০৯৯. প্রহ্লাদ চরিত্র

শুন যুধিষ্ঠির রাজা অপূর্ব্ব কথন।
প্রহ্লাদ নামেতে তার জন্মিল নন্দন।।
দিনে দিনে হৈল শিশু মহাভক্তিমান।
বৈষ্ণবেতে নাহি কেহ তাহার সমান।।
নারায়ণ পরায়ণ শান্ত শুদ্ধমতি।
তাহার পরশে শুদ্ধ হয় বসুমতী।।
পুত্রের চরিত্র দেখি দুঃখিত অন্তরে।
নিযুক্ত করিল গুরু পড়াইতে তারে।।
আশ্চর্য্য, শুনহ বলি তার বিবরণ।
পাঠশালে গুরু বসি থাকে যতক্ষণ।।
কেবল রাখিয়া মাত্র পুস্তকেতে দৃষ্টি।
মনে মনে জপে নিজ নারায়ণ ইষ্টি।।
কার্য্য হেতু গুরু যবে যায় যথা তথা।
তবে শিশুগণে ডাকি কহে এই কথা।।
শুন ভাই, এই পাছে কোন্ প্রয়োজন।
না জানহ বড় শত্রু আছয়ে শমন।।
তরিয়া যাইবে আর নাহিক উপায়।
কৃষ্ণপদে রাখ চিত্ত, করো ‍নাহি দায়।।
এমত প্রকারে নিত্য কহে শিশুগণে।
আর দিন তারা সব কহিল ব্রাহ্মণে।।
শুনিয়া শিষ্যের কথা গুরু ধায় বেগে।
প্রহ্লাদ চরিত্র কহে নৃপতির আগে।।
বিপ্র বলে, ,শুন রাজা হইল প্রমাদ।
সকল করিল নষ্ট তোমার প্রহ্লাদ।।
যতেক পড়াই আমি, তাহে নাহি মন।
অনুক্ষণ জপে বিষ্ণু রাম নারায়ণ।।
কৃষ্ণ বিনা তার আর নাহি মনোরথ।
সকল বালকেরে সে কহে এই মত।।
এতেক বৃত্তান্ত যদি ব্রাহ্মণ কহিল।
ক্রোধভরে নরপতি পুত্রে ডাকাইল।।
জিজ্ঞাসিল, কহ বাপু বিচার কেমন।
আমার পরম শত্রু সেই নারায়ণ।।
কেবা সেই বিষ্ণু, তার চিন্তা কর বৃথা।
অধ্যাপক ব্রাহ্মণের নাহি শুন কথা।।
শিশু বলে, এই কথা পড়িলে কি হবে।
অনিত্য সংসার পিতা কেমনে তরিবে।।
না জান পরম শত্রু আছে যে শমন।
তাহে কে করিবে রক্ষা বিনা নারায়ণ।।
অখিল সংসার মাঝে যত চরাচর।
সেই নারায়ণ সর্ব্বভূতের ঈশ্বর।।
এ তিন ভুবনে আছে যাঁহার নিয়ম।
তাঁহার আশ্রয় নিলে কি করিবে যম।।
অসংখ্য তাঁহার মায়া কহনে না যায়।
সর্ব্বভূতে আত্মরূপে ভ্রমিয়া বেড়ায়।।
নিযুক্ত করেন নানা বুদ্ধি স্থানে স্থানে।
বৈরীরূপে সদা তুমি ভাব তাঁরে মনে।।
অভাগ্য তাহারে বলি, ভক্তি নাহি যায়।
চিরকাল দুঃখে ভ্রমে, মিথ্যা জন্ম তার।।
ধ্যান করি ব্রহ্মা যাঁর নাহি পান দেখা।
তুমি আমি কিবা ছার, তাহে কোন্ লেখা।।
আমার পরমারাধ্য সেই দেব হরি।
অশেষ বিপদ হতে যাঁর নামে তরি।।
তাহা ছাড়ি অন্য পাঠ পড়ে যেই জন।
অমৃত ছাড়িয়া করে গরল ভক্ষণ।।
শুনিয়া পুত্রের মুখে এতেক ভারতী।
মহাক্রোধে বলে তবে দানবের পতি।।
মোর বংশে হৈল এই দুষ্ট দুরাত্নন।
কাষ্ঠের ভিতর যথা থাকে হুতাশন।।
জন্মিলে পোড়ায়ে কাষ্ঠে করে ছারখার।
তেমতি জন্মিল দুষ্ট কুপুত্র আমার।।
আমার শত্রুর গুণ গায় অবিরত।
