১. নিকুঞ্জবিহারী ধাড়া

নিকুঞ্জবিহারী ধাড়া একসময় রাজনীতি করতেন। দলের এক নেতার দুর্নীতি কাগজে ফাঁস করে দেওয়ার পর বহিষ্কৃত হন। সেই এক্সক্লুসিভ স্টোরি আমার কলম দিয়েই দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় বেরিয়েছিল। আমাকেও এ জন্য অনেক ঝড়ঝাঁপটা পোহাতে হয়েছিল। কিন্তু দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও নিকুঞ্জবাবুর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়নি। আমলা, পুলিশ এবং উঁচুতলার আমির-ওমরা মহলে তার প্রতি শ্রদ্ধাভাব ছিল। এদিকে আমার ফ্রেন্ড-ফিলোসফার-গাইড কর্নেল নীলাদ্রি সরকারও প্রভাবশালী মানুষ। তাই সাংবাদিক জীবনের এক ভীষণ সঙ্কট থেকে আমি অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম।

নিকুঞ্জবাবুকে আমি দাদা বলতাম। হাতে সময় থাকলেই বালিগঞ্জ প্লেসে ওঁর বাড়িতে যেতাম। মেদিনীপুরের এক জমিদারবংশের উত্তরপুরুষ নিকুঞ্জদা সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। পূর্বপুরুষদের প্রাসাদতুল্য বাড়িটি উনি পরিবেশ বিজ্ঞানীদের একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দান করেছিলেন এবং নিজের থাকার জন্য রেখেছিলেন দোতলার একটি মাত্র ঘর। ষাট বছর বয়সের নিকুঞ্জদা অকৃতদার মানুষ। নিজেই রান্নাবান্না, কাপড়কাঁচা বেঁচে থাকার জন্য দরকারি নিত্যনৈমিত্তিক সব কাজকর্ম করতেন।

উনি দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর ভেবেছিলাম, নতুন কোনও দল করবেন বা অন্য কোনও দলে যোগ দেবেন। তাই ওঁর ভবিষ্যৎ কাজকর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করতাম। নিকুঞ্জদা বলতেন, নাহ। আর রাজনীতি নয়। যদি বলো সমাজসেবা, তা-ও নয়। সমাজসেবাতেও রাজনীতি এসে যায়। তবে পড়াশোনা করা বা একটু-আধটু লেখালেখি নিয়ে থাকা যায় কি না ভাবছি।

তাহলে নিশ্চয় আত্মজীবনী লিখবেন?

তোমার মাথা খারাপ? কেঁচো খুঁড়তে অনেক সাপ বেরিয়ে পড়বে। যাই হোক, দেখি কী করা যায়। একটা কিছু নিয়ে তো থাকতেই হবে।

এটা মার্চ মাসের কথা। তারপর নিকুঞ্জদা খবরের কাগজ থেকে মুছে গেলেন। ওঁর কথা জনগণও যথারীতি ভুলে গেল। আমিও আর ওঁকে নিয়ে উৎসাহ বোধ করিনি। হঠাৎ অক্টোবর মাসের গোড়ার দিকে একদিন সকালে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি নিকুঞ্জদা সোফার ওপরে অভ্যাসমতো দুই পা মুড়ে বসে কফি খাচ্ছেন। সেই একই চেহারা এবং বেশভূষা। গায়ে হাফহাতা ফতুয়া, পরনে ধুতি। আমাকে দেখে সহাস্যে বললেন, আরে এসো এসো! এতক্ষণ তোমার কথাই হচ্ছিল।

একটু অবাক হয়ে বললাম, আপনি এখানে?

 কেন? এখানে আমি এলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়?

পাশে বসে বললাম, না, নিকুঞ্জদা। মহাভারত অশুদ্ধ হলে তবেই এখানে কেউ আসেন।

বুঝলাম না।

প্লিজ নিকুঞ্জদা, স্টোরিটা আমারই প্রাপ্য। আমাকে দিন।

নিকুঞ্জদা অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন, স্টোরি? মানে, তোমাদের কাগজে স্টোরির কথা বলছ?

