০৮২. দুর্য্যোধনের সৈন্য দর্শনে ভীমার্জ্জুনের রণসজ্জা ও যুধিষ্ঠিরের সান্ত্বনা

এখানে প্রভাতে উঠি ভাই পঞ্চ জন।
নিত্য নিয়মিত কর্ম্ম করি সমাপন।।
স্নান হেতু যান সবে সহ দ্বিজগণ।
ফল পুষ্প হেতু কেহ প্রবেশের বন।।
মৃগয়া করিতে যান ভীম ধনঞ্জয়।
রাজার নিকটে রহে মাদ্রীর তনয়।।
মহাবনে প্রবেশিল ক্রমে দুই ভাই।
রাশি রাশি মৃগ মারিলেন ঠাঁই ঠাঁই।।
বন ভ্রমণেতে দোঁহে শ্রান্ত কলেবর।
বিশ্রাম করেন বসি দুই সহোদর।।
শুনিলেন হেনকালে সৈন্য কোলাহল।
প্রলয় গর্জ্জন যেন সাগরের জল।।
কটকের পদধূলি ঢাকিল গগন।
মেঘে আচ্ছাদিল যেন সূর্য্যোর কিরণ।।
বলেন অর্জ্জুন প্রতি পবন নন্দন।
চল শীঘ্র মৃগয়াতে নাহি প্রয়োজন।।
শুন ভাই, হইতেছে, সৈন্য কোলাহল।
পদধূলি আচ্ছাদিল গগন মণ্ডল।।
কৃষ্ণা সহ রহিলেন পাণ্ডবের ‍নাথ।
বিশেষ বালক মাদ্রীপুত্র দুই সাথ।।
কি কর্ম্ম করিনু ভাই আসি দুই জনে।
কেবা আসি বিরোধিল ধর্ম্মের নন্দনে।।
এতেক বিচারি শীঘ্র যান দুই জন।
হেথায় মাদ্রী পুত্রে করিয়া সম্বোধন।।
সবিস্বয়ে কহেন যে ধর্ম্ম নৃপমণি।
দেখ ভাই বনে আসে কাহার বাহিনী।।
মৃগয়া করিতে গেল ভীম ধনঞ্জয়।
বিলম্ব দেখিয়া মম আকুল হৃদয়।।
এই বনে বাস করে গন্ধর্ব্ব কিন্নর।
বিরোধে আসক্ত সদা বীর বৃকোদর।।
কি জানি কাহার সাথে হইল বিরোধ।
বনে কিবা এসেছিল কোন মহাযোধ।।
আর এক মম মনে জাগে যে সংশয়।
ক্লেশযুক্ত শক্তিহীন দেখিয়া আমায়।।
বনমাঝে থাকি আমি তপস্বীর বেশ।
সহায় সম্পদহীন, নাহি রাজ্য দেশ।।
দুষ্টবুদ্ধি কর্ণ শকুনির মন্ত্রনায়।
মন্দবুদ্ধি দুর্য্যোধন আসে বা হেথায়।।
শীঘ্র কহ সহদেব করিয়া নির্ণয়।
হেনকালে উপনীত ভীম ধনঞ্জয়।।
দেখিয়া আনন্দ চিত্ত ধর্ম্মের নন্দন।
আলিঙ্গন দিয়া কন, কহ বিবর।।
অর্জ্জুন বলেন, দেব নির্ণয় না জানি।
ঘোর শব্দে আসিতেছে কাহার বাহিনী।।
শুনিয়া বিস্ময় বড় জন্মিল হৃদয়।
বিশেষ ‍রাখিয়া হেথা গেলাম তোমায়।।
ব্যগ্র হয়ে শীঘ্র আসিলাম সে কারণে।
ধর্ম্ম বলিলেন, ইহা হয়েছিল মনে।।
তোমা দুই জনে দ্বন্দ্ব হইল কার সনে।
করিতেছিলাম চিন্তা আমি সে কারণে।।
তোমা দোঁহা দেখি গেল সন্দেহ সকল।
কিন্তু কাছে ক্রমে আসে সৈন্য কোলাহল।।
বিপক্ষ স্বপক্ষ পরপকষ এস জানি।
অনুমানে বুঝি ভাই অনেক বাহিনী।।
আজ্ঞামাত্র পার্থ রথ করিতে স্মরণ।
কপিধ্বজ যুক্ত রথ দিল দরশন।।
ধর্ম্মেরে প্রণাম করি পার্থ উঠি রথে।
চলিলেন বায়ুবেগে অন্তরীক্ষ পথে।।
শব্দ অনুসারে পার্থ পশ্চিমেতে যান।
দেখেন কৌরব সেনা সমুদ্র প্রমাণ।।
ধ্বজ ছত্র রথ রথী পদাতি কুঞ্জর।
দেখি জানিলেন পার্থ কৌরব পামর।।
তবে পুনঃ ফিরি আসি অতি শীঘ্রগতি।
