৩. বক্রেশ্বর নদের উত্তর তীরে

বক্রেশ্বর নদের উত্তর তীরে সমান্তরাল বাঁধ পশ্চিমে এগিয়ে একটা সংকীর্ণ পিচরাস্তায় মিশেছে। পিচরাস্তাটা দক্ষিণে আহিরগঞ্জ থেকে উত্তরে এগিয়ে গেছে। সেই রাস্তা পর্যন্ত বাঁধের ওপর মোরাম বিছানো আছে। জিপ মোরাম রাস্তার শেষপ্রান্তে পৌঁছুলে কর্নেল বললেন, সামনে গাছপালার আড়ালে মিঃ সিংহরায়ের ফার্ম। তবে আমরা এখন যাচ্ছি আহিরগঞ্জে। মোহন সিং! আমরা যাব ভবানীপ্রসাদ রায়ের বাড়ি। তুমি ওঁকে চেনো তো?

মোহন সিং জিপ বাঁদিকে দক্ষিণে ঘোরাল। বলল, রায়সাবকে কে চেনে না স্যার? এরিয়ার এম এল এ ছিলেন। এখন পলিটিক্স ছেড়ে সোশ্যালওয়ার্ক করেন। সিংহরায়সাব আর তার কাকাকে রাজি করিয়ে জমিদারি কোঠিতে কলেজ করার জন্য কোশিস্ করছেন।

পিচরাস্তায় কিছুটা এগিয়ে পুরনো আমলে তৈরি একটি ব্রিজে জিপ উঠল। কর্নেল বললেন, এটাই এখানে বক্রেশ্বরের ওপর প্রথম ব্রিজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল। উত্তরে বিহার সীমান্তে একটা সেনাছাউনি ছিল। সেখানে যোগাযোগের জন্যই ব্রিজটা তৈরি হয়। আমার সামরিক জীবনের কিছু স্মৃতি এই রাস্তায় পড়ে আছে। তখন আমার সবে গোঁফ গজিয়েছে।

মোহন সিং বলল, কর্নির্লসাব! ব্রিজের যা কন্ডিশন হয়েছে, মেরামত না। করলে জলদি ভেঙে পড়বে। রায়সাব যখন এম এল এ ছিলেন, তখন একবার। মেরামত হয়েছিল। তারপর আর হয়নি। দেখুন, সারাদিন কমসে কম একশও। বাস-ট্রাক এই ব্রিজের ওপর দিয়ে বিহারে যায়।

কথা বলতে বলতে আমরা আহিরগঞ্জে ঢুকলুম। মফস্বল শহর। ঘিঞ্জি রাস্তা। যানবাহন আর লোকের ভিড়ে ঠাসা। বাজার এলাকা ছাড়িয়ে জিপ ডাইনে। ঘুরল। এবার কিছুটা ছিমছাম বসতি চোখে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে উঁচু বাউন্ডারি ওয়ালে ঘেরা প্রাসাদতুল্য বাড়ির গেটে পৌঁছে মোহন সিং হর্ন বাজাল। গেটের পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে দারোয়ান মোহন সিংকে দেখে বলল, আ রে  মোহন! ক্যায়সে হো তুম?

মোহন সিং বলল, আচ্ছা হ্যায় ভকতজি! গেট খুলদো। কলকাত্তাসে কর্নির্লসাব আয়া। রায়সাবকো খবর ভেজো।

দারোয়ান শশব্যস্তে গেট খুলে কর্নেলের উদ্দেশে সেলাম ঠুকে বলল, যাইয়ে কর্নিলসাব! রায়সাব উধার বাগিচামে হ্যায়।

জিপ নুড়িবিছানো লনে এগিয়ে পোর্টিকোর তলা দিয়ে ঘুরে থেমে গেল। কর্নেল, তারপর আমি নেমে গেলুম। লক্ষ্য করলুম, মোহন সিংহাসিমুখে সেলাম ঠুকছে এক ভদ্রলোককে। ভদ্রলোক কর্নেলের বয়সী। তবে রোগাটে গড়ন। মাথায় একরাশ সাদা চুল। ফর্সা চেহারা। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। ফুলবাগানের শেষদিকটায় তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাতে একটি ছড়ি। কর্নেলকে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন। সহাস্যে বললেন, বাতাসে কর্নেলসায়েবের গন্ধ পাচ্ছিলুম কদিন থেকে। আসুন! আসুন! তিনি হাঁক দিলেন, ভানু! দুটো চেয়ার নিয়ে আয়।

করমর্দনের পর কর্নেল বললেন, সত্যিই কি গন্ধ পাচ্ছিলেন রায়সাহেব?

