৫. ডাইনিং রুমে খাওয়ার টেবিলে বসে

ডাইনিং রুমে খাওয়ার টেবিলে বসে আবার কথাটা মিসেস সুষমা রায়চৌধুরির কাছে টেনে আনলুম। বললুম, আজকাল খুনোখুনির সঙ্গে নারীধর্ষণও সর্বত্র বেড়ে গেছে। কাজেই আপনার যুক্তি অস্বীকার করছি না। কিন্তু আমার সঙ্গে আজ সকালে জয়ার বাবার দেখা হয়েছে।

সুষমা যেন একটু চমকে উঠলেন। বললেন, আপনি কি কবরেজবাড়ি গিয়েছিলেন?

না পথে দেখা হয়েছিল। আমি যে তাঁর মেয়ের লাশ উদ্ধার করেছি, উনি পুলিশসূত্রে জেনেছেন।

কী বললেন, উনি?

বললেন, জয়া পাটনায় চাকরির ইনটারভিউ দিতে বৃহস্পতিবার বেলা তিনটে নাগাদ বেরিয়েছিল। ধরমপুর বাসস্ট্যান্ডে চারটেতে পাটনার বাস ছাড়ে। রাত দশটায় পৌঁছায়। পাটনায় মাসির বাড়িতে রাত কাটিয়ে শুক্রবার জয়ার সকাল দশটায় ইনটারভিউ দেওয়ার কথা ছিল। এদিকে শুক্রবার বিকালে আমি ফাগুলালের সঙ্গে নীল সারসের ছবি তুলতে গিয়ে জয়ার লাশ উদ্ধার করেছি। ডাক্তারের মতে, জয়াকে খুন করা হয়েছিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ছটা নাগাদ। কিন্তু সময়টা বিকাল চারটে নাগাদ বলে আমার অনুমান।

সুষমা রায়চৌধুরি একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, জয়া তাহলে তার বাবাকে মিথ্যা কথা বলেছিল। কবরেজমশাই কি আপনাকে বলেছেন পাটনায় কীসের ইনটারভিউ দিতে যাচ্ছিল জয়া? কোন্ অফিসে?

অবিনাশবাবু তা জানেন না। জয়া তাকে খুলে কিছু বলেনি।

সুষমা বাঁকা মুখে নিঃশব্দে হাসলেন। বললেন, জয়া খুব জটিল চরিত্রের মেয়ে ছিল। অন্তরার মতো ভোলা মনের ছিল না। আপনি জানেন কি, কবরেজমশাই বাচ্চুর সঙ্গে জয়ার বিয়ের প্রস্তাব তুলেছিলেন? আমার হাজব্যান্ড রাজি ছিলেন। আমি রাজি হইনি। বাচ্চু জয়াকে ট্যাকল করতে পারত না। আমিও পারতুম না।

কথাটা বলেই সুষমা রায়চৌধুরি হঠাৎ বেরিয়ে গেলেন। ঘুরে দেখলুম, দক্ষিণে পাঁচিলের কাছে একটা গাইগোরু গন্ধরাজ ফুলগাছের পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছে। মালিবউ সুষমার ডাকে ছুটে গিয়ে গোরুর দড়ি ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। গোরুটা কোথাও বাঁধা ছিল। দড়ি ছিঁড়ে চলে এসেছে। সুষমা বকাবকি করতে করতে মালিবউকে অনুসরণ করে মন্দিরের দিকে অদৃশ্য হলেন।

খাওয়ার পর হলঘরের ভিতর দিয়ে দোতলায় উঠলাম। পূর্বপ্রান্তে আমার ঘরের সামনে বারান্দা থেকে দেখলুম, খিড়কির দরজা খোলা এবং সেইপথে মালিবউ গোরুটাকে পুকুরপাড়ে নিয়ে যাচ্ছে। সুষমা খাপ্পা হয়ে বলছেন, দরজা কে খুলে রেখেছিল?

মালি কালীপদ পুকুরে স্নান করতে নেমেছিল। সে ভেজা শরীরে দরজায় এসে কৈফিয়ত দিতে থাকল। আমি তালা খুলে ঘরে ঢুকে ফ্যান চালিয়ে ইজিচেয়ারে বসলুম। চুরুট জ্বেলে চোখ বুজে চিন্তাভাবনায় ডুবে গেলুম।

কিছুক্ষণ পরে মনে হল, খুনির প্যান্ট-শার্ট ঝোঁকের মাথায় তুলে এনে ভুল করেছি। চিঠি, চাবিরগোছা, সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার নিয়ে প্যান্ট-শার্টটা গর্তে পুঁতে রেখে আসাই উচিত ছিল। ফিরে এসে থানায় ফোন করে খবর দেওয়া উচিত ছিল, আমি ডমরুপাহাড়ের চূড়ায় আর একটা কবর দেখেছি। আইনবিরুদ্ধ কাজ করে ফেলেছি।

পরক্ষণে মনে হল, খুনি আড়াল থেকে লক্ষ করেনি তো, আমি তার প্যান্ট শার্ট খুঁড়ে বের করেছি? বাইনোকুলারে খুঁটিয়ে চারদিক দেখেছিলুম। কিন্তু কোনো ঝোপের আড়াল থেকে কেউ আমার দিকে লক্ষ রাখলে আমার তাকে দেখতে না-পাওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।

