পরিশিষ্ট

আদিম রিপু – ৪

চার

কয়েকদিন কাটিয়া গিয়াছে।

ননীবালা আর আসেন নাই। প্রভাত ঘটিত ব্যাপার অঙ্কুরেই শুকাইয়া গিয়াছে মনে হয়। কেবল বাঁটুল সর্দারের সঙ্গে একবার দেখা হইয়াছিল। বাঁটুল আসিয়াছিল একটি রিভলবার আমাদের গছাইবার জন্য। উচিত মূল্যে পাইলে হয়তো কিনিতাম, কিন্তু ছয়শত টাকা দিয়া ফ্যাসাদ কিনিবার শখ আমাদের ছিল না। ব্যোমকেশ বাঁটুলকে সিগারেট দিয়া অন্য কথা পাড়িয়াছিল।

‘১৭২/২ বৌবাজার স্ট্রীটের কাউকে চেনো নাকি বাঁটুল?’

‘আজ্ঞে চিনি।’

‘অনাদি হালদারকে জানো?’

‘আজ্ঞে।’

‘সেও কি তোমার—মানে—খাতক নাকি?’

বাঁটুল একটু হাসিয়াছিল, অর্ধদগ্ধ সিগারেটটি নিভাইয়া সযত্নে পকেটে রাখিয়া একটু গম্ভীর স্বরে বলিয়াছিল, ‘অনাদি হালদার আগে চাঁদা দিত, কয়েক মাস থেকে বন্ধ করে দিয়েছে; এখন যদি ওর ভাল-মন্দ কিছু হয় আমাদের দায়-দোষ নেই।—কিন্তু আপনারা ওকে চিনলেন কি করে? আগে থাকতে জানা শোনা আছে নাকি?’

‘না, সম্প্রতি পরিচয় হয়েছে।’

বাঁটুল অতঃপর আর কৌতুহল প্রকাশ করে নাই, কেবল অপ্রাসঙ্গিকভাবে একটি প্রবাদ-বাক্য আমাদের শুনাইয়া দিয়া ধীরে ধীরে প্রস্থান করিয়াছিল—‘জলে বাস করে কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করলে ভাল হয় না কর্তা।’

কালীপূজার দিন আসিয়া পড়িল। সকাল হইতেই চারিদিকে দুম্‌দাম্ শব্দ শোনা যাইতেছে। সেগুলি উৎসবের বাদ্যোদ্যম কিংবা সম্মুখ সমরের রণদামামা তাহা নিঃসংশয়ে ঠাহর করিতে না পারিয়া আমরা বাড়িতেই রহিলাম।

সন্ধ্যার পর দীপমালায় নগর শোভিত হইল। রাস্তায় রাস্তায় গলিতে গলিতে বাজি পোড়ানো আরম্ভ হইল; তুবড়ি আতস বাজি ফানুস রঙমশাল, সঙ্গে সঙ্গে চীনে পট্‌কা দোদমা। পথে পথে অসংখ্য মানুষ নগর পরিদর্শনে বাহির হইয়াছে; কেহ পদব্রজে, কেহ গাড়ি মোটরে। মাথার উপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খাঁড়া ঝুলিতেছে, কিন্তু কে তাহা গ্রাহ্য করে! হেসে নাও দু’দিন বইতো নয়।

আমরা বাড়ির বাহির হইলাম না, জানালা দিয়া উৎসব শোভা নিরীক্ষণ করিলাম। এজন্য যদি কেহ আমাদের কাপুরুষ বলিয়া বিদ্রূপ করেন আপত্তি করিব না, কিন্তু বলির ছাগশিশুর ন্যায় গলায় ফুলের মালা পরিয়া নির্বোধ আনন্দে নৃত্য করিতে আমাদের ঘোর আপত্তি।

রাত্রি গভীর হইতে লাগিল। মধ্য-রাত্রে কালীপূজা, উৎসব পুরাদমে চলিয়াছে। আমরা যদিও শক্তির উপাসক নই, বুদ্ধির উপাসক, তবু মা কালীকে অসন্তুষ্ট করিবার অভিপ্রায় আমাদের ছিল না। রাত্রে পলান্ন সহযোগে মহাপ্রসাদ ভক্ষণ করিয়া শয়ন করিলাম।

রাত্রি শেষ হইবার পূর্বেই যে প্রভাত ঘটিত ব্যাপার সাপের মত আবার মাথা তুলিবে তাহা তখনও জানিতাম না।

