কখনো সখনো যে চা-খানায় চা খেতে যাই কিংবা কিছু সময় কাটাতে,
সেখানেই তার সঙ্গে দেখা।
বলা কওয়া নেই,
লোকটা গ্যাট হয়ে বসে আমার মুখোমুখি।
কোনো কোনো মানুষ আছে
যাদের দেখলেই মনে পড়ে পাখির কথা।
লোকটা সে ধরনের একজন মানুষ।
কেন জানি না,
তাকে মনে হলো একটা দাঁড়কাকের মতো,
যদিও এই বিশেষ প্রাণীটির সঙ্গে তার কোনো মিল আমি খুঁজে
বের করতে পারি নি।
লক্ষ করলাম, ওর ভুরুতে বনস্থলির শ্যামলিমা,
হাতের নোংরা নখ থেকে বেরিয়ে এসেছে
গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর লালিমা,
ঠোঁটে সমুরদ্রতটের নুন, চোখে
কবরের ভেতরকার রহস্য।
সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল,
সে এসেছে পৃথিবীর শেষ প্রান্ত থেকে।
আমার চায়ের আমন্ত্রণ প্রত্যাখান করে
লোকটা তাকালো রাস্তার দিকে,
তারপর বলতে শুরু করলো একটি কাহিনী;
আমি শুনতে চাই কিনা সে-কথা জানতেও চাইলো না।
কথার বড়শি দিয়ে সে গেঁথে ফেললো আমাকে।
কার সাধ্য সেই বড়শি থেকে ছাড়া পায়?
তার কথা বলার ধরণ থেকে
ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো আমার কাছে যে,
সে এক প্রাচীন ভ্রমণকারী,
নানা ঘাটের পানি-খাওয়া।
ওর গলায় বহু অভিজ্ঞতার মিশ্র স্বর,
এক চিত্ত-আলোড়নকারী ঐক্যতান। আমার
ওপর দিয়ে বয়ে গেল ঢেউয়ের পর ঢেউ।
বিচিত্র মসলার ঘ্রাণে ভরে উঠলো সেই চা-খানা, অনুভব
করলাম পাখির বুকের উত্তাপ, সুদূরতম দ্বীপের ওপর বয়ে-যাওয়া
হাওয়ার ঝলক, ঝরণার স্বচ্ছ জলের শীতলতা।
সে তার কাহিনী শুরু করলো এভাবে এভাবে-
এক ঝাঁক দাঁড়কাক এসে বসলো উঁচু দেয়ালে,
যেন পুঞ্জ পুঞ্জ হিংসা। ওদের পাখায়
লেখা আছে, একটা শব্দ, প্রতিশোধ।
দাঁড়াকাকগুলো দশদিক চমকে দিয়ে চিৎকার করতে শুরু করলো,
আশে পাশে ছড়িয়ে পড়লো কুচকুচে কালো রঙ।
দাঁড়কাকদের গলা সেই রঙের উৎস।
একে একে ওরা উড়ে গেল প্রাসাদটির প্রতি, ফিরে এল
একটু পরে; ফের হানা দিলো সবাই এক সঙ্গে।
চঞ্চুর আঘাতে আঘাতে ওরা ছিঁড়ে খুঁড়ে
ফেলতে চাইলো ফটকটিকে।
প্রাসাদের ভেতরে ঢুকে ওরা ভেতরকার রহস্য জেনে নিতে চায়,
জেনে নিতে চায় এমন কী আছে প্রাসাদের ভেতরে
যা রাখতে হবে সবার চোখের আড়ালে?
