১১০. সাবিত্রী উপাখ্যান

জিজ্ঞাসেন যুধিষ্ঠির, শুন মহামুনি।
কহিলে রামের কথা অপূর্ব্ব কাহিনী।।
হইল শরীর মুক্ত, সফল এ জন্ম।
সাবিত্রী কাহার নাম, কিবা তাঁর কর্ম্ম।।
কিবা ধর্ম্ম আচরিল, কিবা উগ্রতপে।
কোন্ কোন্ কুল উদ্ধারিল কোন্ রূপে।।
শুনিবারে ইচ্ছা বড় জন্মিল অন্তরে।
মুনিরাজ বিস্তারিয়া কহ গো আমারে।।
মুনি বলে, শুন যুধিষ্ঠির নৃপমণি।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত এই অপূর্ব্ব কাহিনী।।
মদ্রদেশে চিল অশ্বপতি মহীপাল।
পুত্রহেতু শিব সেবা করে বহুকাল।।
সন্তান বিহীন রাজা নিরানন্দ মতি।
কত দিনে হৈল এক কন্যা রূপবতী।।
তপ্তবর্ণ ‍যিনি তার শরীরের শোভা।
কলঙ্ক বিহীন কলানিধি মুখ-আভা।।
বিহঙ্গম-চঞ্চু জিনি বিরাজিত নাসা।
দশন-মুকুতাপাঁতি, সুমধুর ভাষা।।
মদনের ধনু জিনি তার যুগ্ম ভুরূ।
মৃণাল জিনিয়া বাহু, রামরম্ভা ঊরু।।
কুরঙ্গ-নয়নী ধনী, মনোহর কেশ।
মৃগেন্দ্র লজ্জিত হয় দেখি মধ্যদেশ।।
রূপের সমান তার গুণের গণনা।
শুদ্ধমতি সর্ব্বশাস্ত্রে অতি সে প্রবীণা।।
সুপ্রিয়বাদিনী সতী সর্ব্বভূতে দয়া।
অশ্বপতি হৃষ্টমতি দেখিয়া তনয়া।।
সাবিত্রী রাখিল নাম বিচারি তাহার।
সর্ব্বদা পবিত্রা কন্যা, পবিত্র আচার।।
দিনে দিনে বাড়ে কন্যা, পিতার মন্দিরে।
স্বচ্ছন্দে গমনে যায়, যথা ইচছা করে।।
সমান বয়স প্রিয়সখীগণ সাথে।
ভ্রমণ করয়ে সুখে চড়ি দিব্য রথে।।
বিশেষ, বাপের রাজ্যে কিছু নাহি ভয়।
উপনীত হৈলে গিয়া মুনির আলয়।।
বিবিধ কৌতুক দেখে অশ্বপতি-সুতা।
হেনকালে শুন রাজা অত্যাশ্চর্য্য কথা।।
দ্যুমৎসেন নামে অবন্তীর পতি।
শত্রু নিল রাজ্য, বনে করিল বসতি।।
তাহার নন্দন ছিল নাম সত্যবান।
রূপেতে নাহিক কেহ তাহার সমান।।
মুনিপুত্রগণ সহ আছিল ক্রীড়ায়।
সাবিত্রী থাকিয়া দূরে দেখিল তাহায়।।
কন্দর্প জিনিয়া রূপ কিশোর বয়স।
দেখিয়া নরেন্দ্রসুতা জিজ্ঞাসে বিশেষ।।
কাহার নন্দন এই, কহ মুনিগণ।
যার রূপে সমুজ্জ্বল এই তপোবন।।
বনবাসী জন কহে, কর অবধান।
দ্যুমৎসেনের পুত্র, নাম সত্যবান।।
সাবিত্রী শুনিয়া কথা হন হৃষ্টমতি।
মনেতে করিয়া তাঁরে কৈল নিজপতি।।
গৃহেতে আসিয়া তবে নৃপতির সুতা।
জননীর কাছে গিয়া রাণী কহে নৃপবরে।।
