২. রাত নটা থেকে এগারোটা

রাত নটা থেকে এগারোটা

সায়ন্তনের মধ্যে একটা সহজাত জেদ আছে, যা তার গুরুতর ভয়ের সময়েও নিপুণভাবে কাজ করে। সে ভিতরে ভিতরে ছটফট করছিল। অবশ্য ভয়ে নয়– অস্বস্তিতে। বাড়িটা মনে হচ্ছিল একটা ষড়যন্ত্রের ঘাঁটি এবং কোথাও ওঁৎ পেতে আছে এক মারাত্মক খুনী–যাকে বরং বলা যায়, হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক।

অবশ্য তার এই ধারণার পিছনে সোমনাথের সম্ভাব্য ছবির বিষয় কাজ। করছে, এমনও হতে পারে। সোমনাথ এবার একটা অদ্ভুত ছবির থিম নিয়েছে– প্রকৃতি ও সময়। উভয় শক্তির সংঘর্ষে নাকি যে ফেনিল উদ্বেল পরিস্থিতি, তার নাম ত্রাস–হরর। ব্যাপারটা ভারি জটিল। সায়ন্তনের মাথায় ঢোকেনি। সায়ন্তন। জেনেছে, সকালে রোদ্দুর ফুটলে কোথাও এখানে ফাটা নির্জন দেয়ালের ব্যাকগ্রাউন্ডে তাকে কিছু একটা করতে হবে, এবং সোমনাথ ক্যামেরা ধরবে। সায়ন্তন অবশ্য জানে না, সে হিরো কি না। যেমন স্মিতা বা শ্রীলেখাও জানে না কে নায়িকা। আসলে কেউ কিছু জানে না–পরিচালক সোমনাথ ভট্টও না।

সায়ন্তন শ্রীলেখা ও স্মিতার দিকে তাকাল। আজ সকালেই পরস্পর পরিচিত হয়েছে। সবাই। চার জায়গার চারটি যুবক-যুবতী বেছে কুড়িয়ে একখানে জড়ো করেছে শ্রীভট্ট। তাদের দিয়ে স্পষ্ট কী করাবে ঠিক নেই। তাই প্রচুর থ্রিল অনুভব করছিল সবাই। কিন্তু এখন–অন্তত সায়ন্তন ছবির ব্যাপারটা আর আমল দিতে চাইছে না। তার খালি মনে হচ্ছে, একটা বীভৎস খুন ঘটবে। যে কোন সময়–এই পুরনো ভাঙাবাড়ির সিঁড়িতে আততায়ীর চাপা পায়ের শব্দ। শব্দ তার মগজের ধূসর ভাঁজে ঘুনপোকার মতো কুরে খাচ্ছে।

সহজাত জেদটা হঠাৎ সায়ন্তনের চুল ধরে নাড়া দিল। সে হাত বাড়িয়ে টর্চটা নিয়ে কাকেও কোন কথা না বলে বেরোল। একবার তন্নতন্ন খোঁজা, দরকার। এমনও হতে পারে, আর কেউ না–নিরুক্তই তাকে এখান অব্দি অনুসরণ করে এসেছে কলকাতা থেকে। ওকে কিছু বিশ্বাস নেই। শাশ্বতাঁকে সে নাকি পাগলের মতো কোন সময় ভালবাসত। শাশ্বতীর সঙ্গে কী কারণে তার বিয়ে হয়নি। কিন্তু তবু ওকে সে রাহুগ্রাসে আটকে রাখতে চাইত–এসব শাশ্বতীরই বর্ণনা। যাই হোক, শাশ্বতীর এখন তো দিব্যি অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেছে। তার স্বামী ভালো রোজগার করে। একটা গাড়িও আছে। অফিসের এক্সপেন্স অ্যাকাউন্টে ভদ্রলোক স্ত্রীকে নিয়ে মজাসে দিল্লী-বোম্বে ঘোরে। বিয়ের পর একদিন এক সুযোগে হাসতে হাসতে সায়ন্তন বলেছিল, তুমি মুসলমান তা বলে দিয়েছি নিরুক্তকে। নিরুক্ত তো খেপে গেছে-সাবধান!

