৩. মৃন্ময়ীভবন ঘিরে একটা রহস্য

মৃন্ময়ীভবন ঘিরে একটা রহস্যের গা ছমছম করা পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। ডিনারের সময় লক্ষ্য করেছিলাম, এখানে এসে সকলের মধ্যে যে হাসিখুশি ভাব ছিল, আর তা নেই। সুদেষ্ণারও চাপল্য ফুরিয়ে গেছে। সেনসায়েব বেজায় গম্ভীর। তিনি বলেছিলেন, দাদা আমাকে কতকটা এ ধরনের ঘটনার কথা বলেছিলেন। আবার তাই ঘটতে শুরু করল। কর্নেলসায়েব! সৌভাগ্যক্রমে আপনি আমার অতিথি। আপনার যেটুকু পরিচয় পেয়েছি, তা থেকে মনে হচ্ছে, ঈশ্বর আপনাকে ঠিক সময়ে এখানে পাঠিয়েছেন। আপনিই এখন আমার ভরসা।

কর্নেল তাকে আশ্বাস দিয়ে নেমে এলেন। সুদেষ্ণা এবার সঙ্গ দিল না। সে একবার বলেছিল, টমও যাকে ভয় পায়, সে নিশ্চয় ভয়ঙ্কর কিছু। সাধারণ চোর মোটেও নয়। ছোটমামা! টমকে বাইরে না ছেড়ে নিচের হলঘরেই রাখুন। এবার ব্যাপারটা আমাদের সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত।

ঘরে এসে কর্নেল বললেন, রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। শুড়ে পড়ো জয়ন্ত!

বললাম, আপনি কি রাত জেগে ওত পেতে থাকবেন?

নাহ। ভোরবেলা বেরুতে হবে। সেক্রেটারি বার্ডের ছবি এ পর্যন্ত তুলতে পারিনি, যদিও বহুবার বহু জায়গায় ওদের দেখা মিলেছে। এবার মনে হচ্ছে একটা ভালো সুযোগ এসেছে।

রাতটা নিরুপদ্রবে কেটে গেল। ঘুম ভাঙল রাম সিংয়ের ডাকে। ভেতরের দরজা খুলে দিলাম। রাম সিং গম্ভীর মুখে সেলাম ঠুকে বেড-টি দিয়ে গেল। সাতটা বাজে। বারান্দার দিকের দরজা কর্নেল ভেজিয়ে রেখে বেরিয়েছেন। বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে বেড-টি খেতে খেতে দেখলাম, সুদেষ্ণা, বনশ্রী, তন্ময় ও সৌমিত্র পুবদিকে সেই দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে সম্ভবত রাতের ঘটন নিয়ে আলোচনা করছে।

বারান্দা থেকে কান্দ্রা লেক দেখে মুগ্ধ হলাম। বিস্তীর্ণ জলাশয়ের ওপর তখনও হাল্কা কুয়াশার পর্দা টাঙানো। দূরে ঘন নীল কয়েকটা পাহাড়ের আভাস। পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমের পাহাড়টা জঙ্গলে ঢাকা। খালি চোখেই অজস্র সারস দেখতে পাচ্ছিলাম। গাছের ডগায় ঝিম মেরে বসে আছে।

সুদেষ্ণা এসে বলল, জয়ন্তবাবু! কর্নেল বুঝি মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছে?

বললাম, না। কাল বিকেলে বাইনোকুলারে সেক্রেটারি বার্ড আবিষ্কার করেছেন, তার ছবি তুলতে গেছেন। তো আপনারা ওখানে চোরের কোনও সূত্র খুঁজে পেলেন?

সুদেষ্ণা বলল, সূত্র বলতে একটাই। একটা আস্ত ঝোঁপ দুমড়ে মুচড়ে গেছে। মানুষ, না গরিলাজাতীয় প্রাণী?

