৭. চেতনাউদ্যানে যাওয়ার দিন

চেতনাউদ্যানে যাওয়ার দিন কৃষ্ণনগরে যেখানে গাড়ি থামিয়েছিলাম এবং কর্নেল সরপুরিয়া কিনেছিলেন, সেখানে আমাকে গাড়ি দাঁড় করাতে বলে কর্নেল ব্যস্তভাবে নেমে গেলেন। হাইওয়ের দুধারে এখানে অজস্র দোকানপাট। লং রুটের বাসগুলো এখানে কিছুক্ষণ জিরিয়ে যায়। তাই সন্ধ্যাবেলায় মানুষজনের ভিড় আর চারদিকে আলো। প্রতিমুহূর্তে আশঙ্কা হচ্ছিল, অমূল্যবাবু ওরফে লক্ষ্মীবাবু আর মোজাহার দলবল নিয়ে হামলা করে ম্যানিকিনটা লুঠ করে নেবে। কে বলতে পারে ওরা আমাদের অজ্ঞাতসারে অনুসরণ করে আসেনি? অমূল্যবাবু ম্যানিকিনের দাম বাবদ দেড় হাজার টাকা পকেটস্থ করেছিলেন– কর্নেলের এই কথাটা শোনার পর থেকে ক্রমাগত রায়সায়েব এবং তার দুবৃত্ত নাতি অনিরুদ্ধ সম্পর্কে আমার সন্দেহ বেড়ে গিয়েছিল। ম্যানিকিন এবং সেটার পোশাকের দাম ওঁরা ছাড়া আর কে দেবে? রায়সায়েব তার কন্যার আত্মহত্যার জন্য জামাইয়ের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই পারেন। অনিও তার বাবার প্রতি ক্রোধে উন্মত্ত হতেই পারে। সম্র চেতনা, দেবীকে সে ছাড়া আর কে গুলি করে মারার চেষ্টা করবে?

একটু পরে কর্নেল ফিরে এলেন এক ভদ্রলোককে নিয়ে। বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত, ইনি বসুন্ধরা পরিবেশ ট্রাস্টের বিজ্ঞানী ডঃ অশোক রায়। অশোকবাবু আমাদের জন্য এখানে এসে অপেক্ষা করছিলেন। যাই হোক, আর দেরি নয়। অশোকবাবু, আপনার গাড়ি একটু নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে চলুন। বস্তাটা আপনার গাড়িতে পাচার করে আমরা চেতনাউদ্যানে ফিরে যাব। এর পর যা সব করার আপনি কথামতো তা করবেন।

অশোকবাবু চলে গেলেন। দেখলাম, তাঁর গাড়িটা একটু তফাতে দাঁড়িয়ে ছিল। তিনি গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিলেন। কর্নেল আমার গাড়িতে উঠে বলেন, ওঁকে ফলো করো জয়ন্ত!

যেদিক থেকে এসেছিলাম, সেদিকে গাড়ি ঘোরাতে হলো। রেলব্রিজের তলা দিয়ে এগিয়ে নির্জন রাস্তায় কর্নেলের নির্দেশে গাড়ি দাঁড় করালাম। সেখানে একটা রাস্তা ডাইনে ঘুরে গেছে। আমার গাড়ির ডিকি থেকে বস্তাটা অশোকবাবুর গাড়ির ডিকিতে গিয়ে ঢুকল। তারপর অশোকবাবু ডাইনের রাস্তায় চলে গেলেন। আমরা চললাম বাঁ দিকে হাইওয়েতে। হাইওয়ের এই অংশটা প্রায় অর্ধবৃত্তাকার। রাতবিরেতে রাস্তার বাঁক সম্পর্কে এখন আমার বেজায় আতঙ্ক। বাঁক পেরিয়ে রাস্তা সোজা হলো। তখন মুখ খুললাম। অশোকবাবুর সঙ্গে তাহলে আপনার রীতিমতো একটা চক্রান্ত ছিল?

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, ছিল। তবে এখন কোনও কথা নয়। রাত নটার আগেই আমাদের চেতনা উদ্যানে ঢুকতে হবে। কিন্তু তাই বলে তুমি তাড়াহুড়ো কোরো না। যে স্পিডে গাড়ি চলছে, তাতে আমরা ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।

সেই বিপজ্জনক বাঁক সাবধানে পেরিয়ে গেলাম। সোনাইতলার মোড়ে হাইওয়ে ছেড়ে সংকীর্ণ রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল একটু হেসে বললেন, ফ্লাস্কটা নেওয়া হয়নি। চাফি খাওয়া হল না। সরপুরিয়াও বাদ গেল। কিন্তু কী আর করা যাবে? ট্যুরিস্ট লজের ব্যালকনিতে বসে কফি খাব।

