০৫২. ঋতুপর্ণ রাজার সহিত নলের বিদর্ভ নগরে প্রবেশ

রথ চালাইয়া দিল নিষধ ঈশ্বর।
নিমিষে পাইল গিয়া বিদর্ভ নগর।।
আকাশে আইসে রথ মেঘের গর্জ্জনে।
মেঘ অনুমানে নৃত্য করে শিখিগণে।।
তৃষ্ণার্থ চাতক সব করে কলবর।
ঊর্দ্ধৃমুখ করি চাহে, জলাকাঙক্ষী সব।।
বিদর্ভের লোক সব একদৃষ্টে চায়।
রথশব্দ শুনি ভৈমী উল্লাস হৃদয়।।
রথ চালাইয়া হেন জন্মায় বিস্ময়।
নল বিনা হেন শক্তি অন্যের কি হয়।।
আজি যদি আমি নল প্রভু না পাইব।
জ্বলন্ত অনলে তবে প্রবেশ করিব।।
পরনিন্দা পরদ্বেষ কটুবাক্য লোকে।
কখনই যদি মোর নাহি ভাষে মুখে।।
কভু নাহি কহি কটু প্রভুরে উত্তর।
তবে আজি ভেটিব আপন প্রাণেশ্বর।।
এত বলি দময়ন্তী প্রাসাদে থাকিয়া।
গবাক্ষ দ্বারেতে রথ চাহে নিরখিয়া।।
রথ হৈতে নামে তবে ইক্ষবাকু নন্দন।
যথা ভীম নরপতি করিল গমন।।
না দেখিয়া স্বয়ম্বর বিস্ময় হইয়া।
কহে হায় কি করিনু হেথায় আসিয়া।।
ঋতুপর্ণ রাজা দেখি ভীম নরপতি।
বসিতে আসন তাঁরে দিল শীঘ্রগতি।।
ভীম রাজা বলে, শুন অযোধ্যার নাথ।
হেথা আগমন কেন হৈল অকস্মাৎ।।
শুনিয়া নৃপতি মনে মানিল বিস্ময়।
মিথ্যা স্বয়ম্বর হেন জানিল নিশ্চয়।।
স্বয়ম্বর হইলে আসিত রাজগণ।
ভাবিয়া নৃপতি তবে বলিল বচন।।
আসিয়াছিলাম, অন্য আছিল কারণ।
আসিলাম করিবারে তোমা সম্ভাষণ।।
ভীম রাজা বলিলেন, কিভাগ্য আমার।
সে কারণে আগমন হেথায় তোমার।।
শ্রমযুক্ত আছ আজি থাক মম বাস।
এত বলি দিল এক অপূর্ব্ব আবাস।।
আবাস ভিতরে উত্তরিল নরপতি।
অশ্বশালে উত্তরিল বাহুক সারথি।।
অশ্বগণে পরিচর্য্যা করিয়া বান্ধিল।
প্রাসাদ উপরে থাকি বৈদর্ভী দেখিল।।
ঋতুপর্ণ রাজা আর সারথি তাহার।
নল রাজা না দেখি যে, কেমন বিচার।।
এত ভাবি পাঠাইল কেশিনী দূতীরে।
যাহ শীঘ্র কেশিনী, জিজ্ঞাস সারথিরে।।
দেখিয়া উহার মুখ ভ্রম হয় মন।
শীঘ্র আসি কহ ইহা বুঝিয়া কারণ।।
এত শুনি কেশিনী চলিল শীঘ্রগতি।
মধুর বচনে কহে সারথির প্রতি।।
রাজকন্যা দময়ন্তী পাঠাইল হেথা।
কে তুমি, কি হেতু এলে, জিজ্ঞাসিতে কথা।।
বাহুক বলিল মোর অযোধ্যায় স্থিতি।
ঋতুপর্ণ নৃপতির হই যে সারথি।।
হেথা হৈতে গিয়াছিল এক দ্বিজবর।
শুনিলেন ভৈমীর দ্বিতীয় স্বয়ম্বর।।
রজনী প্রভাতে বরিবেক অন্য স্বামী।
এই হেতু ঋতুপর্ণ আসে শীঘ্রগামী।।
শতেক যোজন হতে আসিল নৃপতি।
বাহুক আমার নাম, তাহার সারথি।।
পুণ্যশ্লোক নল বীরসেনের কুমার।
পূর্ব্বেতে ছিলাম আমি সারথি তাঁহার।।
তাঁর ভার্য্যা যে ভৈমীর স্বয়ম্বর কথা।
দ্বিজ মুখে শুনিয়া পাইনু বড় ব্যথা।।
দ্বিতীয় বয়সে এই, তৃতীয়ে কি হবে।
দৈবে যাহা করে, তাহা কে আর খণ্ডিবে।।
এত শুনি কেশিনী বাহুক প্রতি কয়।
তুমি যদি সারথি, নৃপতি কোথা রয়।।
অর্দ্ধবাসা একাকিনী রাখি ঘোর বনে।