হাঃ। তবে ওসব কথা পরে হবে। আজ বিকেলটা বেশ হাসিখুশি। পর পর কদিন বৃষ্টিতে বড্ড একঘেয়ে লাগছিল।

একটা লোক দুটো বেতের চেয়ার আনল। ফুলবাগিচার শেষদিকটায় সবুজ ঘাসের ওপর একটা ইজিচেয়ারে বসলেন রায়সাহেব। আমরা বসলুম বেতের চেয়ারে। ভানু নামে লোকটিকে রায়সায়েব কফির হুকুম দিলেন। কর্নেল বললেন, শুনলুম আপনি রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন?

রায়সায়েবের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। রাজনীতি এখন মাফিয়াদের হাতে চলে গেছে। বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলুম। তবে সমাজসেবা করতে গিয়েও দেখছি একই অবস্থা। তাই ক্রমশ নিজেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। সুদর্শনদের দোতলা বাড়িটা কলেজের জন্য পাওয়া গেছে। কিন্তু সেখানেও দলাদলি। আর তত উৎসাহ পাচ্ছি না।

সুদর্শনবাবুর কাকা শ্যামসুন্দরবাবুর খবর কী?

শ্যামসুন্দর ভালোই আছে ধর্মকর্ম নিয়ে। আমার ১মস্যা হলো, ধর্মের দিকে এখনও মতি এল না। বলুন তো কর্নেলসায়েব, ঈশ্বর যদি সত্যিই থাকেন, তিনি কি বোবাকালা? যদি বলেন, বদমাইশিও তার লীলা, আমি বলব এটা স্রেফ চালাকি। গীতার সম্ভবামি যুগে-যুগে তত্ত্বের কথা ছেলেমানুষি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর দেশটা শ্মশান হয়ে গিয়েছিল। তাহলে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবে ঘটলটা কী?

কর্নেল চারদিকটা দেখছিলেন। বললেন, আপনার মালীর প্রশংসা করা উচিত।

মালী? রায়সাহেব হেসে উঠলেন। মালী আমার বউমা চন্দ্রিমা। আপনি যখন এসেছিলেন, তখন সারা বাড়ি জঙ্গল হয়ে ছিল স্মরণ করুন।

আপনার বউমা কোথাকার মেয়ে?

হেতমপুরের। ওখানকার রাজবংশের সঙ্গে ওদের একটা সম্পর্ক অবশ্য আছে। আপনার মতোই ফুল-পাখি-প্রজাপতি-অর্কিড-ক্যাকটাসের প্রতি বউমার অদ্ভুত নেশা আছে। নিশ্চয় তা চোখে পড়েছে আপনার?

পড়েছে। আপনার ছেলেরা কী করে?

বড় দুর্গাপ্রসাদ তো অ্যামেরিকার হিউস্টনে মেমসায়েব বিয়ে করে ব্যবসা বাণিজ্য করছে। বছরে একবার আসে। ছোট উমাপ্রসাদ কন্ট্রাক্টরি করে। বড় অ্যাডভেঞ্চারার টাইপ ছেলে ছিল। বউমা ওকে শায়েস্তা করেছে। আর একটিমাত্র মেয়ে সুপর্ণা। ক্লাশ টেনের ছাত্রী। বউমা সুপর্ণাকেও সঙ্গিনী করে ফেলেছে। এখন বর্ষাকাল। তা না হলে দেখতেন দুটিতে ফুলবাগানে হুমড়ি খেয়ে বসে ফুলগাছের সেবা করছে।

রায়সায়েব ও কর্নেল নানা বিষয়ে কথা বলছিলেন। আমি বুঝতে পারছিলুম না কর্নেল হঠাৎ কেন এই প্রাক্তন রাজনীতিকের বাড়ি এসে হাজির হলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ভানু আর একটি কাজের মেয়ে বেতের টেবিল ও কফি-স্ন্যাক্সভর্তি ট্রে নিয়ে এল। রায়সায়েব বললেন, ভানু! বউমাকে বলেছিস তো কে এসেছেন?