শুনিয়া কহিল রাজা দুঃখিত অন্তরে।
কোন্ বংশে জন্ম তার, কিবা তার ধর্ম্ম।।
না জানি কেমনে আমি করি হেন কর্ম্ম।
এইরূপে আছে রাজা নিরানন্দ মন।
এক দিন উপনীত ব্রহ্মার নন্দন।।
নারদ মুনিরে দেখি সুখী সর্ব্বজনে।
হৃষ্টমতি নরপতি মুনি আগমনে।।
বসালেন দিব্য সিংহাসনের উপর।
বেদের বিহিত স্তুতি করেন বিস্তর।।
আনন্দে বসিল সবে কথোপকথনে।
সহসা সাবিত্রী কন্যা আসে সেই স্থানে।।
কন্যা দেখি নৃপতিরে কহে তবে মুনি।
পরমা সুন্দরী এই কাহার নন্দিনী।।
অশ্বপতি বলে, মুনি কি কহিব আর।
অপত্য আমার এই কন্যামাত্র সার।।
মুনি বলে, সুলক্ষণা তোমার দুহিতা।
বিবাহ দিয়াছ, কিবা এ অবিবাহিতা।।
রাজা বলে, শিশুমতি অত্যল্প বয়স।
যোগ্যাযোগ্য ভালমন্দ, না জানি বিশেষ।।
বরিয়াছে মনে মনে কারে তপোবনে।
নিরূপণ নাহি জানি সন্দ আছে মনে।।
ভাল হৈল ভাগ্যবশে আসিলে আপনি।
ঘুচিল মনের ধন্দ ওহে মহামুনি।।
নারদ কহেন তবে সাবিত্রীর প্রতি।
কোন বংশে জন্ম তার, কাহার সন্ততি।।
সাবিত্রী কহিল, দেব মুনির আশ্রমে।
দ্যুমৎসেনের পুত্র সত্যবান নামে।।
নারদ কহিল, আমি জানি সর্ব্ব বার্ত্তা।
তাহা ছাড়ি তুমি মাগো বর অন্য ভর্ত্তা।।
সাবিত্রী কহিল, পূর্ব্বে বরিয়াছি মনে।
অন্যে বরি ভ্রষ্টা হব কিসের কারণে।।
মুনি বলে, দোষ নাই, শুন মোর কথা।
সাবিত্রী কহিল, মুনি না হবে অন্যথা।।
পুনঃ পুনঃ দোঁহাকার এই বাক্য শুনি।
ব্যস্ত হয়ে তাঁরে জিজ্ঞাসিল নৃপমণি।।
তাহার বৃত্তান্ত শুনি, কহ মুনিবর।
কি হেতু বরিতে বল অন্য কোন বর।।
কোন্ বংশে জন্ম তার কাহার নন্দন।
কহ শুনি মুনিবর ব্যস্ত বড় মন।।
নৃপতির মুখে শুনি এতেক বচন।
কহিতে লাগিল কৃপাবশে তপোধন।।
সূর্য্যবংশে শূরসেন রাজার সন্ততি।
দ্যুমৎসেন নামে রাজা অবন্তীর পতি।।
মহিমা সাগর মহারাজ গুণবান।
পৃথিবীতে নাহি শুনি তাঁহার সমান।।
খণ্ডন না যায় রাজা দৈবের নির্ব্বন্ধ।
কত দিনে নৃপতির চক্ষু হৈল অন্ধ।।
চক্ষুহীন শিশু পুত্র নাহি অন্য জন।
সময় পাইয়া রাজ্য নিল শত্রুগণ।।
ভার্য্যা পুত্র সঙ্গে করি করে বনবাস।
মহাক্লেশে আছে সবর্ব সুখেতে নিরাশ।।
বিচার করিয়া দেখ দৈবের সংযোগ।
শরীর ধরিলে হয় সুখ দুঃখ ভোগ।।
রাজা বলে, চরিতার্থ হৈনু তপোধন।
এই চিন্তা করি সদা নিরানন্দ মন।।