সায়ন্তন মুসলমান–তা সোমনাথ এবং এরা কেউ জানে না। জানলে কি কিছু ক্ষতি হত? ওলোটপালট হয়ে যেত সব? অথচ কী একটা হয় সায়ন্তনের অদ্ভুত ভীতি কিংবা অস্বস্তি; যেন তক্ষুনি সে সব ব্যাপারে ব্যর্থ হয়ে যাবে কিংবা কেউ তাকে আমল দেবে না। মাঝে মাঝে নিজের এই ছদ্মবেশের দীনতম হীনম্মন্যতা তার কাছে স্পষ্ট হয়। সে ঠিক করে ফেলে, এই হিন্দুত্বের পোশাকটা ছেড়ে বেরিয়ে পড়া দরকার। কিন্তু শেষঅব্দি দেখতে পায়, পরিচিতিটা মোটামুটি বেশ অনেকখানি ব্যাপ্ত হয়েছে–তাই এখন কিছু করতে গেলে হয়তো দারুণ ওলটপালট হয়ে যাবে।

আলিপুর এলাকা ছেড়েছে তিন বছর আগে। তারপর থেকে এই সায়ন্তন। গুপ্ত নাম এবং হিন্দুত্বের ছদ্মবেশ। মাঝে মাঝে মেদিনীপুরে নিজের বাড়িতে, চলে যায় এবং টাকাপয়সা নিয়ে আসে। ওর বাড়িতে সবাই জানে, ফরিদ কলকাতায় থেকে এম. এ. পড়ছে। চূড়ান্ত মিথ্যে। ফরিদ মধ্য কলকাতায় একটা একঘরা ফ্ল্যাট নিয়ে হোটেলে খাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে ফিল্মি দুনিয়ায় এবং চেহারা ও ব্যক্তিত্বের সুযোগে দুচারটে প্রেম করতে পারছে বলা বাহুল্য, প্রেমিকারা হিন্দু এবং ওকে সায়ন্তন গুপ্ত বলেই জানে। ফরিদ ওরফে সায়ন্তন ফিল্মে হিরো হতে চায়। যদিও মাঝে মাঝে নিজের কাছে এটা ভাঁড়ামির মতো লাগে, সে এড়িয়ে যায়। কারণ, বস্তুত ছবির জগতেই তার মানসিক বিচরণ অবিশ্রান্ত–সে নিরন্তর পর্দায় রহস্যময় প্রতিফলনে নিজেকে ছড়িয়ে রাখে। শাশ্বতীর সঙ্গে প্রেম। প্রগাঢ় হলে সে একদিন খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছিল নিজের পরিচয়। শাশ্বতী। হেসে খুন যাকে বলে! পরে অবশ্য ভীষণ রেগে গিয়েছিল–সেটাও ওর মুসলমানত্বের দরুন নয়, সঠিক পরিচিতি গোপন করার জন্যে। যাই হোক, তবু চালিয়ে যেতে পারত শাশ্বতী আসলে তাকে ভালবেসেছিল নিশ্চয়; কিন্তু সরে আসতে হল নিরুক্তর শাসানিতে। এখানেও শেষ হতে পারত সব–হয়নি, শাশ্বতী নিরুক্তকে সব বলে দিয়েছিল। শাশ্বতীর মধ্যে ধর্মবোধটোধ আদতে নেই-ই; সে একালের গল্পের তরলমতি ছেলে-মেয়েদের একজন–যারা খেলার বেঁকে ব্যাঙের ওপর ঢিল ছুঁড়ে মারছিল। শাশ্বতীর কৌতুকবোধ সায়ন্তনরূপী ফরিদের বিপদের মেঘ ভাসিয়ে আনার পক্ষে যথেষ্ট। নিরুক্তটা জন্মখুনী। অনেক রাজনৈতিক খুনজখমে সে হাত পাকিয়েছে। ফের বাসা বদলাতে হয়েছিল সায়ন্তনকে। এদিকে নিরুক্ত হঠাৎ পুলিসের পাল্লায় পড়ে যায়। কিছুকাল স্বস্তিতে কাটানো গিয়েছিল। সম্প্রতি কদিন আগে কাগজে যে বন্দীমুক্তির খবর বেরিয়েছে, তাতে নিরুক্ত ত্রিপাঠীর নাম দেখা গেছে। সায়ন্তন বাসা থেকে খুব কম বেরিয়েছে গত কদিন যাবৎ। হঠাৎ এই সোমনাথ ভট্টের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে যায় এবং এই যোগাযোগ ঘটে। এখন প্রথম প্রশ্ন : সোমনাথ কি নিরুক্তকে, চেনে? জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না। অবশ্য, এও ঠিক–চিনলে সায়ন্তনের আসল পরিচিতি সোমনাথ টের পেত এবং তাকে সোজা বলত। সোমনাথ খুব। স্পষ্টভাষী মানুষ। সুতরাং এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন : নিরুক্তের সঙ্গে বাকি কজনের পরিচয় আছে কি না? থাকতে পারেনাও পারে। থাকলে কিছু যায়-আসে না। এরা কেউ তো সকাল অব্দি জানত না ইউনিটে কে-কে যাচ্ছে। এরপর তৃতীয় প্রশ্ন : নিরুক্ত কি কোন উপায়ে টের পেয়ে তাকে গোপনে অনুসরণ করেছে? এর জবাব হল–তা কেন করবে? নিরুক্ত হয়তো ভুলেই গেছে শাশ্বতীর কথা। তার কথাও। তাছাড়া, গোপনে চুপিচুপি অনুসরণ করার পাত্র নিরুক্ত নয়। সে সোজা সামনে দাঁড়াবে। চার্জ করে বসবে। শাশ্বতীর জাত মেরেছে!