হ্যাঁ, নিশ্চয় কোনও রহস্যময় ঘটনা ঘটেছে। সম্ভবত রজত মুখার্জি এতদিনে প্রতিশোধ নিতে–

আমার কথার ওপর কর্নেল বললেন, না, জয়ন্ত। পাখি।

পাখি? নিকুঞ্জদা কি আপনার মতো পাখিটাখির পাল্লায় পড়েছেন?

নিকুঞ্জদা বললেন, জয়ন্তের মাথায় আসা উচিত, আমার বাড়িতে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের কাজকর্ম হয়। পাখির সঙ্গে পরিবেশের সম্পর্ক আছে।

ও! হ্যাঁ। তা হলে আপনার বাড়িতে কোনও রহস্যময় ঘটনা ঘটেছে। প্লিজ দাদা, স্টোরিটা আমার।

দুই বৃদ্ধ একসঙ্গে হেসে উঠলেন। তারপর নিকুঞ্জদা পিঠের পেছনদিক থেকে একটা কাপড়ের ব্যাগ বের করলেন। ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে আমাকে দিলেন। বললেন, তোমাদের কাগজের অফিসে কাল কার্ড দিয়ে আসা হয়েছে। তুমি এসে ভালো হল। যাবে যেন। তুমি স্টোরি চাইছিলে। এটা তোমার স্টোরির মশলা যোগাবে।

কার্ডটা একটা আমন্ত্রণপত্র। আমার অচেনা কোনও একটা জায়গায় চেতনা উদ্যান-এর দ্বারোদঘাটন করবেন বন ও পরিবেশ দফতরের মন্ত্রী। চোখ বুলিয়ে বললাম, নিকুঞ্জদা তাহলে শেষ পর্যন্ত সমাজসেবাতেই নামলেন?

না, হে। এর মধ্যে রাজনীতির গন্ধ নেই। নিকুঞ্জবাবু উদাত্ত গলায় বললেন। তুমি তো জানো, আমাকে বসুন্ধরা পরিবেশ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান করে রেখেছেন অতুলবাবুরা। আমি আমার পৈতৃক বাড়ি ট্রাস্টকে দিয়েছি। তাই নাম কা ওয়াস্তে চেয়ারম্যান। ওঁদের কাজকর্ম কিছু বুঝি না। তো ওঁরাই ওই চেতনাউদ্যানের পেছনে ছিলেন। ওঁরাই এক বাঙালি শিল্পপতিকে ধরেটরে প্রায় এক কোটি টাকার এক প্রজেক্ট-কী যেন বলে, রূপায়িত করে ফেলেছেন।

একটা বাগানের জন্য এক কোটি টাকা? অবাক হয়ে বললাম। সেই শিল্পপতি ভদ্রলোক দিয়েছেন?

ধুস। নিকুঞ্জবাবু বিরক্ত হলেন। বাগান নয়। উদ্যান। উদ্যান অন্য জিনিস।

 উদ্যান মানেই তো বাগান!

কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। চোখ খুলে বললেন, নিকুঞ্জবাবু! জয়ন্তকে অভয়ারণ্য আর পক্ষিনিবাস বললে বুঝবে।

নিকুঞ্জবাবু বললেন, তার সঙ্গে পর্যটনকেন্দ্রও আছে। ছটা কটেজ আর একটা মস্তবড় লজ। চারদিকে বনজঙ্গল। মধ্যিখানে প্রায় আশি একর একটা জলা। এলাহি ব্যাপার জয়ন্ত। এই নাও, আরও কখানা কার্ড রাখো। তোমার বন্ধুদের দিয়ো। গেলে খুব উপভোগ করবে কিন্তু। বলে কৌতুকে চোখ নাচালেন। ককটেল ডিনারের ব্যবস্থাও আছে।

ষষ্ঠীচরণ আমার জন্য কফি আনল। কফির পেয়ালা তুলে নিয়ে বললাম, আমি যেতে পারব কি না বলতে পারছি না। ১১ অক্টোবর আমার একটা। অ্যাসাইনমেন্ট আছে। চিফ এডিটারের স্পেশাল ইনটারেস্ট।

তোমার আজকাল দেখছি বড় উঁট হয়েছে হে ছোকরা। নিকুঞ্জবাবু চটে গেলেন। নাকি আমি আর রাজনীতি করি না বলে আমার আর এক কানাকড়িও দাম নেই। বেশ বুঝেছি। তাই আজকাল আর আমার ত্রিসীমানা মাড়াও না তুমি।

