পেরিয়ে চড়াইয়ে উঠে গেছে এবং উঁচু জমির ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সুন্দর ছবির মতো কয়েকটা বাড়ি। সবগুলোই একতলা এবং নতুন। বিকেলের আলোয় ঝলমল করছে রঙবেরঙের বাড়ি আর সুদৃশ্য সব লন। শুধু একটা বাড়ি দোতলা এবং পুরনো। এই বাড়িটা শেষ দিকটায় গাছপালার আড়ালে কিছুটা ঢাকা পড়েছে।

আমরা পিচরাস্তা ধরে হেঁটে গেলাম। আসবার দিন এই বাড়িগুলো চোখে না পড়ার কারণ তখনও শেষ রাতের অন্ধকার এবং কুয়াশা ছিল।

কর্নেল বাইনোকুলার তুলে একবার দেখে নিয়েই হাসিমুখে বললেন, বরাত আমাদের আশা করি ভালো জয়ন্ত! দোতলা বাড়িটার গেটের ফলকে বাংলায় লেখা আছে, মৃন্ময়ীভবন।

বলেন কী!

এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ তো বিহার! একসময় বাঙালি ভারতের কোন মুল্লুকে না ডেরা পেতেছিল। চলে এস। প্রবাসী বাঙালি অতিশয় সজ্জন।

পিচরাস্তাটা এই বাড়ির সামনে দিয়ে বাঁক নিয়ে পূর্বে এগিয়েছে। মৃন্ময়ীভবনের গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই কুকুরের গর্জন শোনা গেল। তারপর মধ্যবয়সী নাদুসনুদুস গড়নের হাফপ্যান্ট-হাফশার্টপরা গুফো একটা লোক এগিয়ে এসে কর্নেলকে দেখামাত্র কেন কে জানে সেলাম ঠুকল। সে বিনীতভাবে হিন্দিতে বলল, আপনারা কোথা থেকে আসছেন সার?

কর্নেল বললেন, কলকাতা থেকে।

সে গেট খুলে দিয়ে বলল, আসুন। সেনসায়েব আছেন। ওঁরা পরশু এসেছেন। উনি বলছিলেন কলকাতা থেকে কারা সব আসবেন।

ঢুকে দেখি, অ্যাজবেস্টসের ছাউনি দেওয়া গ্যারাজে দুটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পোর্টিকো বাড়িটার পুবদিকে। পুব-দক্ষিণ জুড়ে বিশাল লন। ফুলবাগিচাও আছে। পুবের লনে ঘাসের ওপর বেতের চেয়ার-টেবিল পাতা। তাতে দুজন যুবক, দুই যুবতী এবং একজন ঝকঝকে চেহারার প্রৌঢ় বসে ছিলেন। আমাদের দেখে প্রৌঢ় ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। যুবক-যুবতীরা মুখ ফেরাল।

কর্নেল বললেন, মিঃ সেন যাদের প্রতীক্ষা করছেন, দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা তারা নই। তো বাই এনি চান্স, বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ মিঃ বি কে সেনের সঙ্গে কি আপনার কোনও সম্পর্ক আছে?

উনি আমার দাদা ছিলেন বলে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন। আপনারা–

কর্নেল তাঁর কথার ওপর একটু হেসে বললেন, আমরা দুর্ভোগে পড়ে আপনার এখানে এসেছি। এই আমার পরিচয়। বলে উনি পকেট থেকে একটা নেমকার্ড বের করে দিলেন।

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। নেচারিস্ট। কার্ডটা পড়ে সেনসায়েব হাঁক দিলেন, রাম সিং! জলদি আউর এক কুর্সি লাও! আপনি বসুন কর্নেল সরকার!

কর্নেল বললেন, আমার এই তরুণ বন্ধুর নাম জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।

সেই লোকটি আর একটা বেতের চেয়ার এনে দিল। একটা চেয়ার অবশ্য খালি ছিল। আমরা বসবার পর কর্নেল সংক্ষেপে আমাদের দুর্ভোগের কথা বললেন। সেনসায়েব সহাস্যে বললেন, আমার সৌভাগ্য যে আপনাদের মতো অতিথি পেলাম। তা ছাড়া আপনি আমার দাদার পরিচিত। দাদা এ বাড়িতে এসে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।

খবরের কাগজে পড়ে খুব মর্মাহত হয়েছিলাম। তবে উনি যে এখানে মারা যান, খবরে তার উল্লেখ ছিল না।

ও কথা থাক। এবার পরিচয় করিয়ে দিই এদের সঙ্গে। এ হলো আমার ছেলে তন্ময়। আমার বউমা বনশ্রী। তন্ময়ের বন্ধু সৌমিত্র। আর আমার ভাগনী সুদেষ্ণা!

