১১১. সাবিত্রীর বুঝিয়া রাজা তনয়ার মন

একান্ত বুঝিয়া রাজা তনয়ার মন।
বন হৈতে সত্যবানে আনেন তখন।।
বিধিমতে পরিণয় দেন নরপতি।
সত্যবান গেল তবে আপন বসতি।।
পুত্রের বিবাহবার্ত্তা মহোৎসব শুনি।
হরিষ বিষাদ মনে কহে রাজা রাণী।।
নিদারুণ বিধি কৈল এমত সংযোগ।
নিরাশ করিল মোরে দিয়া বহুভোগ।।
ইন্দ্রের বৈভব জিনি ত্যজি নিজ দেশ।
বনেতে নিবাস করি তপস্বীর বেশ।।
বধূ মম অশ্বপতি নৃপতির বালা।
কিরূপে এ হেন জন রবে বৃক্ষ তলা।।
অনেক কহিল এইমত রাজা রাণী।
সাবিত্রী দেখিতে যত আইল ব্রাহ্মণী।।
অনেক প্রশংসা করি কহে সর্ব্ব জন।
সমানে সমানে বিধি করিল মিলন।।
তুমি রাণী ভাগ্যবতী, রাজা মহাসাধু।
সে কারণে লভিলে গো সাবিত্রীকে বধূ।।
অনেক লক্ষণ দেখি ইহার শরীরে।
এত বলি সবে গেল নিজ নিজ পুরে।।
পরম আনন্দ মনে রহে চারি জন।
নিত্য নিত্য সত্যবান প্রবেশিয়া বন।।
নানাবিধ ফল মূল করণ্ডেতে ভরে।
প্রতিদিন আনি দেয় সাবিত্রী গোচরে।।
সাবিত্রী মাহাত্ম্য কথা অতি চমৎকার।
যাঁর নামে ধন্য ধন্য জগৎ সংসার।।
শ্বশুর শাশুড়ী সেবে দেবের সমানে।
নানা সেবা করে নিত্য পতি সত্যবানে।।
লক্ষ্মীর সমান হয় সতী পতিব্রতা।
নিত্য নিয়মিত পূজে ব্রাহ্মণ দেবতা।।
দেবতা সেবিয়া শ্রেষ্ঠ পুরুষ পাইল।
মধুর সম্ভাষে বনবাসী বশ কৈল।।
অত্যন্ত তুষিল সর্ব্বভূতে দয়াবতী।
তাঁর গুণে তুল্য দিতে নাহি বসুমতী।।
যত্নে আচরিল যত নানাবিধ ধর্ম্ম।
নিত্য আচরিল যত নানাবিধ কর্ম্ম।।
ইষ্টেতে একান্ত মতি করে আচরণ।
শিল্প কর্ম্ম করে নিত্য বিচিত্র রচন।।
দেখিয়া সানন্দ রাজা রাণী সত্যবান।
সাবিত্রী বসতি করে বর্ষ সেই স্থান।।
নারদের বাক্য সতী স্মরে অনুক্ষণ।
লোকলাজে নানা কাজে নিবারিয়া মন।।
নিমেষে মুহূর্ত্ত দণ্ড পল আদি করি।
দণ্ডে দণ্ডে গণি যায় দিবস শর্ব্বরী।।
পঞ্চদশ দিনে পক্ষ, দ্বিপক্ষেতে মাস।
হেনমতে যায় মাস, বাড়য়ে নিরাশ।।
এইমত অনুক্ষণ সাবিত্রীর মনে।
রাজা রাণী সত্যবান কিছুই না জানে।।
এমন প্রকারে শুন ধর্ম্ম নরবর।
বৎসরের শেষমাত্র দ্বিতীয় বাসর।।
চিন্তায় আকুল হৈল ভূপতির সুতা।
বিচারিল, পূর্ণ হৈল নারদের কথা।।
অবশ্য হইবে যাহা, করিবে ঈশ্বর।
আমার একান্ত ভার তাঁহার উপর।।
হেনমতে মনে মনে ভাবি সারোদ্ধার।
আরম্ভ করিল ব্রত সংসারের সার।।
জ্যৈষ্ঠ মাসে কৃষ্ণ পক্ষে পেয়ে চতুর্দ্দশী।
লক্ষ্মী নারায়ণে সতী পূজে অহর্নিশি।।
শুদ্ধভাবে একমনে বসিয়া সুন্দরী।
অনায়াসে বঞ্চিলেক দিবস শর্ব্বরী।।
প্রভাতে উঠিয়া সতী হয়ে সযতন।
বিধিমতে করাইল ব্রাহ্মণ ভোজন।।
দক্ষিণান্ত করি কার্য্য কৈল সমাপন।
আশীর্ব্বাদ করি গেল যত দ্বিজগণ।।
এইরূপে বঞ্চিলেক দ্বিতীয় প্রহর।
সেই দিনে পূর্ণ সত্যবানের বৎসর।।
তাহাতে ‍নৃপতি সুতা চিন্তাকুল মনা।
হেনকালে শুন রাজা দৈবের ঘটনা।।
নিত্য নিত্য সত্যবান প্রবেশিয়া বন।
ফল মূল কাষ্ঠ যত করে আহরণ।।
দিবসের শেষ দেখি রাজার তনয়।