রাস্তা নাকবরাবর সিধে এগিয়ে একটু বাঁক নিয়েছে। হঠাৎ হেডলাইটে দেখলাম সামনে কোন গাড়ি আসছে এবং আমি আলো নেভালেও সামনের গাড়িটার হেডলাইট আমার চোখ ঝলসে দিচ্ছে। রাতবিরেতে রাস্তায় অনেক ড্রাইভার এমন বেয়াদপি করে। বাঁ দিকে খাল। গাড়িটার মতলব কী? কর্নেলের নির্দেশে ব্রেক চেপে বাঁ দিকে একটা চাকা নামিয়ে গাড়ি দাঁড় করালাম। কর্নেল দ্রুত নেমে গিয়ে এক সাংঘাতিক কাণ্ড করে বসলেন। রিভলভার বের করে ছুটে আসা গাড়িটার দুটো হেডলাইটই গুলি ছুঁড়ে গুঁড়িয়ে দিলেন। অমনি গাড়িটা আমার গাড়ির একটু তফাতে ডান দিকের খালে গিয়ে পড়ল। এবার দেখলাম গাড়িটা একটা ম্যাটাডোর। উল্টে না গেলেও খালের জলে সামনের অংশ ডুবে গেছে। কর্নেল গাড়িতে উঠে বললেন, কুইক জয়ন্ত! আর গুলি খরচ করতে চাইনে!

এবার পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট রাস্তা ছিল। জোরে বেরিয়ে গিয়ে বললাম, নাম্বার নেওয়া উচিত ছিল। সাংঘাতিক খুনে ম্যাটাডোর।

কর্নেল বললেন, তাতে লাভ হত না। এসব ক্ষেত্রে জাল নাম্বারপ্লেট : ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু উল্টে আমরা ফেঁসে যাব না তো?

 কর্নেল চটে গেলেন। তুমি সত্যি বড় বোকা জয়ন্ত! এখনও বুঝতে পারছ না ম্যাটাডোরটার উদ্দেশ্য কী ছিল?

চুপ করে গেলাম। কর্নেল আসার সময় বলেছিলেন, এটা একটা অ্যাডভেঞ্চার বলে ধরে নাও না! তাহলে দেখা যাচ্ছে, ব্যাপারটা সত্যিই একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেল। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, কর্নেল যেন এমন কোনও ঘটনার মোকাবিলায় তৈরি ছিলেন।

গেটকিপার সেলাম ঠুকে গেট খুলে দিল। ট্যুরিস্ট লজে পৌঁছে গাড়ি গ্যারাজে রেখে আমাদের রুমে গেলাম। কিন্তু দরজায় তালা আটকানো আছে। হালদারমশাই কোথায় গেলেন? কর্নেল হন্তদন্ত নেমে গেলেন। একটু পরে ম্যানেজারকে সঙ্গে নিয়ে ফিরলেন। ম্যানেজার মিঃ দাশ ডুপ্লিকেট চাবিতে তালা খুলে দিয়ে আমাকে বললেন, আপনাদের অফিসার মিঃ হালদার ক্যান্টিনে ডিনার খেয়ে বেরিয়ে গেছেন। চাবিটা কাউন্টারে রেখে গেলেই পারতেন।

কর্নেল বললেন, মিঃ দাশ, প্লিজ এখনই কফি পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। গলা শুকিয়ে গেছে।

অবশ্যই। তো দশটার মধ্যে ক্যান্টিন বন্ধ হয়ে যাবে। ডিনার তার আগেই পাঠিয়ে দেব। বলে ম্যানেজার চলে গেলেন।

ঘরে ঢুকে জানালা এবং ব্যালকনির দরজা খুলে দিলাম। ফ্যান চালিয়ে দিলাম। ভ্যাপসা গরম। বাতাস বন্ধ। গতকাল মধ্যরাতে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। আজও যদি বৃষ্টি হয়, আবহাওয়া আবার ঠাণ্ডা হবে।

কফি এসে গেল। কর্নেল কফি খেতে খেতে বললেন, কফি নার্ভ চাঙ্গা করে। তোমাকে আস্ত ম্যানিকিন দেখাচ্ছে ডার্লিং! আশা করি, কফি তোমাকে আবার জ্যান্ত করবে।

বললাম, আমি ঠিক আছি। কিন্তু হালদারমশাইয়ের জন্য ভাবনা হচ্ছে। উনি বড্ড বেশি হঠকারী।

হালদারমশাই হঠকারী তা ঠিক। তবে ওই দেখ, ওঁকে বসুন্ধরার যে ব্যাজ পরতে দিয়েছিলাম, সেটা উনি খুলে রেখে গেছেন। তার মানে উনি এখন চেতনা দেবীর নিযুক্ত প্রাইভেট ডিটেকটিভ হয়ে কাজে নেমেছেন।

ব্যাজটা এতক্ষণে দেখতে পেলাম। কর্নেল ব্যাজটা তুলে নিয়ে বললেন, বাহ্। হালদারমশাই আমাদের জন্য একটা চিঠি ব্যাজের পেছনে এঁটে রেখে গেছেন।