সুদেষ্ণা বলে উঠল, ছোটমামা! আপনি কিন্তু এখনও নিজের পরিচয় ওঁদের দেননি।

তাই বুঝি? সেনসায়েব হেসে উঠলেন। আমি এস কে সেন। সনকুমার সেন।

কর্নেল বললেন, আমার যেন মনে পড়ছে। আপনার দাদা বলেছিলেন, তার ছোটভাই পশ্চিম জার্মানিতে থাকেন। আমার সঙ্গে ওঁর শেষ দেখা দিল্লিতে একটা সেমিনারে। প্রায় বছর দুই আগের কথা। উনি বলেছিলেন, বিহারের একটা খনি এলাকায় আপনার ঠাকুর্দার কয়েকটা খনি ছিল।

ছিল। সেনসায়েব বললেন। তিনটে খনি ঠাকুর্দার আমলেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। বাকি দুটো গভমেন্ট নিয়ে নেন। এই বাড়িটা ঠাকুর্দা সি কে সেনের তৈরি। এখানে আমার ছোটবেলা কেটেছে।

তন্ময় বলল, বাবা! তুমি কিন্তু গেস্টদের আপ্যায়নের কথা ভুলে গেছ?

 সরি! ভেরি সরি! সেনসায়েব হাঁক দিলেন, রাম সিং!

বনশ্রী উঠে দাঁড়াল। আমি যাচ্ছি। কর্নেলসায়েব! হট না কোল্ড?

সুদেষ্ণা মিটিমিটি হেসে বলল, হট। এবং অবশ্যই কফি। আমি জানিঃ কর্নেলসায়েব কফির ভক্ত।

কর্নেল বললেন, মিঃ সেন! আমার বিশ্বাস, আপনার ভাগনী আমাকে চেনেন।,

চিনি মানে? সুদেষ্ণা বলল, ভীষণ জানি। বিশেষ করে সাংবাদিক জয়ন্তবাবুর লেখার আমি ফ্যান। ওঁর লেখাতেই আপনার চেহারার বর্ণনা থাকে। কাজেই দুজনকে দেখামাত্র চিনতে পেরেছিলাম।

তন্ময় বলল, কী আশ্চর্য! তবু তুমি চুপচাপ মুখটি বুজে বসেছিলে?

 বনশ্রী বলল, তিতি সবসময় একটা করে স্টান্ট দেয়।

বুঝলাম সুদেষ্ণার ডাকনাম তিতি। বনশ্রী তাকে টেনে নিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল। সেনসায়েব বললেন, কান্দ্রাতে যখনই আসি, একটা-না-একটা নাটকীয় ঘটনা ঘটে যায়। এবারও ঘটল তা হলে! গত মার্চে ঠিক আপনাদের মতোই আমার দাদার এক বন্ধু এসে হাজির। তিনি একজন ফিল্মডাইরেক্টর। শুটিংয়ের লোকেশন দেখতে বুরুডি গিয়েছিলেন। সঙ্গে ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট আর ক্যামেরাম্যান ছিলেন। রুহা নদীর প্রপাতের কাছে ওঁরা একটা গুণ্ডা হাতির পাল্লায় পড়েন। বেগতিক দেখে ওঁদের ভাড়াকরা জিপগাড়ির ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে উধাও হয়ে যায়। ভাগ্যিস হাতিটার লক্ষ্য ছিল ওই গাড়িটা। তিনজনে। পাহাড়জঙ্গলের মধ্যে দিশেহারা হয়ে রাত দুপুরে দৈবাৎ কান্দ্রাতে এসে পড়েন।

সনৎ সেন খুব রসিক মানুষ। কথাগুলো বলতে বলতে হেসে অস্থির হলেন। কর্নেল বললেন, রুহা প্রপাতের কথা শুনেছিলাম। কিন্তু যাওয়া হয়নি। আসলে সেই অর্কিডের খোঁজে আমি অন্য এলাকায় ঘুরছিলাম। অবশ্য এই কান্দ্রার কথা জানতাম না।

মিঃ সেন উঠে দাঁড়িয়ে দক্ষিণে আঙুল তুলে বললেন, ওই লেকটার নাম কান্দা। ওটা রুহা নদীর অববাহিকায় একটা প্রাকৃতিক জলাধার বলা চলে। তবে দাদা বলতেন, ওটা প্রাগৈতিহাসিক যুগের একটা আগ্নেয়গিরির ক্রেটার।

কর্নেলও উঠে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলারে লেকটা দেখতে দেখতে বললেন, অপূর্ব! প্রচুর জলহস দেখতে পাচ্ছি। মাই গুডনেস! একজোড়া সেক্রেটারি বার্ড!