উনি রাগের চোটে সোফা থেকে পা নামালেন। কফির পেয়ালা টেবিলে রেখে দিলেন। ব্যস্ত হয়ে বললাম, প্লিজ দাদা, ভুল বুঝবেন না। আপনাদের চেতনাউদ্যান যাতে কাগজে ভালো কভারেজ পায়, আমি তার ব্যবস্থা করে দেব।

নিকুঞ্জবাবু আমাকে আর পাত্তা দিলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তাহলে উঠি কর্নেল সায়েব। ১১ তারিখে সকাল নটায় আপনাকে গাড়িতে তুলে নেব। অবশ্য আমার গাড়িটাড়ি নেই। দত্তসায়েব গাড়ি পাঠাবেন। প্রথমে আমাকে তুলে। নিয়ে আপনার এখানে আসবে। সেইমতো কথা হয়েছে। উনি নিজেও আপনাকে রিং করবেন। আমি চলি। আরও কয়েকটা জায়গায় যেতে হবে।

উনি আমার দিকে আর ঘুরেও তাকালেন না। বেঁটে নাদুসনুদুস গড়নের। মানুষ। চটির চটাস চটাস শব্দ তুলতে তুলতে বেরিয়ে গেলেন। মনে হল। আমাকেই পাদুকাপ্রহার করতে করতে চলে যাচ্ছেন। বরাবর এইরকম তেজী, জেদী আর একগুঁয়ে মানুষ। কিন্তু কী আর করা যাবে!

কর্নেলের দিকে তাকালাম। দেখলাম, তিনি গম্ভীর মুখে কার্ডটা দেখছেন। বললাম, এই চেতনাউদ্যান ব্যাপারটা আসলে কী? কেন কোন শিল্পপতি এক কোটি টাকা খরচ করেছেন এর জন্য? তা ছাড়া বহু কোটি টাকার মালিক না হলে এভাবে ফালতু এক কোটি টাকা খরচ করা যায় না। নিশ্চয় কোনও স্বার্থ আছে তার। হয়তো আয়কর ফঁকির ব্যাপার, কিংবা সরকারের কাছে কিছু ধান্দাবাজি–

প্রকৃতিবিদ হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন। থাকতেই পারে জয়ন্ত। তবে অতগুলো টাকা কারও পকেটে না গুঁজে দিয়ে প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য খরচ করা হয়েছে। এটা তো ভালোই।

হেসে ফেললাম। আপনি অবশ্য প্রকৃতি নিয়ে মাথা ঘামান। আপনার কাছে এসব জিনিসের কদর আছে। কিন্তু আমি ভাবছি, নিকুঞ্জদা এর সঙ্গে নিজেকে জড়ালেন কেন?

কেন সে-কথা ওঁর মুখেই শুনলে। বসুন্ধরা পরিবেশ ট্রাস্টের উনি চেয়ারম্যান।

এক কোটি টাকার প্রজেক্ট। বাপ! বনজঙ্গল পাখি-টাখির জন্য এ-ক-কো টি টাকা। কোনও মানে হয়? যে দেশে কোটি-কোটি মানুষের দুবেলা খাওয়া জোটে না।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, কোনও প্রজেক্টের কাজ হলে অনেক গরিব মানুষ তাদের মেহনতের দাম পায়। অনেক বেকারের চাকরি জোটে। অমিয় দত্ত একটা মহৎ কাজ করেছেন।

আপনি চেনেন ভদ্রলোককে?

হ্যাঁ, আলাপ হয়েছে। নিকুঞ্জবাবুর বাড়িতে বসুন্ধরা পরিবেশ ট্রাস্টের উদ্যোগে প্রেস কনফারেন্স ডাকা হয়েছিল। ট্রাস্টের এক বিজ্ঞানী অশোক রায় আমার পরিচিত। অশোকবাবু অর্নিথোলজিস্ট। পক্ষিতত্ত্ববিশারদ। কাজেই তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে নিকুঞ্জবাবুর সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল।

কর্নেল আবার চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। একটু খটকা লাগল। তাই জিজ্ঞেস করলাম, হাই ওল্ড বস! আপনাকে কেমন যেন উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। নাকি শরীর খারাপ?

