১০৬. সীতা হরণ ও শ্রীরামের পঞ্চ বানর ও বিভীষণের সহিত মিলন

হেনকালে আসি তথা রাবণ দুর্জ্জয়।
হরিয়া লইল সীতা দেখি শূন্যালয়।।
শীঘ্র চালাইল রথ, শ্রীরামের শঙ্কা।
পলায় পরাণ লয়ে যথা পুরী লঙ্কা।।
পরিত্রাহি ডাকে সীতা, রাম রাম বলি।
চিহ্ন হেতু স্থানে স্থানে অলঙ্কার ফেলি।।
জটায়ু নামেতে পক্ষী দশরথ সখা।
যুদ্ধ কৈল, রাবণ কাটিল তার পাখা।।
পড়িয়া রহিল পথে পক্ষী পুরাতন।
লঙ্কাপুরী প্রবেশিল ক্রমে দশানন।।
রাবণ বিনয় করি সীতারে বুঝায়।
কৃপা করি দেবী তুমি ভজহ আমায়।।
সীতা বলে, মম প্রভু রাম বিনা ‍নাই।
কত দিনে সবংশে মজিবে তাঁর ঠাঁই।।
ইহা শুনি বন্দী কৈল ‍অশোক কাননে।
রক্ষক রহিল চেড়ী শত শত জনে।।
হেথা মৃগ মারি ‍রাম আশ্রমে আসিতে।
লক্ষ্মণ সহিত তবে দেখা হৈল পথে।।
শ্রীঘ্রগতি আশ্রমে আসিয়া দুই বীর।
শূন্যালয় দেখি দোঁহে হলেন অস্থির।।
অনেক বিলাপ করি দুই সহোদর।
অন্বেষণ করিবারে চলেন সত্বর।।
শোকাকুল হয়ে ভ্রমে কাননে কাননে।
জিজ্ঞাসেন ডাকি রাম তরু লতাগণে।।
ত্যজিয়া আহার জল আলস্য শয়ন।
এইমতে দুই ভাই করেন ভ্রমণ।।
সীতার কঙ্কণ এক ছিল সেই পথে।
তুলিয়া নিলেন রাম কান্দিতে কান্দিতে।।
যত দূর চিহ্ন পান বসন ভূষণ।
সেই অনুসারে দোঁহে করেন গমন।।
দেখিলেন রাম জটায়ুকে মৃতবৎ।
পর্ব্বত প্রমাণ পক্ষী যুদ্ধেতে আহত।।
তাহার নিকটে চলিলেন দুই জন।
জটায়ু তুলিল মুণ্ড জানিয়া কারণ।।
জিজ্ঞাসিতে পক্ষিরাজ কহিলেক কথা।
লঙ্কাপুরী দশানন হরি নিল সীতা।।
অরুণ-নন্দন আমি তব পিতৃসখা।
বধূর অবস্থা দেখি যুদ্ধে আসি একা।।
অনেক করিনু যুদ্ধ করি প্রাণপণ।
হত পাখা হল শেষে বধূর কারণ।।
তোমারে সংবাদ দিতে আছিল জীবন।
উদ্ধার করিও রাম এই নিবেদন।।
এতেক বলিয়া পক্ষী ত্যজিল জীবন।
জানিয়া পিতার সখা ভাই দুই জন।।
অগ্নিকার্য্য করি তার পম্পা নদীতটে।
তথা হৈতে যান ঋষ্যমূকের নিকটে।।
তথায় দেখেন পঞ্চ বানর প্রধান।
সুষেণ সুগ্রীব নল নীল হনূমান।।
দোঁহারে প্রণাম করি জিজ্ঞাসে সম্ভ্রমে।
শ্রীরাম সকল কথা কহিলেন ক্রমে।।
সুগ্রীব জানিল, এই পুরুষ রতন।
প্রণাম করিয়া করে নিজ নিবেদন।।
মোর জ্যেষ্ঠ বালি হয়, রাজ্য অধিকারী।
বলে রাজ্য নিল, আমি যুদ্ধেতে না পারি।।
