০৫৪. ঋতুপর্ণ রাজার স্বদেশ প্রত্যাগমন ও নলের পুনর্ব্বার রাজ্যপ্রাপ্তি

পরে কর্কোটক দত্ত বসন পরিয়া।
লভে নিজ পূর্ব্বরূপ নাগেরে স্মরিয়া।।
স্বরূপেতে নলরাজে দেখিয়া তখন।
পতিব্রতা হইলেন আনন্দে মগন।।
চারি বৎসরান্তে দোঁহে মিলন হইল।
উভয়ে পুনঃ পুনঃ আলিঙ্গন করিল।।
দোঁহে দোঁহাকার দুঃখের কথা কহিল।
প্রভাতে উভয়ে ভীম নৃপেরে ভেটিল।।
জামাতা দেখিয়া ‍নৃপে আনন্দ অপার।
আলিঙ্গন দিয়া বলে সকলি তোমার।।
ঋতুপর্ণ শুনিল এ সব সমাচার।
জানিল যে নল রাজা বাহুক আমার।।
দময়ন্তী প্রত্যাশা ছাড়িল নৃপবর।
শীঘ্রগতি গেল যথা নিষধ ঈশ্বর।।
ঋতুপর্ণ বলে, ভাগ্য আছিল আমার।
তেঁই সে মিলন হইল দোঁহাকার।।
অজ্ঞাতের দোষ যত ক্ষমিবে আমারে।
শুনিয়া নিষধ রাজ বলিল তাহারে।।
কখনই দোষী তুমি নহ মম স্থানে।
কখন আমার ক্রোধ নাহি হয় মনে।।
কলির পীড়নেতে বড় দুঃখ পাইয়া।
ছিলাম তোমার পাশে আনন্দিত হৈয়া।।
তোমার আশ্রয়ে থাকি বিপদ সময়।
সুখেতে ছিলাম যেন ‍আপন আলয়।।
বিপদ সময়ে রাজা যারে যেই রাখে।
ধর্ম্মেতে বাড়য়ে সেই, ধর্ম্ম রাখে তাকে।।
এতএব শুন রায় করি নিবেদন।
এমন বিপদে স্থান দেয় কোন জন।।
হইলে পরম সখা, আর কি বলিব।
গাইব তোমার গুণ যতকাল জীব।।
যাহ সখা, নিজ রাজ্যে করহ গজন।
এত বলি উভয়ে করিল আলিঙ্গন।।
সারথি করিয়া অন্যে কোশলের রায়।
আপনার রাজ্যে গেল হইয়া বিদায়।।
তবে নল নরপতি শ্বশুরে কহিয়া।
নিষধরাজ্যেতে গেল কত সৈন্য লৈয়া।।
এক রথ, ষোল হাতী, পঞ্চাশ তুরঙ্গ।
দুই শত পদাতিক নৃপতির সঙ্গ।।
নিজ রাজ্যে আইলেন নল নরপতি।
পুষ্কর সমীপে যান অতি শীঘ্রগতি।।
পুষ্করে বলিল, তোরে নিজরাজ্যে দিয়া।
অরণ্যে গেলাম আমি দেবনে হারিয়া।।
পুনঃ তব সহিত খেলিব একবার।
আপনার আত্মা পণ করিব এবার।।
জিনিলে তোমার আত্মা হইবে তোমার।
দ্যূতক্রীড়া করিব, আনহ পাশাসারি।
নহিলে উঠহ শীঘ্র ধনুঃশর ধরি।।
নলের বচন শুনি পুষ্কর হাসিয়া।
বলে, বড় ভাগ্য মানি তোমারে দেখিয়া।।
দময়ন্তী সহ তুমি প্রবেশিলে বনে।
এই তাপ অনুক্ষণ জাগে মোর মনে।।
দময়ন্তী দেবনে না কৈলে রাজা পণ।
আমার বাঞ্ছিত বিধি করিল ঘটন।।
এত ভাবি পুষ্কর আনিল পাশাসারি।
