০৮১. দুর্য্যোধনের সপরিবারে প্রভাস তীর্থে যাত্রা

জন্মেজয় বলে, মুনি কর অবধান।
শুনিতে বাসনা বড় ইহার বিধান।।
সর্ব্বজন গেল যদি হইয়া বিদায়।
কি কর্ম্ম করিল সবে রহিয়া কোথায়।।
মুনি বলে, অবধান কর কুরুবর।
কৃষ্ণা সহ কাম্যবনে পঞ্চ সহোদর।।
প্রভাস তীর্থের তীরে বিচিত্র কানন।
ফল পুষ্প অপ্রমিত মৃগ পশুগণ।।
মৃগয়া করেন নিত্য বীর ধনঞ্জয়।
রন্ধনে দ্রুপদ সুতা আনন্দ হৃদয়।।
তীর্থ করি আইলেন ধর্ম্মের নন্দন।
শ্রুতমাত্র মিলিলেন পূর্ব্বের ব্রাহ্মণ।।
পূর্ব্বমত ভোজনাদি করে দ্বিজবৃন্দ।
লক্ষ্মীরূপা যাজ্ঞসেনী রন্ধনে আনন্দ।।
এই মত পঞ্চ ভাই কাননে নিবসে।
হেথা দুর্য্যোধন রাজা আনন্দেতে ভাসে।।
বিপুল বৈভব ভোগ করে ইন্দ্র প্রায়।
অর্থ রাজ্য সৈন্য যত, কহনে না যায়।।
নিজরাজ্য ধর্ম্মরাজ্য একত্র মিলিত।
বিশেষ সে রাজ্য পূর্ব্বে অর্জ্জুন শাসিত।।
সে সকল রাজা হৈল তার অনুগত।
কর দিয়া সবে তারা থাকে শত শত।।
অশ্ব গজ পত্তি যত, কে করে গণনা।
সমুদ্র সমান সব অপ্রমিত সেনা।।
ইন্দ্র দেবরাজ যথা অমর সমাজে।
দুর্য্যোধন মহারাজ পৃথিবীর মাঝে।।
এক দিন সভাস্থলে বসি কুরুপতি।
শকুনি বলিছে তারে, শুন পৃথ্বীপতি।।
উজ্জ্বল ভারতবংশ হৈল তোমা হৈতে।
তুমি মহারাজ হৈলে ভুবন মাঝেতে।।
তোমার সমান কভু না দেখি বিপক্ষ।।
কর দিয়া সেবে তোমা রাজা লক্ষ লক্ষ।
হয় হস্তী রথ পত্তি চতুরঙ্গ দল।
কুবের জিনিয়া রত্ন ভাণ্ডার সকল।।
বিপুল বৈভব তব ইন্দ্রের সমান।
কিন্তু মনে করি আমি এক মন্দ জ্ঞান।।
যেই পুষ্প না হইল ঈশ্বরে অর্পিত।
যে ধনে নাহিক হয় ব্রাহ্মণ সুতৃপ্ত।।
যে সম্পদ ভুঞ্জি নাহি বন্ধুগণ তুষ্ট।
যে সম্পদ শত্রুগণ না করিল দৃষ্ট।।
সে সকল ব্যর্থ বলি পূর্ব্বাপর কয়।
এই অনুতাপ মম জাগিছে হৃদয়।।
সদা তৃপ্ত আছে তব গুণে যত বন্ধু।
পৃথিবী করিল দীপ্ত তব যশ ইন্দু।।
এ সকল অতুল ঐশ্বর্য্য যে হইল।
দুঃখ মোর এ সম্পদ শত্রু না দেখিল।।
পূর্ব্বে ভাল মন্ত্রণা না করিলাম সব।
দেশ ছাড়ি বনে পাঠাইলাম পাণ্ডব।।
নগরের অন্তে যদি অর্পিতাম স্থল।
নিত্য নিত্য দেখাতাম ঐশ্বর্য্য সকল।।
হেরি মনাগুণে দগ্ধ হৈত পঞ্চ জন।
অসহ্য বজ্রের সম বাজিত সঘন।।
কোথায় রহিল গিয়া নির্জ্জন কাননে।
তোমার ঐশ্বর্য্য এত জানিবে কেমনে।।
কর্ণ বলে, যা কহিলে গান্ধারাধিকারী।
ইহা অনুশোচি আমি দিবস শর্ব্বরী।।
নারীর যৌবন যথা স্বামীর বিহনে।
শক্তি শৌর্য্য ব্যর্থ না দেখিলে শত্রুগণে।।
বিভব হয় যে নষ্ট বৈরী না হেরিলে।
বিধির নিয়ম ইহা আমি জানি ভালে।।
যত দিন ইহা সব না দেখে পাণ্ডব।
লাগয়ে আমার মনে বিফল এ সব।।
কিন্তু এক করিয়াছি বিচার নির্ণয়।
বুঝিয়া করহ কার্য্য, উচিত যে হয়।।
প্রভাস তীর্থের তীরে তপস্বীর বেশে।
বাস করে শত্রুগণ তথা নানাক্লেশে।।
সবে চল যাব তথা স্নান করিবারে।
হইবে অনন্ত পুণ্য স্নানে তীর্থনীরে।।
হয় হস্তী রথ পত্তি চতুরঙ্গ দল।
সবাকার পরিবার ভৃত্যাদি সকল।।
ইন্দ্রের অধিক তব বিপুল বিভব।
দেখিয়া দ্বিগুণ দগ্ধ হইবে পাণ্ডব।।
