৬. কর্নেল স্যার ফিরলেন

কর্নেল স্যার ফিরলেন দুটো নাগাদ। ঘরেই লাঞ্চ দিয়ে গিয়েছিল ক্যান্টিন থেকে। হালদারমশাই ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে যথারীতি নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন। উনি এখানে আসার পথে কৃষ্ণনগরে দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছেন।

কর্নেল এসে হালদারমশাইকে দেখে নিলেন। তারপর পোশাক বদলে চাপা গলায় বললেন, তুমি খেয়ে নিলেই পারতে জয়ন্ত? স্নান করেছ দেখছি। বাহ! আমি স্নান করব না। শুধু হাত-মুখ-দাড়ি ধুয়ে নেব।

দু-মিনিটের মধ্যে উনি বাথরুম থেকে ফিরলেন। তারপর দুজনে খেতে বসলাম। খেতে খেতে কর্নেল বললেন, হালদারমশাই কখন এসেছেন?

বললাম, পৌনে একটা নাগাদ। অবশ্য ঘড়ি দেখিনি। উনি কিন্তু জব্বর খবর এনেছেন। রায়বাড়ির অমূল্যবাবুই নাকি

লক্ষ্মীবাবু!

আপনি জানেন?

যাবার পথে চেতনাভিলার বনমালীর সঙ্গে আবার দেখা করেছিলাম। কথায় কথায় বনমালী বলল, দত্তসায়েব সে-রাতে বেরুনোর সময় অমূল্যকে ডাকতে বলেছিলেন। তখন ভোদা জিজ্ঞেস করেছিল, অমূল্য কে? সায়েব নেশার ঘোরে ছিলেন। খাপ্পা হয়ে বলেন, লক্ষ্মীর আরেক নাম অমূল্য। তো লক্ষ্মীবাবু প্যান্ডেলে ডেকরেটারদের ওখানে ছিলেন। তাঁকে দেখতে না পেয়ে ভোদা চলে আসে।

ভোঁদা কে?

চেতনাভিলার সারভ্যান্ট। তার বাড়ি কুসুমপুরে। সায়েব আসার খবর পেলেই সে চলে আসত। বনমালীর ওই এক কথা, বামুন গেল ঘর তো লাঙল তুলে ধর।

মোজাহারের সঙ্গে দেখা হয়নি?

নাহ।

মিসেস দত্ত হালদারমশাইয়ের মুখে কথাটা জানতে পেরে নাকি ফায়ার হয়ে গেছেন। উনি আজ বিকেলের মধ্যে এখানে আসছেন। অমূল্য ওরফে লক্ষ্মীকে উচিত শিক্ষা দেবেন।

খাবার সময় কথা বলতে নেই ডার্লিং!

আপনি বলেন বটে! কিন্তু নিজেই মানেন না।

কর্নেল মুর্গির ঠ্যাং কামড়ে ধরলেন। একজন ক্যান্টিনবয় এসে উঁকি দিল। কিন্তু সায়েবদের খাওয়া শেষ হয়নি দেখে সে তখনই চলে গেল।

খাওয়া শেষ করে কর্নেল বাথরুমে ঢুকলেন। আমি ওঁকে অনুসরণ করলাম। তারপর ফিরে এসে দেখি, কর্নেল ব্যালকনিতে বসে চুরুট ধরাচ্ছেন। আমি হালদারমশাইকে জাগিয়ে দিলাম। ডিটেকটিভদ্রলোক তড়াক করে সোজা হলেন। তারপর রুমালে মুখ মুছে বললেন, কী কাণ্ড!

স্বপ্ন দেখছিলেন নাকি হালদারমশাই?

হালদারমশাই হাসলেন। আর কইবেন না! কর্নেল স্যার কই?

ওই দেখুন। ব্যালকনিতে বসে ধ্যান করছেন।

হালদারমশাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, একটুখানি বাথরুমে যাব। বাথরুম কই?

বাথরুমে দেখিয়ে দিলাম। ক্যান্টিনবয় ট্রে-তে এঁটো বাসন-কোসন সাজিয়ে। নিয়ে গেল। বিলে আমায় সই করিয়ে নিল। ৬৭ টাকা ৭৫ পয়সা। গতরাতে এবং আজ ব্রেকফাস্টের সময় কর্নেল বিলে সই করেছিলেন। ব্যালকনিতে গিয়ে। বললাম, কী সাংঘাতিক বিল! মুর্গির মাংস, ডাল, একটা তরকারি আর এক প্লেট স্যালাডের জন্য ৬৭ টাকা ৭৫ পয়সা?