একেবারে ঘুম ভাঙিল রাত্রি সাড়ে তিনটার সময়। চারিদিক নিস্তব্ধ, জানালা দিয়া বেশ ঠাণ্ডা আসিতেছে। আমি পায়ের তলা হইতে চাদরটা গায়ে জুত করিয়া জড়াইয়া আর এক ঘুম দিবার ব্যবস্থা করিতেছি এমন সময় উৎকট শব্দে ঘুমের নেশা ছুটিয়া গেল।

কে দুদ্দাড় শব্দে দরজা ঠেঙাইতেছে। শয্যায় উঠিয়া বসিয়া ভাবিলাম, সম্মুখ সমরের সীমানা আমাদের দরজা পর্যন্ত পৌঁছিয়াছে, আজ আর রক্ষা নাই। মোটা লাঠিটা ঘরের কোণে দণ্ডায়মান ছিল, সেটা দৃঢ়মুষ্টিতে ধরিয়া শয়নকক্ষ হইতে বাহির হইলাম। যদি মরিতেই হয় লড়িয়া মরিব।

ওদিকে ব্যোমকেশও লাঠি হাতে নিজের ঘর হইতে বাহির হইয়াছিল। সদর দরজা মজবুত বটে কিন্তু আর বেশিক্ষণ নয়, এখনই ভাঙিয়া পড়িবে। আমরা দরজার দু’পাশে লাঠি বাগাইয়া দাঁড়াইলাম।

দুদ্দাড় শব্দ ক্ষণেকের জন্য একবার থামিল, সেই অবকাশে একটি ব্যগ্র কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম—‘ও ব্যোমকেশবাবু—একবারটি দরজা খুলুন—’

আমরা বিস্ফারিত চক্ষে পরস্পরের পানে চাহিলাম। পুরুষের গলা, কেমন যেন চেনা-চেনা। ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল, ‘কে তুমি? নাম বল।’

উত্তর হইল—‘আমি—আমি কেষ্ট দাস—শীগ্‌গির দরজা খুলুন—’

কেষ্ট দাস! সহসা স্মরণ হইল না, তারপর মনে পড়িয়া গেল। অনাদি হালদারের বাড়ির কেষ্টবাবু!

ব্যোমকেশ বলিল, ‘এত রাত্রে কী চান? সঙ্গে কে আছে?’

‘সঙ্গে কেউ নেই, আমি একা—।’

মাত্র একটা লোক এত শব্দ করিতেছিল! সন্দেহ দূর হইল না। ব্যোমকেশ আবার প্রশ্ন করিল, ‘এত রাত্রে কী দরকার?’

‘অনাদি হালদারকে কে খুন করেছে। দয়া করে দরজা খুলুন। আমার বড় বিপদ।’

হতভম্ব হইয়া আবার দৃষ্টি বিনিময় করিলাম। অনাদি হালদার—!

ব্যোমকেশ আর দ্বিধা করিল না, দ্বার খুলিয়া দিল। কেষ্টবাবু টলিতে টলিতে ঘরে প্রবেশ করিলেন। কেষ্টবাবুর চেহারা আলুথালু, ভেট্‌কি মাছের মত মুখে ব্যাকুলতা। তদুপরি মুখ দিয়া তীব্র মদের গন্ধ বাহির হইতেছে। তিনি থপ্ করিয়া একটি চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া হাঁফাইতে হাঁফাইতে বলিলেন, ‘অনাদিকে কেউ গুলি করে মেরেছে। সত্যি বলছি আমি কিছু জানি না। আমি বাড়িতে ছিলাম না—’

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল, ‘ওকথা পরে হবে। আগে আমার একটা কথার জবাব দিন। আমাকে আপনি চিনলেন কি করে? ঠিকানা পেলেন কোত্থেকে?’

কেষ্টবাবু কিছুক্ষণ জবুথবু হইয়া বসিয়া রহিলেন, তাঁহার ভাবভঙ্গীতে একটু ভিজা-বিড়াল ভাব প্রকাশ পাইল। অবশেষে তিনি জড়িত স্বরে বলিলেন, ‘সেদিন আপনারা আমাদের বাসায় গিছলেন, আপনাদের দেখে আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাই আপনারা যখন ফিরে চললেন তখন আমি আপনাদের পিছু নিয়েছিলাম। এখানে এসে নীচের হোটেলে আপনার পরিচয় পেলাম।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ স্থির নেত্রে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল, ‘হুঁ, আপনি দেখছি ভারি হুঁশিয়ার লোক। অনাদি হালদারের কাঁধে চেপে থাকেন কেন?’