চিঠিটা ভাঁজ খুলে পড়ার পর কর্নেল আমাকে পড়তে দিলেন। ইংরেজিতে যা লেখা আছে, তার সরলার্থ হল :

তদন্ত করে জেনেছি, কালো কুকুরটার মালিক জনৈক ফিল্মস্টার সুরঞ্জনা সেন। আমি সিনেমা দেখি না। তাই ভদ্রমহিলাকে চিনি না। তিনি এখানে বিশ্রাম নিতে এসেছেন। চার নম্বর কটেজে আছেন তিনি। তিন নম্বরে আছেন জনৈক সি কে সিনহা এবং তার স্ত্রী। তারা কুকুরটার দৌরাত্মে অস্থির। অথরিটির কাছে কমপ্লেন করবেন বললেন। এবার আসল কথাটা বলি। অমূল্য ওরফে লক্ষ্মী কলকাতা থেকে নাকি আজ ফিরবে না। খবর দিয়েছে ম্যাডাম কাল এখানে আসবেন। আমি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করে অগত্যা রাতের খাওয়া সেরে নিয়ে আবার বেরুলাম। চেতনাভিলায় ঢোকার চেষ্টা করব। কারণ আমার সন্দেহ, ম্যাডামের অজ্ঞাতসারে তার বাড়িতে কিছু গোপন কাজকর্ম হয়। সন্দেহের কারণ যথাসময়ে জানার। আমার জন্য ভাববেন না।

এইসব কথার তলায় জড়ানো হরফে ইংরেজিতে কে কে এইচ লেখা আছে। অর্থাৎ কৃতান্তকুমার হালদার। সংক্ষেপে কে কে হালদার।

বললাম, হালদারমশাইকে নিয়ে যতই হাসি-তামাশা করি না কেন, উনি সত্যিই বিচক্ষণ মানুষ। চিঠিটা ব্যাজের তলায় কী কৌশলে রেখে গেছেন চিন্তা করা যায় না।

কর্নেল আমার কথার দিকে কান না দিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেলেন। মুখে জ্বলন্ত চুরুট। আমি বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম। প্রচণ্ড ক্লান্তি এখন আমাকে পেয়ে বসেছে। কফি সাময়িকভাবে নার্ভ চাঙ্গা করে বটে, কিন্তু ক্রমশ আবার নার্ভ মিইয়ে পড়ছিল।

কর্নেলের ডাকে উঠে বসলাম। কর্নেল বললেন, কী আশ্চর্য, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?

না তো!

কর্নেল হাসলেন। চোখ বুজে তাহলে ম্যাটাডোরটা দেখছিলে! এসো! রাতের খাওয়া সেরে নেওয়া যাক।

বাথরুম থেকে হাত-মুখ রগড়ে ধুয়ে এলাম। কর্নেল খেতে বসে বললেন, হালদারমশাইয়ের খবর ঠিক নয়। একটু আগে একটা অ্যাম্বাসাডার এবং তার পেছনে একটা কন্টেসা গাড়িকে চেতনাউদ্যানে ঢুকতে দেখলাম। আমার অঙ্কটা ঠিকই ছিল দেখা যাচ্ছে। অমূল্যবাবু ওরফে লক্ষ্মীবাবু চেতনা দেবীকে আনতে কলকাতা গিয়েছিলেন। কোনও কারণে দেরি হয়েছিল। যাই হোক, খাওয়ার সময় কথা বলা ঠিক নয়।

বললাম, কিন্তু অমূল্য ব্যাটাচ্ছেলে তো রায়সায়েবের লোক! চেতনা দেবী বোকার মতো তার ফাঁদে পা দিতে এলেন দেখছি।

উঁহু। খাওয়ার সময় কোনও কথা নয়।…..

খাওয়ার পর ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম। ক্যান্টিনবয় এসে এঁটো থালাবাটি ট্রে-তে চাপিয়ে এবং বিল সই করিয়ে নিয়ে গেল। কর্নেল চুরুট জ্বেলে ব্যালকনিতে এলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললেন, এবার অ্যাডভেঞ্চারের শেষ দৃশ্য। তোমার কাগজের জন্য রোমাঞ্চকর এবং এক্সক্লুসিভ স্টোরি পেতে হলে বিছানার কথা ভুলে যাও।

শেষ দৃশ্য?

সম্ভবত।

কখন সেটা শুরু হবে?