কর্নেল হাসলেন। আমরা বসুন্ধরা ট্রাস্টের গেস্ট। ওঁরা টাকা মেটাবেন। চিন্তা কোরো না।

বসুন্ধরার কী স্বার্থ এতে?

পরিবেশ দূষণ রোধ।

অদ্ভুত তো?

মোটেও না জয়ন্ত। চেতনাউদ্যানের পরিবেশ নানাভাবেই দূষিত হতে পারে। এই উদ্যানকে সব দিক থেকে দূষণমুক্ত করার নীতি–আরে! আসুন হালদারমশাই! ঘুমোচ্ছিলেন দেখে ডিসটার্ব করিনি। জয়ন্তের তো এখন ভাতঘুমের সময়।

ব্যালকনিতে গিয়ে বললাম, যথেষ্ট ঘুমিয়ে নিয়েছি। আর ঘুমুতে ইচ্ছে করছে না।

হালদারমশাই ততক্ষণে চাপা গলায় তার রিপোর্ট দিতে শুরু করেছেন। কর্নেল মন দিয়ে শোনার পর বললেন, দত্তসায়েব তার প্রথম পক্ষের শ্বশুরবাড়ির কর্মচারী অমূল্যবাবুকে চিনবেন, এটা স্বাভাবিক। সেই অমূল্যবাবু যদি তার কাছে চাকরি চাইতে যান, তিনি চেনা লোককেই কেয়ারটেকারের চাকরি দেবেন। এবার মজাটা হল, রায়বাড়িতে অমূল্যবাবুর আর তত কিছু কাজ নেই। নেহাত পুরনো লোক বলেই রায়সায়েব তাকে ছাড়াননি। কাজেই দু-জায়গায় দুই নামে চাকরি করার অসুবিধে নেই। চেতনাভিলাতে দত্তসায়েব কখন আসছেন, অমূল্যবাবু ঠিকই খবর পেয়ে যেতেন।

কী করে খবর পেতেন?

 রেডিও সিগন্যালে।

হালদারমশাই সোজা হয়ে বসলেন। উত্তেজনায় তার গোঁফ তিরতির করে কাঁপতে থাকল। কন কী?

এটা কিন্তু আমার থিওরি। চেতনাভিলায় রেডিও ট্রান্সমিশন সেট আছে। মিঃ দত্ত শিল্পপতি। কোটি-কোটি টাকার কারবারি। তার পক্ষে নিজস্ব রেডিও ট্রান্সমিশন সেট খুব জরুরি। তার মোধপুর পার্কের বাড়িতেও এই যন্ত্র থাকা উচিত। এমন হতেই পারে, যোধপুর পার্কের বাড়ি থেকে কেউ অমূল্যবাবুকে রায়বাড়িতে টেলিফোনে খবর দিত।

বললাম, আমার ধারণা রায়সায়েবের সেই প্রাইভেট টেলিফোনে খবর পেতেন অমূল্যবাবু।

কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, এ সবই এখনও আমার অনুমান মাত্র।

কিন্তু অমূল্যবাবু কুমোরটুলির বংশীবাবুকে ডামির অর্ডার দিয়েছিলেন কেন?

হালদারমশাই নস্যির কৌটো বের করে বললেন, কী কইলেন? কী কইলেন? ডামি?

কর্নেল আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে বললেন, পরে বলব হালদারমশাই!

প্রাইভেট ডিটেকটিভ নস্যি নিয়ে রুমালে নাক মুছে বিড়বিড় করতে থাকলেন। প্রাইভেট টেলিফোন, কুমোরটুলি, ডামি–খাইছে!

কর্নেল বললেন, হালদারমশাই! অনি কখনও তার বাবা কিংবা সত্য মিসেস দত্তের কাছে গিয়েছিল কি না আপনাকে খবর নিতে বলেছিলাম!

হালদারমশাই বললেন, হঃ! ম্যাডাম কইলেন, সায়েবেরে থ্রেট করতে আইছিল একবার। এমনকি সঙ্গে ফায়ার আর্মস লইয়া আইছিল। ওনার পোলাড়া ব্যাড ক্যারেক্টার। এক্কেরে গুণ্ডা।

তাহলে মিসেস দত্ত ওকে দেখেছেন?

হঃ!