কেষ্টবাবু বলিলেন, ‘আমি অনাদির ছেলেবেলার বন্ধু—দুরবস্থায় পড়েছি—তাই—’

‘তাই অনাদি হালদার আপনাকে খেতে পরতে দিচ্ছিল, এমন কি মদের পয়সা পর্যন্ত যোগাচ্ছিল। খুব গাঢ় বন্ধুত্ব বলতে হবে।—যাক, এবার আজকের ঘটনা বলুন। গোড়া থেকে বলুন।’

কেষ্টবাবু অপলক চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিলেন, তারপর ঈষৎ করুণ স্বরে বলিলেন, ‘আপনি দেখছি সবই জানেন। কিন্তু সত্যি বলছি আমি অনাদিকে খুন করিনি। আজ বিকেলবেলা—মানে কাল বিকেলবেলা অনাদির সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল। আমি বলেছিলুম, আজ কালীপুজো, আজ আমাকে পঞ্চাশ টাকা দিতে হবে। এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া। অনাদি আমাকে দশটা টাকা দিয়ে বলেছিল—এই নিয়ে বেরিয়ে যাও, আর আমার বাড়িতে মাথা গলিও না।’

‘কে কে আপনাদের ঝগড়া শুনেছিল?’

‘বাড়িতে ননীবালা আর ন্যাপা ছিল। নীচের তলার ষষ্ঠীবাবুও ঝগড়া শুনেছিল। বারান্দায় বসে তামাক খাচ্ছিল, আমি নেমে আসতে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল—মাথার ওপর দিনরাত শুম্ভ নিশুম্ভের যুদ্ধ চলেছে—কবে যে পাপ বিদেয় হবে জানি না।’

‘তারপর বলুন।’

‘তারপর রাত্রি আন্দাজ একটার সময় আমি ফিরে এলাম। এসে দেখি—’

‘রাত্রি একটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?’

‘আপনার কাছে লুকোব না, শুঁড়ির দোকানে বসে মদ খেয়েছিলাম—জুয়ার আড্ডায় জুয়া খেলে তিরিশ টাকা জিতেছিলাম—তারপর একটু এদিক ওদিক—’

‘হুঁ। বাসায় ফিরে কী দেখলেন?’

‘বাসায় ফিরে প্রথমেই দেখি নীচের তলায় ষষ্ঠীবাবু হুঁকো হাতে সিঁড়ির ঘরে পায়চারি করছে। আমাকে দেখে বলে উঠল—ধম্মের কল বাতাসে নড়ে। কিছু বুঝতে পারলাম না। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে দেখি—সিঁড়ির দরজা ভাঙা!

‘ঘরে ঢুকে দেখলাম বেঞ্চির ওপর প্রভাত আর ন্যাপা বসে আছে, ননীবালা দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেয় বসেছে। আমাকে দেখে তিনজনে চোখ মেলে তাকিয়ে রইল, যেন আগে কখনও দেখেনি। আমি তো অবাক। বললাম—একি, তোমরা বসে আছ কেন? কারুর মুখে কথা নেই। তারপর ন্যাপা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে উঠল—কেষ্টবাবু, এ আপনার কাজ। আপনি কর্তাকে খুন করেছেন।

‘খুন! আমার তো মাথা ঘুরে গেল। জিজ্ঞেস করলাম—কে? কোথায়? কেন? কেউ উত্তর দিল না। শেষে প্রভাত বলল—ঐ ব্যালকনিতে গিয়ে দেখুন।

‘রাস্তার ধারের ব্যালকনিতে উঁকি মারলাম। অনাদি পড়ে আছে, রক্তারক্তি কাণ্ড। বুকে বন্দুকের গুলি লেগেছে। দেখে আমার ভির্মি যাওয়ার মত অবস্থা, মেঝেয় বসে পড়লাম। মাথার মধ্যে সব গুলিয়ে যেতে লাগল।

‘তারপর কতক্ষণ কেটে গেল জানি না। ওরা তিনজনে চাপা গলায় কথা কইছে, কি করা উচিত তাই নিয়ে তর্ক করছে। ওদের কথা থেকে বুঝতে পারলাম, সন্ধ্যের পর ওরা কেউ বাড়ি ছিল না, একা অনাদি বাড়িতে ছিল। রাত্রি বারোটা নাগাদ ওরা ফিরে এসে দরজায় ধাক্কা দিয়ে সাড়া পেল না। অনেকক্ষণ ধাক্কাধাক্কির পর ওদের ভয় হল, হয়তো কিছু ঘটেছে। ওরা তখন দরজা ভেঙে বাসায় ঢুকে দেখল ব্যালকনিতে অনাদি মরে পড়ে আছে।

