১০১. রাবণ ও কুম্ভকর্ণরূপে জয়-বিজয়ের মর্ত্ত্যে দ্বিতীয়বার জন্ম

বলিলেন মার্কণ্ডেয় শুন সমাচার।
পূর্ব্বে লঙ্কা ছিল রাক্ষসের অধিকার।।
মহামত্ত হয়ে সবে হিংসিলেক দেবে।
ব্রহ্মার সদনে গিয়া জানাইল সবে।।
শুনিয়া কহিল ব্রহ্মা দেব নারায়ণে।
বিষ্ণু চক্রে ছেদিলেন যত দৈত্যগণে।।
হতশেষ যত ছিল প্রবেশে পাতাল।
ছদ্মরূপে তথা সবে বঞ্চে চিরকাল।।
বিশ্রবা নামেতে ছিল পুলস্ত্য নন্দন।
হইল তাঁহার পুত্র, নামে বৈশ্রবণ।।
পুত্রে দেখি প্রজাপতি করিয়া সম্মান।
দিকপাল করি দিল লঙ্কাপুরে স্থান।।
পাতালে রাক্ষস ছিল, দীঘর্কাল যায়।
স্বস্থান লইতে পুনঃ করিল উপায়।।
সুমালী নামেতে ছিল নিশাচরপতি।
নিকষা নামেতে তার কন্যা রূপবতী।।
কহিল কন্যারে সব ডাকিয়া সাক্ষাতে।
উপায় করহ তুমি নিজ স্থান লৈতে।।
পূর্ব্বেতে আমার রাজ্য ছিল পুরী লঙ্কা।
পাতালে এখন আছি দেবে করি শঙ্কা।।
লঙ্কায় কুবের আছে বিশ্রবা নন্দন।
প্রকারে লইব লঙ্কা, শুনহ বচন।।
বিশ্রবার স্থানে তুমি যাহ শীঘ্রগতি।
প্রসন্ন করিয়া তাঁরে জন্মাহসন্ততি।।
ইহা হৈতে পুত্র হৈলে সাধি নিজ কার্য্য।
দৌহিত্রে সম্ভব হয় মাতামহ রাজ্য।।
বিশেষ বৈমাত্র ভাই তাহার হইবে।
দুই মতে রাজ্য নিতে তারে সম্ভবিবে।।
পিতৃবাক্য শুনি তবে নিকষা রাক্ষসী।
আইলা মুনির কাছে পুত্র অভিলাষী।।
কায়মনোবাক্যে সেবা করিল বিস্তর।
তুষ্ট হয়ে কহ মুনি, লহ ইষ্টবর।।
কন্যা বলে, পুত্রকাম্যে আসিলাম আমি।
বলিষ্ঠ নন্দন দুই আজ্ঞা কর তুমি।।
বিশ্রবা বলিল, এই সময় কর্কশ।
হইবে যুগল পুত্র দুর্জ্জয় রাক্ষস।।
মুনির চরণে করি অনেক বিনয়।
হরিষ বিধানে কন্যা পুনরপি কয়।।
মনে দুঃখ জনমিল পুত্র কথা শুনি।
সর্ব্বগুণে এক পুত্র দেহ মহামুনি।।
সন্তুষ্ট হইয়া তারে কহে তপোধন।
সববর্গুণে এক পুত্র দেহ মহামুনি।।
সন্তুষ্ট হইয়া তারে কহে তপোধন।
সর্ব্বগুণে শ্রেষ্ঠ হবে তৃতীয় নন্দন।।
এতেক শুনিয়া কন্যা আনন্দে রহিল।
যথাকালে ক্রমে তিন পুত্র প্রসবিল।।
জ্যেষ্ঠ জয় নামে হৈল দুর্জ্জয় রাবণ।
কুম্ভকর্ণ বিজয়, অনুজ বিভীষণ।।
জন্মমাত্র তিন ভাই মহাবল হৈল।
মাতৃবাক্য শুনি সবে তপ আরম্ভিল।।
মহাক্লেশে তপ কৈল সহস্র বৎসর।
তুষ্ট হয়ে প্রজাপতি দিতে এল বর।।
রাবণ বলিল, অন্য বরে কার্য্য নাই।
