০৮৭. হস্তিনায় সশিষ্য সুর্ব্বাসার আগমন

জনমেজয় বলে, মুনি কহ বিবরণ।
সহজে অশুদ্ধবুদ্ধি রাজা দুর্য্যোধন।।
আজন্ম হিংসিল দুষ্ট নানা দুরাচারে।
ক্ষমাবন্ত ধর্ম্মশীল ধর্ম্ম অবতারে।।
তথাপিহ করি স্নেহ তারেন সঙ্কটে।
হেন জনে দুঃখ দুষ্ট দিলেক কপটে।।
মৃত্যু হৈতে উদ্ধারিল যেই মহাজন।
পুনরপি বাঞ্ছা করে তাহার মরণ।।
অহিংসা পরম ধর্ম্ম, না করে গণন।
সে হেতু সবংশে মজে রাজা দুর্য্যোধন।।
শুনিনু অপূর্ব্ব কথা তোমার বদনে।
অতঃপর কি করিল দুষ্টবুদ্ধিগণে।।
শুনিবারে ইচ্ছা বড় ইহার বিধান।
পিতামহগণ তবে গেল কোন্ স্থানে।।
শুনিতে আনন্দ বড় জন্ময়ে অন্তরে।
মুনিবর বিস্তারিয়া বলহ আমারে।।
বলেন বৈশম্পায়ন, শুন কুরুবর।
কাম্যক-কাননে আছে পঞ্চ সহোদর।।
যজ্ঞ জপ ব্রত তপ ধর্ম্ম আচরণ।
পূর্ব্বমত শত শত ব্রাহ্মণ ভোজন।।
হেথায় আসিয়া তবে কৌরব প্রধান।
গন্ধর্ব্বপতির হাতে পেয়ে অপমান।।
আহারে অরুচি হৈল, অভিমান মনে।
একান্তে বসিয়া কহে যত দুষ্টগণে।।
হে কর্ণ প্রাণের সখা, মাতুল ঠাকুর।
কি মত প্রকারে মোর দুঃখ হবে দূর।।
করিলে সুযুক্তি সবে যতেক মন্ত্রণা।
বিশেষ হইল সেই আপন যন্ত্রণা।।
সুন্দর দেখিতে চক্ষে পরিল অঞ্জন।
বিধির বিপাকে অন্ধ হইল নয়ন।।
গন্ধর্ব্ব করিল যত মোর অপমান।
ততোধিক শত্রুহস্তে হয়ে পরিত্রাণ।।
ইহা হতে মৃত্যু শ্রেষ্ঠ, গণি শতগুণে।
এতেক দুর্গতি হবে, কেবা ইহা জানে।।
আর দেখ পাণ্ডবের পুণ্যের প্রকাশ।
স্বর্গের অধিক সুখ অরণ্যে নিবাস।।
ইন্দ্রের সমান সঙ্গী চারি সহোদর।
সূর্য্যতুল্য শত শত কত দ্বিজবর।।
মনের মানসে সবে করে নানা ভোগ।
দ্রুপদ-নন্দিনী একা করয়ে সংযোগ।।
জানিনু নিশ্চয় তারা দৈবে বলবান।
মম সুখ নহে তার শতাংশে সমান।।
সূর্য্যের সমান পঞ্চ শত্রু বলবন্ত।
ত্রয়োদশ বৎসরান্তে করিবেক অন্ত।।
অর্জ্জুনে জিনিবে হেন নাহি ত্রিভুবনে।
সুরাসুর নর আদি আছে যত জনে।।
মাতুল, ত্রিগর্ত্ত, তুমি, আমি, দুঃশাসন।
বহুশ্রম করিলে না পারি কদাচন।।
বনের নিবাস শেষ যে কিছু আছয়।
ইতিমধ্যে এমন উপায় যদি হয়।।
প্রকারে পরম শত্রু যদি হয় নাশ।
আমার মনের হয় পূর্ণ অভিলাষ।।
এতেক কহিল যদি রাজা দুর্য্যোধন।
কহিতে লাগিল তবে দুষ্ট মন্ত্রিগণ।।
কি কারণে কর তুমি পাণ্ডবের ভয়।
