পরিশিষ্ট

চিড়িয়াখানা – ৬

ছয়

রাস্তা দিয়া চলিতে চলিতে নিশানাথবাবুকে প্রশ্ন করিলাম,—‘আচ্ছা, নেপালবাবুরা কতদিন হল এখানে এসেছেন?’

নিশানাথ বলিলেন,—‘প্রায় দু’বছর আগে। এক-আধ মাস কম হতে পারে।’

মনে মনে নোট করিলাম, সুনয়না প্রায় ঐ সময় কলিকাতা হইতে নিরুদ্দেশ হইয়াছিল। জিজ্ঞাসা করিলাম,—‘ঠিক ঠিক সময়টা মনে নেই?’

নিশানাথ চিন্তা করিয়া বলিলেন,—‘দু’বছর আগে, বোধহয় সেটা জুলাই মাস। মনে আছে, আমার স্ত্রী লেখাপড়া ছেড়ে দেবার দু’-তিন দিন পরেই ওরা এসেছিল।’

‘আপনার স্ত্রী—লেখাপড়া—’

‘আমার স্ত্রীর মাঝে লেখাপড়া আর বিলিতি আদবকায়দা শেখবার শখ হয়েছিল। মাস আষ্টেক-দশ নিয়মিত কলকাতা যাতায়াত করেছিলেন, একটা বিলিতি মেয়ে-স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পোষালো না। উনি স্কুল ছেড়ে দিয়ে বাড়ি এসে বসবার দু’-তিন দিন পরে নেপালবাবু মুকুলকে নিয়ে উপস্থিত হলেন।’

সংবাদটি হজম করিয়া পূর্ব-প্রসঙ্গে ফিরিয়া গেলাম,—‘নেপালবাবু কলোনীর কোন্ কাজ করেন?’

নিশানাথ অম্লতিক্ত হাসিলেন,—‘বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেন, দাবা খেলেন, আর সব কাজে আমার খুঁত ধরেন।’

‘আপনার খুঁত ধরেন?’

‘হ্যাঁ, আমি যে-ভাবে কলোনীর কাজ চালাই ওঁর পছন্দ হয় না। ওঁর বিশ্বাস, ওঁর হাতে পরিচালনার ভার দিলে ঢের ভাল চালাতে পারেন।’

‘উনি তাহলে কোনও কাজই করেন না?’

একটু নীরব থাকিয়া নিশানাথ বলিলেন,—‘মুকুল খুব কাজের মেয়ে।’

মুকুল কাজের মেয়ে হইতে পারে; পিতার নৈষ্কর্ম সে নিজের পরিশ্রম দিয়া পুরাইয়া দেয়। কিন্তু আমরা আসিব শুনিয়া তাহার মাথা ধরিল কেন? এবং জানালা দিয়া লুকাইয়া আমাদের পর্যবেক্ষণ করিবারই বা তাৎপর্য কি?

মোড়ের কাছে আসিয়া পৌঁছিলাম। সামনে পিছনে রাস্তা চলিয়া গিয়াছে, রাস্তার ধারে দূরে দূরে কয়েকটি কুঠি (নক্সা পশ্য)। কুঠিগুলির ব্যবধানস্থল পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছে গোলাপ ও অন্যান্য ফুলের গাছ। প্রচুর জলসিঞ্চন সত্ত্বেও ফুলগাছগুলি মুহ্যমান।

মোড়ের উপর দাঁড়াইয়া নিশানাথ পিছনের কুঠির দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিলেন,—‘সবশেষের কুঠিতে রসিক থাকে। তার এদিকের কুঠি ব্রজদাসের। ঐ যে ব্রজদাস বারান্দায় বসে কি করছে।’

তিনি সেইদিকে আগাইয়া গেলেন,—‘কি হে ব্রজদাস, কি হচ্ছে?’

কুঠির বারান্দায় একটি প্রবীণ ব্যক্তি মাটিতে বসিয়া একটা হামান্‌দিস্তা দুই পায়ে ধরিয়া কিছু কুটিতেছিলেন। বেঁটে গোলগাল লোকটি, মাথায় পাকা চুলের বাব্‌রি, গলায় কণ্ঠি, কপালে হরিচন্দনের তিলক। নিশানাথের গলা শুনিয়া তিনি সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং হাস্যমুখে বলিলেন,—‘একটা গরু রুগিয়েছে, তার জন্যে জোলাপ তৈরি করছি,—নিমের পাতা, তিলের খোল আর এন্ডির বিচি।’

‘বেশ বেশ। যদি পারো প্রফেসার গুপ্তকে একটু খাইয়ে দিও, উপকার হবে।’ বলিয়া নিশানাথ ফিরিয়া চলিলেন।

বৈষ্ণব ব্রজদাস মিটিমিটি হাসিতে হাসিতে দাঁড়াইয়া রহিলেন। তাঁহার চক্ষু দুটি কিন্তু বৈষ্ণবোচিত ভাবাবেশে ঢুলু ঢুলু নয়, বেশ সজাগ এবং সতর্ক। দুইজন আগন্তুককে দেখিয়া তাঁহার চক্ষে যে জিজ্ঞাসা জাগিয়া উঠিল তাহা তিনি মুখে প্রকাশ করিলেন না। নিশানাথও পরিচয় দিলেন না।

ফিরিয়া চলিতে চলিতে নিশানাথ বলিলেন,—‘ব্রজদাস চিরকাল বৈষ্ণব ছিল না। ও বৈষ্ণব হয়ে গরু-বাছুরগুলোর ভারী সুখ হয়েছে। বড় যত্ন করে, গো-বদ্যির কাজও শিখেছে। গো-সেবা বৈষ্ণবের ধর্ম কিনা।’

নিশানাথবাবুর কথার মধ্যে একটু শ্লেষের ছিটা ছিল। প্রশ্ন করিলাম,—‘উনি বৈষ্ণব হওয়ার আগে কী ছিলেন?’