এদেশে গরিলা নেই বলেই জানি।

না। আমি গরিলা বলছি না। ওই ধরনের কোনও প্রাণী কি থাকতে পারে না?

নিশ্চয় পারে। তবে সে পাঁচিল ডিঙিয়ে এ বাড়িতে ওত পাততে আসবে কেন?

ধরুন, এমন যদি হয়, ওই জন্তুটা কারও পোষা এবং সে আড়ালে থাকে?

 একটু হেসে বললাম, অসম্ভব নয়। কিন্তু তার উদ্দেশ্য কী থাকতে পারে?

ছোটমামাকে উত্ত্যক্ত করে এখান থেকে তাড়ানো। যাতে তিনি এই বাড়িটা বেচে দিয়ে চলে যান।

কেউ কি এ বাড়ি কিনতে চায়?

নাহ্। তা হলে ছোটমামার কাছে জানতে পারতাম।

আপনার কী মনে হয় বলুন?

বুঝতে পারছি না। তবে এমনও হতে পারে, এ বাড়িতে এমন দামী কোনও জিনিস আছে–ধরুন, বড়মামার উদ্ভাবিত কোনও ফরমুলা– সুদেষ্ণা একটু হেসে ফেলল। নাহ্। রহস্যকাহিনী পড়ে খালি মাথায় এ ধরনের আইডিয়া আসে।

ঠিক বলেছেন। তবে একটা কথা আছে, টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন।

সেনসায়েব টমকে নিয়ে সম্ভবত প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। তাঁকে পুবের লনে দেখা গেল। একেবারে সায়েবি কেতা। হাতে একটা ছড়ি। মাথায় টুপি। তাকে দেখে বনশ্রী, তন্ময় এবং সৌমিত্র এগিয়ে এল।

সুদেষ্ণা বলল, আমি আসছি জয়ন্তবাবু!

সে চলে গেল দলটার দিকে। আমি উঠে গিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম।

কর্নেল ফিরে এলেন পৌনে আটটা নাগাদ। ক্লান্তভাবে বসে বললেন, এ যাত্রা শুধুই ব্যর্থতা। পাখি দুটো একটুর জন্য উড়ে গেল। কয়েকটা সাধারণ। প্রজাতির প্রজাপতি দেখলাম।

বললাম, শুধুই ব্যর্থতা বলবেন না। মৃন্ময়ীভবনে একটা রহস্যের গন্ধ পেয়ে। যাননি কি?

কর্নেল তার টুপি, কিটব্যাগ, প্রজাপতিধরা জাল, বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা টেবিলে রেখে বাথরুমে গেলেন। সেই সময় সেনসায়ের এলেন। কর্নেলসায়েবকে ফিরতে দেখলাম।

ফিরেছেন। তবে সেক্রেটারি বার্ডের ছবি তুলতে পারেননি।

 উনি কি বারান্দায়?

নাহ। রাগ করে বাথরুমে ঢুকেছেন।

সেনসায়েব আড়ষ্টভাবে হাসলেন। তারপর হাঁক দিলেন, তিতি, কর্নেলসায়েবের কফি নিয়ে এস।

উনি আমার বিছানায় বসে পড়লেন। রাত্রে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?

আজ্ঞে না।

আমি শুধু ভরদ্বাজ এবং সিনহার জন্য চিন্তা করছি।

তারা কে?

আমার বন্ধু বলতে পারেন। সুশীল ভরদ্বাজ কলকাতার একটি বড় বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্তা। রমেশ সিনহা একসময় গভমেন্টের কী একটা বড় পোস্টে ছিল। এখন আমার মতোই নিষ্কর্মা। চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার শখ হয়েছিল। লোকসান খেয়ে ফেঁসে গিয়েছিল। তবে পৈতৃক সম্পত্তি যা আছে, সে বাকি। জীবনের জন্য নিশ্চিন্ত। এখন ওর হবি দুর্গম সব জায়গায় ঘুরে বেড়ানো।