ভানু বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। বউদিদিমণি এখনই আসছে।

ওরা চলে গেল। এতক্ষণে রায়সায়েব আমার দিকে ঘুরলেন। এঁকে তো চিনতে পারলুম না!

কর্নেল হাসলেন। আপনি সাংবাদিকদের ওপর বেজায় খাপ্পা ছিলেন। আশা করি, এখন আর তত খাপ্পা নন।

রায়সায়েব হাসলেন। ইনি বুঝি সাংবাদিক?

হ্যাঁ। আমার এই তরুণ বন্ধুর নাম জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।

রায়সাহেব বললেন, কর্নেলসায়েব! তাহলে এমনি-এমনি বলিনি আপনার গন্ধ পাচ্ছিলুম! দৈনিক সত্যসেবক আমার বাড়িতে আসে। আমার বউমা নাকি তাদের পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্রে এই কাগজটার ফ্যান। জয়ন্তবাবু কি আপনাদের স্থানীয় সংবাদদাতার পাঠানো ভুতুড়ে বাঘ আর চোরের খবর সম্পর্কে বিস্তারিত ফলোআপের জন্য কর্নেলসায়েবকে ফলো করে এসেছেন?

বললাম, ফলোআপ করার সুযোগ পেলে অবশ্য ছাড়ব না।

রায়সায়েব এবার অট্টহাসি হাসলেন। সুদর্শনটাকে সাহসী আর বুদ্ধিমান ভাবতুম। আট-দশ বছর বিদেশে কাটিয়ে এসেছে। সামান্য ব্যাপারে এত ভয় পেয়ে গেল কেন বুঝতে পারছি না! জানেন কর্নেলসায়েব? কদিন আগে সুদর্শন আমার কাছে এসেছিল। সব ঘটনা শুনে ওকে বললুম, শাটুলবাবু কোবরেজের কীর্তি। কোনো ছিঁচকে মস্তানকে টাকা দিয়ে তোমার ফার্মের কোনো ভেষজ গাছ হাতাতে চায়। সুদর্শন বললে, শাটুলবাবু নিজেই হাজারটা রোগে ভুগছেন। তা ছাড়া বাঘের ব্যাপারটার কী এক্সপ্ল্যানেশন হয়? আমি বললুম, অট্টহাসের জঙ্গলে একসময় বাঘ ছিল। এখনও না থাকার কারণ নেই। পেটের দায়ে ছাগল বা হাঁসমুরগি চুরি করতে এসেছিল।

কর্নেল বললেন, ওঁর ফার্মে ছাগল-হাঁস-মুরগি আছে নাকি? সেবার তো দেখিনি!

পাঁচু নামে একটা লোক রেখেছে সুদর্শন। পাঁচু তার বউকে নিয়ে ফার্মে থাকে। তাদের একটা ছাগল আছে। হাঁস-মুরগিও আছে। তবে পাঁচুর বউ সেগুলোকে ফার্মের বাইরে বেড়ার ভেতর রাখে। আপনি গেলেই দেখতে পাবেন। কিছুদিন আগেও আমি হাঁটাচলা করতুম। ডাক্তারের পরামর্শ! বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে সুদর্শনের ফার্ম অব্দি যেতুম। বর্ষা পড়ে গেল। তাই আর বেরোই না। এই লনেই হাঁটাচলা করি। রায়সায়েব মুখ নামিয়ে চশমার ওপর দিকে তাকিয়ে কর্নেলকে চাপাস্বরে বললেন, সুদর্শন আপনার কাছে যাবে বলছিল। গিয়েছিল তাহলে?

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, হ্যাঁ। তবে আমার আগ্রহ অট্টহাসের জঙ্গলে অর্কিড সংগ্রহ। সেবার এসেছিলুম মার্চ মাসে। জঙ্গলের ভেতর একটা ব্লাড় জমিতে পাথরের ফাঁকে একধরনের অর্কিড দেখেছিলুম। বর্ষায় তার চারা নিয়ে গেলে বাঁচানো যাবে।

এই সময়ে এক যুবতী এবং এক কিশোরী বাড়ির পেছনদিক থেকে বেরিয়ে এল। রায়সায়েব সহাস্যে বললেন, বউমা এসে গেছে। কর্নেলসায়েবের গল্প শুনে ওর খুব আগ্রহ। আর সুপর্ণা তো আপনার ফ্যান।

বউমা চন্দ্রিমা কর্নেলের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বললেন, কদিন থেকে বাবা বলছিলেন আপনি আসবেন। আপনার কত গল্প শুনেছি বাবার কাছে।

কিশোরী সুপর্ণাকে কর্নেল আদর করে নিয়ে বললেন, ইশ তুমি যে একেবারে মহিলা হয়ে উঠেছ!