নিজ পরাক্রম নাহি জান মহাশয়।।
বুদ্ধিবলে করিব উপায় যত আছে।
তাতে রক্ষা পেয়ে দেখি কেমনেতে বাঁচে।।
অস্ত্রের অনলে দগ্ধ করিব পাণ্ডবে।
সামান্য কর্ম্মেতে কেন চিন্ত এত সবে।।
দুষট মন্ত্রিগণ যত কহিলেক ভাষা।
তার কত দিনান্তরে আইল দুর্ব্বাসা।।
সঙ্গেতে সহস্র দশ শিষ্য মহাঋষি।
মধ্যাহ্ন সূর্য্যের প্রায় উত্তরিল আসি।।
দুর্য্যোধন শুনি তবে ঋষি আগমন।
আগুসরি কত দূরে গেল সর্ব্বজন।।
যতেক অমাত্য আর সহোদর শত।
মুনির চরণে সবে হৈল দণ্ডবত।।
প্রণাম করিল শিষ্যগণে সর্ব্বজনে।
বসাইল মুনিরাজে রত্ন সিংহাসনে।।
সুবাসিত জল আনি রাজা দুর্য্যোধন।
আপনি করিল ধৌত মুনির চরণ।।
পাদ্য অর্ঘ্য আদি দিয়া পূজে মুনিরাজে।
সেই মতে পূজিলেক শিষ্যের সমাজে।।
করযোড় করি তবে রাজা দুর্য্যোধন।
কহিতে লাগিল কিছু, বিনয় বচন।।
নিবেদন আছে কিছু, কিন্তু ভয় নয়।
আমার ভাগ্যের কথা কহনে না যায়।।
আজি মোরে সুপ্রসন্ন হৈল দেবগণ।
সে কারণে দেখিলাম তোমার চরণ।।
মুনি বলে, শুনিয়াছি তব ভাগ্য কথা।
সে হেতু আসিতে বাঞ্ছা বহুদিন হেথা।।
তোমার বৈভব যত শুনি লোকমুখে।
দেখিতে আসিনু হেথা মনের কৌতুকে।।
রাজা বলে, উগ্র তপ কৈল পিতৃগণ।
জানিনু প্রসন্ন মোরে দেব দ্বিজগণ।।
পাইলাম আজি পূর্ব্ব তপস্যার ফল।
নিশ্চয় জানিনু মোর জনম সফল।।
জানিলাম আজি মোরে সুপ্রসন্ন বিধি।
নতুবা আমার গৃহে কেন তপোনিধি।।
বহুবিধ স্তব কৈল কৌরব সমাজ।
বসিবারে আজ্ঞা করি কহে মুনিরাজ।।
মুনি বলে, ভাগ্যবন্ত তুমি ক্ষিতিতলে।
নহিবে এমন আর ক্ষত্রিয়ের কুলে।।
মহাবংশজাত তুমি খ্যাত চরাচর।
তব পূর্ব্ব পিতামহ যত পূর্ব্বাপর।।
মহাকীর্ত্তিমান যত সবে মহাতেজা।
সে মত হইলে তুমি নিজে মহারাজা।।
কিন্তু পূর্ব্ব পিতামহ করিল যে কর্ম্ম।
সেইমত প্রাণপণে পাল কুলধর্ম্ম।।
যজ্ঞ তপ ব্রত আর ব্রাহ্মণ ভোজন।
সুনীতে করিবে নিত্য প্রজার পালন।।
দ্রব্য কিনি মূল্য দিবে, উচিত যে হবে।
বিক্রয় করিতে ঔপাধিক না লইবে।।
পালন করিবে প্রজা পুত্রের সমানে।
দোষমত শাস্তি দিবে দুষ্টবুদ্ধি জনে।।
মান্যজনে নিত্য নিত্য বাড়াইবে মান।
যে কিছু কহিবে কথা বিনয় বিধান।।
সতত না হয় শান্তি, সদা নহে রোষ।
কালের উচিত কর্ম্ম পরম পৌরুষ।।
দুষ্ট বুদ্ধিদাতা যেই দুষ্ট দুরাচার।