নাহ্।

একটু পরে বললাম, আপনি চেতনাউদ্যানের অনুষ্ঠানে যাবেন। আমারও অবশ্য যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু

কিন্তু কিসের? তোমার কাগজের বসকে বলে ম্যানেজ করো।

তেমন কোনও স্টোরি তো পাব না। মানে, আমার কলমে যে-সব স্টোরি পাবলিক খায়।

পেতেও পারো। কারণ হালদারমশাই আজ ভোরে চেতনাউদ্যানের দিকে পাড়ি জমিয়েছেন।

একটু চমকে উঠলাম। প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদারের আগেভাগে ওখানে যাওয়া মানেই তার হাতে একটা কেস এসে গেছে। কৈসটা কী?

 কর্নেল চোখ বুজেই বললেন, গত রাত্রে ফোন করেছিলেন। খুলে কিছু বলেননি। শুধু ওঁর মক্কেলের নামটা জানিয়েছেন।

কে ওঁর মক্কেল?

চেতনা দেবী–যাঁর নামে উদ্যান।

তিনি কে?

অমিয় দত্তের স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর দত্তসায়েব এই অবাঙালি যুবতাঁকে বিয়ে করেছেন। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার‍্যা বলা হয়তো ঠিক হবে না। দত্তসায়েবের বয়স পাঁচের কোঠায়। কিন্তু এখনও ওঁকে যুবক বলে ভুল হয়।

দত্তসায়েব কি জানেন তার স্ত্রী প্রাইভেট ডিটেকটিভ হায়ার করেছেন?

 নাহ। তুমি যেন মুখ বুজে থাকবে। সাবধান।

 কিন্তু কেসটা কী?

বললাম তো, হালদারমশাই কিছু খুলে বলেননি।

আপনি দেখেছেন ভদ্রমহিলাকে?

হুউ। এসব ক্ষেত্রে ধরে নিতে পারো, ভদ্রমহিলা রূপবতী। তবে কথা বলেন কম। ব্যক্তিত্ব আছে। সেই প্রেস কনফারেন্সে আলাপ হয়েছিল।

ওপেনিং ফাংশনে উনি নিশ্চয় যাবেন?

যাওয়ারই কথা। ওঁর নামেই এত বড় একটা প্রজেক্ট। মার্কিন টার্মে বলা চলে ন্যাশনাল পার্ক।

ক্রমশ আমার আগ্রহ বাড়ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, জায়গাটা ঠিক কোথায়?

কার্ডে লেখা আছে। পড়ে দেখ।

কার্ডে চোখ বুলিয়ে বললাম, নদীয়া জেলার কুসুমপুর লেখা আছে শুধু। তাঁর মানে কলকাতা থেকে অনেক দূরে।

হ্যাঁ। দূরে তো বটেই। হাইওয়ে থেকেও প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার ভেতরে যেতে হবে। বাংলাদেশ বর্ডারের কাছাকাছি।

হাসতে হাসতে বললাম, বর্ডার বললেই স্মাগলিঙের দুর্গন্ধ ভেসে আসে।

কর্নেল চোখ খুলে কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন। সেই সময় ডোরবেল বাজল। একটু পরে ষষ্ঠীচরণ এসে বলল, এক ভদ্রলোক এয়েছেন বাবামশাই! মাথায় সাধুবাবাদের মতো লম্বা চুল। কীরকম যেন শুটকো মড়া। সে দাঁত বের করল কৌতুকে। আমার দিকে তাকিয়ে ফের বলল, মানুষ বলেই মনে হয় না দাদাবাবু।

কর্নেল যথারীতি চোখ কটমট করে বললেন, নিয়ে আয়।

এর পর যিনি ঘরে ঢুকলেন, তাকে দেখে সত্যিই শুটকো মড়া মনে হল। ঢ্যাঙা, রোগাটে গড়ন। লম্বাটে কঁচাপাকা চুলের গোছা পিঠে ঝুলছে। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। তিনি নমস্কার করে বললেন, কর্নেল সায়েবের আমাকে মনে পড়তে পারে। আমার ওয়ার্কশপে সেবার পায়ের ধুলো দিয়েছিলেন। আমার নাম বংশীবদন পাল।

কর্নেল বললেন, বসুন বংশীবাবু। অনেকদিন পরে আপনাকে দেখছি বলে হঠাৎ চিনতে পারিনি।

বংশীবাবু আড়ষ্টভাবে সোফায় বসলেন। আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বললেন, কাল থানায় গিয়েছিলুম। আর্টিস্ট বলে একটু নামযশ আছে। রাষ্ট্রপতির পদক পেয়েছিলুম। সেই খাতিরে পুলিশ ডায়রি অবশ্যি নিল। কিন্তু আমি পড়েছি গোলকধাঁধায়। তা এঁকে চেনা-চেনা মনে হচ্ছে!