দেখলে চিনতেও পারবেন?

হঃ!

আর আপনি তো ওকে চেনেনই?

হঃ!

তাহলে আপনি এখনই কাজে নামুন।

কন!

আপনাকে বসুন্ধরা ট্রাস্টের একটা ব্যাজ দিচ্ছি। বুক পকেটে এঁটে আপনি ঘোরাঘুরি করুন। দেখুন অনি তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে এখানে এসেছে কি না।

বলে কর্নেল ঘরে ঢুকে কিটব্যাগ থেকে একটা সবুজ রঙের সুদৃশ্য ব্যাজ এনে দিলেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ সহাস্যে বললেন, ব্যাজের দরকার কী? আমার ফায়ার আর্মস আছে।

না। ফায়ার আর্মসের দরকার হবে না। সেদিন আপনি এসেছিলেন সাধুর ছদ্মবেশে। আজ বসুন্ধরা ট্রাস্টের অফিসারের ছদ্মবেশে ঘুরুন। চেতনা দেবী এলে আপনার এই ছদ্মবেশ দেখে খুশিই হবেন।

ম্যাডাম যদি ওনার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেন?

থাকবেন। আর যদি উনি থাকার কথা না বলেন, আমাদের ডেরায় চলে আসবেন। ম্যানেজারকে বলে ক্যাম্পখাট আর বিছানার ব্যবস্থা করব। খাওয়ারও অসুবিধে হবে না।

আমার ব্যাগ বরং আপনাদের ঘরে থাক।

থাক।

 সঙ্গে ব্যাগ লইয়া ঘোরা ঠিক নয়। কী কন জয়ন্তবাবু?

সায় দিলাম। প্রাইভেট ডিটেকটিভ ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুকপকেটে ব্যাজ এঁটে নিলেন। তারপর ওঁর ব্যাগ খুলে আগ্নেয়াস্ত্রটি বের করলেন। বুঝলাম গুলি ভরা আছে। কারণ খুব সাবধানে অস্ত্রটা প্যান্টের পকেটে ঢোকালেন। ওঁর প্যান্ট সাবেক ফ্যাশনের এবং যথেষ্ট ঢিলে।

হালদারমশাই চলে যাওয়ার পর কর্নেল বললেন, তুমি ডামি সম্পর্কে সাবধান জয়ন্ত।

হালদারমশাইকে কথাটা জানানো উচিত ছিল না কি?

তুমি ভুলে যাচ্ছ জয়ন্ত, উনি ছিলেন পুলিশ অফিসার। রিটায়ার করার পরও পুলিশের স্বভাব ওঁর যায়নি।

পুলিশের স্বভাব মানে?

বেপরোয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। হঠকারিতা। জেদ। এরকম অনেক কিছু। ভাল-মন্দের প্রশ্ন অবান্তর। এসব জিনিস ব্রিটিশ আমলের পুলিশি ঐতিহ্যসূত্রে বহাল আছে। আর হালদারমশাইয়ের তো দেখেছি, অনেক সময় মনেই থাকে না যে উনি রিটায়ার করেছেন।

একটু পরে বললাম, এই মোজাহার লোকটির সম্পর্কে বনমালীর কাছে। কিছু জানতে পেরেছেন?

দত্তসায়েবের বডিগার্ড ছিল একসময়। পরে চেতনাভিলা গার্ড দেবার জন্য দত্তসায়েব ওকে নিয়ে আসেন।

অমূল্যবাবু ওরফে লক্ষ্মীবাবু ফ্যান্সি টেলার্সের কার্ডে এম আলি লিখেছিলেন। বংশীবাবুকে উনি মুখে বলেছিলেন, তার নাম মোজাহার আলি। কেন?

আমার অনুমান–তোমাকে সেদিন বলেছিলামওদর্জির নাম হিসেবে। মুসলিম নাম মাথায় এসে যায়। মুসলিম নাম হিসেবে অমূল্যবাবুর মনে তার চেনাজানা মোজাহার এসে যাওয়া স্বাভাবিক ছিল।

কিন্তু ডামির ব্যাপারটা এখনও বুঝতে পারছি না বস্।

ম্যানিকিন বলো জয়ন্ত। ডামি বলতে আরও অনেক কিছু বোঝায়।

ঠিক আছে। তো অমূল্যবাবুর একটা ম্যানিকিন দরকার হয়েছিল কেন?

