পরিশিষ্ট

আদিম রিপু – ১৬

কবি হেমচন্দ্ৰ লিখিয়াছিলেন‌, পোহায় আগস্ট নিশি একত্রিশা বাসরে। তারপর কতকাল কাটিয়া গিয়াছে‌, প্রথম পৌর স্বয়ংপ্ৰভুতার সেই দিনটিকে স্মরণ করিয়া রাখে। এমন কেহ বাঁচিয়া নাই। আবার আর একটি আগস্ট নিশি পোহাইল। এবারও পর্ব ঘরে ঘরে‌, এবারও বাসাড়ে বাসিন্দা বেওয়া বেশ্যা করে সোর। কেবল পটভূমিকা আরও বিস্তৃত হইয়াছে‌, আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষে ছড়াইয়া পড়িয়াছে।

সকালে ঘুম ভাঙিয়া চিন্তা করিতে বসিলাম। এই যে ভারতবর্ষ স্বাধীন হইল ইহাতে আমার কৃতিত্ব কতটুকু? একটা পতাকা নাড়িয়াও তো সাহায্য করি নাই। (ব্যোমকেশ দিল্লীতে গিয়া সাত মাস ধরিয়া কিছু কাজ করিয়াছে। ) আমার মত শত সহস্ৰ মানুষ আছে যাহারা কিছুই করে নাই‌, অথচ তাহারা স্বাধীনতার ফল উপভোগ করিবে। একজন নীেকার দড়ি টানে‌, দশজন নদী পার হয়। ইহাই যদি সংসারের রীতি‌, তবে কর্ম ও কর্মফলের যোগাযোগ কোথায়?

ব্যোমকেশকে আমার আধ্যাত্মিক সমস্যার কথা বলিলাম। সে বলিল‌, ‘স্বাধীনতা পরের চেষ্টায় পেয়েছি‌, কিন্তু নিজের চেষ্টায় তাকে সার্থক করে তুলতে হবে। কাজ এখনও শেষ হয়নি।’

বেলা সাড়ে ন’টার সময় ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘চল‌, এবার বেরুনো যাক। প্ৰভাতের বাসা হয়ে তার দোকানে যাব।’

জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘প্ৰভাতের বাসায় কী দরকার?’

মৃদু হাসিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ননীবালা দেবীকে বড় দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।’

বৌবাজারের বাসার নিম্নতলে অনিবাৰ্য ষষ্ঠীবাবু হুঁকা-হাতে বিরাজমান। আমাদের দেখিয়া চকিতভাবে হুঁকা হইতে মুখ সরাইলেন। ব্যোমকেশ মিষ্টস্বরে জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ওপরতলার সঙ্গে এখন আর কোনও গণ্ডগোল নেই তো?’

ষষ্ঠীবাবু উদ্বেগপূর্ণ চক্ষে চাহিয়া বলিলেন‌, ‘না-হ্যাঁ-না‌, গণ্ডগোল আমার কোনও কালেই ছিল না‌, আমি বুড়ো মানুষ‌, কারুর সাতেও নেই‌, পাঁচেও নেই-’

ব্যোমকেশ হাসিল‌, আমরা সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া গেলাম।

সিঁড়ির দরজা খুলিয়া দিল একটি দাসী। অপরিচিত দু’জন লোক দেখিয়া সে সরিয়া গেল‌, আমরা প্রবেশ করিলাম। যে ঘরটিতে পূর্বে একটি কেঠো বেঞ্চি ছাড়া আর কিছুই ছিল না‌, সেই ঘরটিকে কয়েকটি আরামপ্রদ চেয়ার দিয়া সাজানো হইয়াছে‌, দেয়ালে রবি বমরি ছবি। ননীবালা দেবী বৃহৎ একটি চেয়ারে বসিয়া চোখে চশমা আটিয়া একটি প্রখ্যাত ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা দেখিতেছেন; তাঁহার হাতে পেন্সিল।