রাত বারোটা নাগাদ। অশোকবাবু সদলবলে শর্টকাটে আসবেন। রাস্তাটা.. কঁচা। কিন্তু জিপগাড়ির পক্ষে অগম্য কোনও রাস্তা নেই।

কিন্তু ওঁর গাড়িটা তো দেখেছি জিপ নয়।

এবার জিপ। ওঁরা আসবেন কুসুমপুরের ভেতর দিয়ে। কুসুমপুর পর্যন্ত অন্তত দশ কিলোমিটার পাকা রাস্তা পাবেন। তার ওদিকটা কাঁচা।

রাত এগারোটায় কর্নেল আমাকে ডেকে নিয়ে নিচে গেলেন। নির্জন লন পেরিয়ে আমরা অমিয় সরোবরের ধারে পার্কের একটা বেঞ্চে বসলাম। কৃষ্ণপক্ষের রাত। সমান্তরাল রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টের আলোর ছটা লেকের জল ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। আজ রাতে আকাশ নির্মেঘ। বাতাস বইছে না। লেকের জলে নক্ষত্রের প্রতিবিম্ব ঝিলমিল করছে। বাঁ দিকে একটু দূরে গালপালার ভেতর কটেজের আলো দেখা যাচ্ছে। আরও দূরে চেতনাভিলার রেডিও-এরিয়েলের শীর্ষে লাল আলো চোখে পড়ল।

অস্বস্তি আর উদ্বেগ নিয়ে বসে আছি তো আছি। সময় কাটছে না। কতক্ষণ পরে একটু দূরে পেছন দিকে গাড়ির চাপা শব্দ শুনলাম। আলোর ঝলকও দেখা গেল। তারপর আবার স্তব্ধতা। কর্নেল আস্তে বললেন, ওঁরা এসে গেছেন। চলো। আমরা রাস্তায় গিয়ে অপেক্ষা করি।

রাস্তার ধারে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম, অশোকবাবু হনহন করে এগিয়ে আসছেন। কাছাকাছি এলে কর্নেল সাড়া দিলেন। অশোকবাবু বললেন, কটেজ এরিয়া পেরিয়ে গিয়ে কোথাও বসা যাক। ওদিকে অনেক গাছ আছে। বসার জন্য বেঞ্চও আছে।

কর্নেল বললেন, ওঁরা কি জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গেছেন?

 হ্যাঁ। চলুন!

আমার মনে হচ্ছে, এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। রাস্তায় আলো আছে। বরং কটেজ এরিয়ার পেছন দিয়ে ঘুরে যাওয়া যাক।

অশোকবাবু দেখে নিয়ে বললেন, ঠিক বলেছেন।

আমরা বাঁ দিকে জঙ্গলের ভেতর ঢুকলাম। কটেজ এরিয়ার পাশ দিয়ে। যাওয়ার সময় কুকুরের গর্জন কানে এল। অশোকবাবু থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, কুকুর আনার পারমিশন দিল কে? স্পষ্ট করে বলা আছে, কুকুর নিয়ে উদ্যানে ঢোকা নিষেধ।

কর্নেল বললেন, কোন সিনেমা অভিনেত্রীর কুকুর। ফ্যানদের হাত থেকে বাঁচতে নাকি কুকুর সঙ্গে এসেছেন। সিনেমা অভিনেত্রীদের সাতখুন মাফ।

না না। ব্যাপারটা দেখতে হবে।

কটেজ এরিয়া পেরিয়ে গিয়ে আমরা চেতনাভিলার কাছাকাছি একটা গাছের তলায় দাঁড়ালাম। অশোকবাবু বললেন, আর কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে?

কর্নেল বললেন, চেতনাভিলার ওপরে ওই যে লাল আলোটা দেখতে পাচ্ছেন, ওটা সবুজ হলেই আমরা হানা দেব। এতক্ষণে আশা করি বাড়িটা ঘিরে ফেলা হয়েছে।

হ্যাঁ। আমি ওঁদের বলেছি, যত শিগগির সম্ভব চেতনাভিলা ঘিরে ফেলতে হবে। আপনার কথামতো বি এস এফের একটা দলও স্পিডবোট নিয়ে বাড স্যাংচুয়ারির ওদিকে ওত পেতে থাকবে। সব ব্যবস্থা করতেই তো একটু দেরি হয়ে গেল।

আমি না বলে পারলাম না, তাহলে আমার অনুমান সত্য হল কর্নেল। আমি বলেছিলাম বর্ডার কথাটার সঙ্গে স্মাগলিং—

কর্নেল বললেন, চুপ! অশোকবাবু! রেডিও-এরিয়েলের আলো সবুজ হয়ে গেল। চলুন!

শালবন থেকে বেরিয়ে আমরা লেকের দিকে গেলাম। তারপর কিছুটা এগিয়ে চেতনাভিলার গেটে পৌঁছুলাম। অশোকবাবু চিৎকার করে ডাকলেন, লক্ষ্মীবাবু! লক্ষ্মীবাবু!

দেখলাম, শীর্ষের আলোটা আবার লাল হয়ে গেল। বারকতক ডাকাডাকির পর সেই মালী বনমালী দাসকে দেখা গেল। সে আস্তেসুস্থে এগিয়ে এসে বলল, আপনারা কোত্থেকে আসছেন স্যার?