কর্নেল বললেন, জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা। জয়ন্ত! ইনি একজন বিখ্যাত মূর্তিশিল্পী। অসাধারণ ডামি গড়েন। এমন প্রতিমূর্তি গড়েন যে জ্যান্ত বলে ভুল হয়। কলকাতার অনেক জুয়েলারি দোকানে এঁর তৈরি ডামি আছে। অবশ্য ম্যানিকিন বললে ঠিক বলা হয়।

বংশীবাবু বললেন, আজকাল আর তত গড়ি না। বয়স হয়েছে। চাহিদাও নেই। তবে পূজাপার্বণে ঠাকুর গড়ি। মাঝে মাঝে অর্ডার পেলে পাথরের স্ট্যাচু। তো অনেকদিন পরে একটি ডামির অর্ডার পেয়ে শেষে থানা-পুলিশ করতে হল।

থানায় কেন গিয়েছিলেন বলুন?

বংশীবাবু বিমর্ষভাবে বললেন, মাস দেড়েক আগে এক ভদ্রলোক তাঁর টেলারিং শপের জন্য একটা ডামি তৈরির অর্ডার দিয়েছিলেন। জুতোসুদ্ধ ফুলসাইজ মেল ডামি হবে কিন্তু বিলিতি সায়েব চলবে না। দিশি সায়েব হওয়া চাই। আর তো বিলিতি সায়েবদের যুগ নেই। হাফিল্মের হিরোটাইপ চেহারা যেন হয়।

বংশীবাবু জোরে শ্বাস ছেড়ে ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে দিলেন। কর্নেল কার্ডটা পড়ে বললেন, ফ্যান্সি টেলার্স। লিন্ডসে স্ট্রিটের ঠিকানা দেখছি। এখান থেকে বেশি দূরে নয়।

তো ফ্যান্সি টেলার্সের ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হয়েছিল, ডামির প্রাইমারি শেপ তৈরি হলে যেন টেলিফোনে ওঁকে খবর দিই। তখন উনি লোক পাঠিয়ে মাপজোক নেবেন। তারপর সেই মাপমতো শার্ট-টাই-কোট-প্যান্ট যা লাগে তৈরি করবেন। সেই পোশাক আমার কাছে পৌঁছলে তখন আমি বডির বাকি অংশে ফিনিশিং টাচ দেব।

অর্থাৎ পোশাক পরানোর পর?

আজ্ঞে হ্যাঁ। টেলারদের ডামিতে সেটাই করা হয়।

ঠিক বলেছেন। অকারণ বাড়তি খরচ করার মানে হয় না। তারপর কী হল বলুন?

বংশীবাবু আবার জোরে শ্বাস ছেড়ে বললেন, আজ কত তারিখ যেন? সব গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে।

৯ অক্টোবর।

হ্যাঁ। ডামির প্রাইমারি শেপ দিয়ে রোজ ফোন করি। আমার ফোন নেই। পাড়ার একটা ওষুধের দোকান থেকে ফোন করি। ওঁরা বলেন, কালই মাপ নিতে লোক যাবে। এই করে শেষ পর্যন্ত ওঁদের লোক গেল দোসরা অক্টোবর। খুব রেগে গিয়েছিলুম। জীবনে এমন কাণ্ড কখনও ঘটেনি। বরং উল্টে পার্টিই তাগাদার চোটে অস্থির করেছে।

কর্নেল নিভে-যাওয়া চুরুট জ্বেলে বললেন, ইন্টারেস্টিং। তারপর?