ননীবালা দেবীর বেশভূষা দেখিয়া তাক লাগিয়া যায়। চকচকে পাটের শাড়ির উপর লতা-পাত কাটা ব্লাউজ‌, দুই বাহুতে মোটা মোটা তাগা ও চুড়ি; সোনার হইতে পারে‌, গিলটি হওয়াও অসম্ভব নয়। মুখে গৃহিণী-সুলভ গাম্ভীর্য। ননীবালা যে অনাদি হালদারের রাহু গ্রাস হইতে মুক্ত হইয়া নিজ মূর্তি ধারণ করিয়াছেন তাহাতে সন্দেহ নাই।

ননীবালা আমাদের দেখিয়া একটু থাতমত হইলেন‌, তারপর হারমোনিয়ামের ঢাকনি খুলিয়া সম্ভাষণ করিলেন‌, ‘আসুন আসুন। কেমন আছেন?—ওরে চিনিবাস‌, দু’ পেয়ালা চা নিয়ে আয়। ব্যোমকেশবাবু্‌, একটু মিষ্টিমুখ-?’

‘না না‌, ওসব কিছু দরকার নেই। আমরা প্রভাতবাবুর খোঁজে এসেছিলাম।’

‘প্ৰভাত! সে তো আটটার সময় দোকানে চলে গেছে। —একটু বসবেন না?’

চেয়ারে নিতম্ব ঠেকাইয়া বসিলাম। শুধু ঝি নয়‌, চিনিবাস নামধারী ভৃত্যও আছে‌, সম্ভবত রাঁধুনীও নিযুক্ত হইয়াছে। শুক্রের মহাদশা না পড়িলে হঠাৎ এতটা বাড়-বাড়ন্ত দেখা যায় না।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ওটা কি করছেন?’

ননীবালা বলিলেন‌, ‘ক্রসওয়ার্ড পাজল ভাঙছি। জানেন‌, আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছি‌, একুশ হাজার টাকা।’ তাঁহার কণ্ঠে হারমোনিয়ামের সপ্তসুর গিটকিরি খেলিয়া গেল।

গয়নাগুলা। তবে গিলটির নয়। আমরাও কিছুদিন ক্রসওয়ার্ডের ধাঁধা ভাঙিবার চেষ্টা করিতেছিলাম; কিন্তু আমাদের ভাঙা কপাল‌, ধাঁধা ভাঙিতে পারি নাই।

অভিনন্দন জানাইয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আজ তাহলে উঠি। নৃপেনবাবুও কি দোকানে গেছেন?’

ননীবালা অপ্ৰসন্ন স্বরে বলিলেন‌, না। কাল থেকে ওর কি হয়েছে‌, ঘরে দোর বন্ধ করে আছে। কী যে করছে ওই জানে‌, খাওয়া-দাওয়ার সময় নেই‌, দোকানে যাওয়া নেই-ওকে দিয়ে আর দেখছি আমাদের চলবে না।’

আমরা বিদায় লইলাম। পথে যাইতে যাইতে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘প্ৰভাত যে দোকান বিক্রি করে দিচ্ছে এ খবর বোধহয় ননীবালা জানেন না।’

দোকানের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া ব্যোমকেশ একবার এদিক ওদিক চাহিল তারপর বলিল‌, ‘তুমি দোকানে যাও‌, আমি আসছি। জুতোয় একটা পেরেক উঠেছে।’

দোকানের সামনা-সামনি রাস্তার অপর পারে গোলদীঘির দেয়াল ঘেঁষিয়া এক ছোকরা জুতা মেরামত করার সরঞ্জাম লইয়া বসিয়াছিল, ব্যোমকেশ তাহার কাছে গিয়া জুতা মেরামত করাইতে লাগিল। আমি দোকানে প্ৰবেশ করিলাম।

প্রভাত হিসাবের খাতাপত্ৰ লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছিল‌, বলিল‌, ‘এই যে! ব্যোমকেশবাবু এলেন না?’

‘আসছে। আপনার হিসেব তৈরি?’