সায়ন্তন বারান্দায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজের এইসব ভাবনার মুখোমুখি হল এবং শেষে একটু হাসল। যা ভাবছে, তা হাস্যকর, উদ্ভট, অলীক। কোনরকমে যুক্তির ধোপে টেকে না। অথচ, এও সত্য যে সে নিরুক্তর প্রতি একটা প্রচণ্ড আতঙ্ক মনে রেখেছে। সেটা অহেতুক হোক, যাই হোক–কিন্তু আছে। তার চমক সে প্রতি মুহূর্তে টের পাচ্ছে। তার মানে, নিরুক্তর আততায়ী ইমেজটা অন্তত এখন এই ভুতুড়ে কারখানায় বৃষ্টির রাতে বার বার ভেসে উঠছে–সেটা যত অবাস্তবই হোক।

সায়ন্তন, টর্চ জ্বেলে সিঁড়ি খুঁজল। দেখতে পেল। সিঁড়িটা সঙ্কীর্ণ–পাথরের ধাপ। সেকালে এমন সরু আর ঘোরালো সিঁড়ি করার একটি কারণই থাকতে পারে–সে হচ্ছে : দুশমনের আক্রমণ রোখা। সায়ন্তন সিঁড়িতে পা বাড়াতেই দারুণ চমকে উঠল। কে তার পিঠ ছুঁয়েছে এবং ফিসফিস করে উঠেছে–কোথায় যাচ্ছেন?

চকিতে ঘুরে টর্চ ফেলল সে। সিতারা!

ওপরে ইয়াকুব গজগজ করছে শোনা গেল। তারপর তার একচোখা লণ্ঠনের ছটা দেখা গেল। সিতারা সঙ্গে সঙ্গে সরে তার ঘরে গিয়ে ঢুকল।

সায়ন্তন হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েকমুহূর্ত। তারপর সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠে যেতেই ইয়াকুবের মুখোমুখি হল। ইয়াকুব বলল, কোই চুটিভি নেহী দেখা হুজুর! বিলকুল খালি হ্যায়-ঔর জঞ্জাল! আইয়ে–আপভি দেখ লিজিয়ে।

.

শান্তকে হঠাৎ আবার বেরোতে দেখে সোমনাথ বলল কোথায় যাচ্ছ?