সুপর্ণা বলল, কর্নেলজেঠু! ওই ভদ্রলোক কে, আমি বলতে পারি।

তাই বুঝি?

উনি আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট সেই সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি।

রায়সায়েব বললেন, ব্যাপারটা কী? আমি যে বোকা বনে গেলুম!

চন্দ্রিমা আমাকে নমস্কার করে বলল, আমরা দুজনেই কিন্তু আপনার ফ্যান। দৈনিক সত্যসেবকে আপনার কর্নেলসায়েরকে নিয়ে লেখা কত সাংঘাতিক স্টোরি পড়েছি।

সুপর্ণা বলল, কর্নেলজেঠু আর জয়ন্তদা যখন এসেছেন, তখন একটা জমজমাট রহস্য কোথাও ঘটেছে! তাই না বউদি?

চন্দ্রিমা মুখ টিপে হেসে বলল, সুদর্শনবাবুর ফার্মে চোর বাঘ আর ভূত নিয়ে কীসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। সত্যসেবকে বেরিয়েছে। পড়োনি সুপু?

সুপর্ণা চোখ বড় করে বলল, ও স্মা! আমি ভুলেই গিছলুম। কর্নেলজেঠু! আমি আপনাকে একটা ক্লু দিচ্ছি।

রায়সায়েব বললেন, কী আশ্চর্য! তোরা দুটিতে এত সব খবর রাখিস?

সুপর্ণা মুখে রহস্যের ভঙ্গি ফুটিয়ে চাপাস্বরে বলল, পাঁচু নামে সুদর্শনজেঠুর ফার্মে একটা লোক আছে। তার ভাই কিনু হিঁচকে চোর। শ্রাবন্তীদিদিমণি সুদর্শন জেঠুর রিলেটিভ। শ্রাবন্তীদিদিমণি অন্য টিচারদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। আমি শুনে ফেলেছিলুম। কিনুই নাকি ফার্মে চুরি করতে ঢুকেছিল।

কর্নেল কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, চমৎকার ব্লু। তো কিনু কী চুরি করতে ঢুকেছিল?

সুপর্ণা ফিসফিস করে বলল, চোরের স্বভাব। যা পাবে, তাই নেবে। ময়রাবুড়ির ঘরে সিঁদ কেটে কিনু জিলিপি খেতে ঢুকেছিল। ধরা পড়ে খুব মার খেয়েছিল। তাই না বাবা?

রায়সায়েব হাসলেন। হ্যাঁ। কিনু ছিঁচকে চোর তা সবাই জানে। কিন্তু বাঘের ব্যাপারটা? কিনু বুঝি বাঘবশকরা মন্তর জানে? সুদর্শনের ফার্মে বাঘ নিয়ে ঢুকেছিল কিনু। এই তোর ক্লু তো?

বাঘ এসেছিল পাঁচুর ছাগল খেতে।

কর্নেল হাসলেন। বাহ্! ঠিক ধরেছ। কিন্তু পুলিশ পাহারা দিচ্ছিল ফার্মে। কিনুকে ধরতে পারল না কেন?

বা রে পাঁচু তো ওর দাদা। দাদার ঘরে লুকিয়ে পড়েছিল। কিনুকে অ্যারেস্ট করুক পুলিশ। পিটুনি খেয়ে সব বলবে।

রায়সায়েব বললেন, তা হলে আর রহস্যটা জমল কই?

সুপর্ণা বিব্রতভাবে বলল, আমি আর কিছু জানি না। কর্নেলজেঠু জানেন।

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। রহস্য একটা আছে। সে-রহস্য একটা ভূতকে নিয়ে। ভুতটা চুরি করে না। সে রাতবিরেতে ফার্মে দামী সব ওষুধের ঝোঁপ দুমড়ে মুচড়ে ভাঙে। যাই হোক, বউমার ক্যাকটাস আর অর্কিডগুলো দেখে যাই। এখনই অন্য একখানে যেতে হবে। চলো বউমা!