‘আমার মাথাটা একটু পরিষ্কার হলে আমি বললাম—তোমরা আমাকে দোষ দিচ্ছ কেন—আমি অনাদিকে খুন করব কেন? অনাদি আমার অন্নদাতা বন্ধু—। ন্যাপা লাফিয়ে উঠে বলল—ন্যাকামি করবেন না। আমি যাচ্ছি পুলিসে খবর দিতে। এই বলে সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

‘আমার ভয় হল। পুলিস এসে আমাকেই ধরবে। ওরা সাক্ষী দেবে আমার সঙ্গে অনাদির ঝগড়া হয়েছিল। আমি আর সেখানে থাকতে পারলাম না, উঠে পালিয়ে এলাম। কোথায় যাব কিছুই জানি না; রাস্তায় নেমে আপনার কথা মনে পড়ল।’—

কিছুক্ষণ কথা হইল না, কেষ্টবাবু যেন ঝিমাইয়া পড়িলেন। কিন্তু লক্ষ্য করিলাম ঝিমানোর মধ্যে তাঁহার অর্ধনিমীলিত চক্ষু দুটি বার বার ব্যোমকেশের মুখের উপর যাতায়াত করিতেছে।

ব্যোমকেশ হঠাৎ বলিল, ‘আপনি তাহলে অনাদি হালদারকে খুন করেননি।’

কেষ্টবাবু চমকিয়া চক্ষু বিস্ফারিত করিলেন, ‘অ্যাঁ! না, ব্যোমকেশবাবু, আমি খুন করিনি। আপনিই ভেবে দেখুন, অনাদিকে খুন করে আমার লাভ কি?’

ব্যোমকেশ বলিল, ‘অনাদি হালদার আপনাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল।’

কেষ্টবাবু বলিলেন, ‘সে ওর মুখের কথা, রাগের মুখে বলেছিল। আমাকে সত্যি সত্যি তাড়িয়ে দেবার সাহস অনাদির ছিল না।’

‘সাহস ছিল না! অর্থাৎ আপনি অনাদি হালদারের জীবনের কোনও গুরুতর গুপ্তকথা জানেন।’

কেষ্টবাবু কিছুক্ষণ নীরব রহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘অনাদির সব গুপ্তকথা আমি জানি, তাকে আমি ফাঁসিকাঠে লটকাতে পারতাম। কিন্তু ওকথা এখন থাক, যদি দরকার হয় পরে বলব, ব্যোমকেশবাবু। এখন আমাকে পুলিসের হাত থেকে বাঁচাবার একটা ব্যবস্থা করুন।’

ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিয়া বলিল, ‘আপনাকে যদি বাঁচাতে হয় তাহলে কে সত্যি খুন করেছে সেটা জানা দরকার। ঘটনাস্থলে যেতে হবে।’

কেষ্টবাবু শঙ্কিত হইলেন, স্খলিতস্বরে বলিলেন, ‘আমাকেও যেতে হবে?’

‘তা যেতে হবে বৈ কি। আপনি না গেলে আমি কোন্ সূত্রে যাব?’

‘কিন্তু, সেখানে পুলিস বোধহয় এতক্ষণ এসে পড়েছে—’

ব্যোমকেশ কড়া সুরে বলিল, ‘আপনি যদি খুন না করে থাকেন আপনার ভয়টা কিসের?—অজিত, তৈরি হয়ে নাও, আমরা তিনজনেই যাব।’

কেষ্টবাবু বিহ্বলভাবে বসিয়া রহিলেন, আমরা বেশবাস পরিধান করিয়া তৈয়ার হইলাম। বসিবার ঘরে ফিরিয়া আসিলে কেষ্টবাবু চেয়ার হইতে কষ্টে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু, আপনার বাড়িতে একটু—হে হে, মদ পাওয়া যাবে? একটু হুইস্কি কিম্বা ব্র্যান্ডি, হাতে পায়ে যেন বল পাচ্ছি না।’

ব্যোমকেশ বিরক্ত হইয়া বলিল, ‘আমি বাড়িতে মদ রাখি না। আসুন।’