 শান্ত জবাব দিল, দেখি, সায়ন্তনবাবু কী করছেন!

অন্ধকার। যেও না-টর্চ নেই আর!

স্মিতা আর শ্রীলেখা লক্ষ্য করছিল। স্মিতা হাসল, শ্রীলেখা গম্ভীর। শান্ত কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেল। সোমনাথ চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকল।

শান্ত বারান্দায় গিয়ে দেখল সিতারা তার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে টিমটিমে একটা লম্ফ জ্বলছে। শান্ত সকৌতুকে বলল, তারপর সিতারা বেগম!

সিতারা কেমন হাসল–আলো তার পেছনে বলে হাসির ভাবার্থ স্পষ্ট নয়। শান্ত তার কাছে গেল। …বিপদটা কিসের বলো তা বেগম সাহেবা, শুনি!

সিতারা ভুরু কুঁচকে বলল, ঠাট্টা আমি পছন্দ করিনে।

তুমি রহস্যময়ী, সিতারা!

সিতারা একটু চুপ করে থেকে বলল, আপনারা কে? কেন এসেছেন এ ভুতুড়ে বাড়িতে?

সিনেমার ছবি তুলতে।

এখানে কী ছবি তুলবেন? শিগগির চলে যান এখান থেকে।

কেন? সেটাই জানতে এলুম।

 এটা গোরস্থান। শয়তানের আড্ডা।

 শয়তান! সে আবার কী! ..শান্ত হেসে উঠল। …ভূতপ্রেত?

 থেকে দেখুন, শয়তান কী।

সিতারা, তুমি বাংলা বলতে পারো। আমার অবাক লাগছে কিন্তু! তোমার স্বামী তো খাঁটি অবাঙালি! ব্যাপারটা কী বলো তো?

ব্যাপার আবার কী? আমরা বাংলা, খোট্টাই উর্দু–দুটোতেই কথা বলি। বুড়ো এখন খান্দানী দেখাচ্ছে আপনাদের সামনে–তাই।

কী কাণ্ড! ইয়াকুব বাংলা বলতে পারে?

 খুব। চেপে ধরুন না, বলবে। …সিতারা আবার হাসল। …এই লালবাগে আমরা সাতপুরুষ ধরে বাস করছি।

বাঃ। আচ্ছা সিতারা, তুমি তখন আমাকে দেখে হাসলে কেন?

এমনি।

উ হু। এমনি কেউ হাসে না।

আমি হাসি। আমার অভ্যেস।

 সিতারা, ইয়ে–তোমার এই লোকটার সঙ্গে বিয়ে হল কেন?

সিতারা মুখ নামাল।

 লজ্জা হচ্ছে বুঝি?

 সিতারা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, বরাত। তাছাড়া কী বলব?

সিতারা, তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগছে।

সিতারা ওর মুখের দিকে তাকাল। একটু হাসল। …আমাকে অনেকের ভালো লাগে। ওটা কোন কথা নয়; বাবু।

যাক গে, এর সঙ্গে তোমার বিয়ে হল কেন?

আমাদের খান্দানে বরের অভাব, তাই। বাঙালি মুসলিম খান্দানে তো আমাদের মেয়ে দেয় না। দেখবেন, কত মেয়ে বুড়ী হয়ে মরে গেল, বর জোটেনি। আমার বরাত, বাবু।

এই জঙ্গলে গোরস্থানে তোমার খারাপ লাগে না, সিতারা?

লাগে তো। কী করব?

শান্ত মুচকি হেসে বলল, তোমার চেহারা তো সুন্দর। সিনেমায় নামবে? চেষ্টা করতে পারি।

সিতারা চাপা হাসল। ..সিনেমা আমি প্রায়ই দেখি। আমার বুড়ো সেদিকে খুব ভালো। কিন্তু হঠাৎ সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। …বুড়ো আসছে। আপনি চলে যান বাবু! বলে সে ঘরের ভিতর চলে গেল। বাঁশপাতার কপাট দুটো ঠেলে দিল দরজায়।

শান্ত সিঁড়ির কাছে গেল। আলোর ছটা আসছে। তারপর ইয়াকুব একচোখা আলো ফেলল ওর ওপর। … কোই নেই হ্যায়, সাব। বিলকুল খালি।

ইয়াকুব, ও-বাবু কোথায়?