সুখ দুঃখ শরীরের সহযোগে জন্ম।
সময়ে প্রবল হয় আপনার কর্ম্ম।।
আপন ইচ্ছায় ভাল মন্দ কিছু নয়।
দৈবের সংযোগে সেই যখন যে হয়।।
বরযোগ্য বটে যদি সেই সত্যবান।
আজ্ঞা কর, কন্যাধনে করি তাঁরে দান।।
মুনি বলে, তাহে মানা করিতেছি আমি।
পুনঃ পুনঃ মোরে কেন জিজ্ঞাসহ তুমি।।
কুলে শীলে রূপে গুণে তোমা হৈতে শ্রেষ্ঠ।
সকল সুন্দর বটে, একমাত্র কষ্ট।।
আজি হৈতে যেই দিনে বর্ষ পূর্ণ হবে।
সেই দিন সত্যবান নিশ্চয় মরিবে।।
কহিনু ভবিষ্য কথা যদি লয় মনে।
যোগ্য দেখি কন্যাদান কর অন্য জনে।।
শুনিয়া মুনির মুখে এতেক ভারতী।
কহিতে লাগিল অশ্বপতি নরপতি।।
কদাচ কর্ত্তব্য মম নহে এই কর্ম্ম।
শিশুর ক্রীড়ায় নাহি কভু ধর্ম্মাধর্ম্ম।।
ধনে মানে কুলে শীলে হবে গুণবান।
বিচার করিয়া তারে দিব কন্যাদান।।
দোষ না থাকিবে তার, হবে রাজ্যেশ্বর।
এমত পাত্রেতে কন্যা দিব মুনিবর।।
কন্যা-দানকর্ত্তা পিতা আছে পূর্ব্বাপর।
তাহে যদি মনে নহে, হবে স্বয়ম্বর।।
আনাইব পৃথিবীর যত নৃপচয়।
দেখিয়া বরিবে কন্যা, যারে মনে লয়।।
কি হেতু বরিবে অল্প আয়ু সত্যবান।
বিশেষ বৈধব্য দুঃখ মরণ সমান।।
শুনিয়া দোঁহার মুখে এতেক ভারতী।
কৃতাঞ্জলি সাবিত্রী কহিছে গুণবতী।।
শুনহ জনক মম সত্য নিরূপণ।
কদাপি নয়নে নাহি হেরি অন্য জন।।
যখন মানসে তাঁরে বরিয়াছি আমি।
জীবনে মরণে সেই সত্যবান স্বামী।।
বৈধম্য যন্ত্রণা যদি থাকে মোর ভোগ।
খণ্ডণ না যাবে পিতা, দৈবের সংযোগ।।
অনিত্য সংসার এই, অবশ্য মরণ।
না মরিয়া চিরজীবী আছে কোন্ জন।।
মৃত্যুর উৎপত্তি দেখ শরীরের সাথে।
আজি কিম্বা কালি কিম্বা শত বৎসরেতে।।
অসার সংসার মাত্র, আছে এক ধর্ম্ম।
কিমতে তাহারে ছাড়ি করি অন্য কর্ম্ম।।
ধিক্ ধিক্ কিবা ছার সুখ অভিলাষ।
ধর্ম্ম ছাড়ি অধর্ম্মে যে করে সুখ আশ।।
কি করিবে সুখ পিতা, কত কাল জীব।
কুকর্ম্মে আজন্মকাল নরকে থাকিব।।
এত শুনি ধন্য ধন্য করি তপোধন।
আশীর্ব্বাদ করি যান নিজ নিকেতন।।
অশ্বপতি দুঃখ অতি পাইল অন্তরে।
কহিল অনেক কথা সাবিত্রীর তরে।।
বুঝাইল নরপতি বিবিধ বিধান।
সাবিত্রী কহিল, মোর পতি সত্যবান।।
ভারত-পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালী প্রবন্ধে রচে কাশীরাম দাস।।