‘হাঁ। এই দেখুন না।’

আমি হিসাবে দেখিতে বসিলাম। কিছুক্ষণ পরে ব্যোমকেশ আসিয়া যোগ দিল; হিসাব পরীক্ষা শেষ করিতে বেলা দুপুর হইয়া গেল। আমরা উঠিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমরা তিন হাজার টাকাই দেব। কাল সকাল আটটার সময় চেক পাবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে দখল দিতে হবে।’

‘যে আজ্ঞে।’

সেদিন অপরাহ্নে ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ইন্দুবাবুকে টেলিফোন কর না‌, গদানন্দর সাম্প্রতিক খবর যদি কিছু পাওয়া যায়।’

বলিলাম‌, ‘গদানন্দ তো পালিয়েছে‌, তাকে ইন্দুবাবু কোথায় পাবেন?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘গদানন্দ শিউলীকে নিয়ে পালিয়েছে‌, কিন্তু ফেরারী হয়নি। শিউলী সাবালিকা‌, সে যদি কারুর সঙ্গে বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে থাকে‌, তাতে ফৌজদারি হয় না। গদানন্দ খুব সম্ভব তাকে নিজের বাসায় তুলেছে।’

‘আচ্ছা‌, দেখি—‘

ইন্দুবাবুকে ফোন করিলাম। তিনি আমার প্রশ্ন শুনিয়া বলিলেন‌, ‘গদানন্দর খবর জানি বৈকি। তাকে নিয়ে সিনেমা-মহল এখন সরগরম। সেদিন আপনাদের বলেছিলাম। কিনা। গদানন্দ শিউলীকে নিয়ে ভেগেছে‌, তারপর তাকে রেজিস্ট্রি অফিসে বিয়ে করেছে। এই নিয়ে গদানন্দর তিনবার হল।’

‘তিনবার। তিনবার কী?

‘তিনবার বিয়ে।’

‘বলেন কি‌, আরও দুটো বউ আছে?’

‘এখন আর নেই। প্রথম বিউটা দেখতে খুব সুন্দরী ছিল‌, কিন্তু সিনেমায় সুবিধে হল না; ক্যামেরায় তার চেহারা ভাল এল না। সে হঠাৎ একদিন হার্ট ফেল করে মারা গেল। তারপর গদানন্দ আর একটা মেয়েকে ফুসলে এনে বিয়ে করল। এ মেয়েটা অভিনয় ভালই করত। কিন্তু personality ছিল না‌, দেখা গেল তাকে দিয়ে হিরোইনের পার্ট চলবে না। সেটাও বেশিদিন টিকল না।’

‘কি সর্বনাশ! আপনার কি মনে হয় গদানন্দ বৌ দুটোকে-অ্যাঁ!’

‘ভগবান জানেন। শিউলীর অবশ্য মাইকের গলা ভাল। এই যা ভরসা।’

ব্যোমকেশকে বাতা শুনাইলাম। সে আপন মনে মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল‌, তারপর বলিল‌, ‘গদানন্দের বংশপরিচয় জানতে ইচ্ছে করে। এক পুরুষে এতটা হয় না।’

ক্ৰমে সন্ধ্যা হইল। নগর দীপাবলীতে সজ্জিত হইয়া আর একটি দীপান্বিতা রাত্রিকে স্মরণ করাইয়া দিল। ঘরে ঘরে দোকানে দোকানে রেডিওর জলদমন্দ্র স্বর অন্য সব শব্দকে ডুবাইয়া দিল। সকলেরই কান পড়িয়া আছে দিল্লীর পানে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সেখানে স্বাধীনতার উদ্বোধন হইবে।

সাতটার সময় চকিতের ন্যায় নৃপেন আসিল‌, দ্বারের নিকট হইতে ব্যোমকেশের হাতে একটি চকচকে চাবি দিয়া আলাদীনের জিনের মত অদৃশ্য হইল।

দশটার সময় আমরা আহার শেষ করিলাম।

সাড়ে এগারটার সময় ব্যোমকেশ পুঁটিরামকে বলিল‌, ‘আমরা এখনি বেরুব‌, কখন ফিরব ঠিক নেই। তুই জেগে থাকিস। আর একটা আংটায় কাঠকয়লা দিয়ে আগুন করবার যোগাড় করে রাখিস। আমরা ফিরে এলে আগুন জ্বালবি।’

পুঁটিরাম ‘যে আজ্ঞে’ বলিয়া প্ৰস্থান করিলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম‌, কাঠকয়লার আগুন কি হবে?’