আত্মপক্ষ ত্যজি হয় পর অনুগত।।
না রাখিব এই শিশু মার এই কাল।
বিলম্ব হইলে বহু বাড়িবে জঞ্জাল।।
রাজার আদেশ শুনি যত দৈত্যগণ।
চতুর্দ্দিকে ধরি সবে করে প্রহরণ।।
একে একে করিল সকলে অস্ত্রাঘাত।
কিছুতেই না হইল তাহার নিপাত।।
বিস্ময় মানিয়া পুত্রে ডাকি দৈত্যপতি।
জিজ্ঞাসিল, কি প্রকারে পেলে অব্যাহতি।।
এখন করহ ত্যাগ শত্রুগণ কথা।
নিজ শাস্ত্র অধ্যয়ন করহ সর্ব্বথা।।
নিতান্ত যদ্যপি তোর আছে ইষ্টে মন।
করহ শিবের সেবা করিয়া যতন।।
প্রহ্লাদ কহিল, মোরে রাখিলেন হরি।
হরি সখা থাকিতে কে হয় মম অরি।।
কত শিব, কত ব্রহ্মা, কত দেব দেবী।
না ‍পায় যাঁহার অন্ত বহুকাল সেবি।।
আমার পরম ইষ্ট তাঁহার চরণ।
অন্য পাঠ পঠনেতে নাহি প্রয়োজন।।
এত শুনি মহাক্রোধে দৈত্যের ঈশ্বর।
কহে, শুনি মার আনি দন্তাল কুঞ্জর।।
আজ্ঞামাত্র ধাইল যতেক দৈত্যগণ।
প্রহ্লাদে বেড়িল আনি যতেক বারণ।।
অঙ্কুশ আঘাতে দন্ত দিল হস্তীগুলা।
অঙ্গে ঠেকি ভাঙ্গে যেন সুকোমল মূলা।।
বিস্ময় মানিয়া রাজা জিজ্ঞাসে বৃত্তান্ত।
কহ পুত্র কি প্রকারে ভাঙ্গে গজদন্ত।।
শিশু বলে, করীদন্ত বজ্রের সমান।
কি মতে ভাঙ্গিব আমি নহি বলবান।।
একান্ত আছয়ে যার নারায়ণে মতি।
তাহার করিতে মন্দ কাহার শকতি।।
শুনিয়া দৈত্যের পতি অতি ক্রোধ মনে।
আদেশ করিল যত অনুচরগণে।।
যেইরূপে পার শীঘ্র মার এই পাপ।
ইহার জীবনে বড় পাইব সন্তাপ।।
ইহা শুনি যত দৈত্য প্রহ্লাদে ধরিল।
বিষম অনল জ্বালি তাহাতে ফেলিল।।
কৃষ্ণ বলি অগ্নি মাঝে পড়া মাত্র শিশু।
শীতল হইল বহ্নি, না হইল কিছু।।
দেখিয়া যতেক দৈত্য দুঃখিত অন্তর।
নিকটে পর্ব্বত ছিল অতি উচ্চতর।।
সবে মিলি গিরিশিরে প্রহ্লাদেরে তুলি।
পৃথিবী উপরে তারে ফেলাইল ঠেলি।।
পড়ে শিশু নারায়ণ চিন্তিয়া অন্তরে।
বালক শুইল যেন তূলার উপরে।।
দেখিয়া দৈত্যের পতি চিন্তাকুল মনে।
নিকটে ডাকিয়া তবে যত মল্লগণে।।
সংহার করিতে দিল তাহাদের হাতে।
কতেক প্রহার করি নারিল বধিতে।।
তবে রাজা নিকটেতে ডাকি বিপ্রগণে।
এক যজ্ঞ আরম্ভিল বধিতে নন্দনে।।
প্রহ্লাদে মারিতে কৈল যজ্ঞ আরম্ভণ।
তাহাতে হইল দগ্ধ সকল ব্রাহ্মণ।।
তবেত দেখিয়া শিশু দ্বিজের মরণ।
পরিত্রাহি ডাকে, রক্ষা কর নারায়ণ।।
এইত ব্রাহ্মণ হয় তোমার শরীর।
ইহার মৃত্যুতে আমি হইনু অস্থির।।
বিশেষে আমার হেতু ব্রাহ্মণের ক্লেশ।
আমারে করিয়া কৃপা রাখ হৃষীকেশ।।
তবে যদি ব্রাহ্মণ না হইবে সজীব।
অগ্নিতে প্রবেশ করি আমিহ মরিব।।
এরূপে করিল শিশু অনেক স্তবন।
ভক্ত-দুঃখ দেখি তবে দেব নারায়ণ।।