ঘোষযাত্রা করি, সর্ব্বলোকেতে কহিবে।
কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণ ক্ষত্তা কেহ না জানিবে।।
ইহার বিধান এই মম মনে আসে।
এই যাত্রায় দুই কার্য্য, হৈবে বিশেষে।।
কর্ণের এতেক বাণী শুনি সেইক্ষণ।
সাধু সাধু প্রশংসা করিল দুর্য্যোধন।।
দুঃশাসন জয়দ্রথ ত্রিগর্ত্ত প্রভৃতি।
সাধু সাধু বলি উঠে যতেক দুর্ম্মতি।।
কর্ণ বলে, বিলম্ব না কর কুরুপতি।
সুসজ্জ সকল সৈন্য কর শীঘ্রগতি।।
আজ্ঞামাত্র দুঃশাসন হইল বাহির।
ডাকিল সকল সৈন্য সব যোদ্ধা বীর।।
যত বন্ধু বান্ধব সহিত পরিবার।
নারীগণ শুনি হৈল আনন্দ অপার।।
দ্রৌপদী সহিত দেখা দ্বিতীয় উৎসব।
তীর্থস্নান তৃতীয় চিন্তিয়া এই সব।।
বিশেষে সন্তুষ্টা নারী যাত্রা মহোৎসবে।
সর্ব্বকাল বন্দীরূপে থাকে বদ্ধভাবে।।
নৃযান গোযান আর অশ্বযান সাজে।
রথে রথী চড়িল পদাতি পদব্রজে।।
বাহিনী সাজিছে বহু বাজিছে বাজনা।
সমুদ্র সদৃশ সেনা, কে করে গণনা।।
সাজাইয়া সর্ব্বসৈন্য দুঃশাসন বেগে।
করযোড়ে দাণ্ডাইল নৃপতির আগে।।
শুনিয়া কৌরবপতি উঠিল সম্ভ্রমে।
বাহির হইয়া নিরীক্ষয়ে ক্রমে ক্রমে।।
সমুদ্র লহরী যেন রথের পতাকা।
মেঘের সদৃশ হস্তী, নাহি যায় লেখা।।
মনোহর মনোজ্ঞ উত্তম তুরঙ্গম।
পৃথিবী আচ্ছাদি বীর বিশাল বিক্রম।।
সশস্ত্র সকল সৈন্য দেখিতে সুন্দর।
শমন সভয় হয়, কিবা ছার নর।।
কর্ণ বলে, বিলম্বে নাহিক প্রয়োজন।
ভীষ্মদেব শুনে যদি করিবে বারণ।।
এই হেতু তিলেক না বিলম্ব যুয়ায়।
শীঘ্রগতি চল সখা, এই অভিপ্রায়।।
শুনিয়া কৌরবপতি বিলম্ব না কৈল।
গমন সময়ে সব বিদুর জানিল।।
যথা রাজা সৈন্যমাঝে যায় শীঘ্রগতি।
মধুর বচনে কহে দুর্য্যোধন প্রতি।।
শুনি তাত, যাবে নাকি প্রভাসের স্নানে।
পুণ্যকার্য্যে বাধা নাহি করি, সে কারণে।।
কুরুবংশ শ্রেষ্ঠ তুমি রাজচক্রবর্ত্তী।
পূরিল ভুবন তিন তোমার সুকীর্ত্তি।।
এ সময়ে যত কর ধৈর্য্য আচরণ।
ভূষিত বিভব হবে, দ্বিগুণ শোভন।।
সবাকার মন মুগ্ধ প্রভাস গমনে।
নিষেধ না করি আমি, এই সে কারণে।।
নানা চিত্র বিচিত্র সুন্দর বনস্থল।
দেবতা গন্ধর্ব্ব তথা নিবসে সকল।।
বহু সিদ্ধি ঋষিগণ উপনীত তথা।
কার সনে দ্বন্দ্ব নাহি করিবে সর্ব্বথা।।
দুর্য্যোধন বলে, তাত যে আজ্ঞা তোমার।
যদি দ্বন্দ্ব করি তবে কি ভয় আমার।।
মম সৈন্য দেখ তাত তোমার প্রসাদে।
ইন্দ্র যম আসে যদি জিনিব বিবাদে।।
তথাপি বিরোধে মম কোন প্রয়োজন।
শীঘ্র তুমি নিজ গৃহে করহ গমন।।
বিদুরে মেলানি করি কৌরবের পতি।
না করি বিলম্ব আর চলে শীঘ্রগতি।।
বিনা ভীষ্ম দ্রোণ দ্রোণী কৃপাচার্য্য বীর।
সর্ব্বসৈন্যে দুর্য্যোধন হইল বাহির।।
চলিতে চরণভরে কম্পিতা ধরণী।
ধূলা উড়ি আচ্ছাদিল দিনে দিনমণি।।
সৈন্য কোলাহল জিনি সাগর গর্জ্জন।
প্রমাদ গণিল সবে, না বুঝি কারণ।।
নগর ছাড়িয়া বনে করিল প্রবেশ।
মহাঘোর শব্দে পূরিল বনপ্রদেশ।।
মেঘেরে সদৃশ ধূলি গগনমণ্ডলে।
বহু ক্ষেত্র ভাঙ্গি সবে চলে বহু স্থলে।।
ভারত-পঙ্কজ-রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালি প্রবন্ধে বিরচিল তাঁর দাস।।