মুহূর্ত্তেকে উত্তরিলা যথা ধর্ম্মপতি।।
পার্থে দেখি আগু হয়ে ধর্ম্মের নন্দন।
জিজ্ঞাসেন কনেহ, দেব কি জিজ্ঞাস আর।
দেখিলাম সৈন্য সহ কুরু কুলাঙ্কার।।
আমা সবা হিংসিবারে আসিল এখানে।
নহে এই বনস্থলে কোন্ প্রয়োজনে।।
এত শুনি মহাক্রোধে বীর বৃকোদর।
আস্ফালন করি ভুজ উঠিল সত্বর।।
করযোড় করি বলে সম্বোধিয়া ধর্ম্ম।
দেখ মহারাজ দুষ্ট দুর্য্যোধন কর্ম্ম।
কপটে কপটী সব রাজ্যধন নিল।।
জটা বল্ক পরাইয়া কাননে পাঠাল।
দেশ হৈতে রত্ন ধন কিছু নাহি আনি।
কোনমতে তার বাঞ্ছা নাহি কৈনু হানি।।
সময় নির্ণয় মোরান না করি লঙ্ঘন।
তথাচ আসিল দুষ্ট করিতে হিংসন।।
ধর্ম্ম হেতু এত কষ্ট আমা পঞ্চ জনে।
সে ধর্ম্ম ফলিল আজি দুষ্ট দুর্য্যোধনে।।
এতেক যে সৈন্য সাজি আসিছে হেথায়।
তবু মনে লাগে ক্ষুদ্র পতঙ্গের প্রায়।।
প্রসন্ন হইয়া রাজা আজ্ঞা কর মোরে।
মুহূর্ত্তেকে সংহারিব শতেক সোদরে।।
উঠ শীঘ্র ধনঞ্জয়, বিলম্বে কি কাজ।
এত অপমানে কি তিলেক নাহি লাজ।।
নিয়ম পূরিতে দিন যে কিছু আছয়।
মোরা না লঙ্ঘিনু, সেই পাপিষ্ঠ লঙ্ঘয়।।
হে নকুল সহদেব বীরের প্রধান।
স্ববাঞ্ছিত সিদ্ধি কেন না কর বিধান।।
এতেক কহিল যদি বৃকোদর বীর।
ক্রোধেতে অস্থির হৈল পার্থের শরীর।।
জ্বলন্ত অনলে যেন ঘৃত ঢালি দিল।
মাদ্রীপুত্র দুই জন গর্জ্জিয়া উঠিল।।
সুসজ্জ করিল সবে যার যে বাহন।
তূণ হৈতে লন তুলি দিব্য অস্ত্রগণ।।
আড়া ভাঙ্গি তূণমধ্যে রাখে পুনর্ব্বার।
ধনুকেতে গুণ দিয়া দিলেন টঙ্কার।।
কবচে আবৃত তনু, নানা অস্ত্র পেঁচি।
দেবদত্ত শঙখনাদ কৈল সব্যসাচী।।
পুনঃ পুনঃ গদা লোফে পবননন্দন।
তখন কহেন ধর্ম্ম মধুর বচন।।
শুন ভাই কোন্ কর্ম্ম তোমার অসাধ্য।
সহজে অর্জ্জুন এই দেবের অবধ্য।।
বালসূর্য্যসম দুই মাদ্রীর তনয়।
ইন্দ্র যম আসে যদি, কিবা তাহে ভয়।।
কিন্তু আগে কারণ করহ নিরূপণ।
কোন কার্য্য হেতু হেথা আসে দুর্য্যোধন।।
বনেতে ভ্রমণ কিংবা হেতু তীর্থ স্নান।
মৃগয়া করিতে কিবা করিল বিধান।।
নির্ণয় না জানি আগে যদি কর যুদ্ধ।
নিশ্চিত হইবে তবে ধর্ম্মপথ রুদ্ধ।।
যদি আগে তারা হিংসা করিবে তোমার।
তুমিও মারিও তারে, নাহিক বিচার।।
দুর্ব্বলের বল ধর্ম্ম, তাহে ক হেলা।
দুস্তর সাগরে আর আছে কোন্ ভেলা।।
ধর্ম্মপুত্র মুখে শুনি এতেক বচন।
বিরস বদনে নিবর্ত্তিল চারি জন।।
কূলে নিবারিল যেন সমুদ্র লহরী।
সুসজ্জ বসিল সবে ধর্ম্ম বরাবরি।।
সম্মুখে বসিল যত ব্রাহ্মণ মণ্ডল।
অমর বেষ্টিত যেন দেব আখণ্ডল।।
মৃগচর্ম্ম কুশাসনে তপস্বীর বেশ।
বল্ক পরিধান, শিরে জটাভার কেশ।।
কথোপকথনে অতি সবার আনন্দ।
হেনকালে আসে দুর্য্যোধন মতিমন্দ।।
ব্রাহ্মণ-মণ্ডলী আর ভাই পঞ্চ জনা।
