১১২. সত্যবানের মৃত্যু এবং যমের নিকট সাবিত্রীর বরপ্রাপ্তি

চেতন রহিল হৈল রাজার তনয়।
ক্রমে ক্রমে আয়ু শেষ হইল তথায়।।
দেখিয়া নৃপতি-সুতা ভাবে মনে মন।
কাল পরিপূর্ণ হৈল রাজার নন্দন।।
অবশ্য আসিবে হেথা কৃতান্ত কিঙ্কর।
দেখিব কেমনে লয় আমার ঈশ্বর।।
সাবিত্রী এতেক ভাবি রহে ঘোর বনে।
হেথায় ডাকিল যম যত দূতগণে।।
সত্যবানে আনিবারে কহে ধর্ম্মরাজ।
আজ্ঞাতে আসিল শীঘ্র দূতের সমাজ।।
যথায় কাননে পড়ি নৃপতি নন্দন।
তাহার নিকটে গেল যমদূতগণ।।
পরশিতে না পারিল সাবিত্রীর তেজে।
নিরস্ত হইয়া দূত কহে ধর্ম্মরাজে।।
দূত-মুখে ধর্ম্মরাজ পাইয়া বারতা।
আপনি আসিল শীঘ্র সত্যবান যথা।।
দেখিয়া সাবিত্রী বলে, তুমি কোন্ জন।
ধর্ম্মরাজ বলে, আমি সবার শমন।।
রাজপুত্র সত্যবান এই তব স্বামী।
কালপূর্ণ হৈল আজি, লয়ে যাই আমি।।
শুনিয়া সাবিত্রী কহে, যে আজ্ঞা তোমার।
বিধির নির্ব্বন্ধ লঙ্ঘে, শক্তি আছে কার।।
মায়াতে মোহিত সব, কেবা কার পতি।
সবে সত্যধর্ম্ম মাত্র অখিলের গতি।।
এতেক কহিয়া সতী ছাড়ি সত্যবানে।
করযোড়ে রহিলেন যম বিদ্যবানে।।
সত্যবান পাশে আসি তবে সূর্য্যসুত।
শরীর হইতে লৈল পুরুষ অদ্ভূত।।
অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ তনু দেখিতে সুন্দর।
বন্ধন করিয়া নিয়া চলিল সত্বর।।
দেখিয়া পতির দশা হয়ে দুঃখমতি।
কিছু না কহিয়া চলে যমের সংহতি।।
দেখিয়া কৃতান্ত তবে জিজ্ঞাসিল তারে।
কে তুমি, কি হেতু, বল যাবে কোথাকারে।।
কালেতে হইল তব পতির মরণ।
তার জন্য বৃথা চিন্তা কর কি কারণ।।
জগতে নিয়ম আছে সবে এইমত।
কালপূর্ণ হৈলে, সবে যায় মৃত্যুপথ।।
আমার বচনে ঘরে যাহ গুণবতি।
ত্বরায় স্বামীর এবে চিন্ত ঊর্দ্ধগতি।।
ধর্ম্মরাজ মুখে শুনি এতেক উত্তর।
রাজার নন্দিনী কহে করি যোড়কর।।
যে কিছু কহিলে প্রভু, সব জানি আমি।
কেবা কার ভাই বন্ধু, কেবা কার স্বামী।।
সহজে সংসার মিথ্যা, বিশেষ আমার।
মায়াবশে কি কারণে যাব পুনর্ব্বার।।
কাল পূর্ণ, মরে পতি দুঃখ নাহি ভাবি।
সকলে মরিবে, কেহ নহে চিরজীবী।।
এইমত বিশ্বমাঝে আছে যত জন।
জনম লভিলে হয় অব্যশ্য মরণ।।
ধর্ম্মাধর্ম্ম অনুসারে সুখ দুঃখ ভোগ।
নিজ ইচ্ছা নহে, ইহা বিধির সংযোগ।।
স্বকর্ম্ম ভুঞ্জিবে এবে এই মম পতি।
আমার কি সাধ্য করি তাঁর ঊর্দ্ধগতি।।
আপনি আপন বন্ধু, যদি রাখে ধর্ম্ম।
আপনি আপন শত্রু করিলে কুকর্ম্ম।।
সুখ দুঃখ ধর্ম্মাধর্ম্ম সদা অনুগত।
পূর্ব্বাপর আছে এই নীতি শাস্ত্রমত।।
সে কারণে প্রাণপণে করিবেক ধর্ম্ম।
সতের সঙ্গতি হৈলে করে নানা কর্ম্ম।।