অনুরক্তা নারী ছাড়ি গেলেন কেমনে।।
সেই বস্ত্র পরিধিয়া আছয়ে অদ্যাপি।
নাহি রুচে অন্ন জল পুণ্যশ্লোকে জপি।।
এত শুনি ব্যথিত হইল রাজা নল।
বারিধারা নয়নেতে বহে অশ্রুজল।।
রাজা বলে, যেই হয় কুলবতী নারী।
স্বামীর বিশ্বাস কথা রাখে গুপ্ত করি।।
আপন মরণ বাঞ্ছে স্বামীর কারণ।
তথাপি স্বামীর নিন্দা না করে কখন।।
বিবস্ত্র হইয়া যেই পশিল কানন।
অল্প ভাগ্য নহে তার, পাইল জীবন।।
হেনজনে ক্রোধ করিবার যোগ্য নয়।
রাজ্যনষ্ট জ্ঞানভ্রষ্ট প্রাণমাত্র রয়।।
এত বলি শোকাকুল কান্দে পরপতি।
কেশিনী সকল জানাইল ভৈমী প্রতি।।
ভৈমী বলে, নল এই, নহে অন্যজন।
পুনরপি যাহ তুমি, বুঝহ লক্ষণ।।
কি আচার, কি বিচার, কোন কর্ম্ম করে।
বুঝিয়া আমারে আসি কহিবে সত্বরে।।
আজ্ঞা পেয়ে দাসী তবে করিল গমন।
দেখিয়া সকল কর্ম্ম আইল তখন।।
কেশিনী বলিল, শুন রাজার নন্দিনী।
বাহুকের যত কর্ম্ম দেবমধ্যে গণি।।
রন্ধন সামগ্রী যত ঋতুপর্ণ নৃপে।
মাংস আদি পাঠাইয়া দিল তব বাপে।।
সে সব সামগ্রী দিল বাহুকের স্থান।
দেখিয়া তাহার কর্ম্ম হয়েছি অজ্ঞান।।
শূন্যকুম্ভে কিঞ্চিৎ করিল দৃষ্টিপাত।
পূর্ণকুম্ভ তখনি হইল অকস্মৎ।।
সেই জলে সব দ্রব্যজাত প্রক্ষালিল।
তৃণকাষ্ঠ ছিল, কিন্তু অনল না ছিল।।
তৃণমুষ্টি হস্তে করি কাষ্ঠমধ্যে দিল।
দৃষ্টিমাত্রে তৃণ কাষ্ঠ আপনি জ্বলিল।।
ক্ষণমাত্রে সব দ্রব্য করিল রন্ধন।
ভৈমী বলে, আর কেন বুঝেছি কারণ।।
কেশিনী এখনি তুমি যাহ আরবার।
ব্যঞ্জন আনহ তুমি রন্ধন তাহার।।
কেশিনী মাগিল গিয়া বাহুকে ব্যঞ্জন।
দময়ন্তী স্থানে গিয়া দিল সেইক্ষণ।।
খাইয়া ব্যঞ্জন ভৈমী হরষিত মন।
নিশ্চয় জানিনু এই নলের রন্ধন।।
তবে কন্যা পুত্রে দিল কেশিনী সংহতি।
কি বলে, বুঝিয়া তুমি এস শীঘ্রগতি।।
কেশিনীর সঙ্গে দেখি নন্দন নন্দিনী।
শীঘ্রগতি উঠি কোলে করে নৃপমণি।।
দোঁহা মুখ দেখি রাজা কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।
পুনঃ পুনঃ চুম্ব দিয়া আলিঙ্গন করে।।
কতক্ষণে কেশিনীরে বলিল রাজন।
দুই শিশু দেখি মোর স্থির নহে মন।।
এই মত কন্যা পুত্র আছে যে আমার।
বহুদিন দেখা নাহি সঙ্গে দোঁহাকার।।
সেই কথা স্মরিয়া করিনু যে রোদন।
অপত্য বিচ্ছেদ তাপ নহে সম্বরণ।।
পাছে কেহ দেখিয়া কহিবে কোন কথা।
লয়ে যাহ দুই শিশু, কার্য্য নাহি হেথা।।
এতেক শুনিয়া তবে কেশিনী চলিল।
বাহুকের যত কথা ভৈমীরে কহিল।।
শুনিয়া বৈদর্ভী ব্যগ্র হইল দর্শনে।
শীঘ্র গিয়া জানাইল জননীর স্থানে।।
আজ্ঞা যদি কর যাই নলে দেখিবারে।
শুনিয়া বৃত্তান্ত রাণী আজ্ঞা দিল তারে।।
তনয় তনয়া সঙ্গে করিয়া কামিনী।
পতি দরশনে যায় মরালগামিনী।।
আরন্যেতে উত্তম নলের উপাখ্যান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।