চন্দ্রিমার সঙ্গে সুপর্ণা আর কর্নেল ফুলবাগানের ভেতর এগিয়ে গেলেন। রায়সায়েব বললেন, দেখা যাচ্ছে জয়ন্তবাবুর অনেক ফ্যান আছে। এই আহিরগঞ্জের মতো প্রত্যন্ত জায়গায় যখন দু-দুজন ফ্যান, তখন সর্বত্রই আছে তা ধরে নেওয়া যায়। বউমার বুদ্ধিসুদ্ধির ওপর আমার আস্থা আছে। কাজেই আমিও আপনার ফ্যান হওয়ার চেষ্টা করব।

বললুম, আমাকে আপনি তুমি বললে খুশি হব।

বেশ! তাই বলছি। রায়সায়েব একটু চুপ করে থাকার পর ফের বললেন, একটা কথা আমি সরাসরি কর্নেলসায়েবকে না বলে তোমাকেই বলছি। সুদর্শন আমাকে বলেছিল, এক একর জমিতে সে কুঙ্কুমের চাষ করেছে। তো–

ওঁর কথার ওপর বললুম, কুঙ্কুম, না জাফরান? আমি তো শুনেছি জাফরানের কথা।

জাফরানকে ভারতে কুঙ্কুম বলা হয়। তবে সাধারণ কুঙ্কুম নয়, বাজারে। হোলিখেলার সময় যা কুঙ্কুম নামে পাওয়া যায়। ভেষজ কুঙ্কুম। অবশ্য ভারতের ভেষজ কুঙ্কুম আর মধ্য এশিয়া বা পশ্চিম এশিয়ার জাফরানে নাকি পার্থক্য আছে। তো যা বলছিলুম। সুদর্শনের ফার্মে কুঙ্কুম বা জাফরান ক্ষেতে চোরের হামলার কারণ কী? সুদর্শন আমাকে খুলেই বলেছে, জাফরান চাষে সে কোটি টাকা লাভ করবে। মানেটা বুঝতে পারছ? সুদর্শনের ভাইটাল একটা পয়েন্টে কেউ আঘাত করতে চাইছে।

ওঁর কোনো শত্রু তা করতে পারে!

ঠিক। তুমি ঠিক ধরেছ। সুদর্শন জোর দিয়ে আমাকে বলেছিল, ওর সঙ্গে কারও শত্রুতা নেই। কিন্তু আমি তো জানি ওর অতীত জীবন তত ক্লিন ছিল না। ওকে দেশ ছেড়ে কেন বিদেশে পালাতে হয়েছিল, সে কথা ও ভুলে গেল কী করে?

উনি নাকি কমবয়সেই বিখ্যাত শিকারী হয়ে উঠেছিলেন?

হ্যাঁ। অট্টহাসের জঙ্গল তখন আরও বড় ছিল। ওয়াটার ড্যাম অব্দি ঘন জঙ্গল ছিল। বাঘ-ভালুক-হাতির খুব উৎপাত ছিল। হাতিরা পশ্চিমে ছোটনাগপুর এলাকায় পালিয়ে গেছে। কখনও-সখনও ভালুক দেখা যায় বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে। একটা বাঘ অন্য কোনো জঙ্গল থেকে এসে পড়াও স্বাভাবিক। কিন্তু পল্টু–মানে সুদর্শনের হাতের টিপ অব্যর্থ।

ওঁকে বিদেশে পালাতে হয়েছিল কেন?

পল্টুর বাবা রামসুন্দর সিংহরায় জমিদারের ছেলে। জমিদারিপ্রথা উঠে গেলেও এলাকার মানুষ তাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করত। পল্টুকে সিউড়ি কলেজ থেকে কলকাতার কলেজে পড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। পল্টু ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিল। তারপর সে সত্তরের দশকে নকশাল মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এই। এলাকায় ঘাঁটি করে পল্টু প্রচণ্ড সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। তখন তার মেজাজ এমন হিংস্র হয়ে উঠেছিল যে, আমার মতো মানুষকেও সে বা তার সঙ্গীরা রেয়াত করত না। অবশ্য আমার ওপর সরাসরি হামলা হয়নি। কিন্তু আহিরগঞ্জের এক বড় ব্যবসায়ী তারক দত্ত পাশের একটা গ্রাম বোলতুলির এক বড় চাষী কাসেম মোল্লা–আরও কিছু লোক পল্টুদের হাতে মারা পড়ে। তারক দত্তের ছেলে। ছিল না। দুই মেয়ের বাইরে বিয়ে হয়েছিল। দত্তের আড়ত এক মাড়োয়ারি ভদ্রলোক কিনে নিয়েছিলেন। তারকের ভাই শ্যামলের ছোটবেলা থেকেই ধর্মকর্মের বাতিক ছিল। সে তারাপীঠে এক সাধুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিল। অনেক বছর সেখানেই ছিল সে। আজকাল কোথায় আছে জানি না।

কর্নেল ফিরে এলেন এতক্ষণে। বললেন, বাহ্! সাংবাদিকের সঙ্গে জমিয়ে। আড্ডা দিচ্ছেন দেখছি!