এটা একটা আইনবিরোধী কাজ। পুলিশের দিক থেকে দেখলে অবশ্য এই কাজের সঙ্গত কৈফিয়ত কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের পক্ষে দেওয়া সঙ্গত হতে পারে, কেন না আগামীকাল পুলিশ সুপার মিঃ শর্মা এসে পড়বেন। কিন্তু আদালতে আমার বেসরকারি গোয়েন্দাগিরি গ্রাহ্য না হতেও পারে।

দুটো বাজলে আমি সেজেগুজে যথারীতি পিঠে কিটব্যাগ এঁটে গলায় বাইনোকুলার আর ক্যামেরা ঝুলিয়ে খিড়কির দরজায় গেলুম। দরজা ভেজানো ছিল। খুলেই দেখি কালীপদ পুকুরপাড়ে ঘাসজমিতে বসে বিড়ি টানছে। গাইগোরুটা খুঁটিতে লম্বা দড়ি দিয়ে বাঁধা এবং গোরুটা ঘাস খাচ্ছে।

আমাকে দেখে কালীপদ বিড়ি ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে নমস্কার করল। তারপর বলল, স্যার কি আবার চণ্ডীপাহাড়ে যাচ্ছেন?

বললুম যাচ্ছি। তবে ওই মাঠে সকালে লালঘুঘুর ঝাঁক দেখেছিলুম। দেখি, ছবি তুলতে পারি কি না। তো তুমি এবেলা কি গোরু চরিয়েই কাটাবে? ফুলগাছে জল দেবে না?

কালীপদ হাসল। বলল, কাল রাতে যা বৃষ্টি হয়েছে, আর এক সপ্তাহ বৃষ্টি না হলেও জল লাগবে না।

বৃষ্টির পর খোঁড়াখুঁড়ি করলে মাটি জমাট হয় না। তুমি সিডবেড তৈরি করেছ দেখলুম।

আজ্ঞে হ্যাঁ। কাল সকালে খুরপি হাতে কাজে লাগব।

তুমি খন্তা দিয়ে কী খোঁড়ো কালীপদ?

বুঝলেন না। সিডবেড তৈরির সময় খন্তা দিয়ে খুঁড়তে হয়। তারপর সার। ছড়িয়ে মাটি উলটে-পালটে গুঁড়ো করতে হয়।

তোমার খন্তা নাকি হারিয়ে গিয়েছিল? ফাগুলাল বলছিল।

কালীপদ গম্ভীরমুখে বলল, গত পরশু পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে–ওই যে দেখছেন, বেগুনখেতে খোঁড়াখুঁড়ি করে ওখানেই রেখেছিলুম। তারপর আনতে মনে ছিল না। কাল সকালে মনে পড়ল। কিন্তু বেগুনখেতে খন্তা নেই। কেউ বেগুন চুরি করে খন্তা নিয়ে পালিয়েছে।

কিন্তু পরে খুঁজে পেয়েছিলে শুনলাম। ফাগুলাল বলছিল।

হ্যাঁ স্যার। হঠাৎ দেখি, বাড়ির ভিতর করবীগাছের পিছনে পড়ে আছে। কালীপদ হাসল। কোনো বাড়ির ঝি-চাকরের কাজ। সায়েবকে বাঙালিটোলায় সবাই খাতির করে। মনিব দেখতে পেয়ে ধমকেছে। তখন পাঁচিলের ওপর দিয়ে ফেলে দিয়েছে। আমি স্যার কথাটা চেপে গেলুম। মেমসায়েবকে তো দেখছেন। খুব কড়া ধাতের মানুষ। বাইরে বেগুনখেতে খন্তা রেখে এসেছিলুম শুনলে খন্তার দাম মাইনে থেকে কেটে নিতেন।

তাই তুমি বলেছ, করবীগাছের কাছে রেখেছিলে–মনে ছিল না?

কালীপদ আবার হাসল। বলল, ফাগুলাল আমাকে বুদ্ধিটা দিয়েছিল। ফাগুলাল খুব চালাক লোক। তবে ভালোমানুষ। খুব ভালোমানুষ।

জিজ্ঞেস করলুম, ওই পাশের বাড়িটা কার কালীপদ?

ভানুডাক্তারের বাড়ি। ডাক্তারবাবু মারা গেছেন। ডাক্তারগিন্নি বেঁচে আছেন। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। দুই ছেলে। বড়ো ছেলে হাসপাতালে কাজ করে। ছোটো–

সহসা মেমসায়েব-এর আবির্ভাব খিড়কির দরজায়। কালী বলে ডেকেই তিনি আমাকে দেখতে পেলেন। বললেন, কর্নেলসায়েব আবার চণ্ডীপাহাড়ে যাচ্ছেন নাকি?

