০৭৩. পাণ্ডবগণের বদরিকাশ্রম হইতে গন্ধমাদন পর্ব্বতে গমন

কহেন জনমেজয়, কহ তপোধন।
বদরিকাশ্রমে যান পাণ্ডুর নন্দন।।
কেমনে রহেন তথা অর্জ্জুন বিহনে।
বিস্তারিয়া কহ মুনি শুনিব শ্রবণে।।
মুনি বলে, অবধান কর নৃপবর।
বনবাসে গত হয় চতুর্থ বৎসর।।
পঞ্চ বর্ষ প্রবেশিয়া সপ্তমাস গেল।
একদিন পঞ্চজনে একান্তে বসিল।।
অর্জ্জুন বিহনে সবে নিরানন্দ মন।
কহিল লাগিল কৃষ্ণা করিয়া রোদন।।
দেখ মহারাজ এই দৈবের কারণ।
সর্ব্বসুখ বিলাসে বঞ্চিত এই জন।।
যে হেতু অর্জ্জুন গেল অস্ত্র শিখিবারে।
হইল বৎসর পঞ্চ, না দেখি তাহারে।।
প্রাণের বিহনে যেন শরীর ধারণ।
অর্জ্জুন বিচ্ছেদে তেন আছি পঞ্চজন।।
তোমা সবাকার মনে না জানি কি লয়।
পার্থের বিহনে মম প্রাণ স্থির নয়।।
ভীম বলে, যা কহিলে দ্রুপদ নন্দিনী।
শীর্ণ মম কলেবর, এই সব গণি।।
সূর্য্যের সমান সেই সর্ব্ব গুণাধার।
শাসিলাম মহী বাহুবলেতে যাহার।।
যাহার তেজেতে হৈল সুরাসুর বশ।
এ তিন ভুবনে যার প্রকাশিল যশ।।
তাহার বিহনে প্রাণ শান্ত কিবা হয়।
হেনকালে কহে দোঁহে মাদ্রীর তনয়।।
যত দিন নাহি দেখি পার্থ মহাবীর।
আহারে অরুচি, চিত্ত সদাই অস্থির।।
কোথা দিব তুলনা সে অর্জ্জুনের গুণ।
পাণ্ডব কুলের চক্ষু কেবল অর্জ্জুন।।
তবে যদি পার্থ সহ নহে দরশন।
আমরা ত্যজিব প্রাণ এই নিরূপণ।।
এত শুনি কহিলেন ধর্ম্ম নৃপমণি।
কহিলে যতেক কথা, সব আমি জানি।।
অসাধ্য সাধন হেতু যেই ভাই মূল।
তাহার বিচ্ছেদে মম পরাণ আকুল।।
কিন্তু আমি শুনিয়াছি মুনির বচন।
অর্জ্জুন অজেয়, হেন কহে সর্ব্বজন।।
চিন্তা না করিহ কিছু আমার কারণে।
পূর্ব্বকথা স্মরণ হইল এতদিনে।।
আমারে কহিল পার্থ গমনের কালে।
আশীর্ব্বাদ করিহ যে আসি ভালে ভালে।।
চিন্তা না করিহ কিছু তাহার কারণে।
পঞ্চবর্ষে আসি পুনঃ নমিব চরণে।।
গন্ধমাদনেতে সবে করিবে গমন।
সেইখানে আসি আমি মিলিব তখন।।
চলহ তথায় শীঘ্র, যাই সর্ব্বজন।
অবশ্য অর্জ্জুন সনে হবে দরশন।।
এত বলি নম্রভাবে ধর্ম্মের নন্দন।
লোমশ মুনিরে করিলেন নিবেদন।।
মুনি আশ্বাসিয়া কহিলেন এই কথা।
চল শীঘ্র, অবশ্য যাইব সবে তথা।।
চলিল লোমশ আগে ধৌম্যের সহিত।
কৃষ্ণাসহ চারি ভাই যান হরষিত।।
দুর্গম কানন পথ লঙ্ঘি শত শত।
উদ্দেশিয়া যান গন্ধমাদন পর্ব্বত।।
নানাবিধ গিরি বন বহু নদ নদী।
পশু পক্ষী বৃক্ষ লতা কে করে অবধি।।
নানা মিষ্ট আলাপনে হর্ষযুক্ত মন।
ছাড়ি মৈনাকাদি করিলেন গমন।।
উত্তরেতে হিমালয় পর্ব্বতের শ্রেষ্ঠ।
কত দূরে গন্ধমাদন হৈল যে দৃষ্ট।।
পরম সুন্দর শুক্ল স্ফটিক সঙ্কাশ।
দেখিয়া সবার হৈল পরম উল্লাস।।
যত্নে উঠিলেন সবে অতি উচ্চগিরি।
তথা থাকি দেখিলেন কুবেরের পুরী।।
দূরেতে নগরবর অতি শোভা ধরে।
হইল অমরাবতী ভ্রম সবাকারে।।
বিবিধ প্রশংসা তার করি সর্ব্বজন।
কৌতুকে দেখয়ে সবে গিরি উপবন।।
কুবের শাসন সেই হয় গিরিবর।