রায়সায়েব হাসলেন। সুদর্শনের ব্যাকগ্রাউন্ড শোনাচ্ছিলুম। বউমার কীর্তিকলাপ দেখলেন?

দেখলুম। অসাধারণ!

চন্দ্রিমা বলল, অসাধারণ কিছু না। বইপত্র পড়ে লোকাল নার্শারিতে অর্ডার দিয়ে চারা বা বীজ আনিয়ে নিই।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, এ বেলা মিঃ সিংহরায়ের ফার্মে যাবার কথা। তার আগে আপনার সঙ্গে দেখা করে গেলুম। সেচবাংলোয় উঠেছি। টেলিফোনে খবর নিলে খুশি হব। চলি বউমা! সুপু! চলি। তোমার ব্লু অবহেলা করব না কিন্তু!

চন্দ্রিমা বলল, আমার অনুরোধ, কাল দুপুরে আপনারা এ বাড়িতে দুমুঠো খাবেন। কথা দিন!

কর্নেল বললেন, ঠিক আছে। রায়সায়েবের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। এখন চলি!

রায়সায়েব, চন্দ্রিমা এবং সুপর্ণা গেটে এসে আমাদের বিদায় দিল। জিপ স্টার্ট দিয়ে মোহন সিং বলল, এবার কোথায় যাবেন স্যার?

মিঃ সিংহরায়ের ফার্মে।

কর্নেলকে মিঃ সিংহরায়ের অতীত জীবনের ঘটনা বলার জন্য উদগ্রীব ছিলুম। কিন্তু মোহন সিংহের সামনে ওসব কথা বলা উচিত মনে করলুম না।

ব্রিজ পেরিয়ে পিচরাস্তা থেকে বাঁদিকে আর একটা সংকীর্ণ মোরাম রাস্তা পাঁচিলঘেরা ফার্মের গেটে পৌঁছেছে। ফার্মে আলো জ্বলে উঠল সেইসময়। হর্ন শুনে সুদর্শন সিংহরায় বেরিয়ে এসেছিলেন। একটা লোক গেট খুলে দিল। সেই সময় কুকুরের গর্জন আর প্রচণ্ড হাঁকডাক কানে এল।

জিপ একতলা সারবন্দি ফার্ম হাউসের সামনে থামল। সুদর্শন আমাদের একটা সুন্দর বিদেশি কেতায় সাজানো বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। তাঁকে খুব। গম্ভীর দেখাচ্ছিল। আমরা বসলে তিনি আস্তে আস্তে বললেন, বিকেলে হেকিমসাহেব বেরিয়ে গেছেন। এখনও ফিরছেন না। আমার অস্বস্তি হচ্ছে।

কর্নেল বললেন, ভাববেন না। যে-কোনো সময় ফিরে আসবেন।

আমি ওঁর খোঁজে বেরিয়েছিলুম। একদল আদিবাসীর সঙ্গে দেখা হলো। তাদের জিজ্ঞেস করলুম জঙ্গলের মধ্যে কোনো টুপি-আলখাল্লা পরা লোককে দেখেছে কি না। তারা শিকারে গিয়েছিল। তারা বলল, অট্টহাস মন্দিরের কাছে ওইরকম একটা লোককে দেখেছে। আমি গার্ড শিউশরণ আর গোপালবাবুকে ওঁর খোঁজে পাঠিয়েছি। গার্ডের হাতে বন্দুক আছে। তবু উদ্বেগ যাচ্ছে না। ভদ্রলোক বড় খেয়ালি।

কর্নেল বললেন, অপেক্ষা করা যাক কিছুক্ষণ। তারপর না ফিরলে আমরা বেরুব। সুদর্শন সিংহরায় শ্বাস ছেড়ে বললেন, ওঁকে সঙ্গে এনে ভুল করেছি।…