কর্নেল আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকলেন এবং বাইনোকুলার এনে ট্যুরিস্ট লজের উত্তরে শালবনের দিকটা দেখতে দেখতে বললেন, বসুন্ধরা অফিসের হেমাঙ্গবাবু এখনও এলেন না। অফিসে তালা। আটকানো দেখতে পাচ্ছি। তার মানে, চেয়ারম্যান নিকুঞ্জ ধাড়ার মৃত্যুতে অঘোষিত ছুটি। সান অব দি সয়েলরা শোকদিবস পালন করছেন। ধরে নেওয়া যায়, হেমাঙ্গবাবু শ্বশুরবাড়ি গেছেন। তার স্টাফেরাও বউ-কাচ্চাবাচ্চার সঙ্গসুখ উপভোগ করছে।

বলে কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে আমার দিকে ঘুরলেন। তুমি কী বলছিলে যেন?

মনে মনে বিরক্ত হয়ে বললাম, অমূল্যবাবুর ম্যানিকিন দরকার হয়েছিল কেন?

তার আগে ম্যানিকিনটার সদগতি করা দরকার। চলো জয়ন্ত। শুভস্য শীঘ্রম্। বসুন্ধরা অফিসের দিকটা এখন নিরিবিলি। এমন সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না।

দরজায় তালা এঁটে দুজনে বেরুলাম। বিলক্ষণ জানি, কোনও প্রশ্ন তুললেও এখন আর জবাব পাব না। নিচে গিয়ে কর্নেল বললেন, তোমার গাড়িটা দরকার হবে। আমি বাইরের রাস্তায় যাচ্ছি। তুমি গাড়ি নিয়ে এসো।

একটু পরে পেছনের টিনের চাল-চাপনো গ্যারাজ থেকে গাড়ি নিয়ে বেরুলাম। কর্নেল গাড়িতে উঠে বললেন, সোজা এগিয়ে ডাইনে ঘুরবে। তারপর বাঁ দিকে। তাড়াহুড়োর দরকার নেই।

শালবনের ভেতর দিয়ে সংকীর্ণ পিচের রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে কর্নেলের নির্দেশমতো যেখানে পৌঁছুলাম, সেখানে বিশাল বোর্ডে লেখা ছিল, বসুন্ধরা পরিবেশ ট্রাস্ট। এখনও পুরো বাড়িটা তৈরি হয়নি। একপাশে স্টোনচিপস, বালির স্তূপ, লোহালক্কড়, ইটের পাঁজা আর ঝোপঝাড়। কর্নেল চারদিক দেখে, নিয়ে সেখানে কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে গেলেন। তারপর ফিরে এলেন একটা বস্তা নিয়ে। বস্তাটা ভিজে দেখাচ্ছিল। বস্তার ভেতরে কিছু আছে। তবে তত ওজনদার নয়। বললেন, কুইক। গাড়ির ডিকি খুলে এটা রাখতে হবে।

বিনা প্রশ্নে নির্দেশ পালন করলাম। ওঁর কথামতো গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে ট্যুরিস্ট লজে ফিরে এলাম। কর্নেল নেমে গেলেন। গ্যারাজে গাড়ি রেখে এসে দেখলাম, কর্নেল লনের কোনার দিকে রাখা বেতের চেয়ারে বসে আছেন। চারটে চেয়ার এবং একটা গোলটেবিল নিয়ে বিস্তৃত লনে এমন কয়েকটা আড্ডার ব্যবস্থা আছে। তবে এখানে বসলে পেছনের গ্যারাজটার দিকে লক্ষ্য রাখা যায়। ওঁর মুখোমুখি বসে বললাম, ম্যানিকিনটার খোঁজ পেয়েছিলেন তাহলে?

কর্নেল চুরুট জ্বেলে বললেন, হ্যাঁ। তবে ওখানে ওটা আমিই লুকিয়ে রেখেছিলাম। বার্ড-স্যাংচুয়ারির দুর্গম এলাকা থেকে জিনিসটা এত দূরে নিয়ে আসতে কমপক্ষে দু-ঘণ্টা সময় লেগেছে। জঙ্গলও জায়গায় জায়গায় খুব ভুগিয়েছে।

কোথাও জলের ভেতর বস্তাটা লুকোনো ছিল?

ছিল।

 টের পেলেন কী করে?