লক্ষ্মীবাবুকে ডেকে দাও। বলো, বসুন্ধরার অশোক রায় তার সঙ্গে দেখা করতে চান। জরুরি দরকার আছে।

আমি ও কর্নেল পেছনে ছিলাম। তাই আমাদের লক্ষ্য করেনি বনমালী। সে বলল, বাবু কলকাতা থেকে ফিরে টায়াড হয়ে ঘুমুচ্ছেন। দেখি, উঠবেন নাকি।

সে চলে গেল। একটু পরে দেখলাম একজন শক্তসমর্থ গড়নের ভদ্রলোক হন্তদন্ত এগিয়ে আসছেন। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। কর্নেল আমাকে টেনে বাঁ দিকে পাঁচিলের আড়ালে বগলদাবা করার মতো চেপে বসালেন। অশোকবাবু বললেন, লক্ষ্মীবাবু! একটা জরুরি কাজে এসে পড়েছি। এখনই কলকাতা ফিরতে হবে। গেট খুলুন!

এত রাতে কী জরুরি কাজ স্যার?

আছে! গেট খুলুন!

স্যার! ম্যাডাম এসেছেন। তাঁকে ডিসটার্ব করা ঠিক নয়। কথাটা বলুন না! কান আছে। শুনতে পাব।

কথাটা ম্যাডামের সঙ্গেই হবে লক্ষ্মীবাবু!

সর্বনাশ! রাত বারোটায় ওঁকে ঘুম থেকে জাগানো অসম্ভব। তাতে ওঁর মনের যা অবস্থা

অশোকবাবু ধমক দিলেন। গেট খুলুন! মিসেস দত্তকে ঘুম থেকে জাগানোর দায়িত্ব আমার।

ক্ষমা করবেন স্যার!

তাহলে গেট ভেঙে আমাকে ঢুকতে হবে। আমার সঙ্গে বসুন্ধরার স্টাফ এসেছে। তাদের ডাকতে আমি বাধ্য হব লক্ষ্মীবাবু!

হাঃ হাঃ হাঃ! মশা মারতে কামান দাগবেন কেন স্যার? আসতে চাইছেন যখন, আসুন। তবে ম্যাডামকে ডিসটার্ব করা উচিত হবে না।

গেট খুলুন বলছি!

গেটের তালা খোলার শব্দ হল। তারপর গেটটা একটু ফাঁক হল। অশোকবাবু ঢুকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল গিয়ে ঢুকলেন। আমিও দেরি করলাম না। লক্ষ্মীবাবু হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। বললেন, এ কী হচ্ছে? এ কী হচ্ছে?

কর্নেল তার পাঞ্জাবির গলার অংশ খামচে ধরে কানের নিচে রিভলভারের নল ঠেকিয়ে বললেন, চুপ! একটা কথা বললে মুণ্ডু উড়ে যাবে। লক্ষ্মী ছেলের মতো সঙ্গে চলুন।

বনমালী তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ঘরে ঢুকে দরজা এঁটে দিল। লন পেরিয়ে পোটিকোর তলায় গিয়ে দেখি, সিঁড়ির মাথায় মেমসায়েব-চেহারার এক। যুবতী দাঁড়িয়ে আছে। তার নাসারন্ধ্র স্ফীত। ভ্রুযুগল কুঞ্চিত। পরনে সাদা নাইটি।

অশোকবাবু ইংরেজিতে বললেন, ম্যাডামকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য দুঃখিত। কিন্তু কথাটা এত জরুরি যে একটু হইচই না করে উপায় ছিল না।

এই তাহলে সেই চেতনা দেবী! দেখতে অবশ্য সুন্দরী এবং ঈষৎ সেক্সি গড়ন। ঠোঁট কামড়ে ধরে ম্যাডাম কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, অমূল্যবাবুকে ছেড়ে দিন।

কর্নেল বললেন, উপায় নেই মিসেস দত্ত! এই ভদ্রলোক খুনের আসামী। ইনি এবং আপনার স্বামীর দেহরক্ষী মোজাহার আপনার স্বামীকে খুন করেছে।

কী অদ্ভুত কথা বলছেন? আমার স্বামী গাড়ি-দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।

অশোকবাবু বললেন, চলুন ম্যাডাম! ঘরে গিয়ে বসে সব কথা খুলে বলছি।

 ঠিক আছে। আসুন!

সেই সময় দেখলাম, দুজন পুলিশ অফিসার এবং দুজন সশস্ত্র কনস্টেবল এসে পোর্টিকোর তলায় দাঁড়ালেন। একজন পুলিশ অফিসার লক্ষ্মীবাবুকে কর্নেলের জিম্মা থেকে করতলগত করে ফেললেন। মিসেস দত্ত ততক্ষণে ভেতরে ঢুকে গেছেন।

বসার ঘরে গিয়ে কর্নেল বললেন, মিসেস দত্তের আমাকে মনে পড়া উচিত ছিল।

চেতনা বললেন, আপনি কর্নেল সরকার!