বললুম কাছাকাছি যাব। ওই পলাশগাছের কাছে মাঠের উপর লালঘুঘুর ঝক দেখেছিলুম। ছবি তোলার সুযোগ পাইনি। এবার গিয়ে দেখি।

সুষমা বললেন, দেখুন। কালী! বাড়ি আয়। কাজ আছে। তোর বউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

মাঠে নেমে বাইনোকুলারে দেখে নিলুম, প্রয়াত ডাক্তারবাবুর বাড়ির পিছন থেকে ঝোপঝাড় আর উঁচু-নিচু গাছের জঙ্গল সেই আমবাগানের কাছে গিয়ে থেমে গেছে। আমবাগানের ভিতর কোনাকুনি পশ্চিম-উত্তরে এগিয়ে সংকীর্ণ রাস্তায় পৌঁছেছিলুম। তারপর বেঙ্গল ক্লাব।

কালীপদর খন্তা চুরি যাওয়ার ঘটনা যত গুরুত্বপূর্ণ হোক, আমাকে খুনির প্যান্ট-শার্টের একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

হাঁটতে হাঁটতে পলাশগাছের কাছে পৌঁছেলুম। তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে একটা গর্ত আবিষ্কার করলুম। মাটিটা সেখানে ঢালু এবং ঢালের গায়ে গর্তটা শেয়ালের বলে মনে হল। বাইনোকুলারে পশ্চিমে বাঙালিটোলার দিকটা দেখে নিলুম। কালীর বউ গোরটার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু বলছে। বাইনোকুলারে ওর ঠোঁট নড়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।

আমি ঢালের নিচে বসে কিটব্যাগের পিছন থেকে পলিপ্যাকটা বের করলুম। তারপর ভিজে প্যান্ট শার্ট ছুরিটা রেখে দলা পাকিয়ে গর্তে ভরে দিলুম। ঢালের নিচে রাতের বৃষ্টি স্রোত বইয়ে দিয়েছিল। অজস্র রঙের কুচি পাথর ছড়িয়ে ছিল। সেগুলো তোলার জন্য রবারের দস্তানা দুহাতে পরে নিলুম। তারপর গর্তটা সেইসব খুদে পাথরে বুজিয়ে দিলুম। তারপর ইচ্ছা করেই শার্টের একটু অংশ টেনে চোখে পড়ার মতো করে ঝুলিয়ে দিলুম।

কিছুক্ষণ ক্যামেরাটা ধরে গুঁড়ি মেরে যেন লালঘুঘুদের ফোটো তুলছি, এইভাবে এগিয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আর কী বিস্ময়কর ঘটনা! সত্যিই লালঘুঘুদের একটা ঝাক টাড় জমিটার পূর্বপ্রান্ত থেকে উড়ে গেল চণ্ডীপাহাড়ের দিকে!

একটু দেখে নিলে আঁকটা আমার চোখ এড়িয়ে যেত না। এই প্রজাতির ঘুঘু এখন দুর্লভ হয়ে এসেছে।

কিন্তু কী আর করা যাবে! আমি উঁচু টাড় জমিতে উঠে কিছুক্ষণ চণ্ডীপাহাড়ের দিকে বাইনোকুলারে ঝকটা লক্ষ করতে থাকলুম। তারপর ঘুরে সোজা উত্তরে এগিয়ে মেঠো রাস্তায় পৌঁছোলুম। হাঁটতে হাঁটতে বেঙ্গল ক্লাবের পাশ দিয়ে নিচের পিচরাস্তা দিয়ে ধরমপুরের দিকে চললুম।

ক্রমে দুধারে নতুন-পুরনো বাড়ি, মানুষজন এবং তেরাস্তায় যানবাহনের ভিড় এসে গেল। একটা সাইকেল রিকশ ডেকে বললুম, পুলিসস্টেশন চলো! জলদি যানা পড়ে গা!

রিকশাওয়ালা আমাকে বিদেশী ট্যুরিস্ট ভেবে বলল, বিশ রুপৈয়া স্যার!

এবার বাংলায় বললুম, কী বলছ তুমি? থানা কুড়ি টাকা ভাড়া? রিকশওয়ালা অবাক হয়েছিল। এবার হাসল। বলল, ঠিক আছে সার! দশ টাকা তো দেবেন?

বললুম, ঠিক আছে। চলো!…

ওসি শ্যামসুন্দর সিংহ আমাকে দেখে হাসার চেষ্টা করে ইংরেজিতে বললেন, নীল সারসের ছবি তুলতে পেরেছেন, আশা করি?

না মিঃ সিংহ! গম্ভীর মুখে বললুম, নীল সারস দম্পতি সম্ভবত কোনো দেবদেবী।

কফি খান কর্নেল সরকার। মিঃ শৰ্মা আমাকে জানিয়েছেন, আপনি সবসময় কফি খান।

কফির হুকুম দিয়ে মিঃ সিংহ একটা ফাইলে সই করলেন। বললুম, কফি খেয়েই আপনাকে নিয়ে বেরুতে চাই। বললুম না নীল সারস দম্পতি কোনো দেবদেবী?

মিঃ সিংহ ভুরু কুঁচকে তাকালেন। আপনি চণ্ডীপাহাড়ে গিয়েছিলেন শুনেছি। সেখানে কি আপনার কেসের আরও কোনো তথ্য পেয়েছেন?