সুদেষ্ণা এসে টেবিলের একপাশে ট্রে রাখল। কফির সরঞ্জামের সঙ্গে দুপ্লেট স্ন্যাক্সও এনেছে। সে বলল, তোমার সেই পালোয়ান হরি সিং এসে গেছে ছোটমামা! বউয়ের জ্বর বলে পরশু আসতে পারেনি। কাল বিকেলে জ্বর ছেড়েছে।

সে হেসে ফেলল। কর্নেল বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে অভ্যাসমতো সম্ভাষণ করলেন, মর্নিং!

সেনসায়েব মর্নিং বলে প্রজাপতিধরা জালটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিলেন। এটা কী?

সুদেষ্ণা বলল, ওঃ ছোটমামা! তুমি প্রজাপতিধরা জাল কখনও দেখনি?

কোথায় যেন দেখেছিলাম!

প্রবীরকাকুর কাছে। প্রবীরকাকুও কর্নেলের মতো লেপিডস্টারিস্ট ছিলেন না?

হ্যাঁ। বেচারা ক্যান্সারে মারা পড়ল। জিনিয়াস ছেলে ছিল।

সুদেষ্ণা আমাদের তিনজনের হাতে কফির পেয়ালা তুলে দিয়ে চলে গেল। কর্নেল বললেন, সেই রাজেনবাবুর সঙ্গে আলাপ হলো মিঃ সেন!

সেনসায়েব তুম্বো মুখে বললেন, কোথায় আলাপ হলো?

ফেরার পথে। একটা পাথরে চুপচাপ বসে ছিলেন ভদ্রলোক। আমাকে দেখে জেরা শুরু করলেন। পরিচয় দিলাম। তখন জিজ্ঞেস করলেন, লেকের ধারে ডঃ বি কে সেন নামে কারও সঙ্গে দেখা হয়েছে কি না।

সেনসায়েবকে রুষ্ট দেখাল। বললেন, বদ্ধ পাগল হয়ে গেছেন ভদ্রলোক।

হ্যাঁ। ওঁর ধারণা, ডঃ বি কে–সেনের অপঘাতে মৃত্যু হয়েছে। তাই তার প্রেতাত্মা কান্দ্রায় এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমি বুঝতে পারি না কেন দাদাকে নিয়ে রাজেনবাবুর এত মাথাব্যথা! সেনসায়েব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। এবার উনি আমার কাছে এলে আর ভদ্রতা রাখব না। টমকে লেলিয়ে দেব।

ছেড়ে দিন। মানসিক রোগীদের কোনও কোনও ব্যাপারে একটা ফিক্সেশন– মানে, বদ্ধমূল ধারণা গড়ে ওঠে। আপনি হ্যালুসিনেশনের কথা বলছিলেন। কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। ফের বললেন, উনি জজসায়েব ছিলেন। তা-ও বললেন। আপনার দাদার সঙ্গে নাকি ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল।

থাকতেই পারে। দাদা কান্দ্রা রিসর্টে জনপ্রিয় ছিলেন। সবাই তাকে শ্রদ্ধাভক্তি করত। বলে সনৎ সেন উঠে দাঁড়ালেন। আপনারা ব্রেকফাস্ট করবেন কটায়?

নটায়। অবশ্য যদি অসুবিধে না থাকে।

 ছি ছি! কী বলছেন? আপনারা আমার সম্মানিত অতিথি।

সেনসায়েব বেরিয়ে যাওয়ার পর বললাম, ওই রিটায়ার্ড জজসায়েবের ওপর মিঃ সেন যেন বেশিরকম খাপ্পা।

কর্নেল হাসলেন। সেটা স্বাভাবিক। কারও দাদা ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বললে ছোটভাই খাপ্পা হতেই পারে।

একটা ব্যাপারে আমার একটু খটকা লাগছে।

কী ব্যাপারে?