ভোরে বার্ড-স্যাংচুয়ারিতে গিয়ে বাইনোকুলারে দৃশ্যটা চোখে পড়েছিল। মোজাহার তালডোঙায় বস্তাটা নিয়ে গিয়ে একটা জলটুঙ্গির কাছ ঘেঁষে ডুবিয়ে রাখছিল। জায়গাটা টোপাপানায় ভরতি। তাই বেরাও খুব ভোগান্তি হচ্ছিল। অবশেষে টোপাপানা চাপিয়ে ঢেকে দিল। ম্যানিকিন হাল্কা জিনিস। ডুবতেই চায় না।

ওঃহো! তাই আপনি বলছিলেন মোজাহার পালিয়ে যাওয়া মাছ খুঁজে বেড়াচ্ছে?

কর্নেল হাসলেন। মোজাহার একখানে তার তালডোঙা রেখে চলে যাওয়ার পর আমি সুযোগটা নিলাম। তারই তালডোঙাটায় চেপে সেখানে গিয়ে বস্তাটা তুললাম। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওতে ম্যানিকিন আছে। কারণ অমূল্যবাবু ওরফে লক্ষ্মীবাবু যেভাবেই হোক আমার পরিচয় জানতেন এবং এখানে আসার উদ্দেশ্য টের পেয়েছিলেন। হুমকি দিয়ে চিঠিও লিখেছিলেন। তারপর ম্যানিকিনটা চেতনাভিলা থেকে সরিয়ে দুর্গম জায়গায় লুকিয়ে রাখার নির্দেশ মোজাহারকে দিয়ে গিয়েছিলেন। যাই হোক, আমি করলাম কী, বস্তাটা তুলে বার্ড-স্যাংচুয়ারির এমন জায়গায় নিয়ে গেলাম, যেখান থেকে চেতনাউদ্যানে ঢোকা সহজ। একটা ঝোপের ভেতর ওটা রেখে তালডোঙায় চেপে চলে এলাম। মোজাহার যেখানে তালডোঙা রেখে গিয়েছিল, সেখানে একইভাবে রাখলাম। বাকিটা তুমি অনুমান করে নাও।

ব্রেকফাস্টের পর বেরিয়েছিলেন আপনি। তখন বস্তাটা এনে বসুন্ধরা অফিসের ওখানে রেখেছিলেন। কিন্তু চেতনাউদ্যান ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া আছে না?

আমার কিটব্যাগে অনেক দরকারী জিনিস থাকে, তা তুমি জানো। বলে কর্নেল তিনটি আঙুল দেখালেন। তিনটে কাঁটাতার কেটেছি মাত্র। কাটার পর প্লাসের সাহায্যে জোড়াও দিয়েছি। আমার সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা যে কত সময় কাজে লাগে বলার নয়।

উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, মোজাহার খেপে গেছে নিশ্চয়। তার নাকি দলবল আছে এখানে।

কর্নেল নির্বিকার মুখে বললেন, অমুল্যবাবু ওরফে লক্ষ্মীবাবু এতক্ষণে কলকাতায় খবর পেয়ে গেছেন। রেডিও-ট্রান্সমিশন সেট থাকার এই সুবিধে। ওয়েভলেন্থ যা-ই হোক, সিগন্যালের ভাষায় কথা চালাচালির অসুবিধে নেই। বলতে পারো, এটা বর্ডার এলাকা। ডিফেন্সের অনেক ঘাঁটি আছে। তাদের যন্ত্রে ওই সিগন্যাল শোনা যাবে এবং সন্দেহও হবে। কিন্তু ভুলে যেও না দত্তসায়েব একজন শিল্পপতি এবং এই প্রজেক্টে এক কোটি টাকা দান করেছেন। কাজেই তার রেডিও-ট্রন্সমিশন সেট ব্যবহারের অনুমতি যোগাড় করার অসুবিধে হয়নি বলেই আমার ধারণা।

 ম্যানিকিনের কথা বলুন এবার।

ম্যানিকিনের অবস্থা শোচনীয়। বেচারাকে বিবস্ত্র করে ভেঙে দুমড়ে বস্তায় ঢোকানো হয়েছে।

কিন্তু এই কেসে ম্যানিকিনের রোলটা কী?