রাগ চেপে থাকতে হল। মোটা টাকা পাব। অ্যাডভান্স করে গেছে পাঁচশো টাকা। আরও দেড় হাজার দিয়ে ডেলিভারি নেবে। কম টাকা নয়। বংশীবাবু মুখ নামিয়ে আস্তে বললেন, আমার লোভ। প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে তৈরি এসব ডামির বাজারদর মোটে দুশো-আড়াইশো টাকা। ফুলসাইজ ফিমেল হলে বড়জোর তিনশো। সেখানে দু-হাজার টাকা অফার করেছিল।

ষষ্ঠীচরণ লোক বুঝে পানীয় আনে। বংশীবাবুর জন্য চা আনল। কর্নেল বললেন, চা খেতে খেতে বলুন। বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।

আমার কিন্তু মোটেই তেমন কিছু মনে হচ্ছিল না। তবে থানায় যাওয়ার কারণটা জানতে আগ্রহ হচ্ছিল। বংশীবাবু চায়ের কাপপ্লেট তুলে নিয়ে বললেন, মাপ নিয়ে গেল দোসরা অক্টোবর। পোশাক এল চৌঠা অক্টোবর সন্ধ্যাবেলায়। দামী পোশাক। যাই হোক, পোশাক পরিয়ে দেখলুম, নিখুঁত হয়েছে। এর পরের কাজ একটা রাত্তিরেই শেষ করে ফেললুম। কাঠের পাটার সঙ্গে কেমিক্যাল আঠা দিয়ে জুতোপরা পা দুটো সেঁটে দিলুম।. ফাপা বডি। একেবারে হাল্কা। পেছনে ঠেকা দিয়ে রেখেছিলুম। সকালে ঠেকা সরিয়ে নিলুম। তারপর ফিনিশিং টাচ। বংশীবাবু চায়ে কয়েকবার চুমুক দেওয়ার পর বললেন, ৬ তারিখে সন্ধ্যাবেলায় ডেলিভারি নিতে আসার কথা। কিন্তু এল না। ফোন করলুম। ওঁরা বললেন, কাল দশটায় লোক যাবে। তো আমার ওয়ার্কশপ তো আপনি দেখেছেন!

হু। তারপর কী হল বলুন?

৭ তারিখে সকালে দেখি, ডামি নেই।

নেই? মানে, চুরি গেছে?

আজ্ঞে। চোর তালা ভাঙেনি। ওয়ার্কশপের চালের টালি সরিয়ে ডামি তুলে নিয়ে পালিয়েছে।

আমি বললাম, দামী পোশাকের লোভেই চুরি করেছে।

বংশীবাবু আমার কথায় কান দিলেন না। বললেন, ফ্যান্সি টেলার্সের দোকান খোলে এগারোটায়। সেখানে গিয়ে ওয়েট করছিলুম। দোকান খুলল। একে একে লোকজন এসে গেল। আমি সেই ভদ্রলোক আর যে মাপ আনতে গিয়েছিল, তাদের দুজনকে দেখতে পেলুম না। চুরির কথা বলতেও সাহস হচ্ছিল না। শেষে মালিকের খোঁজ করলুম। তিনি আমার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন। কার্ড দেখালুম। তওঁ বললেন, আমাদের ডামির অভাব নেই। ওই দেখুন কত ডামি। রাখার জায়গাই নেই, তো নতুন করে–

কর্নেল বললেন, ডামির অর্ডার ওঁরা দেননি?

আজ্ঞে না। এটাই তো অবাক কাণ্ড। পাঁচশো টাকা! দামী পোশাক। অদ্ভুত না?

কর্নেল কিছুক্ষণ চুরুট টানার পর বললেন, কিন্তু টেলিফোন নাম্বার তো ঠিক ছিল?

বংশীবাবু মাথা নেড়ে বললেন, আজ্ঞে না। কার্ডে ফোন নাম্বার কেটে ডটপেনে অন্য নাম্বার লেখা আছে দেখুন!

দেখেছি। কিন্তু এমন ঝুঁকি নিলেন কেন ভদ্রলোক, সেটাই প্রশ্ন। আপনি দেরি দেখে ফ্যান্সি টেলার্সে গিয়ে হাজির হতেও পারতেন।

উনি নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন, দরকার হলে ফোনে যোগাযোগ করবেন।

কোনও কারণ দেখাননি?