সেনসায়েব এবার এসে আবার রাম সিংয়ের ভাই হরি সিংকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। লোকটা নাকি পালোয়ান। সে এসে গেছে। ওদিকে ওঁর দুই বন্ধুরও আসার কথা। কোন বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্তা সুশীল ভরদ্বাজ এবং দেশে-বিদেশে টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো জনৈক রমেশ সিনহা।

কর্নেল বাইনোকুলার নিয়ে বারান্দায় গেলেন। তারপর বাইনোকুলারে লেক দেখতে থাকলেন। একটু পরে বললেন, সত্যিকার খটকা হলো, এক রিটায়ার্ড জজসায়েবের আচরণ। লেকের পশ্চিমে একটা টিলার মাথায় কোনও দেবতার পোড়োমন্দির আছে। এখনও উনি সেখানে বসে আছেন। আমাকে বলছিলেন, ডঃ বি কে সেনের প্রেতাত্মার সঙ্গে ওঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে ওখানে।

হাসতে হাসতে ওঁর কাছে গিয়ে বললাম, আমাকে একবার দেখতে দেবেন?

 দেখ। বলে কর্নেল বাইনোকুলার আমার হাতে দিলেন।

বাইনোকুলারে দেখলাম, ঢিলে প্যান্টশার্টপরা রোগাটে চেহারার এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক একটা পাথরে বসে ছিলেন। এইমাত্র হঠাৎ উঠে গিয়ে একটা ভাঙাচোরা মন্দিরের আড়ালে অদৃশ্য হলেন। বললাম, প্রেতাত্মা এসে গেছে মনে হচ্ছে। মন্দিরের আড়ালে চলে গেলেন রাজেনবাবু।

কর্নেল আমার কাছ থেকে বাইনোকুলার ছিনিয়ে নিলেন। তারপর নিজে দেখতে থাকলেন। কিছুক্ষণ দেখার পর উনি বারান্দা থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে দক্ষিণের পাঁচিলের দিকে গেলেন। লক্ষ্য করলাম, কর্নেল বাইনোকুলার অ্যাডজাস্ট করে নিচ্ছেন। এ সময় ওঁকে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না, আমার যত কৌতূহলই থাক।

একটু পরে সুদেষ্ণা আর একজন ঘোমটা-ঢাকা মেয়ে ঘরে এল। মেয়েটি কফির ট্রে যত্ন করে গুছিয়ে তুলে নিয়ে গেল। বুঝলাম, মেয়েটি রাম সিংয়ের বউ। সুদেষ্ণা বারান্দায় এসে বলল, কর্নেল কি সেই পাখি খুঁজছেন?

বললাম, না। রাজেনবাবুকে।

 কেন?

ঘটনাটা সকৌতুকে বললাম। সুদেষ্ণা কিন্তু হাসল না। একটু চুপ করে থাকার পর চাপাস্বরে বলল, আপনাদের বলেছি, বড়মামার মৃত্যুর ঘটনা আমার কাছে এখনও রহস্যজনক থেকে গেছে। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে, গত মার্চে ছোটমামার সঙ্গে এখানে আসার পর রাজেন দ্বিবেদী আমাকে অদ্ভুত কিছু কথা বলেছিলেন সেগুলো হয়তো পাগলামি নয়।

 কী বলেছিলেন উনি?

