১০০. নৃসিংহাবতার ও হিরণ্যকশিপু বধ

নিকটে আনিয়া রাজা আপন সন্ততি।
মধুর বচনে কহে প্রহ্লাদের প্রতি।।
কহ পুত্র, বিস্ময় যে হৈল মোর মনে।
এতেক বিপদে তোরে রাখে কোন জনে।।
শিশু বলে, সর্ব্বভূতে যেই নারায়ণ।
সঙ্কট হইতে মোরে তরে সেই জন।।
নয়ন থাকিতে পিতা না হইও অন্ধ।
তোমারে কহিনু ঘুচাইয়া মনোধন্ধ।।
একান্ত হইয়া ভজ সেই বিষ্ণুপদ।
নষ্ট না করিহ পিতা এ সুখ সম্পদ।।
বিদ্যমানে দেখিলে যে মোরে বধিবারে।
কত না করিলে পিতা অশেষ প্রকারে।।
যত অস্ত্র প্রহারিল সব দৈত্যগণে।
হস্তীগন্ত ঠেকি দেহে ভাঙ্গে ততক্ষণে।।
শীতল হইল অগ্নি, দেখিলে পরীক্ষা।
পড়িনু পর্ব্বত হৈতে, তাহে পেনু রক্ষা।।
মহামত্ত মল্লগণ হৈল হীনদর্প।
আরো জান বিষহীন হৈল কালসর্প।।
প্রসাদে পাইনু রক্ষা যজ্ঞের অনলে।
সমুদ্রে ফেলিলে তবে শিলা বান্ধি গলে।।
সাক্ষাতে দেখিলে, জলে ভাসিল পাষাণ।
তথাচ নহিল দূর তোমার অজ্ঞান।।
এ হেন বিভব সুখ সম্পদ তোমার।
তাঁর ক্রোধে নিশিষেকে হবে ছারখার।।
ইহা শুনি দৈত্যপতি কহিল পুত্রেরে।
কোথা আছে তোর বিষ্ণু, কোন রূপ ধরে।।
শিশু বলে, আছে প্রভু সবার অন্তর।
অনন্ত যাঁহার রূপ, বেদে অগোচর।।
আব্রহ্ম পর্যন্ত্য কীট সকল সংসারে।
আত্মরূপে আছে প্রভু সবার ভিতরে।।
দৈত্য বলে, বিষ্ণু আছে সবার হৃদয়।
সংসার বাহির পুত্র এই স্তম্ভ নয়।।
ইতিমধ্যে বিষ্ণু যদি থাকিবে সর্ব্বথা।
যথার্থ জানিব তবে তোমার এ কথা।।
প্রহ্লাদ কহিল, শুন মোর নিবেদন।
যত জীব, তত শিব রূপে নারায়ণ।।
স্তম্ভমধ্যে অবশ্যই আছে মোর প্রভু।
অন্যথা আমার বাক্য না জানিহ কভু।।
শুনিয়া পুত্রের মুখে এতেক ভারতী।
নির্ণয় জানিতে তবে দৈত্য কুলপতি।।
হাতে গদা লয়ে উঠে করি মহাদম্ভ।
মধ্যখানে হানিলেক স্ফটিকের স্তম্ভ।।
হেনকালে শুন রাজা অপূর্ব্ব কাহিনী।
ভক্তবাক্য পালিবারে দেব চক্রপাণি।।
সেবকের বাক্য আর রাখিতে সংসার।
স্তম্ভমধ্যে আসি হরি হন অবতার।।
পূর্ব্বেতে ব্রহ্মার স্তবে ‍যিনি নারায়ণ।
মনুষ্য শরীর আর সিংহের বদন।।
স্তম্ভ মধ্যে নরসিংহ দেখে দৈত্যপতি।
দেখিল অনন্ত ‍সূক্ষ্ম অপূর্ব্ব আকৃতি।।
সুন্দর সিংহের মুখ মনুষ্য শরীর।
মুহূর্ত্তেকে স্তম্ভ হৈতে হইল বাহির।।
ক্রমে ক্রমে বাড়ে যেন প্রভাতের ভানু।
নরসিংহ বিস্তারিল ক্রমে নিজ তনু।।
দেখিয়া বিরাট মূর্ত্তি কাঁপে দৈত্যঘটা।
ব্রহ্মাণ্ড ঠেকিল গিয়া দিব্য সিংহজটা।।
গভীর গর্জ্জিয়া করে অট্ট অট্ট হাস।
শব্দ শুনি ত্রৈলোক্য মণ্ডলে হৈল ত্রাস।।
এমত প্রকারে রাজা দেব নরহরি।
হিরণ্যকশিপু দৈত্যে রোষভরে ধরি।।
ঊরুমধ্যে রাখি তারে বিদারিলা বুক।
মারেন দুরন্ত দৈত্য, দেবের কৌতুক।।
মহামূর্ত্তি দেখি ভয় পায় দেবগণ।
নির্ভয় প্রহ্লাদ মাত্র করিল স্তবন।।
কৃপা কর কৃপাসিন্ধু অনাথের নাথ।
ত্রৈলোক্য কাঁপিল শব্দ শুনিয়া নির্ঘাত।।
বিশেষ বিরাটমূর্ত্তি দেখিয়া তোমার।
সুরাসুর মূর্চ্ছাগত নর কোন ছার।।
সংবরহ নিজমূর্ত্তি, দেখি লাগে ভয়।
কি কারণে কর প্রভু অকালে প্রলয়।।
হেনমতে কহে শিশু হইয়া বিকল।
অন্তর্য্যামী নারায়ণ জানিল সকল।।
শান্তমূর্ত্তি হয়ে তবে কহে ভগবান।
না হল, না হবে, ভক্ত তোমার সমান।।
মহাভক্ত তুমি হও শরীর আমার।
চিরকাল কর সুখে রাজ্য অধিকার।।
একান্ত আমার ভক্তি না ছাড়িবে মনে।
তাপ না করিহ কিছু পিতার মরণে।।
জন্মিবে তোমার বংশে যত মহাবল।
অবশ্য আমার ভক্ত হইবে সকল।।
হেনমতে সান্ত্বাইয়া প্রহ্লাদ কুমার।
অভিষেক করি তারে দেন রাজ্যভার।।
এইমতে দুই ভাই শাপে মুক্ত হয়।
পুনর্ব্বার হৈল দোঁহে রাক্ষস দুর্জ্জয়।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীদাস কহে, শুনে লভে নর জ্ঞান।।