চণ্ডীপাহাড়ে নয়। নিচের মাঠে একটা গর্তে কিছু পোঁতা আছে। নীল কাপড়ের একটু অংশ দেখা যাচ্ছিল। আমি খুঁড়িনি। কারণ এটা কোনো দুর্গমপাহাড়ের চূড়া নয় এবং সময়টা রাত্রিও নয়।

নীল কাপড়ের অংশ! আপনার কী ধারণা বলুন কর্নেল সরকার?

শার্টের অংশ মনে হয়েছে।

মিঃ সিংহ নিষ্পলক দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, খুনি মেয়েটিকে মারার পর তার প্রেমিককেও মেরে ওখানে পুঁতেছে। তা-ই কি?

জানি না। গিয়ে দেখবেন আপনারা।

একটু পরে কফি আর বিস্কুট এল। কফির স্বাদ যেমনই হোক, আমাকে চাঙ্গা করে। কফি খেয়ে চুরুট ধরিয়ে বললুম, সেখানে জিপগাড়ি সরাসরি গিয়ে পৌঁছোতে পারে।

ঘটনার এই অংশটুকু সংক্ষেপে বলছি। ইনভেস্টিগেটিং অফিসার মিঃ দুবে। খুনির রক্তমাখা ভিজে প্যান্ট-শার্ট এবং মার্ডার উইপন পেয়ে খুবই খুশি হয়ে বলেছিলেন, এবার খুনিকে ধরে ফেলতে আর একটা দিন সময় নিচ্ছি। শার্টটা বিদেশী। কিন্তু প্যান্টে স্থানীয় দরজির দোকানের স্টিকার সেলাই করা আছে। ওসি মিঃ সিংহ বলেছিলেন, কর্নেল সরকার নেচারোলজিস্ট। সর্বত্র ঘুরে বেড়ান। কাজেই তার পক্ষে ভিকটিমের লাশ এবং খুনির পোশাক ইত্যাদি খুঁজে বের করা সম্ভব। তবে এইসব কাজ আকস্মিকতার পর্যায়ে পড়ে। পুলিশের পক্ষে এই পদ্ধতিতে তদন্ত করা সম্ভব নয়। কোনো সূত্র ধরেই পুলিশকে পা বাড়াতে হয়। তা সত্ত্বেও কর্নেল সরকার পুলিশের পক্ষ থেকে ধন্যবাদের পাত্র। আমি ওঁদের বলিনি, ডমরুপাহাড়ে লাশ আর জামা-প্যান্ট খুনির পুঁতে রাখার কারণ, শঙ্খচূড় সাপের গুজব। সাপের ভয়ে ওই পাহাড়ে কেউ চড়ে না।

তখন বিকাল সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। পুলিশের জিপ থেকে আমি বাঙালিটোলার নিচের রাস্তায় নেমেছিলুম। হাঁটতে হাঁটতে অরিন্দম রায়চৌধুরির বাড়ির সামনে গিয়ে দেখলুম, ফাগুলাল রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে সে সেলাম দিল বলল, কালীপদর বউয়ের কাছে এইমাত্র শুনলুম, পুলিশের জিপগাড়ি পুবের মাঠে গিয়েছিল। আপনি তাদের সঙ্গে ছিলেন।

বললুম, তুমি শ্মশান থেকে কখন ফিরলে?

তিনটে নাগাদ ফিরেছি। স্নান করে খেয়ে কালীপদর বউয়ের কাছে কথাটা শুনলুম। ওদিকে পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখলুম, পুলিশের জিপগাড়ি চলে গেছে। তারপর ভাবলুম, এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো আপনাকে দেখতে পাব। পুলিশের জিপ থেকে আপনাকে নামতে দেখলুম। এখনও বেলা আছে। তাই ধরেই নিয়েছিলুম, আপনি আবার পাখিদুটোর খোঁজে ডমরুপাহাড়ে যাবেন।

কথাগুলো বলে ফাগুলাল খইনি ডলতে থাকল। বললুম, কবরেজমশাই ফিরেছেন?

ফিরেছেন। দুঃখ হচ্ছে, মানুষটা একেবারে বোবা হয়ে গেছেন। একটু ভেবে নিতে আমি ডমরুপাহাড়ের চূড়ায় নীল সারস দম্পতিকে বাইনোকুলারে খুঁজে দেখার ভান করলুম। আগেই বলেছি, রাস্তার পশ্চিমে একটা টিলা এখান থেকে সেই অশ্বত্থাগাছটা দেখার পথে বাধা। কিন্তু সূর্য ঢলে পড়েছে টিলাটার দিকে। অশ্বত্থাগাছটা দেখা না গেলেও ডমরুপাহাড়ের কিয়দংশে রাস্তার ধারে উঁচু। শালবনের ফাঁক দিয়ে কয়েক মিনিট ধরে একটা লোককে দেখার চেষ্টা করলুম। সূর্যের ছটা বাইনোকুলারে প্রতিফলিত হওয়ায় লোকটার চেহারা কিছুতেই স্পষ্ট হল না। লোকটা সূর্যের ছটার মধ্যে কালো হয়ে ফুটে হারিয়ে গেল ডানদিকে। লোকটা তার জামা-প্যান্ট আনতে গিয়েছিল, এতে নিঃসংশয় হওয়া চলে। জামা প্যান্ট না পেয়ে সে এবার নিশ্চয় গা ঢাকা দেবে।

ফাগুলাল সাগ্রহে বলল, পাখিদুটো দেখতে পাচ্ছেন স্যার?

