১১৪. যুধিষ্ঠিরের কাম্যবন ত্যাগ এবং দ্রৌপদীর দর্প বিবরণ

বৈশম্পায়ন কহিলেন, শুন কুরুবর।
কৃষ্ণা সহ কাম্যবনে পঞ্চ সহোদর।।
মার্কণ্ডেয় মুনি যদি করিল গমন।
হইল বিষাদে মগ্ন, সবাকার মন।।
কাম্যবন ত্যাগ হেতু বিচারয় মনে।
হেনকালে আসিলেন দেব নারায়ণে।।
দিন কত সেই স্থানে রহে যদুবীর।
আনন্দসাগরে মগ্ন রাজা যুধিষ্ঠির।।
আর দিন সর্ব্ব জন বসি একযোগে।
কহিলেন যুধিষ্ঠির গোবিন্দের আগে।।
মম এক নিবেদন দেবকীতনয়।
অতঃপর হেথা থাকা উপযুক্ত নয়।।
নষ্ট চেষ্টা আরম্ভিবে যত ‍দুষ্টগণ।
পুনঃ পুনঃ আসি সবে করিবে হিংসন।।
আর দেখ সমাগত অজ্ঞাত সময়।
এ সময়ে শত্রু কাছে থাকা ভাল নয়।।
এ বন ত্যজিয়া যাব অন্য দূরদেশ।
খুঁজিয়া কৌরব যথা না পায় উদ্দেশ।।
সে কারণে নিবেদন করি ভগবান।
বুঝিয়া করহ কার্য্য, যে হয় বিধান।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, যাহা কেহিতেছ তুমি।
ইহার বিচার পূর্ব্বে করিয়াছি আমি।।
চল সবে অজ্ঞাতে রহিবে অনায়াসে।
কৌরব চণ্ডাল নাহি যায় যেই দেশে।।
শুনিয়া কৃষ্ণের মুখে এতেক উত্তর।
আনন্দিত যুধিষ্ঠির পঞ্চ সহোদর।।
ধৌম্য পুরোহিত সঙ্গে করি ধর্ম্মরাজ।
নিকটে আনিয়া যত ব্রাহ্মণ-সমাজ।।
করযোড়ে কহিলেন রাজা দুঃখমনে।
অবধান কর সবে মম নিবেদনে।।
সবে জান হৈল আসি অজ্ঞাত সময়।
সে কারণে নিবেদিতে মনে করি ভয়।।
কৃপা করি যাও সবে হস্তিনা নগর।
যাবত না হয় পূর্ণ অজ্ঞাত বৎসর।।
করিবে সবার সেবা মম জ্যেষ্ঠতাতে।
কহিবে পাণ্ডব গেল বঞ্চিতে অজ্ঞাতে।।
তথায় রহিতে সবে যদি নাহি মন।
পাঞ্চাল দেশেতে তবে করিহ গমন।।
আশীর্ব্বাদ কর যেন সবার প্রসাদে।
অজ্ঞাত বৎসর মোরা বঞ্চি অপ্রমাদে।।
এত শুনি বিদায় হইল সর্ব্বজন।
হলেন বিশেষ দুঃখী ধর্ম্মের নন্দন।।
আশীর্ব্বাদ করি তবে বিপ্রকুল চলে।
কতক হস্তিনা গেল, কতক পাঞ্চালে।।
সবারে বিদায় করি রাজা যুধিষ্ঠির।
কাম্যবন হৈতে তবে হলেন বাহির।।
আগে ধর্ম্ম চলিলেন, বিপ্র কত জন।
গোবিন্দ সহিত যান পাছে চারি জন।।
চলিলেন যাজ্ঞসেনী পাকপাত্র হাতে।
ত্রৈলোক্য-মোহিনীরূপা সবার পশ্চাতে।।
বহু দিন নিবসতি ছিল কাম্যবন।
ছাড়িয়া যাইতে সবে নিরানন্দ মন।।
বিবিধ পর্ব্বত আর বহু নদ নদী।
স্থাবর জঙ্গম আদি কে করে অবধি।।
বিবিধ বনের শোভা দেখিয়া কৌতুকে।
স্বচ্ছন্দ গমনে সবে যান মনঃসুখে।।
তারপর তাহার দ্বিতীয় দিনান্তরে।
নিকটে আইল সবে কাম্য সরোবরে।।
দেবের দুর্ল্লভ সেই তীর্থ মনোরম।
জলে জলজন্তু, নানাজতি বিহঙ্গম।।
প্রফুল্ল কমলে ভৃঙ্গ পিয়ে মকরন্দ।
কুসুম-উদ্যান তটে দেখিতে আনন্দ।।
বসিল বৃক্ষের তলে দেখি মনোরমে।
বিশ্রাম করিল সবে পথি পরিশ্রমে।।
জল স্থল দেখি আর রম্য কাম্যবন।
প্রশংসা করেন নানামতে সর্ব্বজন।।
শ্রীকৃষ্ণ কহেন, ইথে সবে কর স্নান।
পৃথিবীতে তীর্থ নাহি ইহার সমান।।
এ তীর্থ স্পর্শনে নাহি যম অধিকার।
তর্পণ করিলে পিতৃমাতৃ-কুলোদ্ধার।।
এতেক কহেন যদি দেবকীনন্দন।
আনন্দ বিধানে স্নান করে সর্ব্ব জন।।
হেনমতে পঞ্চ ভাই পরম কৌতুকে।
তিন রাত্রি বঞ্চি তথা রহিলেন সুখে।।
পরদিন প্রাতঃকালে উঠে সর্ব্বজনে।
হেনকালে যাজ্ঞসেনী ভাবে মনে মনে।।
এ তিন ভুবনে আমি সতী পতিব্রতা।
স্বামীর সহিত বনে দুঃখেতে দুঃখিতা।।
পুনঃ পুনঃ ধন্যবাদ দেয় মুনিগণ।
নিশ্চয় জানিনু মম সফল জীবন।।
অখিল ভুবনপতি এত বশ যার।
ইহা হৈতে কিবা আছে গৌরবের আর।।
এইমত অহঙ্কার করে যাজ্ঞসেনী।
জানিলেন অন্তর্য্যামী দেব চক্রপাণি।।
গর্ব্ব চূর্ণ করিবারে চিন্তে নারায়ণ।
দেখিলেন হেনকালে এক তপোবন।।
নানা বৃক্ষে নানা ফল ধরে বিধিমতে।
কৌতুকে দেখেন সবে চাহি দুই ভিতে।।
পাসরিল পথশ্রম মহা আনন্দিত।
কত দূরে তপোবনে হন উপনীত।।
স্বর্গের সমান সেই স্থান মনোহর।
দেখি হৃষ্টমতি ধর্ম্ম পঞ্চ সহোদর।।
দৈবে পথশ্রমে হৈল অবশ শরীর।
শ্রান্তিযুক্ত সেই স্থানে বসে যুধিষ্ঠির।।
স্থান দান আরম্ভিল কোন কোন জন।
আলস্য ত্যজিতে কেহ করিল শয়ন।।
পূজা হেতু কেহ বা পুষ্পচয়ন করে।
কেহ বা ফল মূল আনে ক্ষুধার তরে।।
মনের আনন্দে সবে বসি রহে তথা।
দৈবের সংযোগ শুন অপূর্ব্বা বারতা।।
মহাভারতের কথা অমৃতসমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।