সংসারের সার সঙ্গ, বলে মুনিগণে।
সঙ্গদোষে চোর হয়, সাধু সঙ্গগুণে।।
সাবিত্রীর মুখে শুনি এতেক ভারতী।
পরম সন্তুষ্ট হয়ে বলে মৃত্যুপতি।।
পৃথিবীতে সাধ্বী তুমি, নৃপতির সুতা।
তোমার জননী ধন্যা, ধন্য তব পিতা।।
শ্রবণে শুনিনু তব বাক্য সুধারস।
বর লহ গুণবতি, হৈনু তব বশ।।
সত্যবানে ছাড়ি তুমি মাগ অন্য বর।
যাহা ইচ্ছা মাগি লহ আমার গোচর।।
সাবিত্রী কহিল, যদি হলে কৃপাবন।
অপুত্রক আছে পিতা, দেহ পুত্রদান।।
যম বলে, তারে আমি দিনু পুত্রবর।
যাহ শীঘ্রগতি তুমি আপনার ঘর।।
সাবিত্রী কহিল, শুন মম নিবেদন।
তব সঙ্গ ছাড়িবারে নাহি চায় মন।।
সতের সংসর্গে যেন স্বর্গেতে নিবাস।
আমারে করিতে চাহ ইহাতে নিরাশ।।
পূর্ব্ব পিতৃ পুণ্যবলে নিজ ভাগ্যবশে।
তোমা হেন শুননিধি পাই অনায়াসে।।
ইহা হৈতে কর্ম্মবন্ধ না হইল ক্ষয়।
জানিনু আমারে বাম বিধাতা নিশ্চয়।।
এত শুনি তুষ্ট হয়ে বলে মৃত্যুপতি।
অমৃত অধিক শুনি তোমার ভারতী।।
পুনঃ পুনঃ মহানন্দ জন্মাতেছ মনে।
বর মাগ, বিনা সত্যবানের জীবনে।।
সাবিত্রী কহিল, যদি কৃপা হৈল মোরে।
শ্বশুর আছেন অন্ধ, চক্ষু দেহ তাঁরে।।
শমন কহেন, চক্ষু হইবে তাঁহার।
রজনী অধিক হয়, যাও নিজাগার।।
রাজার নন্দিনী কহে, সব জান তুমি।
সংসার বাসনা কভু নাহি করি আমি।।
নাহি চাহি পুত্র বন্ধু, নাহি চাহি পতি।
আজ্ঞা কর, সদা যেন ধর্ম্মে রহে মতি।।
এত শুনি তুষ্ট হয়ে কহে দণ্ডপাণি।
পরম সুশীলা তুমি রাজার নন্দিনী।।
তব বাক্যে হর্ষ পূর্ণ হৈল মোর মন।
বর মাগ বিনা সত্যবানের জীবন।।
সাবিত্রী কহিল, আর না করিব লোভ।
লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু, পাছে হয় ক্ষোভ।।
সে কারণে বর নিতে ভয় বাসি মনে।
শুনিয়া কৌতুকে যম কহে সেইক্ষণে।।
পতির জীবন ছাড়ি মাগ অন্য বর।
দিব তাহা, যাহা চাহ আমার গোচর।।
সাবিত্রী কহিল, বর মাগি যে শমন।
রাজ্যহীন শ্বশুরের দেহ রাজ্য ধন।।
যম বলে, হৃত রাজ্য পাবে নৃপবর।
বিলম্বে নাহিক কার্য্য, যাহ নিজ ঘর।।
সাবিত্রী কহিল, শুন মম নিবেদন।
অবশ্য হইবে যাহা বিধির লিখন।।
মায়াতে মোহিত সবে সত্যপথ ত্যজে।
ঘোর পাপ পঙ্ক-হ্রদে ইচ্ছাবশে মজে।।
আমার আমার করি বলে সর্ব্ব জন।
মিথ্যা ঘর পরিবারে মজাইয়া মন।।
বান্ধব শ্বশুর নারী পুত্র পিতা মাতা।
অনর্থের হেতু সব মহা দুঃখদাতা।।
এ সব পালন হেতু ত্যজে নিজ ধর্ম্ম।
ভরণ পোষণ করে করিয়া কুকর্ম্ম।।
পশ্চাতে অধর্ম্মভাগী হয় সেই জনা।
নিজ অঙ্গে ভোগ করে বিবিধ যন্ত্রণা।।
নয়ন থাকিতে অন্ধ প্রায় যত লোক।