বাইনোকুলার নামিয়ে বললুম, ফাগুলাল। কবরেজমশাইয়ের সঙ্গে সকালে আমার আলাপ হয়েছে। আমি তার বাড়ি যেতে চাই।

ফাগুলাল বলল, চলুন! ওঁর বাড়ি দেখিয়ে দিচ্ছি। আমাকে মেমসায়েব বাড়িতে থাকতে বলেছেন। কারণ সায়েব বাড়িতে নেই।

ঠিক আছে। চলো। বাড়িটা দেখিয়ে তুমি চলে আসবে।

ফাগুলালকে অনুসরণ করে যেদিক থেকে এসেছি সেইদিকে হেঁটে গেলুম। বেঙ্গল ক্লাবগামী সংকীর্ণ চড়াই রাস্তাটায় দুটো বাড়ির পর উঁচু ঘাসে ঢাকা একটুকরো জমির উপর পাশাপাশি দুটো আমলকীগাছ। ডানদিকে মাটিটা নিচু এবং পাথুরে। গতরাতে এখান দিয়ে বৃষ্টির জল নেমে যাওয়ার চিহ্ন চোখে পড়ল। ফাগুলাল বলল, ওই একতলা বাড়িটা। এই আমলকীগাছ দুটো দেখছেন, কবরেজমশাইয়ের নিজের হাতে লাগানো গাছ। শীতে আমলকী ফলে গাছ ভরে যায়। ওঁর উঠোনে একটা হরীতকীগাছও আছে দেখবেন।

আমি নিচু পাথুরে মাটির উপর এগিয়ে দেখলুম, উঁচু জমিতে ওঠার জন্য পাথরের চারটে ধাপ তৈরি করা আছে। ফাগুলাল চলে গেল। বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলুম, একাংশ বারান্দা। আর বাড়ির সেই অংশের ছাদ থেকে বিবর্ণ একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে। আয়ুর্বেদ চিকিৎসালয়। তার নিচে লেখা কবিরাজ শ্রী অবিনাশ ভট্টাচার্য আয়ুর্বেদশাস্ত্রী।

বারান্দার ডানদিকে বাড়ির পাশের একটা ঘর বেরিয়ে এসেছে। ওখানে একটা বন্ধ দরজা। বারান্দার সামনের দরজাটা খোলা। আমলকীগাছদুটো গাঢ় ছায়া ফেলেছে বারান্দায়। আমি খোলা দরজার সামনে দাঁড়াতেই সাড়া এল আসুন।

ঘরে জুতোসুদ্ধ ঢুকব কি না দ্বিধা ছিল। কিন্তু অবিনাশবাবু সামনে এসে বললেন, আপনাকে কষ্ট করে জুতো খুলতে হবে না। আসুন।

ভিতরে ঢুকে দেখলুম, ঘরটার প্রায় এক তৃতীয়াংশে কয়েকটা আলমারি এবং বাকিটা তক্তপোশের উপর গদিতে সাদা চাদর ঢাকা বসার জায়গা। কয়েকটা বালিশ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। দরজার সামনে খালি জায়গায় পা ঝুলিয়ে গদিতে বসলুম।

অবিনাশবাবু বললেন, আপনি জয়ার ঘর সার্চ করার কথা বলেছিলেন।

 বললুম, আপনি নিজে কি সার্চ করেছেন?

না। আমি আপনার অপেক্ষায় ছিলুম। বলে তিনি ভিতরের দরজা দিয়ে আমাকে ঢুকতে ইশারা করলেন। তারপর সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন। পাখা ঘুরছিল। বন্ধ করলেন।

ওই দরজা দিয়ে ভিতরের বারান্দায় গেলুম। পাঁচিলঘেরা উঠোনের শেষপ্রান্তে হরীতকী গাছ দেখলুম। বেশ বড়ো উঠোন। তবে সবটাই উঠোন নয়। প্রায় অর্ধেকটা ভেষজ গাছ ও লতার মাচানে ঢাকা উত্তরে টালিছাওয়া রান্নাঘর। বারান্দার বাঁদিকে একটা দরজা ভেজানো ছিল। সেটা খুলে অবিনাশবাবু ভিতরে আলো জ্বালিয়ে এবং পাখা চালিয়ে দিলেন। একটা তক্তপোশে বিছানার উপর সুদৃশ্য বেডকভার। আধুনিক রুচিতে সাজানো ঘর। কিন্তু আসবাব তত দামি নয়। লেখাপড়ার টেবিল আর বইয়ের র‍্যাক। অবিনাশবাবু বললেন, আপনি দেখুন খুঁজে, যদি কোনো সূত্র পান। আমার বিশ্বাস, কিছু পাবেন না।

আমি টেবিলের ড্রয়ার টানতেই খুলে গেল। ড্রয়ারের ভিতরে পুরোনো জংধরা একটা লম্বা চাবি, সেফটিপিনের ছোট্ট খাপ, ক্লিপ, অনেকগুলো ডটপেন, একটা খুদে নোটবই, অচল রিস্টওয়াচ ইত্যাদি নাড়াচাড়ার ছলে বেঙ্গল ক্লাবের চাবির গোছা চালান করলুম। আগেই চাবির গোছা বের করে হাতে লুকিয়ে রেখেছিলুম।

অবিনাশবাবু জয়ার একটা বাঁধানো রঙিন ছবির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁকে ডাকলুম। দেখুন তো এই চাবির গোছা এবাড়ির নাকি?