ধন্যবাদ।

 আপনারা বসুন। আমি আসছি।

কর্নেল ভেতরের দরজার কাছে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বললেন, না, মিসেস দত্ত! আপনাকে এখন ভেতরে যেতে দেওয়া উচিত হবে না।

আপনি কী বলতে চান?

আপনি আগে বসুন। তারপর বলছি।

কর্নেল সরকার! আপনি আমার সঙ্গে অভদ্রতা করছেন! ডঃ রয়! এই বৃদ্ধ লোকটিকে চলে যেতে বলুন।

এই সময় একজন পুলিশ অফিসার এসে ঘরে ঢুকলেন। মিসেস দত্ত শক্ত মুখে বললেন, ডঃ রয়! আপনি পুলিশ নিয়ে এসেছেন কেন?

কর্নেল বললেন, আপনি আগে বসুন মিসেস দত্ত!

চুপ করুন! মিসেস দত্ত কেঁদে ফেললেন এতক্ষণে। অমিয় বেঁচে থাকলে আপনাদের এই অসভ্যতা সহ্য করত না। একজন অসহায় বিধবাকে আপনারা কেন এভাবে অপমান করতে এসেছেন?

অশোকবাবুর দিকে কর্নেল একটা ইঙ্গিত করলেন। অমনি উনি পুলিশ অফিসারের দিকে ঘুরে বললেন, আপনাদের অপারেশন শুরু করুন এবার।

ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরের আলো নিভে গেল। তারপরই টর্চের আলো জ্বলে উঠল। সেই আলোয় দেখলাম, কর্নেল টাল সামলাতে গিয়ে ধরাশায়ী হচ্ছেন এবং মিসেস দত্ত পর্দা তুলে ভেতরের ঘরে ঢুকছেন। পরক্ষণে দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

তারপর যা সব ঘটতে থাকল, তা একেবারে ভৌতিক উপদ্রব বলা চলে। নানারকম দুদ্দাড় শব্দ, চিৎকার-চ্যাঁচামেচি, তারপর কয়েকবার গুলির শব্দ। আমি দেয়ালে সেঁটে দাঁড়িয়ে আছি। কী ঘটছে বুঝতে পারছি না। কর্নেলকে টর্চের আলো জ্বেলে এক পলকের জন্য বেরিয়ে যেতে দেখেছি। অশোকবাবুরও কোনও সাড়াশব্দ নেই।

ঝনঝন শব্দে কাচ ভাঙল কোথায়। আবার গুলির শব্দ শুনলাম। তখন গুঁড়ি মেরে বসে পড়লাম।

কিছুক্ষণ পরে কোনও বাঙালি মেয়ের আর্তনাদ শোনা গেল। আমাকে ছেড়ে দিন স্যার! আমি কিছু জানি না। তারপর হিপিয়ে হিপিয়ে কান্না। একেবারে মড়াকান্না!

তারপর আলো জ্বলে উঠল। কর্নেলের ডাকাডাকি শুনলাম। তিনি ডাকছিলেন, জয়ন্ত! জয়ন্ত! তুমি কোথায়?

পোর্টিকোর দিকের দরজা খোলা ছিল। সেখানে গিয়ে দেখি, কর্নেল দাঁড়িয়ে আছেন। বললাম, কী সর্বনেশে ব্যাপার।

হ্যাঁ। সর্বনাশটা অবশ্য শেষ পর্যন্ত ঘটল না। চলো, হালদারমশাইয়ের অবস্থা দেখবে।

কর্নেলকে অনুসরণ করে পেছনের দিকে গেলাম। দেখলাম, প্রাইভেট ডিটেকটিভ ঢ্যাঙা হয়ে দাঁড়িয়ে নস্যি নিচ্ছেন। তার পায়ের কাছে একগোছা ছেঁড়া দড়ি। আমাকে দেখে সহাস্যে বললেন, আর কইবেন না জয়ন্তবাবু! সব কেসে এই আমার ভাইগ্য! আমারে রশি দিয়া বান্ধে!

কর্নেলকে বললাম, মিসেস দত্ত কোথায়?

 সিক্স রাউন্ডার রিভলভারের শেষ চারটে গুলি ছুঁড়েও সুবিধে করতে পারেননি। পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন।

সে কী? পুলিশ ওঁকে ধরল কেন?