কর্ম্মসূত্রে বদ্ধ যেন তসরের পোক।।
বিধির নির্ব্বন্ধ সেই বৃক্ষপত্র খায়।
যথাকালে আপনার কর্ম্মফল পায়।।
জানিয়া তথাপি তারা থাকে অনায়াসে।
পাছে বিপরীত বুদ্ধি হয় কালবশে।।
সুখেতে থাকিব হেন ভাবিয়া অন্তরে।
নিজসূত্রে বন্দী হয়ে অবশেষে মরে।।
সেই মত পৃথিবীতে হৈল যত লোক।
মায়ামোহে মজি সবে শেষে পায় শোক।।
সংসার অসার প্রভু, সার ধর্ম্মপথ।
তাহা বিনা নাহি মম অন্য মনোরথ।।
গৃহ ঘোর মহাবন্ধে যেতে কদাচন।
নিশ্চয় জানিহ দেব, নাহি মম মন।।
সর্ব্বহারা কাঁদে প্রাণ চিন্তার হুতাশে।
শীতল হউক দেব তোমার আবাসে।।
আজ্ঞা কর মুহূর্ত্তেক থাকিব সংহতি।
এত শুনি তুষ্ট হয়ে বলে মৃত্যুপতি।।
তোমার চরিত্র ধন্য লাগে চমৎকার।
অগোচর নহে মম অখি সংসার।।
অল্পকালে ধমর্ম প্রতি হেন তব মতি।
তোমার তুলনাযোগ্য নাহি দেখি ক্ষিতি।।
পৃথিবীতে খ্যাত হৈল তোমার সুযশ।
মধুর বচনে তব হইলাম বশ।।
পতির জীবন ভিন্ন মাগ অন্য বর।
যাহা ইচ্ছা মাগি লহ আমার গোচর।।
কন্যা বলে, এই সত্যবানের ঔরসে।
হইবেক এক পুত্র পঞ্চম বরষে।।
হেনমতে দেহ মোরে শতেক নন্দন।
অঙ্গীকৃত নিজবাক্য করহ পালন।।
কৃতান্ত কহিল, ঘরে যাহ গুণবতি।
মম বরে হবে তব শতেক সন্ততি।।
এত বলি শীঘ্রগতি চলিল শমন।
সাবিত্রী তাঁহার পাছে করেন গমন।।
যম বলে, কি কারণে, যাহ তুমি কোথা।
চারি বর দিনু, কেন ত্যক্ত কর বৃথা।।
সাবিত্রী কহিল, দেব উত্তম কহিলে।
জন্মিবে শতেক পুত্র, নিজে বর দিলে।।
অলঙ্ঘ্য তোমার বাক্য কে পারে লঙ্ঘিতে।
আমার হইবে পুত্র সত্যবান হৈতে।।
ইহার বিধান আগে কহ ধর্ম্মরাজ।
তোমার সংহতি মম নাহি কোন কাজ।।
সাবিত্রীর মুখে শুনি এতেক ভারতী।
পরম লজ্জিত হয়ে কহে মৃত্যুপতি।।
এ তিন ভুবনে তুমি সতী পতিব্রতা।
পবিত্র হইবে লোক শুনি তব কথা।।
বিশেষ করিলে ব্রত চতুর্দ্দশী দিনে।
পাইলে এ চারি বর তাহার কারণে।।
দ্বিতীয় তোমার কর্ম্ম কহনে না যায়।
নতুবা শুনেছ কোথা মৈলে প্রাণ পায়।।
লহ ত তোমার পতি রাজা সত্যবান।
কৌতুকে গমন কর আপনার স্থান।।
যেই ব্রত সাধিলে সতি বসিয়া অহর্নিশি।
লোকে পরে করিবে সাবিত্রী চতুর্দ্দশী।।
ভক্তিভাবে এই ব্রত করে যেই জন।
পাইবে পরম পদ না যায় খণ্ডন।।
তোমার মহিমা যেবা করিবে স্মরণ।
আমা হৈতে ভয় তার না রবে কখন।।
তোমার গুণেতে বশ হইলাম আমি।
যাহ শীঘ্র, গৃহে যাও লয়ে নিজ স্বামী।।
পৃথিবীতে ভোগ কর পরম কৌতুকে।
অন্তকালে দুই জনে যাবে বিষ্ণুলোকে।।
এত বলি মৃত্যুপতি ছাড়ি সত্যবানে।
আনন্দ বিধানে যান আপনার স্থানে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।