অবিনাশবাবু চাবির গোছা আমার হাত থেকে নিয়ে বলল, এই তো ক্লাবের চাবি। এবার আমি বুকপকেট থেকে আঠা দিয়ে জোড়া হিজিবিজি চিঠিটা বের করে তাকে দিয়ে বললুম, চিঠিটা পড়তে পারেন কি না দেখুন।

ফতুয়ার পকেট থেকে চশমা বের করে চিঠিটা দেখতে দেখতে তিনি বললেন কিছু পড়া যাচ্ছে না। কিন্তু চিঠির কাগজটা–

বলুন!

ছোট্ট প্যাডের কাগজ। বলে অবিনাশবাবু ফতুয়ার পকেট থেকে অবিকল একই সাইজের একটা চিঠি বের করে বললেন, অরুর ছেলে বাচ্চু আজ একটা লোকের হাতে শ্মশানে এটা পাঠিয়েছিল। একই কাগজ মনে হচ্ছে।

চিঠিটা নিয়ে দেখলুম, লেখা আছে :

শ্রদ্ধেয় জ্যাঠামশাই,
অনিবার্য কারণে জয়ার সৎকারের সময় উপস্থিত থাকতে পারলুম না। ক্ষমা করবেন। আমাদের বাড়ির পক্ষ থেকে ফাগুলাল যাবে। কিছু দরকার হলে তাকে বলবেন। ক্লাবের ছেলেদেরও বলা আছে। প্রণাম নেবেন।
–বাচ্চু।

এটা পড়ার পর অবিনাশবাবুর হাত থেকে হিজিবিজি চিঠিটা নিলুম। জয়ার টেবিলের সামনে বসে আতসকাঁচ বের করে বাচ্চুর হাতের লেখার ধাঁচের সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে কি না পরীক্ষা করতে মন দিলুম।

অবিনাশবাবু বললেন, আমি এখন চা খাই। আপনার জন্যও চা, করি। আপনি আপনার কাজ করুন। কেমন?

কোনো জবাব দিলুম না। প্রায় দশমিনিট পরে অবিনাশ ভট্টাচার্য যখন দুকাপ চা হাতে ঘরে ঢুকলেন, তখন আমার মোটামুটি পাঠোদ্ধার শেষ। বাচ্চু জয়াকে যা লিখে পাঠিয়েছিল, তার সারমর্ম হল : পাটনা যাওয়ার আগে সে যেন প্যাকেটটাকে দেয়।

আনুমানিক পাঠ নয়। আতসকাঁচ আমাকে আগেও এমন হিজিবিজি পাঠোদ্ধারে সাহায্য করেছে। কিন্তু একই শর্তে। লেখকের অন্য একটা চিঠির সাহায্য নিতে হয়েছে। কিন্তু কাকে দিতে বলেছে, সেটা একেবারে কালিতে ধেবড়ে গেছে। কলকাতার লালবাজার পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে একটা প্রজেক্টার আছে। চাপচাপ কালির তলায় কোনো শব্দ থাকলে স্ক্রিনে তা ফুটে ওঠে। কেটেকুটে কালিতে ঢেকে দিলেও তলার শব্দটা পড়া যায়। ধরমপুর থানায় সেই আলোকসংশ্লেষণ যন্ত্র আশা করা যায় না।

অবিনাশবাবু মেয়ের বিছানায় বসে চা খাচ্ছিলেন। শুধু বললেন, একই কাগজ। একই কালি।

বললুম হ্যাঁ। এটা বাচ্চুর চিঠি। এবার মনে করে বলুন, বৃহস্পতিবার তিনটে নাগাদ জয়া যখন বেরুচ্ছিল, কেউ কি তাকে এই চিঠিটা দিতে এসেছিল?

অবিনাশবাবু বললেন, না। কেউ আসেনি।

আপনি কি মেয়েকে এগিয়ে দিতে বেরিয়েছিলেন?

না। ওই দরজাটা দেখছেন, ওটা খুললে বারান্দায় যাওয়া যায়। জয়া ওই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলে আমি দরজা বন্ধ করে পাশের ঘরে অভ্যাসমতো গড়িয়ে নিচ্ছিলুম।

আপনি কি আপনার কবিরাজি চিকিৎসার ঘরে শোন? রাত্রেও শোন?