রক্ষা হেতু আছে লক্ষ যক্ষ অনুচর।।
একদিন প্রাতঃকালে উঠি যুধিষ্ঠির।
কৃষ্ণা সহ চারি ভাই হৈলেন বাহির।।
সহিত লোমশ ধৌম্য আদি মুনিগণ।
পরম কৌতুকে প্রবেশের পুষ্পবন।।
শীতল সৌরভ বহে মন্দ সমীরণ।
প্রফুল্ল হইল গন্ধে সবাকার মন।।
নানা পুষ্পে মধুপান করিছে ভ্রমর।
কোকিল ঝঙ্কার করে বসন্ত কিঙ্কর।।
দেখিয়া প্রশংসা করি সাধু সাধু বলি।
মনের মানসে সবে ‍নানাপুষ্প তুলি।।
গতায়াতে ভগ্ন হৈল বহু পুস্পবন।
দেখিয়া কুপিল যত অনুচরগণ।।
ডাকিয়া বলিল ‍শুন মনুষ্য অধম।
এতদিনে সবাকারে স্মরিলেক যম।।
আরে মন্দমতি এই কুবের আলয়।
ঈধৃশ করিলি কাজ, মনে নাহি ভয়।।
ইহার উচিত ফল এইক্ষণে দিব।
মুহূর্ত্তেকে যমালয়ে সবারে পাঠাব।।
এত বলি চতুর্দ্দিকে বেড়ে সর্ব্বজনে।
অন্ধকার করিলেক অস্ত্র বরিষণে।।
দেখিয়া কুপিল তবে ভীম মহাবল।
মুহূর্ত্তেকে নিবারিল রক্ষক সকল।।
মারিল কতেক, তাহা কে করে গণনা।
প্রাণভয়ে পলাইল শেষ যত জনা।।
অতি ত্রাসে ঊর্দ্ধশ্বাসে ধায় অতি বেগে।
কান্দিয়া কহিল গিয়া কুবেরের আগে।।
অবধান মহারাজ করি নিবেদন।
পুষ্পবনে আসিয়াছে নর কতজন।।
ভাঙ্গিয়া পুষ্পের বন মারিল রক্ষক।
কাহারে না করে ভয় অসীম সাহস।।
বলেতে সমান তার নহে ‍কোন জন।
বিনয় করিলে তবু না শুনে বচন।।
যতেক রক্ষকগণ মারিল সকল।
তাহে রক্ষা পাইয়াছি আমরা কেবল।।
বিরোধ তাহার সাথে বড়ই সংশয়।
বুঝিয়া করহ কর্ম্ম, উচিত যে হয়।।
শুনিয়া চরের মুখে এতেক ভারতী।
জ্বলন্ত অনল তুল্য কোপে যক্ষপতি।।
সাজিল অনেক সৈন্য, চতুরঙ্গ সেনা।
যক্ষ রক্ষ পিশাচ গন্ধর্ব্ব অগণনা।।
যথায় ধর্ম্মের সুত কুসুম কাননে।
উত্তরিল যক্ষপতি অতি ক্রোধমনে।।
দেখিয়া জানিল এই রাজা যুধিষ্ঠির।
মাদ্রীপুত্র দুই সহ বৃকোদর বীর।।
নিকট হইল যবে ধর্ম্ম নরবর।
কহিতে লাগিল ক্রোধে গুহ্যক ঈশ্বর।।
বড় বংশে জন্ম রাজা, নহ ত অজ্ঞান।
কি কারণে কর কর্ম্ম নীচের সমান।।
দেবতা ব্রাহ্মণ হেতু ক্ষত্রিয়ের জন্ম।
পুনঃ পুনঃ হিংসা কর ত্যজিয়া স্বধর্ম্ম।।
ক্ষমায় না কহি কিছু, ধর্ম্মভয় বাসি।
পুনঃ পুনঃ ক্ষিপ্ত মত কর্ম্ম কর আসি।।
নহি আমি হীনশক্তি, না হই দুর্ব্বল।
মুহূর্ত্তেকে দিতে পারি সমুচিত ফল।।
এতেক শুনিয়া তবে ধর্ম্মের তনয়।
করযোড় করিয়া কহেন সবিনয়।।
কৃপার সাগর তুমি, দয়ার নিধান।
বিশেষে বালক ভীম, কিবা তার জ্ঞান।।
জনক না লয় যথা বালকের দোষ।
কৃপা করি দূর কর মনের আক্রোশ।।
ইত্যাদি অনেক মতে করিয়া স্তবন।
যক্ষরাজে তুষিলেন ধর্ম্মের নন্দন।।
তুষ্ট হয়ে বর দিয়া মধুর সম্ভাষে।
মনুষ্য বাহনে গেল আপন নিবাসে।।
পরম কৌতুকে মনে ধর্ম্ম নরপতি।
মনোরম দেখি তথা করেন বসতি।।
নানাসুখে মহানন্দে রহে সর্ব্ব জন।
অনুক্ষণ ধ্যান অর্জ্জুনের আগমন।।
ভারত প্ঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালি প্রবন্ধে বিরচিল তাঁর দাস।।