মোদ্দা কথা, ওরা প্রাসাদটিকে দখল করতে চায়।
কিন্তু আপাদমস্তক দামি ধাতুতে মোড়া প্রহরীদের বন্দুকের ধমকে ওরা
ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো, কালো কালো ছেঁড়া পালকে
ছেয়ে গেল চারদিক, দাঁড়কাকগুলো রাশি রাশি মন্ডের
মতো পড়ে রইলো।
ফটক ছিদ্র করবার মতো শক্তিমান ছিল না ওদের চঞ্চু।
আর ওরা অন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রহরীদের বর্মের ঝলসানিতে।
প্রহরীরা বীরদর্পে দাঁড়কাকের শবের ওপর
কুচকাওয়াজ করলো কিছুক্ষণ;
কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
দাঁড়কাকদের পরাজয়ের পর দিন যায়, দিন যায়।
সময়ের ঠোকরে চিড় ধরে না প্রাসাদের প্রাচীরে,
খোলে না ফটক। খুললেও কারো
প্রবেশাধিকার নেই সেখানে,
শুধুমাত্র নির্বাচিতরাই যেতে পারে ভেতরে। যারা যায়
তারা আর ফিরে আসে না। প্রাসাদের প্রাচীরে কিংবা গম্বুজে
কাকপক্ষীও বসতে পারে না। দামি ধাতুতে মোড়া প্রহরীরা
অষ্ট প্রহর প্রস্তুত। একটা পিঁপড়ে ওদের চোখ এড়িয়ে যাবে,
এমন ফাঁকফোকর ওরা রাখেনি কোথাও। প্রাসাদ আছে
প্রাসাদের হালে, কখনো কখনো
ভেতর থেকে ভেসে আসে নানা বাদ্যরব,
নর্তকীদের মঞ্জীর ধ্বনি,
ফটকের বাইরে সকাল সন্ধ্যা বর্মাবৃত প্রহরীরা
করে কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
হঠাৎ একদল শিম্পাঞ্জী সেই প্রাসাদের ওপর
চড়াও হলো একদিন। কিন্তু ওদের উৎপাত
স্তব্ধ হয়ে গেল এক পশলা বুলেটে। একটা আঁচড়ও
লাগলো না প্রাসাদের গায়ে।
পরাভূত শিম্পাঞ্জীদের অনেকেই
বেঘোরে প্রাণ হারালো, যারা বেঁচে
রইলো তাদের বেঁচে না থাকাই ছিল ভালো।
কেউ হারালো হাত, কেউ পা, কেউ কেউ
হাত-পা দু’টোই। প্রহরীদের বর্মে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে,
ঝলসিত হয় চতুর্দিক। শিম্পাঞ্জীদের
শক্রর ওপর প্রহরীরা বীরদর্পে কুচকাওয়াজ
করলো কিছুক্ষণ;
কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
শিম্পাঞ্জীদের পরাজয়ের পর দিন যায়, দিন যায়।
পূর্ব দিকে সূর্য ওঠে, পশ্চিমে অস্ত যায়।
গাছে পাতা গজায়, পাতা ঝরে যায়।
প্রাসাদ থাকে প্রাসাদের হালে; ঝকঝক করে
সূর্যের আলোয়, অন্ধকারকে শাসন করে নিজস্ব আলোর ছটায়।
শোনা যায়, প্রাসাদের ভেতরে বারো মাস তেরো পার্বণ
কাটে প্রায় একই ভাবে, একই তালে লয়ে। মাঝে-মাঝে
গুঞ্জন রটে বাইরে।
গুজব, গুজবই। তাই ওসব নিয়ে
মাথা ঘামানোর লোকের সংখ্যা কম। প্রহরীরা
টহল দিয়ে বেড়ায় প্রাসাদের চারদিক। দিনভর, রাতভর।
কোনো কিছু নড়তে চড়তে দেখলেই বলে, ‘হল্ট’
সহজে কেউ ঘেঁষে না ফটকের কাছে, দূর থেকে
তাকায় আড় চোখে। লোকে বলে,
কোনো কোনো মধ্যরাতে প্রাসাদের প্রাচীরগুলি
ডুকরে ওঠে ট্রয় নগরীর রমণীদের বিলাপের মতো।
শিম্পাঞ্জীদের পরাজয়ের বহু বছর পরে
শত শত লোক ছুটে এল প্রাসাদের দিকে
লাঠিসোঁটা আর দা-কুড়াল নিয়ে।
মনে হলো জন বন্যায় দেশলাইয়ের বাক্সের মতো
ভেসে যাবে প্রাসাদ। কিন্তু ঝাঁক ঝাঁক
বুলেট আর কামানের গোলায় বন্যার
গতি হলো রুদ্ধ, মৃত্যু এলোপাতাড়ি
উপড়ে নিলো বহু প্রাণশস্য।
যারা এসেছিল প্রাসাদের প্রাচীর চুরমার করার জন্যে,
ব্যর্থ হলো তারা।
ওরা এসেছিল একটা সূর্যোদয়ের জন্যে ফিরে গেল
অস্তিত্বময় অমাবস্যা নিয়ে। তখন আমি
জ্বল জ্বলে যুবক, সবেমাত্র কুড়ি পেরিয়েছি।
আমার হাতের মুঠোয় স্বপ্নের চারাগাছ, চোখে
সামুদ্রিক ঢেউয়ের ঝাপটা, আমার সত্তায় ভবিষ্যতের লাবণ্য।
যাকগে, মানুষের সেই পরাজয় আমি প্রত্যক্ষ করেছি।
এত লাশ আমি এর আগে দেখি নি।
চোখে জ্বালা ধরে যায়।
মৃতদেহে এত আগুন, কে জানতো? চোখ পড়ে যায়।
কেউ কেউ বাঁচলো পালিয়ে, কিন্তু সেই
বাঁচার চেয়ে মরাই ছিল ভালো।
আসল পা ছেড়ে কাঠের পা নিয়ে কে বাঁচতে চায়?