সে সবার সহ নাহি করিবে ব্যাভার।।
সতত শাসনে যেন থাকে সর্ব্ব ক্ষিতি।
অনুরক্ত থাকে যেন সকল নৃপতি।।
পরপক্ষে কদাচিৎ নহিবে বিশ্বাস।
রাখিবে অন্তর জানি যত দাসী দাস।।
বিরূপ না হও কভু আত্মপক্ষ জনে।
পালিবে এ সব কথা পরম যতনে।।
নহুষ যযাতি আদি পূর্বব বংশ যত।
পৃথিবী পালিত সবে করি এই মত।।
সে সবা হইতে তব বিপুল বিভব।
দ্বিগুণ পাইবে শোভা হইলে এ সব।।
এত শুনি সবিনয়ে বলে কুরুপতি।
যাহা করিয়াছি আমি, আপন শকতি।।
অতঃপর যাহা হয়, তব উপদেশ।
আপনি করিয়া কৃপা কহিলে বিশেষ।।
পালন করিবে যত্নে তব এই কথা।
আপনি হইলা মম জ্ঞান চক্ষুদাতা।।
পূর্ব্বপিতামহগণ চিল উগ্রতপা।
সে কারণে কর প্রভু এতদূর কৃপা।।
এখন হইল প্রভু সফল জীবন।
এরূপে অনেক স্তুতি কৈল দুর্য্যোধন।।
হেনমতে কথোপকথনে মুনিরাজ।
পরম আনন্দ মতি কৌরব সমাজ।।
নানা বাক্য কথায় কৌতুক মনঃসুখে।
মুনিরে করিল বশ যত সভালোকে।।
একদা একান্তে বসি রাজা দুর্য্যোধন।
ডাকিল শকুনি কর্ণ ভাই দুঃশাসন।।
কর্ণে সম্বোধিয়া কহে কৌরব প্রধান।
আমার বচন সখা কর অবধান।।
বিচার করিনু এক আমি মনে মনে।
পঞ্চ ভাই পাণ্ডবেরা রহে কাম্যবনে।।
দ্রুপদ-নন্দিনী কৃষ্ণা লক্ষ্মীর সমান।
তাহার প্রসাদে সবে পায় পরিত্রাণ।।
সূর্য্যের কৃপার ফলে কিঞ্চিৎ রন্ধনে।
পরম সন্তোষে তাহা ভুঞ্জে লক্ষ জনে।।
যত লোক যায় তথা, সবে অন্ন পায়।
যতক্ষণ যাজ্ঞসেনী কিছু নাহি খায়।।
অক্ষয় থাকয়ে যত চতুর্ব্বিধ ভোগ।
অপূর্ব্ব দিখেহ কিবা বিধির সংযোগ।।
দ্রুপদ-নন্দিনী কৃষ্ণা করিলে ভোজন।
কিঞ্চিৎ মাগিলে নাহি পায় কোন জন।।
প্রতিদিন হেনমতে ভুঞ্জায় সবায়।
দশ দণ্ড নিশাযোগে নিজে কিছু খায়।।
সেকালে, সে স্থানে যদি যান মুনিরাজ।
সংহতি করিয়া যত শিষ্যের সমাজ।।
দ্রৌপদীর ভোজনান্তে যাবে সেইস্থানে।
সেবায় নহিবে ক্ষম ভাই পঞ্চ জনে।।
দোষ দেখি মহামুনি দিবে ব্রহ্মশাপ।
মরিবে পাণ্ডব-বংশ, ঘুচিবে সন্তাপ।।
তোমা সবাকার মনে না জানি কি লয়।
ঋষিরে কহিব বুঝি যদি যোগ্য হয়।।
এতেক বলিল যদি রাজা দুর্য্যোধন।
সাধু সাধু ধন্যবাদ দেয় সর্ব্বজন।।
সবে বলে মহারাজ যে আজ্ঞা তোমার।
করিলে মন্ত্রণা এই সংসারের সার।।
এমত কৌতুকমতি আছে সর্ব্বজন।
ভক্তিভাবে করে নিত্য মুনির সেবন।।