হ্যাঁ। ওঁর দাদা নাকি কিপটে মানুষ। পুরনো ডামি যা আছে, তাই যথেষ্ট। নতুন ডামি করতে তাঁর আপত্তি আছে। বংশীবাবু একটু ভেবে নিয়ে ফের বললেন, আরও কী সব বলেছিলেন মনে পড়ছে না। তবে আমার দিক থেকে এ নিয়ে মাথাব্যথার কারণ ছিল না। অতগুলো টাকা পাব। আমার লোভ!

কর্নেল হাসলেন। আহা। পাঁচশো টাকা তো পেয়ে গেছেন। মন্দ কী?

 তা অবশ্য পেয়েছি। কিন্তু ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত নয়?

অদ্ভুত! আচ্ছা বংশীবাবু, আপনার কাছে ভদ্রলোক কোন তারিখে গিয়েছিলেন মনে আছে?

এক মিনিট। দেখছি। বলে বংশীবাবু ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি-বই বের করলেন। অর্ডার পেয়ে সেদিনই মালমশলা কিনতে গিয়েছিলুম। ক্যাশমেমোটা এর ভেতর আছে। ডায়রির পাতা হাতড়ে ক্যাশমেমোটা পাওয়া গেল। সেটা দেখে বললেন, ২৬ আগস্ট।

২৬ আগস্ট! কর্নেল হঠাৎ সোজা হয়ে গেলেন। দেখি ক্যাশমেমোটা!

বংশীবাবু একটু অবাক হয়ে ছাইরঙা ক্যাশমেমোটা ওঁকে দিলেন। কর্নেল সেটা দেখে নিয়ে ওঁকে ফেরত দিলেন। তারপর বললেন, এই ফোন নম্বরটা কার সেটা এক্সচেঞ্জ থেকে জেনে নেবখন। তবে আপনার চিন্তার কোনও কারণ নেই। আপাতত এই নাম্বারে কেউ সাড়া দেয় নাকি দেখা যাক।

কর্নেল টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। বংশীবাবু বললেন, সাড়া পাবেন না। আমি দুদিন ধরে অনেক চেষ্টা করেছি। সব সময় এনগেজড টোন।

কর্নেল ডায়াল করার পর রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। বললেন, হ্যাঃ। এনগেজড় টোন। আচ্ছা বংশীবাবু, পুলিশকে কি আপনি সব কথা খুলে বলেছেন?

আমার মাথা খারাপ? বংশীবাবু হাসবার চেষ্টা করলেন। শুধু বলেছি, ডামি চুরি গেছে। পাঁচশো টাকা অ্যাডভান্স নেওয়ার কথাও বলেছি। ফ্যান্সি টেলার্সের নাম করিনি। সেই ভদ্রলোকের নামটা অবিশ্যি বলেছি। পুলিশের ব্যাপার আজকাল যা হচ্ছে! খাতিরে একটা ডায়েরি নিল। ব্যস!

কী নাম বলেছিলেন ভদ্রলোক?

কার্ডের উল্টোপিঠে লেখা আছে দেখুন।

 দেখেছি। এম আলি লেখা আছে। কিন্তু পুরো নাম বলেননি উনি?

মোজাহার আলি। কিন্তু চেহারা দেখে মুসলমান বলে চেনা যায় না।

কর্নেল হাসলেন। চেহারা দেখে কি জাতিধর্ম চেনা যায় বংশীবাবু? তবে দর্জির কাজ এক সময় মুসলমানদেরই একচেটিয়া ছিল। এখনও খানিকটা তা-ই থেকে গেছে। কাজেই সেই ভদ্রলোক বুদ্ধিমানের মতো মুসলমান নাম বলেছিলেন।

আমি বললাম, তিনি মুসলমান নন?

নাহ্।

কী করে বুঝলেন?