কর্নেল হঠাৎ একটু চটে গেলেন। তোমাকে এক মহিলা চিঠি লিখে নাকি প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি এত বোকা কেন জয়ন্তবাবু? সেই চিঠিটা তোমার কাছে আছে? থাকলে ওঁর ঠিকানাটা দিও। ওঁর প্রশ্নের উত্তর আমি বিস্তারিতভাবে দেব।

একটু ভড়কে গিয়ে বললাম, ম্যানিকিনের ভেতরে তাহলে চোরাই হীরে মণি-মুক্তো লুকোনো ছিল। ভবানীপুরের সূর্যনারায়ণ রায় জমিদারের বংশধর। তাঁর বাড়িতে ঐতিহাসিক জুয়েলস থাকতেই পারে এবং বখাটে ছেলে অনিকে ফুসলে অমূল্যবাবু

কর্নেল বাধা দিলেন। চেপে যাও। হালদারমশাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছেন।

ঘুরে দেখলাম, ঢ্যাঙা প্রাইভেট ডিটেকটিভ হন্তদন্ত আসছেন এবং মাঝে মাঝে পিছু ফিরে কাকেও দেখে নিচ্ছেন। কেউ ওঁকে তাড়া করে আসছে মনে হচ্ছিল।

ট্যুরিস্ট লজের গেটের কাছে এসে তিনি থমকে দাঁড়ালেন। তারপর যেদিক থেকে আসছিলেন সেইদিকে ঘুরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। কর্নেল ওঁকে লক্ষ্য করছিলেন। এবার একটু কাশলেন।

অমনি হালদারমশাই আমাদের দেখতে পেয়ে ছুটে এলেন। ধপাস করে বসে বললেন, হালার কুত্তা!

কর্নেল বললেন, আপনাকে কুকুর তাড়া করেছিল নাকি?

হঃ। হালদারমশাই উত্তেজিতভাবে নস্যির কৌটো বের করলেন। এক টিপ নস্যি নাকে খুঁজে বললেন, কটেজ এরিয়ায় কোন ব্যাটা কুত্তা লইয়া আইছে। ডেঞ্জারাস ডগ কর্নেল স্যার। আপনি অথরিটিরে জানান। চেতনাউদ্যানে কুত্তা অ্যালাউ করা উচিত না। আনল, আনল, কিন্তু ছাড়া রাখল ক্যান?

কটেজ এরিয়ায় আপনি কি সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলেন?

না। দত্তসায়েবের পোলারে খুঁজছিলাম। হঠাৎ হালার কুত্তা আমারে তাড়া করল।

জিজ্ঞেস করলাম, কালো রঙের অ্যালসেশিয়ান নয় তো?

হালদারমশাই নড়ে বসলেন। হঃ! কালো রঙের অ্যালসেশিয়ান। আপনারা দেখছেন নাকি?

ভবানীপুরে রায়সায়েবের একজোড়া প্রকাণ্ড কালো অ্যালসেশিয়ান আছে দেখেছি।

ওনাগো সারভ্যান্ট ভোলা কইছিল বটে। তবে আমি দেখি নাই। প্রাইভেট ডিটেকটিভ কর্নেলের দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় বললেন, তা হইলে সিওর হওন যায়। কী কন কর্নেলস্যার?

কর্নেল বললেন, কী বিষয়ে?

দত্তসায়েবের পোলা আইয়া কোনও কটেজে আছে।

আপনি তো মাত্র একটা কালো কুকুর দেখেছেন?

একটারে লইয়া আইছে। অন্যটা আছে রায়সায়েবের কাছে।

আমি কথাটা যুক্তিযুক্ত মনে করে বললাম, হ্যাঁ। দুটো কুকুরই নিয়ে এলে রায়সায়েব হইচই বাধাতেন।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, সাড়ে তিনটে বাজে। বারোটার মধ্যে আমাকে চলে যেতে ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনও কিছু ঘটল না। কাজেই জয়ন্ত। চলো আমরা বেরিয়ে পড়ি।

হালদারমশাই গুলি-গুলি চোখে তাকালেন। আমি বললাম, কোথায় যাবেন?