 ইয়াকুব সিঁড়ির মাঝামাঝি বাঁকে দাঁড়িয়ে মুখ ঘুরিয়ে ডাকল–হুজুর!

সায়ন্তনের সাড়া এল না।

ইয়াকুব বলল, উপরমে রহ্ গিয়া। আপভি যানা শাকতা, সাব। যাইয়ে।

শান্ত হঠাৎ কয়েকধাপ উঠে ওর একটা হাত চেপে ধরে বলে উঠল– ইয়াকুব, তুমি তো বাংলায় কথা বলতে পারো। বলছ না কেন?

ইয়াকুব ভড়কে গেল। কাচুমাচু মুখে বলল, থোড়াসা হুজুর–থোড়া পারি।

 চালাকী করো না। খুব ভালোই পারো।

জী নেই–নেহী! কৌন বোলা হুজুর?

শান্ত ওর হাতটা আরও চেপে ধরে একটু মোচড় দিল। …বুড়ো, তুমি ভারি সেয়ানা। বলো, বাংলা বলো!

ইয়াকুব বিকৃতমুখে বলল, আঃ, ছোড় দিজিয়ে-ছেড়ে দিন। এ ক্যায়সা তামাশা, সাব?

শান্ত আরও মোচড় দিল।…তোমাকে ছাড়ছিনে খাঁ সাহেব। বলো, বাংলায় কিছু বলো! ওসব খান্দানী ছাড়োদিকি চাঁদ!

ইয়াকুব ককিয়ে উঠল–আরে বাপ রে বাপ! জান মার দিয়া রে! আপ আদমী আছে, না পাগলা হুজুর? আঃ হা হা! হুজুর, এ বড়াহুজুর! …সে চ্যাঁচাতে থাকল এবার।

সিতারা এল সঙ্গে সঙ্গে। …এ কী করছেন আপনি? ছাড়ুন ওকে, ছাড়ুন বলছি! ওসব আদিখ্যেতা কলকাতায় গিয়ে করবেন। আমি তখনই বুড়োকে বললুম, এসব আপদ বিদেয় করো–শুনলে না! এসব মাকালফল আমি চিনিনে? ঢঙ করবার জায়গা পায় না সব–বেরিয়ে পড়েছে দিগ্বিজয় করতে।…

ইয়াকুবকে ছেড়ে দিয়ে শান্ত ওপরে যেতে যেতে নিচে সোমনাথের কণ্ঠস্বর শুনল। সোমনাথ বলছে, কী হয়েছে ইয়াকুব? ইয়াকুব হাউমাউ করে কী সব বলতে লাগল।

শান্ত ওপরে গিয়ে হোঁচট খেল ইটকাঠের জঞ্জালে। তারপর সাবধানে ঠাহর করে পা বাড়াল। দরজা-জানালা সব খাঁ-খাঁ করছে। বৃষ্টির ছাট এসে পড়ছে। সে ডাকল–সায়ন্তনবাবু, সায়ন্তবাবু।

কোন সাড়া পেল না। তখন হাত বাড়িয়ে সামনেটা দেখে নিতে নিতে সে এগোল। ডাইনে থামওলা বারান্দা। দরজা দিয়ে বারান্দায় যেতেই সে দেখল সায়ন্তন টর্চ জ্বেলে মেঝেয় কী লক্ষ্য করছে। শান্ত বলল, কী দেখছেন সায়ন্তনবাবু?

সায়ন্তন চমকে উঠল। তারপর শান্তকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে বলল, সিগারেটের ছাই খুঁজছি।

শান্ত হেসে বলল। …পেলেন?

নাঃ। সায়ন্তন টর্চের আলো নিচে কবরগুলোর ওপর ফেলে বলল, কিন্তু আশ্চর্য, আমি ঠিকই দেখেছিলুম।

আমিও।

কে হতে পারে, ভাবুন তো লোকটা?