হ্যাঁ। আর তো কোনো ঘর নেই। রোগী কদাচিৎ এলে বারান্দায় বসে চিকিৎসা করি। কিন্তু চিঠিতে কী লিখেছিল বাচ্ছ?

যে চিঠি এনেছিল, তার হাতে একটা প্যাকেট দিতে বলেছিল।

 প্যাকেট? কিসের প্যাকেট?

 জানি না। শুধু প্যাকেট লেখা আছে।

অবিনাশবাবু হঠাৎ একটু নড়ে উঠলেন। আস্তে বললেন, লাইব্রেরির কাজ পাওয়ার কয়েকদিন পরে জয়া আমাকে বলেছিল, বাচ্চু তার ব্যক্তিগত কারবারি কাজে বেঙ্গল ক্লাবকে ব্যবহার করছে। জয়ার ধারণা, কোনো বেআইনি কাজ। তাই সে

হঠাৎ চুপ করে গেলেন অবিনাশবাবু। আধকাপ চা খেয়ে আমি চুরুট ধরালুম। তারপর বললুম, বেঙ্গল ক্লাবের চাবি আপনি কোনো পুলিশ অফিসার ছাড়া কাউকে দেবেন না। চাবিটা এমন কোথাও লুকিয়ে রাখুন, কেউ যেন খুঁজে না পায়। কেউ চাবি চাইতে আসতেও পারে। বলবেন, জয়া আপনাকে চাবি দিয়ে যায়নি। যে চাইতে আসবে, সে যদি চেনা লোক হয়, তাহলে আমাকে তার নাম-ঠিকানা জানাবেন। আমি উঠি।

অবিনাশবাবু বললেন, আপনি এ-ঘর সার্চ করলেন না?

দরকার নেই। বাচ্চুর চিঠিটা আমি রাখলুম।

বেশ।

জয়ার ঘরের অন্য দরজা খুলে দিলেন অবিনাশবাবু। আমি বারান্দায় বেরুলে বললেন, একটা কথা মনে পড়ে গেল।

বলুন।

জয়া যাওয়ার সময় বলেছিল, বাজারে বাচ্চুকে ক্লাবের চাবি দিয়ে যাবে। পাটনা থেকে তার ফিরতে দেরি হতে পারে। অথচ চাবি তার টেবিলের ড্রয়ারে পাওয়া গেল।

জয়া সম্ভবত বাস ধরার জন্য তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে চাবিটা নিতে ভুলে গিয়েছিল। বলে আমি বারান্দা নেমে গেলুম। পিছু ফিরে অবিনাশবাবুকে একবার দেখলুম। বারান্দায় পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন।

আমার অঙ্ক কষা হয়ে গেছে ততক্ষণে। বাচ্চুর গোপনীয় প্যাকেট নির্দেশমতো জয়া ক্লাবের পিছনে থিয়েটারের স্টেজের সরঞ্জামে ঠাসা ঘরে রেখেছিল। চিঠি পেয়ে সে সেই ঘরে ঢুকে প্যাকেট বের করছিল। তখনই পত্রবাহক এবং আততায়ী তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। জয়ার ঘরে বাঁধানো রঙিন ছবিতে দেখে এলুম, সে সুন্দরী ছিল। শুধু সুন্দরী বললে কিছু বোঝায় না। তার চেহারায় তথাকথিত সেক্সি মেয়েদের ছাপ ছিল।

পিচের রাস্তায় প্রাকসন্ধ্যার ধূসরতা। ডমরুপাহাড়ের উত্তর অংশে ঈষৎ রক্তিম আভা। সেই চড়াইয়ের মোড়ে একটু দাঁড়ালুম। চূড়ায় যে লোকটা উঠেছিল, সে যদি খুনি হয়, তা হলে হতাশা আর আতঙ্কে সে পালিয়ে এসে সম্ভবত গাঢাকা দিয়েছে।…

অরিন্দম রায়চৌধুরির বাড়ির গেটের দুই শীর্ষে উজ্জ্বল আলোর ডুম। জঙ্গবাহাদুর সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল। পোর্টিকোর ছাদে মিসেস রায়চৌধুরি, তার বউমা ও তুতুনকে দেখলুম। ফাগুলাল এগিয়ে এসে সেলাম দিয়ে আস্তে বলল, কথা হল?

বললুম, হ্যাঁ। তুমি কফির ব্যবস্থা করো। আর শোনো আমি ফোন করতে চাই।

হলঘরে ফোন আছে। আলো আছে। ফোন করুন। আমি ঠাকুরমশাইকে দেখি, সন্ধ্যারতি শেষ করে কিচেনে ফিরেছেন নাকি।

পোর্টিকোর ছাদ থেকে মিসেস রায়চৌধুরি বললেন, আপনার নীল সারস দম্পতির খবর কী?

বললুম ওরা গা-ঢাকা দিয়েছে।…

হলঘরে ঢুকে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করলুম। সাড়া এলে বললুম, ওসি মিঃ সিংহকে দিন।

হিন্দিতে প্রশ্ন এল কে আপনি?