টেলারিং শপের মালিক যদি মুসলমান হন, তিনি তার দোকানে ডামি রাখেন না। কারণ ওঁদের ধর্মে প্রতিমূর্তি নিষিদ্ধ। তবে হিন্দু বা খ্রিস্টান মালিকের দোকানে ডামি থাকলেও মুসলমান দর্জিরা সেখানে কাজ করতে আপত্তি করেন না। এর কারণ হল রুজিরোজগার।

বংশীবাবু নড়ে বসলেন। ঠিক বলেছেন কর্নেলসায়েব। ভদ্রলোকের নাম শুনে আমার একটু খটকা লেগেছিল মনে পড়ছে। কারণ এর আগে টেলারিং শপের জন্য অনেক ডামি গড়ে দিয়েছি। কিন্তু মালিকরা ছিলেন হিন্দু বা খ্রিস্টান। আপনি কথাটা বলায় মনে পড়ে গেল।

আচ্ছা বংশীবাবু! আপনার অদ্ভুত কাণ্ডের একটা কিনারা করা যায় কি না দেখবখন। আপনার আর চিন্তার কারণ দেখছি না। এসব কথা ভুলে যান। ঘুণাক্ষরে আর কারও সঙ্গে আলোচনা করবেন না কিন্তু!

আমার মাথা খারাপ? বলে বংশীরাবু নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু ওঁর মুখে উদ্বেগের ছাপটা যেন লেগে রইল।

বললাম, তাহলে চেতনাউদ্যানে আপনার যাত্রা স্থগিত। বংশীবাবুর ডামিরহস্য নিয়ে মেতে উঠবেন।

কর্নেল আরও গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লেন। না, জয়ন্ত! দত্তসায়েব, তাঁর স্ত্রী চেতনা দেবী আর নিকুঞ্জবাবুকে যখন কথা দিয়েছি, তখন আর এর অন্যথা হবে না। বিশেষ করে হালদারমশাইকে চেতনা দেবী কেন এবং কী কাজে নামিয়েছেন, আমার জানা দরকার।

বেশ। আমি উঠি এবার। সাড়ে দশটা বাজে।

যাবে? ঠিক আছে। কিন্তু পরশু তোমাকে সল্টলেক থেকে আমি তুলে নিয়ে যাব।

সর্বনাশ! নিকুঞ্জদার সঙ্গে এক গাড়িতে?

 তোমাকে দেখলে ওঁর রাগ পড়ে যাবে।

কিন্তু ঠিক এডিটরের স্পেশাল ইন্টারেস্ট

শাট আপ। স্পেশাল ইন্টারেস্টের ব্যাপারটা তোমারই। আমাকে লুকিয়ে লাভ নেই।

কী বিপদ!

বিপদ তো বটেই। মুখ দিয়ে যে কথাটা বেরিয়ে গেছে, সেই কথাটাই বলে দিচ্ছে ১১ অক্টোবর তোমার অ্যাসাইনমেন্ট বাতিল করা চলে।

হেসে ফেললাম। ওঃ কর্নেল! আপনি টেলিপ্যাথি জানার ভান করবেন না।

টেলিপ্যাথি নয় ডার্লিং। সাইকোলজি।

তার মানে?

তোমাকে সল্টলেক থেকে তুলে নিয়ে যাব বলার সঙ্গে সঙ্গে তোমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কী ছিল? তুমি বলে উঠলে, সর্বনাশ! নিকুঞ্জদার সঙ্গে এক গাড়িতে? এর মানে কী দাঁড়ায় এবার নিজেই বুঝে দেখ। বলে কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! কফি। শিগগির কিন্তু।

বললাম, আপনি সত্যিই আরকুল পয়রো।

কর্নেল ভুরু কুঁচকে বললেন, আরকুল পয়রো? তুমি কি আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা ভদ্রলোকের কথা বলছ। উনি আরকুল পয়রো নন। এরকুল পোয়ারো।

খবরের কাগজে এক পণ্ডিত বলেছেন, আপনি নাকি আরকুল পয়রোর নকল!

এরকুল পোয়ারো। বলে কর্নেল তাঁর বিখ্যাত অট্টহাসি হাসলেন। উন্মাদ! উন্মাদ! পোয়ারোর গোঁফ-কালচার ছিল। আমার দাড়ি থাকলেও দাড়ি-কালচার নেই। পোয়ারোর পাখি-ফুল-প্রজাপতি ক্যাকটাস-অর্কিড নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। প্রকৃতি কী তা উনি চিনতেন না। উনি আমার মতো প্রয়োজনে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতেন না। দুবৃত্তের হাতে উনি মার খেতেন। আমি কখনও মার। খাইনি। আমার মাথা এবং হাত দুই-ই চলে।