 শান্ত চাপা গলায় বলল, হয়তো সিতারা বেগমের প্রেমিক।

দুজনেই হাসতে লাগল। তারপর শান্ত বলল, মেয়েটা আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল, জানেন? বলছিল, এখানে থাকলে বিপদ হবে।

সে কী!

যাই হোক। ব্যাপারটা দেখা যাক্, কী ঘটতে পারে।

না দেখেও তো উপায় নেই। মাথার ওপর ছাদ পাওয়া গেছে বৃষ্টির রাতে। এই যথেষ্ট।

সায়ন্তনবাবু, আপনি কখনো মারামারি করেছেন?

 কেন, কেন?

করেছেন কি না বলুন না!

 সায়ন্তন একটু চুপ করে থেকে বলল, একবার-খুব ছেলেবেলায়। কেন?

প্রেম নিশ্চয় অনেক করেছেন?

হ্যাঁ–না, মানে.. গলা শুকিয়ে গেল সায়ন্তনের।

 করেছেন।

এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন শান্তবাবু?

এমনি। কোন উদ্দেশ্য নেই। শান্ত সিগারেট বের করে জ্বালল। তারপর প্যাকেটটা এগিয়ে দিল সায়ন্তনের দিকে। …স্যরি! অভ্যাস। নিন।

সায়ন্তন টর্চ নিভিয়ে সিগারেট নিল। জ্বালল। তারপর বলল, কাল যদি রোদ্দুর না ফোটে, সোমনাথদা কি এখানেই থেকে যাবেন?

কে জানে! তবে অনন্তকাল থাকার জন্য কেউ নিশ্চয়ই আসেনি।

 বৃষ্টি কমে যাচ্ছে কিন্তু।

বাঃ! বলেই শান্ত হঠাৎ পিছনে ঘুরল। … টর্চ জ্বালুন তো?

তক্ষুনি টর্চ জ্বালল সায়ন্তন। কেউ নেই। বলল, কী?

 যেন পায়ের শব্দ শুনলুম।

ভুতুড়ে বাড়িতে এমন হয়। ছেড়ে দিন। চলুন, নিচে যাই। খুব খিদে পেয়েছে।

দুজনে একটা ঘরের ভিতর দিয়ে সিঁড়ির কাছে এল। সেই সময় শান্ত বলল, শ্রীলেখা ঘড়িমিস্তিরির বউ কেমন করে জানলেন?

সায়ন্তন জবাব দিল, যেন তাই মনে হয়েছিল। সে অস্ফুট হাসল।

স্মিতাকে দেখে কী মনে হয়েছিল?

 ব্রিলিয়ান্ট?

মহিলাটি নাচতে পারেন সম্ভবত। হাঁটার ভঙ্গিটি লক্ষ্য করবেন

 আপনি বড় অদ্ভুত সায়ন্তনবাবু।

কেন?

আমাকে দেখে কী মনে হয়েছে, আগে বলুন।

খুব বড় ঘরের ছেলে।

তোয়াজ করছেন।

না–আমি গন্ধ পাচ্ছি!

ফুঃ! আমার বাবা ছিলেন ফুড-কেরানি–সুইসাইড করে মারা যান।

সে কী!

আমার মা আমাকে মাসির কাছে রেখে চলে যান, আর আসেননি।

সাবধানে নামুন–এখানটা ভাঙা। গর্ত আছে।

সায়ন্তনবাবু, আপনি কে?

সিঁড়ির শেষ ধাপে টর্চ নিভে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্যে। ফের জ্বলল।

সায়ন্তন বলল, আমি–আমি আবার কে? বেকারবাউন্ডুলে। ফিল্মে নামার সখ আছে। পরক্ষণে পা বাড়াতেই সে আছাড় খেল।

শান্ত কাছে এসে হাত ধরে তুলল ওকে। ..খুব লাগল নাকি?

 সায়ন্তন হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। নার্ভাস গলায় বলল, নাঃ।

.