আগে গাড়ি নিয়ে এসো। ম্যানেজারবাবু এখন সম্ভবত তার কোয়ার্টারে। হালদারমশাই বরং আমাদের রুমের জিম্মায় থাকুন। লজের কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবেন, বিশেষ কাজে আমরা সোনাইতলা গেছি। ফিরে এসে ডিনার খাব। আপনি এখন বসুন্ধরার লোক। কিছু খেতে ইচ্ছে করলে অর্ডার দেবেন। বিলে সই করবেন। ব্যস।

কর্নেল দোতলায় আমাদের রুমে গেলেন। হালদারমশাই বিভ্রান্তভাবে তাকে অনুসরণ করলেন। আমি গ্যারেজ থেকে গাড়ি এনে গেটের বাইরে দাঁড় করালাম। গেট সবসময় খোলা। কোনও দারোয়ান নেই। ম্যানেজার বলছিলেন, দুজন দারোয়ান কয়েক দিনের মধ্যেই জয়েন করবে। সাত-তাড়াতাড়ি ওপেনিং ফাংশন হয়ে গেল। তাই একটু অব্যবস্থা চলেছে। আমরা শিগগির সবকিছু ঠিক করে ফেলব।

কর্নেল শুধু তার কিটব্যাগ নিয়ে এলেন। বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা তাঁর গলা থেকে সবসময় ঝোলে। বললাম, হালদারমশাই কি কুকুরের তাড়া খাওয়ার ধকল সামলাচ্ছেন?

কোনও প্রশ্নের জবাব না পেয়ে গুম হয়ে বসে আছেন। বলে কর্নেল গাড়িতে উঠলেন। আমি গাড়ি স্টার্ট দিলে তিনি একটু হেসে ফের বললেন, হালদারমশাই কুকুরটাকে নাকি ফার্স্ট ওয়ার্নিং দিয়েছেন। এর পর তাড়া খেলে গুলি করে মারবেন। আমি ওঁকে বলে এলাম, তাতে মামলার দায়ে পড়বেন। তার চেয়ে কটেজ এরিয়ায় পা না বাড়ানোই ভালো। হা–ডাইনে ঘুরে গেট দিয়ে বেরোও।

তারপর?

 তারপর সোনাইতলায় হাইওয়ে ধরে কৃষ্ণন্নগর।

সেখানে কেন?

 চলো তো!

ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে না?

যাক না। চিয়ার আপ ডার্লিং। এটা একটা অ্যাডভেঞ্চার বলে ধরে নাও না।

হাইওয়ের সেই বিপজ্জনক বাঁকে পৌঁছুনোর আগেই দিনের আলো ধূসর হয়ে যাচ্ছিল। কর্নেল বাইনোকুলারে প্রকৃতিদর্শন করছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, আবার তদন্ত করবেন নাকি?

কর্নেল বাইনোকুলার নামিয়ে রেখে বললেন, দৃশ্যটা কল্পনা করো জয়ন্ত। রাত প্রায় দশটা। বৃষ্টি পড়ছে। দত্তসায়েব কলকাতায় তার প্রিয়তমা যুবতী স্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন। যত দ্রুত সম্ভব তাঁর কাছে পৌঁছুতে চান। তিনি হয়তো একটু ড্রাঙ্ক অবস্থায় ছিলেন। এখন বাঁকের উল্টোদিক থেকে কোনও গাড়ি অত রাতে এলে আলোর সংকেত তো দেবেই, হর্নও বাজাবে। কিন্তু দত্তসায়েব তেমন কিছু দেখতে পেলেন না। তাই তত সাবধানও হলেন না। তাঁর গাড়ির হেডলাইটে বাঁকের মুখ পর্যন্ত রাস্তাটা মোটামুটি পরিষ্কার ছিল, যদিও বৃষ্টির দরুন খুঁটিয়ে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তারপর যেই তিনি বাঁকের মুখে পৌঁছেছেন, অমনি দেখলেন তার গাড়ির সামনে রাস্তার উপর পড়ে আছে একটা ডেডবডি।

চমকে উঠে বললাম, ডেডবডি? তার মানে, কোনও গাড়ি সদ্য কাউকে চাপা দিয়ে পালিয়েছিল।

কর্নেল পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করে সেটা খুললেন। এটা অন্তিমকালে নিকুঞ্জবাবুর লেখা সেই দুর্বোধ্য কথার জেরক্স কপি। তিনি ইংরেজিতে লিখতে চেয়েছিলেন দুর্ঘটনা কী ভাবে ঘটেছিল। স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে : এ ডি ই। অনুমান করা যায়, তিনি লিখতে চেয়েছিলেন : A deadbody was layed on the road–এরকম কোনও বাক্য। কিন্তু A de লেখার পরই তার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়।

ঠিক বলেছেন। একটা ডেডবডি দেখামাত্র দত্তসায়েব পাশ কাটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাঁকের মুখে চাকা পিছলে গিয়েছিল। তারপর গাড়ির সামনে গাছের পাঁচিল দেখে ব্রেক কষতেই দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