এক মিনিট। বলছি। বলে সুদেষ্ণা ভেতরের দিকের দরজা বন্ধ করে এল। তারপর বারান্দায় দাঁড়াল। চারদিকটা দেখে নিয়ে সে বলল, চলুন! কর্নেলের কাছে যাই। ওঁরও শোনা দরকার।

ততক্ষণে কর্নেল বাঁ দিকে ফুলের ঝোপের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা দরজার কপাট খোলার চেষ্টা করছেন। সুদেষ্ণা বলল, ওই দরজা দিয়ে একসময় আমরা লেকের ঘাটে যেতাম। কিন্তু দুবার দুটো বিষাক্ত সাপ দেখা গিয়েছিল বলে ঘাটে যাওয়ার সাহস হয় না। দাদামশাইয়ের বাবার আমলে তৈরি ঘাট। ফেটে গেছে। ঝোঁপ গজিয়েছে। তা ছাড়া লেকের জলটাও খারাপ। কেন জানেন? খনি এলাকার সব আবর্জনা লেকে ফেলা হয়।

সে হন্তদন্ত হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল। কর্নেল ঘুরে আমাদের দেখে বললেন, আবার চোর ঢুকেছে নাকি?

সুদেষ্ণা হাসল। না। আপনাকে নিষেধ করতে এলাম। ওই দরজাটা খুলবেন না।

কেন?

 ওখানে বিষাক্ত সাপের উপদ্রব, তা ছাড়া ঘাটে নামাও যাবে না।

দেখেছি। বলে কর্নেল দরজার আগড়টা হ্যাঁচকা টানে খুলে ফেললেন। কিন্তু কপাট ঠেলে সরানো গেল না। উঁকি মেরে দেখলাম, ওপাশে ঘন ঝোঁপ গজিয়ে বাইরের দিকটাও দুর্ভেদ্য করে রেখেছে। এদিকে কপাটের তলার দিক মাটিতে কয়েক ইঞ্চি চাপা পড়েছে।

কর্নেলও উঁকি মেরে দেখে আগড়টা আটকে দিলেন। সুদেষ্ণা বলল, কর্নেল! রাজেনবাবু সম্পর্কে আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।

বেশ তো! বলো।

সুদেষ্ণা আবার চারদিকটা দেখে নিয়ে চাপাস্বরে বলল, গত মার্চে ছোটমামার সঙ্গে কান্দ্রা এসেছিলাম। একদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে রেললাইনের ধারে গেছি, হঠাৎ দেখি রাজেনবাবু ওপাশের রাস্তা ধরে হন্তদন্ত এগিয়ে আসছেন। ভাবলাম, এই রে! পাগলের পাল্লায় পড়ে এবার কান ঝালাপালা হবে। তক্ষুণি আমি ঘুরে হাঁটতে শুরু করেছি, যেন এঁকে দেখিনি। কিন্তু উনি দৌড়ে এসে আমার কাঁধ খামচে ধরলেন। খাপ্পা হয়ে ওঁকে থ্রেট করলাম। তখন কঁধ ছেড়ে দিয়ে উনি পাগলাটে হাসি হেসে বললেন, তোমার ছোটমামাকে বোলো তোমার বড়মামার সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়। সময় হলেই তোমার বড়মামা শত্রুকে ঢিট করে ফিরে আসবেন। জিজ্ঞেস করলাম, কে বড়মামার শত্রু? রাজেনবাবু বললেন, তা বলব না। নাম বললেই আমাকে সে মেরে ফেলবে। আর তো আমি জজ নই যে শয়তানটাকে জেলে পুরব বা ফাঁসিকাঠে ঝোলাব।

কর্নেল সুদেষ্ণার কথাগুলো মন দিয়ে শুনছেন বলে মনে হলো না। উনি বললেন, রাম সিং বা তার পালোয়ান ভাই যদি পাঁচিল টপকে গিয়ে এই দরজার ওপাশের ঝোঁপগুলো না কাটতে চায়, অগত্যা আমাকেই হাত লাগাতে হবে।

সুদেষ্ণা অবাক হয়ে বলল, সত্যি বলছি কর্নেল, ঘাটে বিষাক্ত সাপ আছে। দুটোই নাকি কেউটে। ছোটমামা স্বচক্ষে দেখেছিলেন। রাম সিং লাঠি নিয়ে আসার আগেই সাপ দুটো লুকিয়ে পড়েছিল।

কর্নেল হাসলেন। আমি রিটায়ার্ড সামরিক লোক। বনে জঙ্গলে গেরিলাযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আছে। বিষাক্ত সাপের পাল্লায় বহুবার পড়েছি। তা ছাড়া সাপ বিষয়েও আমার মোটামুটি অভিজ্ঞতা আছে।

কথা বলতে বলতে আমরা সেই বারান্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ কর্নেল বাড়ির পশ্চিম দিকটা দেখিয়ে সুদেষ্ণাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওটা কি তোমাদের ঠাকুরঘর নাকি?