দক্ষিণ করিয়া চল নৃপতির সেনা।।
আগে চলে অগণিত পদাতিক ঢালী।
মনোরম তুরঙ্গমে সহ মহাবলী।।
অর্ব্বুদ অর্ব্বুদ তবে মেঘবর্ণ হাতী।
অসংখ্য বিচিত্র চিত্র কত শত রথী।।
হেনকালে কৌরবের যত ‍নারীগণ।
ঘুচাল রথের যত বস্ত্র আচ্ছাদন।।
অঙ্গুলীতে দেখাইয়া কহে এই বাণী।
দেখ দেখ কুটীরেতে দ্রুপদ নন্দিনী।।
বড় ভাগ্যে দেখিলাম, কহে সর্ব্বজনা।
পাছে পাছে চলে সৈন্য, কে করে গণনা।।
শকট বলদ উষ্ট্রে নানা দ্রব্য বহে।
সঙ্গে কত শত ভোক্ষ্য ভোজ্য পেয় রহে।।
যে কিছু বিভব বিত্ত রাজার আছিল।
সংহতি সুহৃদ বন্ধু সকলি আনিল।।
উপমার যোগ্য হেন নহে সুরপতি।
বর্ণনা করিতে তাহা কাহার শকতি।।
এইরূপে যায় রাজা কৌরবের পতি।
প্রলয় কালের যেন কলরব অতি।।
সম্ভাষা করিতে এল সঞ্জয় নন্দন।
সম্ভ্রমে সবার করে চরণ বন্দন।।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসেন কহ সমাচার।
কোন্ ধর্ম্মে দুর্য্যোধন করে আগুসার।।
সঞ্জয় নন্দন বলে, কর অবধান।
করিবেন ঘোষযাত্রা প্রভাসেতে স্নান।।
রাজা বলে, এ কর্ম্মে আমার অভিপ্রায়।
আর মোর আশীর্ব্বাদ কহিবে রাজায়।।
এ তীর্থে অনেক সিদ্ধ ঋষির আলয়।
দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ রক্ষ সম্প্রদায়।।
দেখ তিনি কুরুকুলে শ্রেষ্ঠ নরপতি।
বিরোধ না হয় যেন কাহার সংহতি।।
তথা হৈতে শুনিয়া সঞ্জয়সুত গেল।
ধর্ম্মের যতেক কথা রাজারে কহিল।।
শুনি অহঙ্কারে মূঢ় অবজ্ঞা করিল।
অবজ্ঞায় দুষ্ট কর্ণ শকুনি হাসিল।।
সহজে তপস্বী লোকে দেবতার ভয়।
কার শক্তি ক্ষত্রিয়ের কাছে অগ্র হয়।।
এত বলি মৌনভাবে রহে সর্ব্বজনে।
পুণ্যতীর্থ প্রভাসতে যায় কতক্ষণে।।
নানা চিত্র বিচিত্র উদ্যান মনোহর।
প্রফুল্ল কমলবনে গুঞ্জরে ভ্রমর।।
কোকিল কুহরে নিত্য নিজ মত্ততায়।
মুনির মানস হরে বসন্তের বায়।।
বিবিধ বনের শোভা কে করে বর্ণন।
দেখিয়া সানন্দচিত্ত রাজা দুর্য্যোধন।।
দুঃশাসন কর্ণ আদি হরিষ বিধান।
রহিল সকল সৈন্য যথাযোগ্য স্থান।।
সারি সারি বস্ত্রগৃহ দেখিতে সুরঙ্গ।
পর্ব্বত সমান যেন পর্ব্বতের শৃঙ্গ।।
বেড়িল প্রভাসে যথা প্রভাসের বারি।
কৌতুক বিধানে স্নান করে যত নারী।।
তবে দুর্য্যোধন রাজা সহোদর শত।
ত্রিগর্ত্ত শকুনি কর্ণ অমাত্য আবৃত।।
স্নান করি কুতূহলে করে নানা দান।
হয় হস্তী গবীগণ, নাহি পরিমাণ।।
পরম কৌতুকে সবে স্নান দান করি।
বিচিত্র বসন নানা অলঙ্কার পরি।।
জলপান করি তবে বসে সর্ব্বজন।
কৌতুকে বসিয়া করে তাম্বূল চর্ব্বণ।।
আলস্য ত্যজিয়া কেহ করিল শয়ন।
কেহ পাশা খেলে, কেহ করয়ে রন্ধন।।
ভারত পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালি প্রবন্ধে বিরচিল তাঁর দাস।।