সোমনাথের সব ব্যবস্থা নিখুঁত। খিচুড়ি-ডিমসেদ্ধ, পাঁচজনে এলোমেলো কথা বলতে বলতে খেল। শ্রীলেখার রান্নার প্রশংসা হল প্রচুর। তারপর বারান্দায় ইয়াকুবের রাখা বালতির জলে নিজের নিজের হালকা রঙিন প্লেটগুলো ধুতে আরো আধঘণ্টা সময় লেগে গেল। ইয়াকুব থামের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখে অভিমান ও দুঃখের গাম্ভীর্য আছে। শান্ত ধুয়ে উঠলে পালা শেষ হয়েছে। এবং অমনি ইয়াকুব সরে গেছে। শান্ত দেখে নিয়েছে ওঘরে সিতারা খাঁটিয়ায় শুয়ে পড়েছে কখন।

জলটা ইঁদারার–কিন্তু উৎকৃষ্ট। ইয়াকুব জানিয়েছে, এ জলে রুচি না হলে আধমাইল দূরে রাস্তার ধারে একটা গ্রামের বারোয়ারি টিউবেল থেকে সে জল আনতে রাজি আছে। কিন্তু সোমনাথ তাকে যেতে দেয়নি। প্রথমে সন্দিগ্ধতা ছিল, জলপানের পর অবশ্য কেটে গেছে।

এদিকে ততক্ষণে অভাবিত কারণে বৃষ্টি বন্ধ। আকাশে নক্ষত্র ফুটছে।

স্মিতা হঠাৎ বলল, আমরা কে কোথায় শোব?

সোমনাথ বলল, একবার একজাগায় আদিবাসীদের শোওয়া দেখেছিলুম। মাঝখানে একটা কাল্পনিক বৃত্ত এবং তার পরিধিরেখায় মাথা রেখে চারদিকে সব চক্রবৎ শুয়ে থাকে ওরা। বলে সে শতরঞ্জিতে আঁকবার চেষ্টা করল। শ্রীলেখা বলল, বুঝেছি। সে মন্দ হবে না।

শান্ত বলল, কিন্তু ঘুমের ঘোরে আমার হাত ছোঁড়া অভ্যেস আছে যে, হয়তো চুল কিংবা কানের রিঙে-সিরিয়াসলি বলছি–আঙুল আটকে যাবে।

সবাই হাসল। স্মিতা বলল, বরং আমরা ওদিকটায় শুচ্ছি। আপনারা দরজার কাছটায় শোন।

সায়ন্তন বলল, কিন্তু দরজা-জানলা তো হাট করে খোলা!

সোমনাথ ততক্ষণে ঠাহর করে বলল, তাই তো! কপাটচৌকাট কিছু নেই যে! ইয়াকুব ইয়াকুব!

ইয়াকুব আসার আগে শান্ত বলল, মশাও লাগতে পারে!

সবাই ওর দিকে তাকাল। সোমনাথ ফের ডাকল, ইয়াকুব!

 ইয়াকুব খেতে বসেছিল এতক্ষণে। এঁটো হাতেই দৌড়ে এল, হুজুর মেহেরবান!

দরজা-জানলা আটকানোর কোন ব্যবস্থা আছে?

ইয়াকুব একটু ভেবে বলল, চটের পর্দা আছে হুজুর। থোড়াসে সবুর কিজিয়ে। দেতা।

সে চলে গেলে সোমনাথ একটা বেতের বাকসো টেনে নিল। ..পেরেক হাতুড়ি সব আছে। কোন অসুবিধে হবে না।

শান্ত বলল, কিন্তু ঘরে যে ভেন্টিলেটার নেই! আমার দম আটকাবে দাদা।

চটের পর্দার ওপর কেমন চমৎকার ভেন্টিলেটার বানিয়ে দেব দেখবে। বলে সোমনাথ উঠে দাঁড়াল। পেরেক পোঁতার সম্ভাবনা লক্ষ্য করতে থাকল।