ছিল।

তার মানে, এখন নয়। কেন বলো তো?

সুদেষ্ণা আস্তে বলল, ছোটমামিমা মৃত্যুর আগে স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন, ওই মন্দিরের বিগ্রহ কলকাতার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মন্দিরটা নাকি অপবিত্র হয়েছে।

কী বিগ্রহ ছিল?

 রাধাকৃষ্ণের অষ্টধাতুর বিগ্রহ।

মন্দির অপবিত্র হওয়ার কারণ কী, তুমি জানো?

শুনেছিলাম, সেবায়েত ভদ্রলোক নাকি মদ-টদ খেতেন। মাতাল অবস্থায় রাধাকৃষ্ণকে মাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করতেন। তাকে অবশ্য মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছোটমামিমা মারা যাওয়ার আগেই মন্দিরে তালা আটকে দেওয়া হয়েছিল। আমার দুই মামাই কিন্তু ধর্মকর্মের ধার ধারতেন না। ইদানীং ছোটমামার ধর্মে একটু মতি হয়েছে। এখানে আসার পর বলছিলেন, মন্দিরটা ভেঙে নতুন একটা মন্দির তৈরি করবেন। আবার রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করবেন।

দোতলার একটা ঘরের জানালা থেকে বনশ্রী ডাকল, তিতি! এই তিতি!

সুদেষ্ণা মুখ তুলে বলল, বলো?

বাহ্। তুমি দিব্যি রহস্য নিয়ে মেতে আছ। এদিকে আমি হিমশিম খাচ্ছি শিগগির এস।

সুদেষ্ণা হাসল। বনিবউদি অকম্মার ধাড়ি। মাত্র কয়েকজন লোকের ব্রেকফাস্ট। তাতেই কুপোকাত।

সে হাসতে হাসতে চলে গেল। আমরা ঘরে ঢুকলাম। কর্নেল তার বিছানায়। বসে স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে মৃদুস্বরে বললেন, ঘাটের ঝোঁপগুলো পরিষ্কার করতেই হবে। সেনসায়েব কী বলেন দেখা যাক।

জিজ্ঞেস করলাম, ঘাটে এমন কী আছে যে এত ঝুঁকি নিতে চাইছেন?

কর্নেল একটু হেসে নিভে-যাওয়া চুরুটটি ধরালেন। তারপর ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, অন্য কোনও মানুষ যদি কেউটে সাপকে ভয় না পায়, আমিই বা পাব কেন?

অবাক হয়ে বললাম, অন্য কোনও মানুষ? তার মানে, ওখানে কাউকে দেখেছেন?

মুখটি বুজে থাকো। তিতি তোমার ফ্যান। তার প্রতি তোমারও আকর্ষণ স্বাভাবিক।

ভ্যাট! আপনি এ বয়সেও সবসময় রসে টইটম্বুর। তিতি আসলে আপনারই ফ্যান।

কর্নেল হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, অনেকদূর থেকে বাইনোকুলারে দেখা! তাহলেও আমি লোকটাকে ঘাটে ঝোপের মধ্যে বসে থাকতে দেখেছি। কিন্তু সাবধান! মুখ বুজে থাকবে। ভেতরের দরজার কড়া নাড়ছিল কেউ। দরজা খুলে দেখি, বনশ্রী এবং সুদেষ্ণা আমাদের জন্য ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছে।