৫. সুদর্শন সিংহরায়ের হাতে

সুদর্শন সিংহরায়ের হাতে রেনকোট ভাঁজ করা ছিল। তিনি কর্নেলের সঙ্গে ঘরে ঢুকে হালদারমশাইকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। বললেন, কী আশ্চর্য! আপনি এখানে? আর আমরা আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি অট্টহাসের জঙ্গলে!

হালদারমশাই করুণ হেসে বললেন, বজ্জাতগো ল্যাঙ খাইয়া নদীতে পড়ছিলাম।

কর্নেল বললেন, পরে শুনবেন বসুন মিঃ সিংহরায়! আমার মনে হচ্ছে, কোনো আকস্মিক কারণে আপনি এত শিগগির এসে গেছেন!

মিঃ সিংহরায় বসলেন। তার রেনকোট চেয়ারের হাতলে রেখে পিঠের দিকে বেল্টে আটকানো দোনলা বন্দুকটা খুলে টেবিলের ওপর শুইয়ে দিলেন। তারপর বললেন, আপনারা চলে আসার কিছুক্ষণ পরে লোডশেডিং হয়েছিল। এদিকে বৃষ্টিতে আমার কুকুর দুটো বরাবরই ভিজতে চায় না। ফার্মের শেষপ্রান্তে একটা ছোট্ট দোতালা ঘর আছে। সেখানে গার্ড শিউশরণ একটা খাটিয়ায় বসে পাহারা দেয়। কিন্তু সে পাহারা দিতে যায় রাত নটার পর। বৃষ্টি হলে কুকুর দুটো সেই চালায় আশ্রয় নেয়। তো লোডশেডিং হওয়ায় প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে কুকুরদুটোর হাঁকডাক শুনে আমি সার্চলাইট জ্বেলে বন্দুক নিয়ে এগিয়ে গেলুম। জোরালো আলোয় পাঁচিলের কাঁটাতারের ওধারে বাঘটার মাথা চোখে পড়ল। বন্দুক তাক করার সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা অদৃশ্য হয়ে গেল। বাঘটা পাঁচিলে ওঠার চেষ্টা করছিল। দৌড়ে গিয়ে কেঁকের মাথায় পর-পর দুরাউন্ড ফায়ার করলুম। ফার্মের লোকেরাও টর্চ জ্বেলে হইচই শুরু করেছিল। যাই হোক, সার্চলাইটের আলোয় যেখানে বাঘটার মাথা দেখেছিলুম, সেখানে কাঁটাতারে একটুকরো ইলেকট্রিক তার আটকে ছিল। এই দেখুন।

মিঃ সিংহরায় প্যান্টের পকেট থেকে ইঞ্চি ছয়েক তার বের করে কর্নেলকে দিলেন। কর্নেল বললেন, নেগেটিভ-পজিটিভ তার থেকে একটু অংশ জোর করে ভেঁড়া হয়েছে। এটা কাটায় আটকে ছিল?

হ্যাঁ। এমনভাবে আটকে ছিল, টেনে খুলতে আমার এই আঙুলটা ছড়ে গেছে।

আপনি শুধু বাঘের মুখ দেখেছিলেন?

শুধু মুখ! এ অঞ্চলে আগের দিনে বাঘ ছিল। সেগুলো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের চেয়ে ছোট।

কোনো গর্জন শোনেননি?

 নাহ্।

পাঁচিলের ওই জায়গাটাতে কোনো গাছপালা বা ঝোপঝাড়, ভেষজ উদ্ভিদ–

আছে। বাসক পাতার রসে সর্দিকাশির সিরাপ তৈরি হয়। ওখানে ঘন। বাসকঝোপ আছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। বাসকঝোঁপ বন্য উদ্ভিদ। তবে আমি ওগুলো চাষ করেছি।

কাছাকাছি উঁচু গাছ আছে কি?

চারটে নিমগাছ আছে। এখন বুঝতে পারছি পাঁচিলের অত কাছে নিমগাছ রাখা ঠিক হয়নি।

এখন বর্ষায় নিমগাছে ফল থাকার কথা।

হ্যাঁ। ফলগুলো পেকেছে। পাঁচুর বউ ওগুলো যত্ন করে কুড়িয়ে আনে। গোডাউনে শুকনো বীজ প্রায় কিলো পঞ্চাশ রাখা আছে। কিছুদিন পরে কলকাতায় পাঠাব।

কর্নেল ছেঁড়া তারটার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ। নিমগাছগুলো দেখেছি মনে পড়ছে। ওখানে একটা বেঁটে গোরোচনা গাছও দেখেছি।

হ্যাঁ। গোরোচনাও ভেষজ গাছ। মিঃ সিংহরায় জোর শ্বাস ফেলে বললেন, আমি আপনাকে জানাতে এলুম, আজ রাতে অট্টহাসের মন্দিরে আমি যাচ্ছি না। আমার মনে হচ্ছে, কেউ বা কারা আজ রাতে আমাকে ফার্ম থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চক্রান্ত করেছে। আমি ফার্ম ছেড়ে বাইরে রাত কাটাইনি এমন নয়। এই তো গত শনিবার রাতে কলকাতায় ছিলুম। কিন্তু কাকেও জানতে দিইনি সে কথা। ফার্মের লোকদেরও ন তাই আমার ধারণা, আমি অট্টহাসের মন্দিরে আজ রাতে যদি যাই, ফার্মের কোনো ক্ষতি হবে। ওদের লক্ষ্য যেন শুধু জাফরানখেত।

হালদারমশাই আস্তে বললেন, হঃ! কোটি টাকা ইনকাম।

মিঃ সিংহরায় এবার গোয়েন্দাপ্রবরের দিকে ঘুরলেন। আপনার কী ব্যাপার? আপনি এখানে কেন?

কর্নেল সংক্ষেপে ঘটনাটা তাকে জানিয়ে দিলেন। সুদর্শন সিংহরায় বললেন, ভবেশ ঘোষ? এ নামে আহিরগঞ্জে কেউ আছে বলে জানি না। চেহারা কেমন?

হালদার মশাই বললেন, বয়স নিয়ার অ্যাবাউট ফিফটি। তত ফর্সা না। কালোও না। মাথায় এইটুকখানি টাক আছে। গোঁফ-দাড়ি নাই। তত হেলদি না। হাইট কম। নাকটা মোটা। পরনে তাঁতের পাঞ্জাবি আর ধুতি ছিল। ভয়েস একটুখানি ন্যাসাল।

বললুম, কর্নেল! সেই

 কর্নেল দ্রুত বললেন, আহ! ওঁকে বলতে দাও।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন, উপরে-উপরে জেন্টলম্যান, ভিতরে বজ্জাত শয়তান।

সুদর্শন সিংহরায় বললেন, বটুক ঘোষের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে ডেসক্রিপশন। কিন্তু বটুক তো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল একসময়। সিউড়ি কলেজে আমার সঙ্গে পড়ত। বি এ-তে ফেল করে পড়া ছেড়ে দিয়ে পৈতৃক ব্যবসাতে ঢুকেছিল। আহিরগঞ্জে টিভি, মাইক্রোফোন, টেপরেকর্ডার এই সব জিনিসের দোকান আছে বটুকের। কিন্তু বটুকের সঙ্গে আমার কখনও কোনো শত্রুতা ছিল না। বরং নকশাল মুভমেন্টের সময় বটুক আমাদের গোপনে নানারকম সাহায্য করত।

রামভরোসা একটু সাড়া দিয়ে বাইরে থেকে বলল, কর্নির্লসাব! ডিনার রেডি।

কর্নেল উঠে গেলেন দরজার পর্দা তুলে বললেন, একজন গেস্ট আছে বলেছিলুম।

হাঁ স্যার।

পাশের ঘরটার জন্য সুশীলবাবুকে বলেছ তো?

 জি হাঁ। কুছু অসুবিধা হবে না।

ডিনার বরং আধঘণ্টা পরে এ ঘরে দিয়ে যেয়ো। কেমন?

 ঠিক আছে স্যার।

কর্নেল ভেতরে এসে বসলেন। বললেন, বৃষ্টিটা থেমে গেছে। তবে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবার হয়তো বৃষ্টি নামবে।

সুদর্শন সিংহরায় বললেন, আমি উঠি। ওরা আমাকে যতই হুমকি দিক, আমি গ্রাহ্য করিনি। করবও না। কর্নেল সরকারকে শুধু অনুরোধ, আপনার মিশন সফল করুন। আমি শুধু জানতে চাই কে বা কারা আমার পেছনে লেগেছে। তাদের শাস্তি আমি নিজের হাতে দেব। আপনি আমাকে এই সাহায্যটুকু করুন প্লিজ!

হালদারমশাই ব্যাকুলভাবে বললেন, হেকিমি বাকসোতে কাম নাই। মিঃ সিংহরায়! আপনি শুধু আমার ব্যাগটা পাঠাইয়া দ্যান! আমার ঘরের চাবি ডানপকেটে ছিল। জোব্বার অর্ধেকখানি নদী লইয়া গেছে। কিসে বাধছিল জানি না ব্যাবাক ছিঁইড়া গেছে।

কর্নেল বললেন, আমি মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে মিঃ সিংহরায়ের ফার্ম হয়ে আসব। তখন আনব। চিন্তা করবেন না।

সুদর্শন সিংহরায় উঠে দাঁড়ালেন। দেরি করে ফেললুম। আমি চলি কর্নেল সরকার!

কর্নেল তাকে বিদায় দিতে বাইরে গেলেন।

এই সুযোগে জিজ্ঞেস করলুম, আজ আপনি ফার্মের একটা লোকের ওপর লক্ষ্য রেখে কোনো ঝোপে বসেছিলেন শুনেছি। লোকটা কে?

গোয়েন্দাপ্রবর এতক্ষণে একটু হাসলেন, কর্নেলস্যারের লগে শুনছেন?

হ্যাঁ। তার গতিবিধি নাকি সন্দেহজনক?

হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, পাঁচুর বউ। ছাগল লইয়া একটা নিচু ঘাসজমিতে চরাইতে যায় মাইয়াডা। উঁচু জমিতে জঙ্গল আছে। সেই জঙ্গলের ভিতর একটা রোগা কালো ছ্যামড়া য্যান লুকাইয়া ছিল। তারপর পাঁচুর বউরে ইশারায় ডাকল। কী কইল জানি না।

ছ্যামড়া–মানে ছেলেটার বয়স কত হতে পারে?

আপনাগো বয়সী!

হেসে ফেললুম। আমিও আপনার কাছে ছ্যামড়া?

 হালদারমশাইও হাসলেন। ওই হইল গিয়া! ইয়ংম্যানেরে ছ্যামড়া কইতে দোষ নাই।

আমি তত ইয়ংম্যান নই হালদারমশাই!

এই সময় কর্নেল ফিরে এলেন। ইজিচেয়ারে বসে টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, বড় গোলমেলে ব্যাপার। বাঘের মুণ্ডু, ইলেকট্রিক তার, মাদুলি–

ওঁর কথার ওপর বললুম, মাদুলির কথাটা ভুলে গিয়েছিলুম। ওটাতে কী আছে?

কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, মাদুলিতে যা থাকে। জড়িবুটি, নয়তো মন্ত্রলেখা কাগজ।

খুলে কী পেয়েছেন তাই জিজ্ঞেস করছি। জড়িবুটি, না মন্ত্রলেখা কাগজ?

 দুই-ই। বলে কর্নেল চোখ বুজে চিন্তামগ্ন হলেন।

হালদারমশাইকে জিজ্ঞেস করলুম, আপনি ফার্মের রাঁধুনি ঠাকুরমশাইয়ের ঠাকুরঘরে ঢুকেছিলেন শুনে এলুম। ঠাকুরমশাই বলছিলেন, ঠাকুরের গায়েও নাকি হাত দিয়েছিলেন!

গোয়েন্দাপ্রবর একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, হিন্দুসন্তান। ঠাকুরদেবতা ছুঁইলে পাপ হয় না। জলচৌকির উপর মা কালীর বিগ্রহ। বেদিতে বিগ্রহ আছে। ঠাকুরমশাই বিগ্রহ উঠাইয়া বেদিতে কী রাখেন, তাই দেখার ইচ্ছা ছিল।

দেখে নিয়েছেন নিশ্চয়?

হঃ। ওই যে কইছিলেন! মাদুলি। অনেকগুলি তামার মাদুলি আর লাল সুতা। কর্নেলস্যারেরে অলরেডি কইয়া দিছি।

তার মানে, ঠাকুরমশাই লোককে মাদুলি দেন?

 তা ছাড়া আর কী?

কর্নেল চোখ খুলে বললেন, হালদারমশাই যে মাদুলিগুলো দেখেছেন, সেগুলো নতুন। মিঃ সিংহরায়ের কুড়িয়ে পাওয়া মাদুলিটা পুরনো।

বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। এখনও এদের অফিস খোলা আছে। একটা টেলিফোন করে আসি।

কর্নেল বেরিয়ে গেলে হালদারমশাই বললেন, মিঃ সিংহরায়ের ফার্মে সব আছে। টেলিফোন নাই। জিগাইছিলাম ওনারে। কইলেন, চেষ্টা করতাছি। ওই এরিয়ার ফোনের লাইন পাওয়ার চান্স কম।

বলে উনি টেবিলের তলায় দৃষ্টিপাত করলেন। বললুম, কী দেখছেন?

জুতা। কর্নেলস্যারের স্লিপার আমার পায়ে। ব্যবাক ভুইল্যা গেছি। বলে গোয়েন্দাপ্রবর হেসে উঠলেন। আমার নতুন কেনা নাগরা জুতাজোড়াও বজ্জাত নদী খাইয়া ফেলল!

নাগরা জুতো কেন কিনেছিলেন?

কী যে কন? হেকিমসাহেব নাগরা জুতা পরব না? চিৎপুরে একজন হেকিমসাহেবেরে দেখছিলাম। ওনারেই ইনটোটো ফলো করছিলাম।

আপনার টুপিও নদীর পেটে গেছে

হালদারমশাই খি খি করে আবার হেসে উঠলেন। টর্চ, জুতা, দাড়ি, পরচুলা, টুপিবজ্জাত নদী হেকিমসাহেবেরে ব্যাবাক খাইয়া ফেলছে।

হেকিমসাহেবকে খেয়ে হালদারমশাইকে উগরে দিয়েছে।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ প্রাণ খুলে হাসলেন। তারপর বললেন, এতক্ষণে মন হাল্কা হইল। পুলিশলাইফেও এমন স্ট্রেঞ্জ এক্সপিরিয়েন্স হয় নাই।

কর্নেল ফিরে এলেন গম্ভীর মুখে। বললেন, খাবার পাঠাতে বলে এলুম।

জিজ্ঞেস করলুম, কাকে হঠাৎ ফোন করতে গিয়েছিলেন? আপত্তি থাকলে অবশ্য

নাহ। আপত্তি নেই। রায়সাহেবকে ফোন করলুম। বটুক ঘোষ সম্পর্কে জানতে চাইলুম। রায়সাহেব বললেন, বটুক ঘোষ নামকরা ব্যবসায়ী। তবে গতবছর এনফোর্সমেন্ট অফিসাররা ওঁর গোডাউনে হানা দিয়ে অনেক বিদেশি ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেট আটক করেছিলেন। আজকাল ব্যবসা-বাণিজ্যে এটা নতুন। ঘটনা নয়। বলে কর্নেল বাথরুমে ঢুকে গেলেন।

.

 সকালে ঘুম ভেঙেছিল চৌকিদারের ডাকে। সে বেডটি এনেছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলুম, কর্নেলসায়েব কখন বেরিয়েছেন?

রামভরোসা বলল, ভোরবেলায়–পাঁচ কি সওয়া পাঁচ বাজে। গেটের তালা খুলে দিলাম।

পাশের ঘরের ভদ্রলোক কি এখনও ঘুমোচ্ছেন?

না স্যার! চৌকিদার হাসল। চা পিয়ে ড্যামের ধারে চলিয়ে গেলেন। এখনও সেখানে বৈঠে আছেন।

সে চলে গেলে বিছানায় বসে তারিয়ে তারিয়ে চা খেলুম। রাত্রে কর্নেল ফ্যান বন্ধ করে এয়ারকন্ডিশনার চালিয়েছিলেন। এখন দেখি, এয়ার কন্ডিশনার বন্ধ। জানালাগুলো ভোলা এবং ফ্যান ঘুরছে। বাইরে আজ উজ্জ্বল রোদ। ঘড়িতে সাড়ে সাতটা বাজছে।

বাথরুম সেরে বারান্দায় গেলুম। দেখলুম, নিচে ওয়াটারড্যামের ধারে সিমেন্টের বেঞ্চে বসে প্রাইভেট ডিটেকটিভ জলে ঢিল ছুঁড়ছেন। জোরালো বাতাসে সুবিস্তীর্ণ জলাধারে আলোড়ন ঘটেছে। এখান থেকেও ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শোনা যাচ্ছে।

হালদারমশাইয়ের কাছে যাব ভাবছিলুম। হঠাৎ দেখলুম, উনি উঠে পড়লেন। তারপর গেটের কাছে উঠে এলেন। আমাকে দেখে সহাস্যে বললেন, গুড মর্নিং জয়ন্তবাবু!

মর্নিং মিঃ হালদার!

কে. কে. হালদার কাছে এসে বললেন, এই সব জায়গায় আইয়া সায়েব হইতে ইচ্ছা করে। কী বিউটিফুল জায়গা! অ্যাক্কেরে ল্যান্ডস্কেপ। বারান্দায় উঠে বেতের চেয়ার টেনে বসে তিনি হাসলেন। গুড মর্নিং ক্যান কইলাম জিগাইলেন না?

বললুম, আপনি তো বললেন এই সব জায়গায় এলে—

হালদারমশাই আমাকে থামিয়ে বললেন, মোটরসাইকেলের শব্দ শোনেননি?

না তো!

এই বাংলোর কেয়ারটেকার সুশীলবাবু মোটরসাইকেলে কোথায় গেলেন। আমাকে কইয়া গেলেন, গুড মর্নিং স্যার! কোনো অসুবিধা হয়নি তো? বুঝলেন জয়ন্তবাবু? পুলিশলাইফ ছাড়ছি, আর লোকেরাও আমারে স্যার কওয়া ছাড়ছে। অনেকদিন পরে আজ একজন আমারে স্যার কইল।

হালদারমশাইয়ের কথাটা শুনে অবাক লাগল। এক মানুষের ভেতর হয়তো অন্য-অন্য মানুষ থাকে। কোনো কোনো মুহূর্তে সেই ভেতরকার অন্য এক মানুষ বেরিয়ে পড়ে। বুঝলুম, এই প্রাক্তন পুলিশ অফিসার এবং বর্তমান প্রাইভেট ডিটেকটিভকে নিয়ে কর্নেলের সঙ্গে যতই রঙ্গরসিকতা করি না কেন, তার ভেতর যেন এক অবুঝ বালক আছে। তাই তিনি হঠকারী এবং মাঝে মাঝে দারুণ বোকামি করে ফেলেন।…

সওয়া আটটা নাগাদ গেটের নিচে একটা জিপ এসে থামল। জিপ থেকে বেরিয়ে এলেন কর্নেল। তার গলায় যথারীতি ক্যামেরা ও বাইনোকুলার ঝুলছে। পিঠেও কিটব্যাগটি আঁটা। কিন্তু তার হাতে একটা মোটাসোটা ব্যাগ। হালদারমশাই বললেন, কর্নেলস্যার আমার ব্যাগ আনছেন!

জিপটা তাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। কর্নেল এসে সহাস্যে বললেন, মর্নিং হালদারমশাই! মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি তোমাদের সুনিদ্রা হয়েছে।

বললুম, হয়েছে। কিন্তু কার জিপে এলেন? মিঃ সিংহরায়কে তো দেখলুম না!

জিপটা মিঃ সিংহরায়ের। ওঁর ফার্মের পাওয়ারটিলার চালক শম্ভ নায়েক আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন।

হালদারমশাই তার ব্যাগ পেয়ে সবেগে পাশের ঘরে ঢুকে গেলেন। কর্নেল তাঁর কিটব্যাগ, ক্যামেরা আর বাইনোকুলার ঘরে রেখে বারান্দায় এসে বসলেন। চৌকিদার তাকে দেখে হন্তদন্ত হাজির হয়েছিল। কফির হুকুম পেয়ে সে কিচেনের দিকে চলে গেল।

বললুম, মিঃ সিংহরায়ের ফার্মে রাত্রে আর কিছু ঘটেনি তো?

কর্নেল বললেন, নাহ্। তবে পাঁচিলের কাছে বাসকঝোপে একটা অদ্ভুত জিনিস কুড়িয়ে পেয়েছি।

কী জিনিস?

ইলেক্ট্রনিক কোনো যন্ত্রের মতো দেখতে। কিন্তু ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ওটা কী। পরে দেখাচ্ছি।

পাঁচিলের ওধারে বাঘের পায়ের ছাপ থাকা উচিত। লক্ষ্য করেননি?

কর্নেল হাসুলেন। ঘন ঘাসে বাঘের পায়ের ছাপ খুঁজে বের করা যায় না। ফার্মের জমি বড্ড অসমতল। যে এক একর জমিতে ক্রোকাস্ স্যাটিভাস্ অর্থাৎ জাফরান গুল্ম আছে, সেই জমিটা বেজায় রুক্ষ। টাড় পাথুরে জমি। জাফরান। ওইরকম জমিতেই স্বচ্ছন্দে গজাতে আর বাড়তে পারে। জল দাঁড়ায় এমন জমিতে এই উদ্ভিদ বাঁচে না। পাহাড়ি উদ্ভিদ তো! মরু এলাকার রুক্ষ মাটিতে অবশ্য সমতলেও এ সব উদ্ভিদ জন্মায়। তো জাফরানখেতে বাঘের হামলা করার কারণ নেই! আসলে কাঠা পাঁচেক জাফরান তছনছ করেছিল কেউ। তখন বর্ষা নামেনি।

কী ভাবে তছনছ করেছিল?

এলোপাথাড়ি ধারালো কোনো হেঁসো বা কাস্তে চালিয়েছিল কেউ। সেগুলোতে ক্রমে পাতা গজিয়েছে। কয়েকটা গাছ ওপড়ানোর চেষ্টাও করেছিল। পারেনি। জাফরান গুল্ম ওপড়াতে পালোয়ানেরও ঘাম বেরিয়ে যাবে।

হালদারমশাই তার নিজস্ব প্যান্ট-শার্ট-জুতো পরে কর্নেলের পোশাক আর স্লিপার দুটো হাতে নিয়ে এলেন। বললেন, কর্নেলস্যারেরে অসংখ্য ধন্যবাদ! আমার হেকিমি বাকসোটা ঘরে আছে দ্যাখছেন?

কর্নেল বললেন, বহাল তবিয়তে আছে। সময়মতো ফেরত পাবেন। তো আপনি এগুলো আমাদের ঘরে রেখে আসুন। কফির আসর বসবে এখানে।

কিছুক্ষণের মধ্যে রামভরোসা কফি আর স্ন্যাক্সের ট্রে রেখে গেল। কফি খেতে খেতে হালদারমশাই বললেন, আমি একটা প্ল্যান করছিলাম।

কর্নেল বললেন, বলুন!

আহিরগঞ্জ গিয়ে বটুক ঘোষের খোঁজ করব। যদি উনি সেই লোক হন, তা হইলে ওনারে থ্রেটন করব।

কর্নেল হাসলেন। বটুক ঘোষ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। ওঁর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ না করাই ভালো। আমার প্ল্যানটা শুনুন। বটুকবাবুর দোকানের নাম ঘোষ অ্যান্ড সস্ কোম্পানি। আমি আর জয়ন্ত গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলব। আপনি জিপে বসে লক্ষ্য রাখবেন। পরে আমাকে জানিয়ে দেবেন, উনিই ভবেশ ঘোষ কি না। এই যথেষ্ট।

গোয়েন্দাপ্রবর ফুঁসে উঠলেন। এক হালায় আমারে চক্রান্ত কইর‍্যা নদীতে ফেলছিল। যদি বটুক সেই লোক হয়, তারে–

কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তাড়াহুড়ো করবেন না হালদারমশাই! আমাকে প্ল্যানমতো এগোতে দিন। বটুক আর ভবেশ একই লোক হলেও আইনত প্রমাণ করতে পারবেন না সে আপনাকে নদীতে ডুবিয়ে মারার চক্রান্ত করেছিল। তা ছাড়া আপনি তখন ছিলেন এক হেকিমসায়েব।

হালদারমশাই একটু দমে গেলেন। কফি খাওয়ার পর কর্নেল বললেন, আসুন হালদারমশাই! এস জয়ন্ত! মিঃ সিংহরায়ের ফার্মে বাসকঝোপের ভেতর কুড়িয়ে পাওয়া জিনিসটা তোমাদের দেখাই।

ঘরে ঢুকে কর্নেল তার কিটব্যাগ থেকে একটা অদ্ভুত গড়নের যন্ত্র বের করলেন। যন্ত্রটা দেখতে মোটরগাড়ির ইঞ্জিনের পাশে আটকানো হর্নের মতো। কতকটা হেডলাইটের গড়ন। মুখের দিকটায় শক্ত লোহার জাল আছে। পেছনে ইঞ্চি দুয়েক নেগেটিভ-পজিটিভ প্যাচালো তার ঝুলছে। কর্নেল কাঁটাতারে আটকে থাকা সেই ইলেকট্রিক তারটুকু বের করলেন, যেটা মিঃ সিংহরায় গতরাত্রে দিয়ে গিয়েছিলেন। দেখামাত্র বললুম, এই তারটা এই বিদঘুঁটে যন্ত্রের তারেরই অংশ।

হালদারমশাই কালো হেডলাইট বা হর্নের মতো যন্ত্রটা হাতে নিয়ে বললেন, এইটুকখানি ওয়েট।

কর্নেল বললেন, আমার কী ধারণা, তা এখন বলব না। তবে ইলেক্টিক তার দেখে তোমরা নিশ্চয় বুঝতে পারছ, এটা কোনো বৈদ্যুতিক যন্ত্র। ঘোষ। অ্যান্ড সনসে যাওয়ার এটাই হবে উপলক্ষ। আধঘণ্টা পরে ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমরা বেরুব। মোহন সিংয়ের জিপেই যাওয়া ঠিক হবে।

আহিরগঞ্জের বাজারে পৌঁছে কর্নেলের কথামতো মোহন সিং জিপগাড়িটা একটু তফাতে দাঁড় করাল। ঘোষ অ্যান্ড সনস্ তার চেনা। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল সে। বাজার এলাকায় প্রচণ্ড ভিড়। সাইকেলরিকশ, ট্রাক, টেম্পো আর মানুষের বিশৃংখল জটলার মধ্য দিয়ে আমরা দোকানটাতে পৌঁছুলুম। বেশ বড় দোকান। কাউন্টারে একজন স্মার্ট চেহারার যুবক বসে ছিল। কর্নেলকে দেখে বলল, বসুন স্যার!

বটুকবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।

বাবা তো মর্নিংয়ের বাসে সিউড়ি গেছেন।

কর্নেল একটু ইতস্তত করার ভঙ্গিতে কিটব্যাগ থেকে সেই বিদঘুঁটে যন্ত্রটা বের করে বললেন, দেখুন তো। এটা একটু বিগড়ে গেছে। আপনাদের কোনো মেকানিক নিশ্চয় আছে?

যুবকটি যন্ত্রটা হাতে নিয়েই বলল, এটা তো দেখছি জাপানি মাইক্রোফোন। সরি স্যার! এর পার্টস কলকাতা ছাড়া পাওয়া যাবে না।

ঠিক আছে। বলে কর্নেল বেরিয়ে এলেন।

জিপের দিকে যেতে যেতে গোয়েন্দাপ্রবর বলে উঠলেন, মাইক্রোফোন? মাইক্রোফোন কোন কামে লাগছিল? হেভি মিস্ট্রি!…