উনি বাইনোকুলার চোখে রেখে দক্ষিণের নিচু পাঁচিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল, নেশার ঘোরে পাঁচিল ডিঙিয়ে উধাও না হয়ে যান। দিনের আলো দ্রুত কমে আসছে। এই বাড়িটা উঁচুতে বলে লালচে রোদের রঙ পড়েছে লনের এদিকটায়। তন্ময় আমাকে বলল, উনি ওর্নিথোলজিস্ট নাকি?

বললাম, মুখে দাড়ি থাকলেও ওঁকে অবশ্য পক্ষিবিশারদ দ্বিতীয় সালিম আলি বলা যাবে না। এর কারণ আপনি আপনার পিসতুতো বোনের মুখে জানতে পারবেন।

সেনসায়েব সকৌতুকে বললেন, নেচারিস্টরা একটু বাতিকগ্রস্ত হন।

তিনি এগিয়ে গিয়ে কর্নেলের পাশে দাঁড়ালেন। সৌমিত্র এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি সাংবাদিক?

বললাম, বলতে পারেন। তবে আমি সবসময় সাংবাদিক হয়ে থাকি না।

সুদেষ্ণা বলছিল, আপনি ওই কর্নেল ভদ্রলোককে নিয়ে লেখেন। কী লেখেন?

 গল্পটল্প লিখি।

বলেন কী! একজন জলজ্যান্ত মানুষকে নিয়ে গল্প? গল্প তো কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে লেখা হয়।

কী, জবাব দেব বুঝতে পারলাম না। এই সময় সুদেষ্ণা ও বনশ্রী এসে গেল। টেবিলে ট্রে রেখে সুদেষ্ণা কর্নেলকে ডাকতে গেল। বনশ্রী, আমার মুখোমুখি বসে পট থেকে পেয়ালায় কফি ঢালতে ঢালতে চাপাস্বরে বলে উঠল, সৌমিত্র! তোমরা জানো? ওই কর্নেল ভদ্রলোক একজন ডিটেকটিভ। আর ইনি তার অ্যাসিস্ট্যান্ট!

দুজনে অবাক চোখে আমার দিকে তাকাল। ঝটপট বললাম, না না। ওই ধরনের ছকে আমাকে ফেলবেন না প্লিজ! আর একটা কথা। কর্নেলকে কেউ ডিটেকটিভ বললে উনি রেগে আগুন হয়ে যান। সেখানে এক মুহূর্ত থাকেন না।

বনশ্রী বলল, সে কী! কেন?

ওঁর মতে, টিকটিকি বলে যে স্ল্যাং কথাটা চালু আছে, তার উদ্ভব ডিটেকটিভ শব্দ থেকে।

সবাই হেসে উঠল। সুদেষ্ণা, কর্নেল আর সেনসায়েব ফিরে এলেন। কর্নেল উজ্জ্বল মুখে বললেন, কান্দ্রা লেকের কথা এতকাল কেউ আমাকে বলেনি। কোনও বইপত্তরেও পড়িনি। আমার পক্ষে এ একটা অসাধারণ আবিষ্কার বলা চলে। তার চেয়ে আশ্চর্য আবিষ্কার সেক্রেটারি বার্ড-দম্পতি।

সেনসায়েব ঘড়ি দেখে বললেন, বোঝা যাচ্ছে ভরদ্বাজ আর সিনহা লাখানপুর জংশনে নেমে আটকে গেছে। কর্নেল সরকারের মুখে যা শুনলাম, দু-তিন দিনের আগে রেললাইন পরিষ্কার হবে না। কিন্তু ওরা তো অনায়াসে একটা জিপগাড়ি ভাড়া করে চলে আসতে পারত।

তন্ময় বলল, হয় তো ট্রেন লেট করেছে। বিকেলের দিকে কোনও গাড়ি কান্দ্রা আসতে রাজি হবে না। রাস্তার অবস্থা যা দেখে এসেছি। তা ছাড়া জঙ্গলে নাকি বুনোহাতির উৎপাত আছে।

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ওঁরা আপনার বন্ধু?

সেনসায়েব মাথা নাড়লেন। তাঁর মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ ফুটে উঠেছিল। সুদেষ্ণা চোখে হেসে বলে উঠল, ওঁরা এসে যাবেন। ততক্ষণ কর্নেলসায়েবের মুখে বুরুডির জঙ্গলে অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শোনা যাক।

কর্নেল হাসলেন। ব্যর্থ অ্যাডভেঞ্চার। কারণ যে অর্কিডের খোঁজে গিয়েছিলাম, তার দেখা পাইনি।

প্লিজ কর্নেলসায়েব! রহস্যের সমাধান করতে পেরেছেন কি না বলুন।

সৌমিত্র বলল, রহস্য? কী রহস্য?

জানি না বলেই তো জানতে চাইছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অর্কিড নেহাত উপলক্ষ।

সেনসায়েব একটু অবাক হয়ে বললেন, তিতি! ব্যাপারটা একটু খুলে বলবে?

এই সময় পের্টিকোর দিক থেকে কুকুরের গর্জন শোনা গেল। রাম সিং হন্তদন্ত এগিয়ে গেল উত্তর-পশ্চিমে গেটের দিকে। তন্ময় বলল, বাবা! মনে হচ্ছে তোমার বন্ধুরা এসে গেছেন।

সেনসায়েব উঠে পড়লেন। লন পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন। তন্ময়কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি গাড়ি করে কলকাতা থেকে এখানে এসেছেন?

তন্ময় বলল, হ্যাঁ। তবে মাঝপথে একটা রাত আসানসোলে কাটিয়েছি। এ ছাড়া পথে বহু জায়গায় রেস্ট নিয়েছি। প্রায় সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার দূরত্ব। দুটো দিন লেগে যায়। কিন্তু অসাধারণ জার্নি।

কর্নেল গেটের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। গাছপালার ছায়া এখন ওখানে ঘন হয়েছে। উনি আস্তে বললেন, মনে হচ্ছে, সেনসায়েবের বন্ধুরা নন। অন্য কেউ।

লক্ষ্য করলাম, সেনসায়েব কার সঙ্গে কথা বলছেন। তাকে এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। একটু পরে রাম সিংকে ফিরে আসতে দেখা গেল। সে পোর্টিকোর তলায় অদৃশ্য হলো। তারপর গেটের দিকে আলো জ্বলে উঠল। তন্ময় বলল, বনি! তুমি দোতলার ঘরগুলোতে আলো জ্বেলে দাও! তালা দেওয়া আছে।

বনশ্রী বলল, চাবি?

চাবি তো তোমাকে দিয়েছি। কী আশ্চর্য! এত ভুল হয় কেন বুঝি না।

বনশ্রী হাতের হ্যান্ডব্যাগ খুলে দেখে হাসল। আছে। তিতি! একবারটি আসবে?

সুদেষ্ণা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, এখনও কচি মেয়ের মতো ভূতের ভয়। রাম সিং আছে না? ওর নাম ধরে মাঝে মাঝে ডাকবে। তাহলেই ভূতটুত পালিয়ে যাবে।

ভ্যাট! তুমি এস। আহা! এস না বাবা!

দুজনে চলে গেল। তার একটু পরে সেনসায়েব একা ফিরে এলেন। তাঁকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। চেয়ারে বসে তিনি বললেন, রাজেনবাবু এসেছিলেন। ভদ্রলোক দিনে দিনে সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। ফের সেই একই কথা। ভেতরে ঢুকতে চাইছিলেন। বললাম, গেস্টদের নিয়ে ব্যস্ত আছি। পরে আসবেন।

তন্ময় হাসতে হাসতে বলল, আবার জ্যাঠামশাইয়ের প্রেতাত্মার সঙ্গে দেখা হয়েছে? এবার কোথায় দেখা হয়েছে?

লেকের ধারে। বলে সেনসায়েব গম্ভীর হয়ে গেলেন। বুঝলেন কর্নেল সরকার? হ্যালুসিনেশন একটা সাংঘাতিক ব্যাধি। দাদার মৃত্যুর পর আমিও কিছুদিন যেন ওই ব্যাধির পাল্লায় পড়েছিলাম। পরে ডিটেলস বলব। আপনি দাদাকে চিনতেন। কাজেই আপনার সবটা শোনা দরকার।