একদা দিনান্তে বসি হর্ষে মুনিরাজ।
নিকটে ডাকিয়া যত কৌরব সমাজ।।
হ্তি উপদেশ আর মধুর বচন।
দুর্য্যোধনে সম্বোধিয়া কহে তপোধন।।
শুন রাজা ত্রিভুবনে পূরে তব যশ।
তোমার সেবায় বড় হইলাম বশ।।
ইষ্ট বর মাগি লহ মম বিদ্যমানে।
বিদায় করহ শীঘ্র, যাই যথাস্থানে।।
মুনির বচন শুনি রাজা দুর্য্যোধন।
গদগদ ভাষে কহে বিনয় বচন।।
ধন ধর্ম্ম দারা পুত্র বিভব বিপুল।
কেবল তোমার মাত্র আশীর্ব্বাদ মূল।।
পরিপূর্ণ আছে সৈন্য, রাজ্য অধিকার।
কেবল রহুক ভক্তি চরণে তোমার।।
আর এক নিবেদন শুন মহাশয়।
কহিতে সঙ্কোচ করি, কৃপা যদি হয়।।
যথায় কাম্যক বনে পাণ্ডুর তনয়।
সংহতি করিয়া যদি শিষ্য সমুদয়।।
উত্তীর্ণ হইবে যবে দশ দণ্ড নিশি।
সেকালে অতিথি হবে, ওহে মহাঋষি।।
ভক্তিভাব বুঝিয়া জানিবা তার মন।
সবে বলে ধর্ম্মবন্ত পাণ্ডুর নন্দন।।
পূজা করে দেব দ্বিজে, ভক্তি অতিশয়।
সেই কথা পরীক্ষা করিতে যোগ্য হয়।।
সকালে সকল দ্রব্য হয় উপস্থিত।
রন্ধন করেন কৃষ্ণা নিত্য নিয়মিত।।
ভোজন করয়ে যত নিযুক্ত ব্রাহ্মণ।
তাহার মধ্যেতে যদি হয় লক্ষ জন।।
খাদ্যদ্রব্য পরিপূর্ণ থাকে সে সময়।
অনায়াসে খায় তথা যত লোক যায়।।
অভক্তি ভক্তির ভাব না হয় বিদিত।
সে কারণে কালাতীতে যাইতে উচিত।।
দশ দণ্ড নিশা যবে উত্তীর্ণ হইবে।
পাক সমাপন করি যাজ্ঞসেনী খাবে।।
শয়নের উদ্যোগ করিবে সর্ব্বজন।
সেইকালে শিষ্য সহ যাবে তপোধন।।
তবে যদি মধ্যাহ্ন কালের অনুসারে।
যে জন করয়ে ভক্তিভাব বলি তারে।।
সন্দেহ ভাঙ্গিতে ইথে তোমা ভিন্ন নাই।
পরীক্ষিতে যাবে তথা দিনেক গোঁসাই।।
দুর্য্যোধন নৃপতির নম্রকথা শুনি।
কৃপা করি কহিতে লাগিল মহামুনি।।
কোন ভার দিলে রাজা এই কোন্ কথা।
তব প্রীতি হেতু আমি যাইব সর্ব্বথা।।
জানিব সত্যের ভাব রাজা যুধিষ্ঠিরে।
দ্বিতীয় করিব স্নান পুষ্করের নীরে।।
তৃতীয়ে তোমার বাক্যে করিব এ কাজ।
শীঘ্রগতি বিদায় করহ মহারাজ।।
শুনিয়া আনন্দমতি রাজা দুর্য্যোধন।
সবান্ধবে প্রণাম করিল হৃষ্টমন।।
বহুবিধ বিনয় করিল সর্ব্বজনে।
সেইমতে সাদরে সম্ভাষি শিষ্যগণে।।
বিদায় হইয়া মুনি করিল গমন।
রহিল আনন্দমনে রাজা দুর্য্যোধন।।
ব্যাসের রচিত গাথা ভারতোপাখ্যান।
জীবে উদ্ধারিতে এই পুণ্যের সোপান।।