অমর হইব, আজ্ঞা করহ গোঁসাই।।
ব্রহ্মা বলে জন্ম হৈলে অবশ্য মরণ।
বহু ভোগ করিবে জিনিয়া ত্রিভুবন।।
জিনিবে দেবতাসুর নাগ যক্ষ রক্ষ।
অধীন তোমার হবে, আর হবে ভক্ষ্য।।
কুম্ভকর্ণ দুরন্ত সে জানি পদ্মযোনি।
নিজ সৃষ্টি রাখিবারে চিন্তিলা আপনি।।
তার মুখে বীণাপাণি দেবীরে বসাল।
ভ্রমবশে নিদ্রা বর রাক্ষস মাগিল।।
শুনিয়া দিলেন বিধি তারে সেই বর।
রাবণ কহিল তবে হইয়া কাতর।।
এ তিন ভুবনে তুমি সবাকার পতি।
কি হেতু পৌত্রের কর এতেক দুর্গতি।।
ব্রহ্মা বলে, ছমাসে দিনেক জাগরণ।
সে দিনের যুদ্ধে জয়ী হবে ত্রিভুবন।।
যদ্যপি জাগাও পুনঃ থাকিতে নিদ্রায়।
নিশ্চয় মরিবে সেই দিন সর্ব্বথায়।।
হেনমতে সান্ত্বাইয়া ভাই দুই জনে।
তবে বর নিতে কহে শেষে বিভীষণে।।
বিভীষণ কহে, অন্য বরে কার্য্য নাই।
বিষ্ণুভক্তি আজ্ঞা মোরে, করহ গোঁসাই।।
কদাচিত নহে যেন অধর্ম্মেতে মতি।
তুষ্ট হয়ে স্বস্তি স্বস্তি বলে প্রজাপতি।।
আমি তোরে তুষ্ট হয়ে দিনু এই বর।
ধর্ম্ম কর চারি যুগ হইয়া অমর।।
এতেক কহিয়া ব্রহ্মা গেলেন স্বস্থানে।
পরম সন্তোষ পায় ভাই তিন জনে।।
কত দিনে দশানন লঙ্কা নিল কাড়ি।
রহিল পরম সুখে কুবেরে খেদাড়ি।।
তবে ব্রহ্মা দুই পক্ষে কৈল সমাধান।
কৈলাস পর্ব্বতে দিল কুবেরের স্থান।।
তিন পুর জিনি ক্রমে করে অধিকার।
হইল ছত্রিশকোটি নিজ পরিবার।।
মেঘনাদ তার পুত্র অতি মহাবল।
ইন্দ্রজিৎ নাম তার জিনি আখণ্ডল।।
ক্রমেতে জিনিল স্বর্গ মর্ত্ত্য রসাতল।
লঙ্কায় আসিয়া খাটে দেবতা সকল।।
এরূপে রাবণ রাজা করিল উৎপাত।
তবে ইন্দ্র দেবগণে লয়ে নিজ সাথ।।
ব্রহ্মার আগেতে গিয়া কৈল নিবেদন।
আদ্যোপান্ত রাক্ষসের যত বিবরণ।।
তবে ব্রহ্মা নিজ সঙ্গে লয়ে দেবগণে।
উত্তরিল যথা প্রভু অনন্ত-শয়নে।।
অনেক করিল স্তব বেদের বিধান।
জানিয়া কহিলা তবে দেব ভগবান।।
আশ্বাস করিয়া কহে মধুর বচনে।
ভয় না করিহ, সুখে থাক সর্ব্বজনে।।
অবনীতে অবতার হইয়া আপনি।
নাশিব রাক্ষসগণে, শুন পদ্মযোনি।।
এতেক ‍শুনিয়া সবে প্রভুর উত্তর।
আনন্দ বিধানে গেল যে যাহার ঘর।।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত এই অপূর্ব্ব কাহিনী।
সংক্ষেপে কহিব তাহা, শুন ধর্ম্মমণি।।
মহাভারতের কথা সুধার সমান।
শ্রবণে পঠনে নর লভে ধর্ম্মজ্ঞান।।