কিন্তু ওটা মোটেও ডেডবডি ছিল না। ছিল একটা ম্যানিকিন। কুমোরটুলির বংশীবাবুর তৈরি সেই ম্যানিকিন, এখন যেটা তোমার গাড়ির ডিকির ভেতর বস্তাবন্দি।

হকচকিয়ে উঠে বাঁকের মুখে গিয়ে গাড়ি থামালাম। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই যেন গাড়ি থেমে গেল। কর্নেল বললেন, তাহলে একটুখানি নামো। ব্যাপারটা হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিই।

দুজনে নামলাম। তারপর কর্নেল বললেন, এ একটা সুপরিকল্পিত চক্রান্ত জয়ন্ত। এখানে ঘাসের ভেতর ম্যানিকিনের ভাঙা জুতোর কিছু গুঁড়ো কাল আমাকে তুমি তুলে নিতে দেখেছ। চক্রান্তকারীরা ম্যানিকিনের গলায় দড়ি বেঁধে রাস্তার ওধারে সারবন্দি গাছের আড়ালে বসেছিল। দুর্ঘটনার পরই তারা দড়ি টেনে ম্যানিকিন সরিয়ে নেয়। তারপর নিচের ঢাল বেয়ে পালিয়ে যায়। কারণ দুদিকে থেকেই মালবোঝাই ট্রাক আসছিল। এস! এবার রাস্তার ওধারে যাই।

তাকে অনুসরণ করলাম। রাস্তার ওপারে সারবন্দি গাছের ফাঁকে একটা ফোকর দেখিয়ে কর্নেল বললেন, এই দেখ, ম্যানিকিনের কৃত্রিম জুতোর গুঁড়ো, এমনকি বডির প্লাস্টার অব প্যারিসের কিছু গুড়ো ঘাসে জমাট বেঁধে আছে। রাস্তার পিচে কোনও চিহ্ন নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ এটা হাইওয়ে। অনবরত গাড়ি যাতায়াত করছে।

আমার গাড়ির কাছে ফিরে এলাম। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সাবধানে বাঁক পেরিয়ে গেলাম। বললাম, তাহলে দত্তসায়েব রওনা হওয়ার আগেই ম্যানিকিন নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়েছিল।

হ্যাঁ। তবে তুমি ওরা বলছ, আমি বলছি অমূল্যবাবু ওরফে লক্ষ্মীবাবু আর তার স্যাঙাত মোজাহার। চেতনাভিলা থেকে কলকাতা যাতায়াতের জন্য দত্তসায়েব অমূল্যবাবুকে একটা গাড়ি দিয়েছেন। চেতনাউদ্যানের গেটে যে পার্টটাইম গেটকিপার আছে, সে দেখেছিল ডেকরেটারদের ট্রাকের পেছনে অমূল্যবাবুর গাড়ি যাচ্ছিল। গাড়ি ড্রাইভ করছিল মোজাহার। ওদিকে বনমালীর কাছে শুনেছি, চেতনাভিলায় কেয়ারটেকারকে দেখতে না পেয়ে দত্তসায়েব খাপ্পা হয়েছিলেন।

সব বুঝলাম। আমার সন্দেহ, স্বয়ং রায়সাহেবও এই চক্রান্তের পেছনে আছে! কর্নেল হাসলেন। সবটা এখনও বোঝোনি। দত্তসায়েব এবং বসুন্ধরা ট্রাস্টের যৌথভাবে ডাকা প্রেস কনফারেন্সের তারিখ ছিল ২৫ আগস্ট। ২৬ আগস্ট বংশীবাবুকে ম্যানিকিনের অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। বংশীবাবু তারিখটা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার কেন জানি না একটু অস্বস্তি হয়েছিল। হাইনটুইশনও বলতে পারো! তারপর ম্যানিকিনের ডেলিভারি নিতে দেরির কারণ স্পষ্ট। মন্ত্রীমশাইয়ের কাছে উদ্বোধনের তারিখ পেতে দেরি হয়েছিল। সেই তারিখ। পাওয়ামাত্র সাত-তাড়াতাড়ি ম্যানিকিনের পোশাক তৈরির ব্যবস্থা হয়। কিন্তু অমূল্যবাবুর টাকার লোভ প্রচণ্ড। দেড় হাজার টাকা পকেটস্থ করে ওটা বংশীবাবুর ওয়ার্কশপ থেকে চুরি করেছিলেন।….