ইয়াকুব কয়েক মিনিট পরেই তিনটে চট এনে দিল। দুটো দরজা আর। একটা ছোট্ট জানলার পক্ষে তা যথেষ্ট। তিনজন পুরুষ যথেষ্ট পরিশ্রম করে কাজটা সেরে ফেলল।

সোমনাথ ঘড়ি দেখে বলল, পৌনে এগারোটা, এবার শোওয়া যেতে। পারে। সকাল সকাল উঠতে হবে। প্রচুর রোদ পেয়ে যাব মনে হচ্ছে।

শ্রীলেখা স্মিতার দিকে চোখ টিপে বলল, আমরা দুজনে একবার বাইরে যাব। টর্চটা দিন সোমনাথদা।

সোমনাথ উঠে দাঁড়াল…চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।

স্মিতা মুচকি হাসল।..আপনি বারান্দায় দাঁড়ান–তাহলেই যথেষ্ট।

সায়ন্তন বলল, গাড়িটার পাশে চলে যান। পাঁচিলের ধারে।

দুটি মেয়ে হাসতে হাসতে বেরোল। সোমনাথও। সোমনাথ থামের পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ওরা টর্চ জ্বেলে পাশাপাশি চলে গেল। তারপর গাড়ির আড়ালে অদৃশ্য হল। আকাশ এখন বেশ পরিষ্কার। দৃষ্টি মোটামুটি চলে যায়। হঠাৎ সোমনাথের মনে হল, তার পিছনে কে এসে দাঁড়িয়েছে। চকিতে ঘুরল সে। বারান্দা অন্ধকার। ইয়াকুবের ঘরের দরজা বন্ধ। সোমনাথ তক্ষুনি পকেট থেকে দেশলাই বের করতে গিয়ে দেখল, নেই। দেশলাইটা ঘরে। সে অস্ফুট স্বরে বলল, কে?

ঘরের ভিতর থেকে সায়ন্তনের সাড়া এল–কী হল সোমদা?

সোমনাথ মুহূর্তে শক্ত হল। জবাব দিল, কিছু না।

আরো লম্বা পায়ে সময় এগোল। শ্রীলেখারা ফিরছে না। চাপা কথাবার্তা ভেসে আসছে ওদের। এবং আবার সোমনাথের মনে হল, এবার ঠিক তার মাথার ওপর ছাদে ধুপধুপ শব্দ হচ্ছে। মুখ তুলতে না তুলতে শব্দটা থেমে গেল। তখন চুল খাড়া হল সোমনাথের। গায়ে কাঁটা দিল। সে তবু শক্ত থাকার চেষ্টা করছিল। কারণ, তার মনে হচ্ছিল–এই ত্রাস অমূলক। সে বাইরের সঙ্গে যোগসূত্র হারিয়ে ফেলেছে এই অন্ধকারের দুরুন।

কতক্ষণ পরে শ্রীলেখারা ফিরল।

ঘরে তিনজনে ঢুকলে স্মিতা বলল, জানেন সোমনাথদা? ওঁরা ঠিকই বলেছিলেন। এ বাড়ির ওপর তলায় কে যেন লুকিয়ে আছে।

সোমনাথ শুধু শুকনো হাসল।

শ্রীলেখা বলল, স্পষ্ট কিছু দেখিনি–তবে ওপরের বারান্দায় যেন কে দাঁড়িয়ে ছিল। সাহস করে টর্চের আলো ফেলতে পারলুম না। কী জানি, কী দেখব!

স্মিতা বলল, আমি কিন্তু প্রথমে দেখে শ্রীলেখাদিকে বললুম।

সায়ন্তন বলল, কিন্তু আমরা তো তন্নতন্ন খুঁজে এসেছি–কিছু নেই!

শান্ত বলল, পিছনের দিকে সিঁড়ি থাকতে পারে।

সোমনাথ চুরুট ধরিয়ে বলল, মুশকিল! এটাই বড্ড মুশকিল মানে সমস্যা, আমার ক্যামেরায় এখন কোন কাজ করা যাবে না। আলো না হলে…যাক গে। তোমার শোও। আমি জেগে রইলুম আপাতত। শান্ত, জাস্ট দুটোয় তোমার জাগার পালা।