দুই জনে বসে তবে আত্মা পণ করি।।
দেখহ ধর্ম্মের গতি বিচিত্র কেমন।
দুষ্ট কলি দ্বাপর ত নাহিক এখন।।
এত বলি দেবন ফেলিল নররায়।
অবশ্য হয়েন পার ধর্ম্মের নৌকায়।।
জিনিল নৃপতি নল, হারিল পুষ্কর।
পুষ্কর ভাবিল মনে জীবন দুষ্কর।।
হারিয়া নলের হাতে উড়িল জীবন।
পুষ্কর কম্পিত তনু সজল নয়ন।।
ধার্মিক অধর্ম্মভীরু দয়ার সাগর।
অনুজে চাহিয়া তবে বলে নৃপবর।।
না ডরিহ পুষ্কর, নাহিক তব দোষ।
যতেক করিলে, তাতে নাহি করি রোষ।।
কলিতে করিল সব দৈব নিবন্ধন।
পূর্ব্বমত নির্ভয়ে থাকহ হৃষ্টমন।।
তব প্রতি প্রীতি মোর যেইরূপ ছিল।
সন্দেহ নাহিক তায়, সেরূপ রহিল।।
এত শুনি করপুটে বলিছে পুষ্কর।
তব কীর্ত্তি ঘুষিবেক দেব দৈত্য নর।।
বহুদোষে দোষী আমি, ক্ষমিলে আমারে।
তোমার সদৃশ ক্ষমী নাহি চরাচরে।।
এত বলি প্রণমিয়া পড়িল ধরণী।
আশ্বাস করিল তারে নল নৃপমণি।।
পাত্রমিত্রগণ আর নগরের প্রজা।
সর্ব্বলোকে আনন্দিত, নল হৈল ‍রাজা।।
দ্বিজগণে পাঠাইয়া বৈদর্ভী আনিল।
দীর্ঘকাল মহাসুখে রাজত্ব করিল।।
কতদিনে নরপতি চিন্তি মনে মন।
ইন্দ্রসেনে রাজ্যভার করিল অর্পণ।।
নিজ পুত্রে করি রাজা নল নরপতি।
স্বর্গলোক গেল দময়ন্তীর সংহতি।।
বৃহদশ্ব বলে, রাজা শুনিলে সকল।
তোমার অধিক দুঃখ পেয়েছিল নল।।
সম্পদ কাহার কভু নাহি রহে স্থির।
ক্ষনমাত্র রহে যেন জোয়ারের নীর।।
আসিতে না হয় সুখ, যাইতে না দুখ।
সদাকাল সমান ভুঞ্জিবা দুঃখ সুখ।।
পরমার্থ চিন্তা রাজা কর অনুক্ষণ।
সুখ দুঃখ হয় সব কর্ম্ম নিবন্ধন।।
নলের চরিত্র, আর কলির শাসন।
একমন হয়ে যদি শুনে কোন জন।।
খণ্ডয়ে বিপদ ভয়, স্ববাঞ্ছিত পায়।
বংশবৃদ্ধি হয় তার, সুখে কাল যায়।।
কদাচ কলির বাধা নাহি হয় তারে।
যতেক সঙ্কট ভয়, তাহা হৈতে তরে।।
তব দুঃখ নরপতি যাবে অল্পদিনে।
এত বলি অক্ষবিদ্যা দিলেন রাজনে।।
সবা সম্ভাষিয়া মুনি করিল গমন।
প্রণাম করেন তাঁরে ধর্ম্মের নন্দন।।
কাম্যবনে ধর্ম্মপুত্র চারি সহোদর।
অর্জ্জুন বিচ্ছেদে সদা কাতর অন্তর।।
পুণ্যকথা ভারতের শুনে পুণ্যবান।
পৃথিবীতে সুখ নাহি ইহার সমান।।
হরির ভাবনা বিনা অন্যে নাহি মন।
সদাকাল হয় তার গোলোকে গমন।।