কে চায় হুইল চেয়ারে বসে ঝিমোতে? চোখের জ্যোতি হারিয়ে
দিন যাপনের গ্লানি সইতে কে চায়? প্রিয় সঙ্গীর
মুণ্ডুহীন ধড় দেখার পর কেউ সুস্থ, স্বাভাবিক
জীবনের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে কি? আপাদমস্তক
দামি ধাতুতে মোড়া প্রহরীরা
মানুষের লাশের ওপর কুচকাওয়াজ করলো কিছুক্ষণ;
কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ, কুচকাওয়াজ।
সেই পরাস্ত লোকগুলোর মধ্যে ছিল একজন জিপসি।
বেখাপ্পা তার জীবনযাত্রা, অদ্ভুত তার আচরণ।
ওরা পালিয়ে এসে ডেরা বাঁধলো বহুদূরে, নদীতীরে। লোকগুলো
বসেছিল গোল হয়ে ফ্রেস্কোর মণ্ডলের মতো
কারো মাথায় ব্যান্ডেজ,
কারো উড়ে-যাওয়া পায়ে ব্যান্ডেজ,
কারো চোখে ব্যান্ডেজ।
জিপসিটা বললো, মনমরা হয়ে থেকো না তোমরা,
যারা একদিন বীরের মতো প্রবেশ করবে সেই প্রাসাদে
আপাদমস্তক দামি ধাতুতে মোড়া প্রহরীদের
পরাস্ত করে তারা বাড়ছে গোকুলে।
ওরা কারা? জানতে চাইলো সবাই। জানি না,
তবে ওরা আসবে,
দূর দিগন্তের দিকে দৃষ্টি মেলে উত্তর দিলো সেই জিপসি।
কবে আসবে সেদিন?
একটা গুঞ্জন উঠলো আহত লোকগুলোর মধ্যে।
সেই বিজয়ের দিন কবে আসবে? এই প্রশ্ন তীরের মতো
ছুটে গেল জিপসির দিকে। জিপসির চোখে কী একটা
ছায়া দুলে ওঠে যেন,
আকাশে ঝুলে আছে
যুদ্ধে হারিয়ে-যাওয়া চোখের মতো চাঁদ।
জিপসি স্বপ্নঝলসিত কণ্ঠে বলে, বিজয়ের নির্ধারিত কোনো
তারিখ নেই।
এটুকু বলে থামলো আমার
মুখোমুখি বসে থাকা লোকটা।
জিপসির সেই বাণী,
বিজয়ের নির্ধারিত কোনো তারিখ নেই
গুঞ্জরিত হতে থাকলো চা-খানায়,
যেন শুনতে পেলাম আমি।
হঠাৎ দাঁড়কাকের মতো লোকটা চেয়ার ছেড়ে
উঠে দাঁড়ালো, রওনা হলো রাস্তার দিকে। আমি তাকে
ডাকলাম, কিন্তু সে ফিরে তাকালো না পর্যন্ত। যেন আমি
কোনো ধর্তব্যের মধ্যেই নেই। লোকটার,
হাঁটার ভঙ্গিতে কোনো স্বাভাবিকতা ছিল না। খট খট করে
একটা শব্দ হচ্ছিলো। তখুনি
প্রথম বারের মতো লক্ষ করলাম, লোকটার
একটা পা কাঠের। আর
সেই কাঠের পা থেকেই
বিজয়ের কোন নির্ধারিত তারিখ নেই শব্দগুচ্ছ
মঞ্জরিত হয়ে চা-খানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়লো চরাচরে।