বাঁচাইতে দিলেন সে সকল ব্রাহ্মণে।
দেখিয়া প্রহ্লাদ হৈল আনন্দিত মনে।।
দৈত্যপতি শুনি এই সব সমাচার।
না জানিয়া মূঢ়মতি বলে পুনর্ব্বার।।
যাহ সবে সযত্নেতে, আন কালসাপ।
দংশিয়া মারুক আজি কুলাঙ্গার পাপ।।
রাজার আজ্ঞায় যায় যত দৈত্যগণ।
ভুজঙ্গ আনিয়া দিল করিতে দংশন।।
পরম বৈষ্ণব তেজ শিশুর শরীরে।
তাহাতে ভুজঙ্গ বিষ কি করিতে পারে।।
পাষাণ বান্ধিয়া তবে প্রহ্লাদের গলে।
ক্রোধমনে ফেলাইল সমুদ্রের জলে।।
শিশুর সন্ত্রাস কিছু নহিল তাহায়।
নিমগ্ন করিয়া চিত্ত গোবিন্দের পায়।।
ডাকিয়া বলিল শিশু, রাখহ সঙ্কটে।
তোমার কিঙ্কর মরে দুষ্টের কপটে।।
অবশ্য মরিব নাথ, দুঃখ নাহি তায়।
সবে মাত্র ভজিতে না ‍পেনু রাঙ্গা পায়।।
এরূপ অনেক মতে করিল স্তবন।
জানিয়া সেবক দুঃখ দেব নারায়ণ।।
পাষাণ ভাসিল জলে কৃষ্ণের কৃপায়।
বিষ্ণুভক্ত জনে কভু নাহিক সংশয়।।
তাহা অবলম্ব করি আপনার সুখে।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ জপে শিশু পরম কৌতুকে।।
জানিয়া একান্ত ভক্ত দেব দামোদর।
ভক্তের অধীন প্রভু আসিয়া সত্বর।।
কোলে করি আলিঙ্গন করেন তাহায়।
পদ্মহস্ত বুলাইলেন প্রহ্লাদের গায়।।
কহেন প্রহ্লাদে তবে, মাগ ইষ্টবর।
শুনিয়া কহিল শিশু যুড়ি দুই কর।।
যাহারে এতেক স্নেহ আছয়ে তোমার।
ব্রহ্মপদ তুচ্ছ তার, বর কোন ছার।।
ইঙ্গিতে ইন্দ্রের পদ দিতে পার তুমি।
কেবল লাঞ্ছনা তাহা, জানিলাম আমি।।
রাজ্য ধন ভ্রাতা পুত্র দারা পরিবার।
প্রভুপণে সবাকে করিব অহঙ্কার।।
মহামদে মত্ত হয়ে অনীতি করিব।
আছুক অন্যের দায় তোমা পাসরিব।।
ব্রহ্মপদে প্রভু মোর নাহি প্রয়োজন।
কেবল আমার বাঞ্ছা তোমার চরণ।।
তবে যদি বর দিবে অখিলের পতি।
কৃপা করি কর মোর পিতার সদগতি।।
শুনিয়া শিশুর মুখে এতেক কথন।
তুষ্ট হয়ে শ্রীগোবিন্দ দেন ‍আলিঙ্গন।।
প্রহ্লাদে কহেন, তুমি শরীর আমার।
মম সুখ দুঃখ ভোগ সকলি তোমার।।
উদ্ধার করিব আমি তোমার জনকে।
নিজালয়ে যাও তুমি পরম কৌতুকে।।
দুষ্ট দৈত্যগণে তুমি না করিহ ভয়।
যথা তুমি তথা আমি, জানিহ নিশ্চয়।।
এত বলি বৈকুণ্ঠেতে যান দৈত্যরিপু।
চর জানাইল যথা হিরণ্যকশিপু।।
শুন রাজা তোমার পুত্রের সমাচার।
পাষাণ ভাসিল জলে সহিত তাহার।।
নানাবিধ যন্ত্রণা দিলাম মোরা সবে।
না জানি, পাইল প্রাণ কার অনুভবে।।
শুনিয়া চরের মুখে এতেক বচন।
নিকটে ডাকিল দৈত্য আপন নন্দন।।
বিনাশকালেতে বুদ্ধি বিপরীত হয়।
চরগণে আদেশিয়া পুত্রকে আনায়।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, স্বর্গের সোপান।।