মুনিশাপে আসে হেথা, তার শক্তি নাই।
সে কারণে আছি প্রাণে, শুনহ গোঁসাই।।
রাম বলে, আজি হৈতে তুমি মোর মিতা।
তব রাজ্য দিব আমি, তুমি দিবে সীতা।।
সুগ্রীব বলিল, তবে যে আজ্ঞা তোমার।
সীতা উদ্ধারিতে প্রভু হৈল মোর ভার।।
শ্রীরাম কহেন, কালি প্রত্যূষ সময়।
বালিকে মারিয়া রাজা করিব তোমায়।।
হেনমতে রঘুনাথ বালিরাজা মারি।
সুগ্রীবের করিলেন রাজ্য অধিকারী।।
চারি মাস সেই স্থানে রহে রঘুনাথ।
কপিরাজ সুগ্রীবের লয়ে তবে সাথ।।
সমুদ্রের তীরে যান সৈন্য সমাবেশে।
হনূমানে পাঠাইল সীতার উদ্দেশে।।
পবন নন্দন বীর পোড়াইল লঙ্কা।
রাজপুত্রে মারি বীর নৃপে দিল শঙ্কা।।
সীতার উদ্দেশ করি আসে মহাবীর।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ তাহে হইলেন স্থির।।
হেনকালে শুন রাজা দৈব বিবরণ।
রাবণ অনুজ ধর্ম্মশীল বিভীষণ।।
করযোড় করি নৃপে কহে বিধিমতে।
সীতা দিয়া শরণ লইতে রঘুনাথে।।
ধন রাজ্য বংশ বৃদ্ধি কর নরপতি।
শুনিয়া রাবণ ক্রোধে মারিলেক লাথি।।
যেইকালে বিভীষণে প্রহারে চরণে।
রাজ্যলক্ষ্মী আশ্রয় করিল বিভীষণে।।
অতি দুঃখে বহির্গত হৈল বিভীষণ।
রামের চরণে গিয়া লইল শরণ।।
শ্রীরাম কহেন, তুমি শত্রু সহোদর।
কিরূপে বিশ্বাস তোমা করিবে অন্তর।।
বিভীষণ বলে, প্রভু মনে ভাব যদি।
তোমার সেবক আমি জনম অবধি।।
ইথে অন্যমত যদি করি কদাচন।
হইব কলির রাজা, কলির ব্রাহ্মণ।।
কলিতে জন্মিব, আর জীব দীর্ঘকাল।
শুনিয়া রামের হৈল আনন্দ বিশাল।।
লক্ষ্মণ কহেন হাসি করি যোড়কর।
উত্তম করিল দিব্য রাক্ষস ঈশ্বর।।
তপস্যা করিয়া চিরকাল যাহা পায়।
পরদ্রোহ করিয়া এ সব যদি হয়।।
ইহা ছাড়ি অন্য বাঞ্ছা করে কোন্ জন।
হাসিয়া কহেন রাম, বালক লক্ষ্মণ।।
কলিতে ব্রাহ্মণ রাজা দীর্ঘজীবী জন।
এই তিনে পরিত্রাণ নাহি কদাচন।।
করিল কঠোর দিব্য রাক্ষসের পতি।
না বুঝি হাসিলে ভাই, তুমি শিশুমতি।।
আজি হৈতে মিত্র মম হৈল বিভীষণ।
তোমারে অর্পিব লঙ্কা মারিয়া রাবণ।।
বিচার করিল তিনজন এই মত।
ল্ঙ্কায় গমনে সবে হলেন ‍উদ্যত।।
বানর সকলে সিন্ধু বান্ধে অবহেলে।
পাষাণ ভাসিল রাজা সাগরের জলে।।
বান্ধে নল জলনিধি রাম উপরোধে।
কটক সকলে পার হয়ে কার্য্য সাধে।।