১১৩. সত্যবানের পুনর্জ্জীবন লাভ

পুনঃ পতি পেয়ে সতী হরষিত মতি।
স্বামীর নিকটে যান অতি শীঘ্রগতি।।
মহানন্দে লয়ে সেই অঙ্গুষ্ঠ পুরুষে।
স্বামী-অঙ্গে নিয়োজিল পরম হরিষে।।
চৈতন্য পাইয়া উঠে রাজার নন্দন।
নিদ্রা হতে হৈল যেন পুনঃ জাগরণ।।
হেনকালে শুন যুধিষ্ঠির নৃপমণি।
অস্ত গেল দিবাকর, আইল রজনী।।
দেখি সত্যবান অতি চিন্তাকুল মনে।
কহিতে লাগিল সাবিত্রীরে সম্বোধনে।।
কহ প্রিয়ে কি করিব, অতি ঘোর নিশি।
কিমতে পাইব রক্ষা অরণ্যেতে বসি।।
চিনিতে নারিব পথ, অন্ধকার ঘোর।
কেন প্রিয়ে না করিলে নিদ্রাভঙ্গ মোর।।
হায় বিধি কালনিদ্রা মোরে আনি দিল।
কান্দিবেক মাতাপিতা হয়ে শোকাকুল।।
সাবিত্রী কহিল, প্রভু শুন মম কথা।
হইল যে কর্ম্ম, তাহা চিন্তা কর বৃথা।।
নিদ্রাভঙ্গ করি যদি পাপ বড় হয়।
সেই জন্য জাগাইতে মনে হৈল ভয়।।
বিচার করিনু মনে, আছে কিছু বেলা।
নিশ্চিন্তে রহিনু আমি মনে করি হেলা।।
মেঘেতে আচ্ছন্ন, বেলা নারিনু বুঝিতে।
মম দোষ নাহি কিছু, না ভাবিহ চিতে।।
অকারণে গৃহে যেতে কর মনোরথ।
রাত্রিকালে বনস্থলে না জানিব পথ।।
চল প্রভু এই বৃক্ষে আরোহণ করি।
কোনমতে বঞ্চি প্রভু এ ঘোর শর্ব্বরী।।
প্রভাতে উঠিয়া কালি করিব গমন।
যে আজ্ঞা তোমার, এই মম নিবেদন।।
সত্যবান বলে, হবে যাহা আছে ভালে।
ইহা না করিয়া কোথা যাব রাত্রিকালে।।
এত বলি উঠি দোঁহে বৃক্ষের উপরে।
চিন্তায় আকুল রহে দুঃখিত-অন্তরে।।
হেথায় হইল চক্ষু অন্ধ নৃপতির।
পুত্রের বিলম্ব দেখি হলেন অস্থির।।
শোকাকুলে কান্দে যত রাজার ঘরণী।
কোথায় রহিল পুত্র, এ ঘোর রজনী।।
তিন দিন উপবাসী বধূ গেল সাথে।
না জানি কেমনে নষ্ট হইল বা পথে।।
এতদিনে স্বামী যদি পেলে চক্ষুদান।
হারাইল রত্ননিধি পুত্র সত্যবান।।
হায় বধু গুণবতী, নন্দিনী সমান।
তোমা দোঁহে না দেখিয়া ফাটে মোর প্রাণ।।
ঘোর বনে বনজন্তু শত শত ছিল।
অভাগীর কর্ম্মদোষে দোঁহারে হিংসিল।।
নাম ধরি কান্দি উঠে দম্পতি দুজনে।
কারণ জানিতে আসে যত মুনি স্থানে।।
একে একে কহে তবে যত ‍মুনিগণ।
কি হেতু তোমরা এত করিছ রোদন।।
আশ্বাস করিয়া কয়, না করিহ ভয়।
সুখের লক্ষণ রাজা জানিহ নিশ্চয়।।
আমা সবাকার বাক্য কভু নহে আন।
পাইবে সাবিত্রী আর পুত্র সত্যবান।।
সান্ত্বনা করিয়া সবে চলি গেল ঘর।
চিন্তাকুল রহে দোঁহে দুঃখিত অন্তর।।
এতেক কষ্টেতে বঞ্চিলেক সেই নিশি।
হেনকালে সূর্য্যোদয় হয় পূর্ব্বদিশি।।
প্রভাত জানিয়া তবে রাজার নন্দন।
ফল মূল কাষ্ঠ লয়ে করিল গমন।।
হেথা রাজা রাণী করে পথ নিরীক্ষণ।
হেনকালে সন্নিধানে আসে দুই জন।।
তিতিল দোঁহার অঙ্গ প্রেম-অশ্রু-জলে।
সেই মত হর্ষ হৈল সর্ব্ব বনস্থলে।।
আশ্রমে আসিল দোঁহে প্রফুল্ল বদনে।
সত্যবান বধূ সহ আসিল ভবনে।।
শুনিয়া আসিল বনে ছিল যত জন।
বিস্ময় মানিয়া সবে জিজ্ঞাসে কারণ।।
কহিল সাবিত্রী সবাকারে বিবরণ।
আদি অন্ত যত সব বনের কথন।।
এত শুনি সর্ব্বজন সাবিত্রীর কথা।
জানিল মানবী নহে অশ্বপতি-সুতা।।
অনেক প্রশংসা করে মিলি সর্ব্বজন।
আশীর্ববাদ করি সবে করিল গমন।।
সাবিত্রী-চরিত্র-কথা শুনি রাজরাণী।
আপনারে কৃতকৃত্যা ভাগ্যবতী মানি।।
স্নান দান করি রহে হরিষ অন্তরে।
শুন ধর্ম্মরাজ, তার কত দিনান্তরে।।
অশ্বপতি নরপতি হৈল পুত্রবান।
শত্রু জিনি নিজ রাজ্য নিল সত্যবান।।
সাবিত্রীর শত পুত্র হৈল যথাকালে।
নিজ রাজ্যে একত্র বঞ্চিল কুতূহলে।।
সাবিত্রীর তুল্য নাই এ তিন ভুবনে।
দুই কুল উদ্ধারিল আপনার গুণে।।
অন্ধ পায় চক্ষু, মৃতজনে পায় প্রাণ।
অপুত্রক ছিল রাজা হৈল পুত্রবান।।
জন্মাইল আপনার শতেক সন্ততি।
ভ্রষ্ট রাজ্য উদ্ধারিল সতী গুণবতী।।
এই হেতু সর্ব্বজন, ভুব্ন ভিতরে।
সাবিত্রী সমান হও আশীর্ব্বাদ করে।।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত এই ধর্ম্মের নন্দন।
দ্রৌপদীতে দেখি আমি তাহার লক্ষণ।।
এত বলি নিজস্থানে গেল মুনিরাজ।
আনন্দ বিধানে রহে পাণ্ডব সমাজ।।
ভারত-চরিত্র রচে মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালি প্রবন্ধে বিরচিল কাশীদাস।।