বিচারিল বনে যেতে হইল সময়।।
করণ্ড কুঠার নিল আপনার করে।
বিদায় লইল গিয়া মায়ের গোচরে।।
রাণী বল, শুন পুত্র দিবা অবশেষ।
এমত সময়ে বনে না কর প্রবেশ।।
সত্যবান বলে, মাতা না করিহ ভয়।
এখনি আসিব মাতা, জানিহ নিশ্চয়।।
এত বলি চলিলেন রাজার কুমার।
সাবিত্রী পাইয়া বার্ত্তা দেখে অন্ধকার।।
শোকাকুলা বিবেচনা করে মনে মন।
পূর্ণ হৈল, যাহা কৈল ব্রহ্মার নন্দন।।
কাল পূর্ণ হৈল আজি রাজার নন্দনে।
কর্ম্মসূত্রে টানি এবে লয় মৃত্যুস্থানে।।
জনম বিবাহ মৃত্যু যথা যেই মতে।
সময়ে আপনি সবে যায় সেই পথে।।
সে হেতু যেখানে তার আছে মৃত্যুস্থান।
নৃপতি-নন্দন তথা করিছে প্রয়াণ।।
সতী ভাবে কাল প্রাপ্ত যদি মম পতি।
আমার উচিত হয় যাইতে সংহতি।।
কারে না কহিল কিছু নৃপতির সুতা।
শীঘ্রগতি গেল তবে পতি যায় যথা।।
নৃপতি শুনিয়া বলে নিষেধ বচন।
সাবিত্রী নিষেধ নাহি মানে কদাচন।।
রাজরাণী বার্ত্তা পান, বধূ যায় বন।
চিন্তাকূল মহারাণী আসি সেইক্ষণ।।
সাবিত্রীর প্রতি কহে মধুর বচন।
কহ বধূ, চিন্তা কর কিসের কারণ।।
ফলমূল লয়ে স্বামী আসিবে এখন।
কি কারণে মহাকষ্টে যাবে তুমি বন।।
অন্য কেহ নাহি তাহে, ভীষণ কানন।
কি কারণে চিন্তা কর স্বামীর কারণ।।
দুই দিন হল তাহে আছ উপবাসী।
ভোজন করহ ঘরে আসি সুখে বসি।।
শাশুড়ীর মুখে শুনি এতেক বচন।
কহিতে লাগিল করযোড়ে সেইক্ষণ।।
আসিয়া পশ্চাতে আমি করিব ভোজন।
আজ্ঞা দেহ ঠাকুরাণী দেখে আসি বন।।
বিশেষতঃ আছে হেন শাস্ত্রের প্রসঙ্গ।
ব্রতশেষে আছে হেন শাস্ত্রের প্রসঙ্গ।।
দেখিয়া বনের শোভা দিবস বঞ্চিব।
আনন্দে স্বামীর সঙ্গে এখনি আসিব।।
সাবিত্রীর অভিলাষ বুঝি রাজরাণী।
নিবৃত্ত হইল, আর না কহিল বাণী।।
সাবিত্রী চলিল তবে সহ সত্যবান।
নিবিড় কানন মাঝে করিল প্রয়াণ।।
বিবিধ কৌতুক দেখি যান দুই জন।
বহুবিধ ফল মূল কৈল আহরণ।।
মুনিবাক্য মনে করি নৃপতির সুতা।
স্বামী হেতু অন্তরে হইল চিন্তাযুতা।।
না জানি কেমনে হবে পতির মরণ।
সত্যবান নাহি জানে এত বিবরণ।।
ভ্রমণে করিয়া সুখে তুলে ফলমূল।
পাত্র পরিপূর্ণ হৈল নাহি আর স্থল।।
রাখিয়া আঁকশি সাজি সাবিত্রীর কাছে।
কাষ্ঠ হেতু সত্যবান উঠে গিয়া গাছে।।
কুঠারে কাটিল তবে বৃক্ষসহ ডাল।
উপস্থিত হৈল আসি ক্রমে মৃত্যুকাল।।
অকস্মাৎ শিরঃপীড়া করিল অস্থির।
সহস্র নাগেতে যেন দংশিলেক শির।।
সত্যবান বলে, শুন রাজার তনয়া।
বুঝিতে না পারি কিবা হৈল দেবমায়া।।
দশদিক অন্ধকার দেখি অকস্মাৎ।
সহস্র সহস্র শেল মারয়ে নির্ঘাত।।
দেহ হৈতে যায় বুঝি এবে মোর প্রাণ।
নিস্তার নাহিক আর, হইনু অজ্ঞান।।
সাবিত্রী কহিল, আমি জানি পূর্ব্বকথা।
ধৈর্য্য ধর, অবিলম্বে যাবে শিরোব্যথা।।
এক কথা বলি আমি, শুন দিয়া মন।
বৃক্ষ হৈতে শীঘ্র তুমি নামহ এখন।।
শয়ন করিয়া সুখে থাকহ ঠাকুর।
হইবেক সকল পীড়া মুহূর্ত্তেকে দূর।।
নিজ অঙ্গ বস্ত্র পাতি সতী পুণ্যবতী।
ঊরুতে রাখিয়া শির শোয়াইল পতি।।