আজ এই চমৎকার গোধূলিতে একটি কবিতা
লিখতে গিয়ে ভাবছি,
আমার পংক্তিমালাকে খানিকটা ধোপদূরস্ত
হতে হবে। নাটকের কুশীলবদের মতো ওদের ঘাড়ে মুখে
কিছু পাউডার ঘসে, সারা গায়ে পারফিউম
ছিটিয়ে নেওয়াটাই কেতা। আপনারা যারা
আমার শব্দাবলীর ওপর আলতো বুলিয়ে যাবেন চোখ
অপমান করার ভঙ্গিমায়, তারা মাননীয় বুর্জোয়া;
পাতি বুর্জোয়া। যদি শব্দগুলোর পিঠে ঘোড়া বাগানো
কোড়া মারেন ঘন ঘন, ওরা ট্যা ফো করবে না।
প্রশ্ন করতে পারেন, ‘তুমি কি বাপু সাধুসন্ত কেউ?’ মোটেই না;
আমার মাথার ভেতরে
সুড়ঙ্গ কেটে ঢুকে পড়েছে বৈবাগ্য,
এ-কথা মনে করারও কারণ নেই। খুলেই বলি,
আমাকে এমন এক ব্যামো
কাঁকড়ার মতো আঁকড়ে ধরেছে যে,
দিনানুদৈনিক ভাষায় কিছু একটা উগরে না দিলে
অসহ্য লাগে আমার, নিজেই নিজের মাংস ছিঁড়তে ইচ্ছা করে।
জীবন এমন একটি গাছ, যার ডালে বসে
পা দোলাতে, পাতায় চুমো খেতে
অথবা শ্রাবণ সন্ধ্যায় বৃষ্টির মুক্তো মাথা পেতে নিতে,
আঁজলা উপচে-পড়া জ্যোৎস্না পান করতে
খুব ভালো লাগে। জানেনই তো
এই গাছের ডাল থেকে খ’সে সেই অজ্ঞাতলোকে
একবার যদি চলে যাই, আর
ফেরা হবে না কস্মিনকালেও। তাই, শত চড়াই-উৎরাই
পেরিয়ে টিকে থাকাটাই একটা দারুণ খেলা।
মাঝে-মধ্যে ধারালো নখ দিয়ে
জীবনের দাঁত খুঁটে
গোবেচারা উপহার হাতে প্রিয়জনের জন্মদিনে হাজির হই।
না ভাই, আমি সেই রুবিদের দলে নই, যাঁরা
ফুলবাবু সেজে বঙ্গভবনের দরবারে
কবিতা আবৃত্তি করতে যান। ওঁরা আবৃত্তি করেন
মাদী কবিতা, হিজড়ে কবিতা, টেবো কবিতা,
মার কাটারি কবিতা, ধান্দাবাজ কবিতা, ঠগী কবিতা,
ঢ্যাঙা গাল-তোবড়ানো কবিতা, চিমড়ে কবিতা।
কী করে হাসতে হয়, লোক হাসাতে হয়, কেমন করে
পা ফেলতে হয় রঙিন গালিচায়, আমলাদের
সঙ্গে আমড়াগাছি করতে হয়, দৃষ্টি হানতে হয়
প্রসাধনধন্য সুন্দরীদের দিকে আর বড়-মেজো সেজো
দেবতাদের ফেলে-দেওয়া থুতু চেটে তুলে নিতে হয় সৌজন্যবশত,
এসব কায়দা তাঁরা রপ্ত করেছেন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে।
সেই মাননীয় কবিদের সিংহ দরজায়
কার্ড দেখিয়ে ঢুকতে হয় দরবারে এবং রাষ্ট্রপতির
সঙ্গে একই মঞ্চ থেকে পদ্য পড়ার ভাবনায়
তাঁরা আহ্লাদে আটখানা অষ্টপ্রহর। সেই কবিকুল
এমন এক সিঁড়ি বানাচ্ছেন যা বেয়ে তরতরিয়ে
সোজা জান্নাতুল ফেরদৌস। আগাম ঝিলিক
এখন তাঁদের চোখে মুখে
তারার ঝকমকানি।
ভয় নেই, কল্পনাশক্তির অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও
আস্তাকুঁড়কে ঝুলন্ত স্বর্গোদ্যান ভেবে
পদ্য আওড়াতে শুরু করবো না অকাল-বসন্তে।
আমার এই বেহুদা উচ্চারণকে পাতি বুর্জোয়া মনের
বিকার বমন ঠাউরে নিয়ে
আমাকে চলতে দিন আমার পথে,
যে-পথে হাজার হাজার বেকার আর খাদ্যান্বেষী মানুষের ভিড়।
বস্তুত আমি এখন
স্বর্গ আর নরকের মাঝখানে ঝুলছি। স্বীকার করি,
আমার এই অবস্থান ভীষণ অস্বস্তিকর এবং
এ-কথা বলতে আমার লজ্জা নেই, আমি চাই না
আমার কবিতা রূপজীবিনীর মতো কোমর দুলিয়ে
দম আটকে মরুক বুর্জোয়া ঠাসা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত
দরবারে, বরং আমি চাই
আমার কবিতা যেন নেরুদা অথবা
নাজিম হিকমতের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে
দুরন্ত হাওয়ায়, খোলা পথে, সবুজ মাঠে, সড়কদ্বীপের
জনসমুদ্রে, যেন সামিল হতে পারে সুস্থ, সবল সোনার টুকরো
আগামী প্রজন্মের কাতারে, আজকের
মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারে নিষ্কলুষ নতুন সভ্যতার।