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।

 দয়া করে একটু ধরুন।

তারপর মিঃ সিংহের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। কর্নেল সরকার। আনন্দ টেলার্স থেকে একটু আগে আই ও মিঃ দুবে রিং করেছিলেন। নাম পাওয়া গেছে। একটু অসুবিধা অবশ্য আছে।

তার গার্জেন শক্তিমান।

আপনি জানতে পেরেছেন?

হয়তো পেরেছি। আপাতত একটা কাজ করুন। কবিরাজ অবিনাশ ভট্টাচার্যের বাড়িতে গিয়ে বেঙ্গল ক্লাবের চাবি চেয়ে নিন। ক্লাবের তিনটে ঘরই তন্নতন্ন করে সার্চ করুন। এটা খুব জরুরি।

একটু আভাস দিন।

স্বচক্ষে যা দেখার দেখতে পাবেন। আর শুনুন। লোকটাকে তার বাড়িতে আজ রাতে হয়তো পাবেন না। কাল পুলিশ সুপার মিঃ এ আর শর্মা আসা অবধি অপেক্ষা করুন। তারপর কথা হবে …

টেলিফোনের রিসিভার রেখে দেখি, ফাগুলাল দাঁড়িয়ে আছে। আমি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে বারান্দা ধরে আমার থাকার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলুম। ফাগুলাল আমাকে অনুসরণ করছিল। তালা খুলে আলো এবং পাখার সুইচ অন করে দিলুম। টুপি, কিটব্যাগ, বাইনোকুলার, ক্যামেরা রেখে ইজিচেয়ারে বসলুম।

ফাগুলাল আস্তে বলল, কফি আসছে। ততক্ষণে একটা কথা বলি স্যার!

 বলো!

 খুনি কে পুলিশ জানতে পেরেছে?

বলছে, পেরেছে। তাই পুলিশকে বললুম তাকে তার বাড়িতে পাওয়া যাবে না।

ক্লাবঘরে পুলিশকে যেতে বললেন কেন স্যার? ওখানে কী সার্চ করবে?

একটু হেসে বললুম, তুমি বুদ্ধিমান ফাগুলাল। তোমার কী ধারণা বলো?

ফাগুলাল বারান্দার বাঁদিকে ঘুরে কেউ আসছে কি না দেখে নিয়ে বলল, আমার সায়েবকে যেন বলবেন না স্যার! সায়েবও কিছু জানেন না। আমি শুধু জানি। মনে হচ্ছে, আপনিও জানতে পেরেছেন। বাচ্চুবাবুর আসল ব্যবসা নেশার জিনিস। কোকেন, আফিং, গাঁজা, চরস এইসব। আরও কী নাম আছে, মনে পড়ছে না। নেপাল থেকে আসে। বাংলাদেশ থেকে আসে। জঙ্গবাহাদুরের মামা রণবাহাদুর বাছুবাবুর এজেন্ট। মাঝে মাঝে সে এলে বাচ্চুবাবু দামি হোটেলে তার থাকার ব্যবস্থা করে। ধারিয়া নদীর ধারে আজকাল অনেক বড়ো বড়ো হোটেল হয়েছে।

তোমার কি মনে হয় ক্লাবঘরে বাচ্চুর সেইসব মাল লুকোনো আছে?

থাকতেও পারে। সায়েব বাড়িতে নেই। বাচ্চুবাবুর কিছু হলে মেমসায়েব আপনার উপর চটে যাবেন।

তোমার চিন্তার কারণ নেই, ফাগুলাল। বাচ্চুবাবু পুলিশের লক্ষ্য নয়। তার গোপন কারবারের কথা পুলিশ জানে না। কিংবা জেনেও কোনো কারণে চুপ করে আছে।

কিন্তু আমি জানি, ক্লাবঘরে ওইসব জিনিস বাচ্চুবাবু লুকিয়ে রাখে।

কবরেজমশাইয়ের মেয়েকে বাচ্চু ক্লাবঘর দেখাশোনার ভার দিয়েছিল, ওটা লোক দেখানো। ক্লাব রোজ খোলা থাকলে এবং লোকজন যাতায়াত করলে পুলিশের ইনফর্মাররা কিছু সন্দেহ করবে না। কথাটা বুঝলেন স্যার?

তুমি বুদ্ধিমান, ফাগুলাল। ঠিক ধরেছ। এবার একটা কথা শোনো। আমি কাল ভোরেই কলকাতা ফিরব। যদি সাড়ে ছটার বাস ধরতে পারি, ধারাগাঁও রেলস্টেশনে আটটা পাঁচের এক্সপ্রেস ট্রেন ধরতে পারব। পুলিশের কাজ পুলিশ করুক।

ফাগুলাল আরও গম্ভীর হয়ে গেল। সে বলল, আমিও জানতে পেরেছি, কবরেজমশাইয়ের মেয়েকে কে খুন করেছে। কিন্তু তাকে পুলিশ ধরবে না। ধরার সাহস পাবে না। সে–

ফাগুলাল হঠাৎ চুপ করল। বুঝলুম, ঠাকুরমশাই কফি আনছেন। একটু পরে। নরহরি ঠাকুর এসে বললেন, ফাগুলাল। তোমাকে অরুর গিন্নি ডাকছে। শিগগির যাও।

ফাগুলাল চলে গেল।

.