আন্তর্জাতিক ড্রাগ স্মাগলিং গ্রুপের এক মেম্বার পামেলা ক্রুজ ওরফে চেতনা ডাট আসলে গোয়র মেয়ে। বছর তিনেক আগে সে আমেরিকায় পালিয়ে গিয়েছিল। নিউইয়র্কে ঘটনাচক্রে সে অমিয় দত্তের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পায়। তারপর ঘটনাচক্রেই সে এই জঙ্গল আর বার্ড-স্যাংচুয়ারির কথা জানতে পারে। কারণ মিঃ দত্তের মনে তার আত্মঘাতিনী স্ত্রীর জন্য অপরাধবোধ ছিল। স্ত্রীর ইচ্ছা অনুসারে এই প্রজেক্টে টাকা ঢালতে চেয়েছিলেন। সেই সুযোগটা পামেলা নেয়। কিন্তু মিঃ দত্ত বেঁচে থাকলে এই বাড়িকে স্মাগলিংয়ের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। তাই সে তাকে হত্যার জন্য একটা জটিল চক্রান্তের জাল তৈরি করে এবং টাকার লোভ দেখিয়ে অমূল্যবাবু এবং মোজাহারকে কাজে লাগায়। ওর পরিচারিকাও টাকার লোভে হুকুম তামিল করে।

কী হুকুম?

যোধপুর পার্কের বাড়িতে টেনিস লনে আসলে পামেলা নিজেই পরপর দুবার গুলি ছুঁড়েছিল। কিন্তু ওর পরিচারিকা বলেছিল, একটা লোককে পালাতে দেখেছে। মনে পড়ছে।

হ্যাঁ। বুঝতে পারছি পরিচারিকা আগে থেকে শেখানো মিথ্যা কথা বলেছিল। একটু আগে যে বাঙালি মেয়েটির মড়াকান্না শুনলাম, তাহলে সেটা তারই। কত্রীর সঙ্গে এখানে এসে সেও ধরা পড়েছে। কিন্তু আপনি কীভাবে–

আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, টেনিস বল জয়ন্ত! মাত্র একটা টেনিস বল! মিঃ দত্তের মতো একজন কোটিপতি কেন একটা তুচ্ছ টেনিস বল কুড়িয়ে আনতে বাড়ির বাইরে নিজে ছুটে যাবেন? সহজেই বোঝা যায়, পামেলা তাঁকে ইসিস্ট করেছিল। প্রশ্ন করে জেনেছিলাম, ঠিক তা-ই। কারণ বলটা নাকি পামেলার খুব প্রিয়। অথচ এ একটা হেঁদো যুক্তি নয় কি? পামেলার প্রেমে মিঃ দত্ত উন্মাদ। কাজেই পামেলা সেই সময়ে আততায়ীর হামলার ঘটনা ঘটানোর সুযোগ চেয়েছিল। সে ইচ্ছে করেই বলটি পাঁচিলের বাইরে পাঠিয়েছিল। তারপর নিজেই লুকিয়ে রাখা ফায়ার আর্মস বের করে পর-পর দুবার গুলি ছুঁড়েছিল। এর ফলে বার্ড-স্যাংচুয়ারির অনুষ্ঠানে স্বভাবত মিঃ দত্ত তাকে নিয়ে যাবেন না। অথচ ওঁকে যেতেই হবে এবং রাতের মধ্যেই কলকাতা ফিরতে হবে। রাস্তায় ম্যানিকিন ফেলে রেখে দুর্ঘটনায় ওঁর মৃত্যু ঘটানো হবে। তো যাই হোক, ঘটনাটা শুনে আমার একটু খটকা লাগে। তারপর ওর ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজতে শুরু করেছিলাম।

এই সময় অশোকবাবু এসে গেলেন। আপনারা এখানে? আমি উদ্বিগ্ন হয়ে খুঁজছিলাম। বার্ড-স্যাংচুয়ারিতে মোজাহার ধরা পড়েছে। বেগতিক দেখে ব্যাটাচ্ছেলে পালিয়ে যাচ্ছিল। এবার ওর স্থানীয় স্যাঙাতদের নাম পুলিশ আদায় করে ছাড়বে। চলুন, ট্যুরিস্ট লজে যাওয়া যাক।

হালদারমশাই বললেন, কী কাণ্ড। ম্যাডামের গাড়ি ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমিও ঢুকছিলাম। ম্যাডাম আমারে লক্ষ্মীবাবুর লগে যাইতে কইলেন। সে আমারে সেই রুমে লইয়া গেল। তারপর মোজাহার আইয়া আচমকা আমারে বাঁধল। ফায়ার আর্মস ইউজের সুযোগ পাই নাই।

হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল বললেন, অসাধারণ চক্রান্ত! প্রাইভেট ডিটেকটিভ পাঠিয়ে তাঁকে রাতদুপুরে মিথ্যামিথ্যি নাটকের মতো সংলাপ শুনিয়ে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে চেয়েছিল পামেলা। রায়বাবু এবং অনির কাঁধে দায়িত্ব চাপাতে চক্রান্ত করেছিল। মিঃ দত্ত তো উইল করে যাননি। কাজেই চেতনাভিলার মালিকানা তাঁর মৃত্যুর পর অনিশ্চিত হয়ে থাকত। তার চেয়ে অনিকে জেলে ঢোকাতে পারলে আর ঝামেলা বাধার চান্স থাকে না।