নিশানাথ বলিলেন,—‘জজ-সেরেস্তার কেরানি। ওকে অনেকদিন থেকে জানি। মাইনে বেশি পেত না কিন্তু গান-বাজনা ফুর্তির দিকে ঝোঁক ছিল। সেরেস্তার কেরানিরা উপরি টাকাটা সিকেটা নিয়েই থাকে। কিন্তু ব্রজদাস একবার একটা গুরুতর দুষ্কার্য করে বসল। ঘুষ নিয়ে দপ্তর থেকে একটা জরুরী দলিল সরিয়ে ফেলল।’

‘তারপর?’

‘তারপর ধরা পড়ে গেল। ঘটনাচক্রে আমিই ওকে ধরে ফেললাম। আদালতে মামলা উঠল, আমাকে সাক্ষী দিতে হল। ছ’বছরের জন্যে ব্রজদাস শ্রীঘর গেল। ইতিমধ্যে আমি চাকরি ছেড়ে কলোনী নিয়ে পড়েছি, জেল থেকে বেরিয়ে ব্রজদাস সটান এখানে এসে উপস্থিত। দেখলাম, একেবারে বদলে গেছে; জেলের লাপ্‌সি খেয়ে খাঁটি বৈষ্ণব হয়ে উঠেছে। আমি সাক্ষী দিয়ে জেলে পাঠিয়েছিলাম সেজন্যে আমার ওপর রাগ নেই বরং কৃতজ্ঞতায় গদ্গদ। সেই থেকে আছে।’

বলিলাম,—‘বৃদ্ধা বেশ্যা তপস্বিনী।’

নিশানাথ একটু নীরব থাকিয়া বলিলেন,—‘ঠিক তাও নয়। ওর মনের একটা পরিবর্তন হয়েছে। আধ্যাত্মিক উন্নতির কথা বলছি না। তবে লক্ষ্য করেছি ও মিথ্যে কথা বলে না।’

কথা বলিতে বলিতে আমরা আর একটা কুঠির সম্মুখে আসিয়া পৌঁছিয়াছিলাম, শুনিতে পাইলাম কুঠির ভিতর হইতে মৃদু সেতারের আওয়াজ আসিতেছে। আমার সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে নিশানাথ বলিলেন,—‘ডাক্তার ভুজঙ্গধর। ওর সেতারের শখ আছে।’

রমেনবাবু একাগ্র মনে শুনিয়া বলিলেন,—‘খাসা হাত। গৌড়-সারঙ বাজাচ্ছেন।’

ডাক্তার ভুজঙ্গধর বোধহয় জানালা দিয়া আমাদের দেখিতে পাইয়াছিলেন, সেতারের বাজনা থামিয়া গেল। তিনি বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইলেন, বলিলেন,—‘একি মিস্টার সেন, রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে কেন? রোদ লাগিয়ে ব্লাড্-প্রেসার বাড়াতে চান?’

ডাক্তার ভুজঙ্গধরের বয়স আন্দাজ চল্লিশ, দৃঢ় শরীর, ধারালো মুখ। মুখের ভাব একটু ব্যঙ্গ-বঙ্কিম; যেন বুদ্ধির ধার সিধা পথে যাইতে না পাইয়া বিদ্রূপের বাঁকা পথ ধরিয়াছে।

নিশানাথ বলিলেন,—‘এঁদের বাগান দেখাচ্ছি।’

ডাক্তার বলিলেন,—‘বাগান দেখাবার এই সময় বটে। তিনজনেরই সর্দিগর্মি হবে তখন হ্যাঁপা সামলাতে হবে এই নাম-কাটা ডাক্তারকে।’

‘না, আমরা এখনি ফিরব। কেবল বনলক্ষ্মীকে একবার দেখে যাব।’

ডাক্তার বাঁকা হাসিয়া বলিলেন,—‘কেন বলুন দেখি? বনলক্ষ্মী বুঝি আপনার বাগানের একটি দর্শনীয় বস্তু, তাই এঁদের দেখাতে চান?’

নিশানাথ সংক্ষেপে বলিলেন,—‘সেজন্যে নয়, অন্য দরকার আছে।’

‘ও—তাই বলুন—তা ওকে ওর ঘরেই পাবেন বোধহয়। এত রোদ্দুরে সে বেরুবে না, ননীর অঙ্গ গলে যেতে পারে।’

‘ডাক্তার, তুমি বনলক্ষ্মীকে দেখতে পার না কেন বল দেখি?’

ডাক্তার একটু জোর করিয়া হাসিলেন,—‘আপনারা সকলেই তাকে দেখতে পারেন, আমি দেখতে না পারলেও তার ক্ষতি নেই। —সে যাক, আপনার আবার রক্তদান করবার সময় হল। আজ বিকেলে আসব নাকি ইন্‌জেকশনের পিচ্‌কিরি নিয়ে?’

‘এখনো দরকার বোধ করছি না।’ বলিয়া নিশানাথ চলিতে আরম্ভ করিলেন।