বললাম, বোঝা যাচ্ছে, অমূল্যবাবু রায়সায়েবের প্রাইভেট টেলিফোন ফেরত না দিয়ে অনির ঘরে কেন রেখেছিলেন। অনি সত্যি নির্বোধ ছেলে।

হ্যাঁ। নির্বোধ এবং গোঁয়ারও। বখাটে ছেলে বললেই অবশ্য ঠিক বলা হয়। বড়লোক দাদুর একমাত্র নাতি। শাসন করার মতো কেউ নেই। অমূল্যবাবু তাকে নিজের কাজে ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সম্ভবত একজন করে গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে দিতেও পটু এই ধুরন্ধর অমূল্যরন্স ঘোষ ওরফে লক্ষ্মীকান্ত বোস। রায়বাড়িতে অমূল্যরতন ঘোষ আর চেতনাভিলায় লক্ষ্মীকান্ত বোস।

কর্নেল হেসে উঠলেন। বললাম, ম্যানিকিনের পোশাকটা খুঁজে দেখেছেন?

ওঁর ঘরে পাওয়া গেছে। মওকামতো কলকাতায় বেচে আসতেন অমূল্যরতন। ইউজড ড্রেস কেনার জন্য চৌরঙ্গি-ধর্মতলায় অনেক হকার পাওয়া যায়।

অশোকবাবু বললেন, আপনি বারবার টেনিস বলের প্রসঙ্গটা তুলছিলেন নার্সিংহোমে। এবার বুঝতে পারছি, আপনার উদ্দেশ্য কী ছিল।

হ্যাঁ, ওটাই আমার মূল সূত্র। গোয়েন্দা পরিভাষায় যাকে বলে কু। তবে নিকুঞ্জবাবুর একটা কথায় তার আগেই আমার খটকা বেধেছিল। নিকুঞ্জবাবু বলেছিলেন, চেতনাভিলায় রেডিও ট্রান্সমিশন যন্ত্র বসিয়েছেন দত্তসাহেব। কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, ইচ্ছে করলে দত্তসায়েবের মতো মানুষ ওখানে টেলিফোন লাইন টেনে নিয়ে যেতেও পারতেন। কুসুমপুর ব্লক অফিসে টেলিফোন আছে। বড়জোর এক কিলোমিটার দূরত্ব। এত বড় একটা প্রজেক্টে টেলিফোন লাইন তো খুব দরকার ছিল। কিন্তু তার বদলে রেডিও ট্রান্সমিশন সেট কেন? এখন বুঝতে পারছি, ওটা পামেলার পরামর্শেই বসানো হয়েছিল। দত্তসায়েব পামেলার প্রেমে উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন।

অশোকবাবু বললেন, হ্যাঁ। টেলিফোন লাইনের ব্যবস্থাও এই প্রজেক্টে ছিল! কিন্তু লক্ষ্য করছিলাম, মিঃ দত্ত যেন প্রস্তাবটা এড়িয়ে যেতে চাইছেন।

চেতনাভিলায় পুলিশ পাহারা দিচ্ছে। আমরা লেকের সমান্তরাল রাস্তায়। হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ বনমালীর কথা আমার মনে পড়ল। বললাম, কর্নেল! চেতনাভিলার মালী শ্ৰীমান বনমালীর কী অবস্থা?

কর্নেল সহাস্যে পকেট থেকে একটা ক্যাসেট টেপ বার করে দেখালেন। বললেন, বনমালীর ক্যাসেট প্লেয়ারের খুব শখ। পয়সাকড়ি জমিয়ে সে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার কিনেছিল। কদিন আগে হঠাৎ তার ঘর থেকে ওটা চুরি যায়। কাল সকালে আবার সে যন্ত্রটা তার ঘরে আবিষ্কার করে। এতে তার ভীষণ অবাক হওয়ার কথা। কিন্তু আজ দুপুরে একটা ফুলগাছের ঝোপে এই টেপটা। পড়ে থাকতে দেখে সে খুশি হয়। তখন চেতনাভিলা জনশূন্য। সে টেপটা বাজাতে গিয়ে অদ্ভুত সব কথাবার্তা শোনে। হা-হালদারমশাই যে সব সাংঘাতিক সংলাপ শুনেছিলেন, তা এই টেপে রেকর্ড করা আছে।

হালদারমশাই লাফিয়ে উঠলেন। হঃ! সেইজন্য আমি কোনও লোক দেখি নাই। খালি কথাবার্তা শুনছিলাম।

কর্নেল বললেন, ট্যুরিস্ট লজের কোনও কর্মীর ক্যাসেট প্লেয়ার থাকা সম্ভব। কাল সকালে এটা বাজিয়ে আপনাকে শোনাব। আমরাও শুনব। উত্তেজনার চোটে প্রাইভেট ডিটেকটিভ এক টিপ নস্যি নিলেন।…