সে বলিল‌, ‘অতীতকে ভস্মীভূত করে ফেলতে হবে।’

মধ্যরাত্রির কিছু আগে আমরা বাহির হইলাম। ঘরে ঘরে শঙ্খ বাজিতেছে—

গোলদীঘির চারি পাশের দোকানগুলি কিন্তু বন্ধ। দোকানদারেরা বোধকরি নিজ নিজ ঘরে গিয়া রেডিও যন্ত্র আঁকড়াইয়া বসিয়া আছেন। এত রাত্রে এদিকের রাস্তাগুলিও জনবিরল হইয়া’ আসিয়াছে।

একটি ল্যাম্পপোস্টের ছায়াতলে একজন লোক দাঁড়াইয়া বিড়ি টানিতেছিল, আমরা নিকটবর্তী হইলে বাহির হইয়া আসিল। দেখিলাম বিকাশ।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কিছু খবর আছে নাকি?’

বিকাশ বলিল‌, ‘না। প্রভাতবাবু সাড়ে ন’টার সময় দোকান বন্ধ করে চলে গেছেন।’

‘হাতে কিছু ছিল?’

‘না।‘

‘তারপর আর কেউ আসেনি?’

‘না।‘

‘আচ্ছা‌, আসুন তাহলে।’

তিনজনে রাস্তা পার হইয়া প্ৰভাতের দোকানের সম্মুখে উপস্থিত হইলাম। ব্যোমকেশ চাবি দিয়া দ্বারের তালা খুলিল; বেশ অনায়াসে তালা খুলিয়া গেল। তারপর চাবি বিকাশের হাতে দিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমরা দু’জনে ভেতরে যাচ্ছি‌, আপনি তালা বন্ধ করে দিন। কতক্ষশ অপেক্ষা করতে হবে বলা যায় না। আপনি যেমন ছিলেন তেমনি থাকবেন। যদি কেউ দোর খুলে ভেতরে ঢোকে‌, আপনার কিছু করবার দরকার নেই।’

‘আচ্ছা‌, স্যার।’

আমরা অন্ধকার দোকানে প্রবেশ করিলাম। ব্যোমকেশের পকেটে বৈদ্যুতিক টর্চ ছিল‌, সে তাহা জ্বলিয়া ঘরের চারিদিকে ফিরাইল। সারি সারি বইগুলা যেন দাঁত বাহির করিয়া নীরবে: হাসিল। আমরা পিছনের কুঠুরিতে প্রবেশ করিয়া তক্তপোশের কিনারায় বসিলাম‌, মাঝের দরজা একপাট খোলা রহিল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এ ঘরে বই নেই‌, এ ঘরে বোধহয় আসবে না।’

আমি বললাম‌, ‘ব্যোমকেশ রক্তপুরে আমরা প্ৰভাতের দোকানে কি করছি জানতে পারি কি?’

ব্যোমকেশ আমার কানে কানে বলিল‌, ‘গুড় গুড় গুড় গুড়িয়ে হামা‌, খাপ পেতেছেন গোষ্টমামা।’

বইয়ের দোকানের একটা গন্ধ আছে‌, নূতন বইয়ের গন্ধ। এই গন্ধ সাধারণত টের পাওয়া যায় না‌, কিন্তু গভীর রাত্ৰে দোকানের মধ্যে বন্ধ থাকিলে ধীরে ধীরে অনুভব হয়। একটু ঝাঁজালো‌, নাক সুড় সুড় করে‌, হাঁচি আসে।

তার উপর নিজেদের নিশ্বাসের কার্বন-ডায়কসাইড আছে। ঘণ্টাখানেক প্রতীক্ষ্ণ করিবার পর অনুভব করিলাম‌, ঘরের বাতাস ভারী হইয়া আসিতেছে। গরমে প্ৰাণ আনচান করিয়া উঠিল। বলিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ—‘

ব্যোমকেশ বজ্রমুষ্টিতে আমার হাত চাপিয়া ধরিল‌, তাহার গলা হইতে চাপা শীৎকার বাহির‌ হইল ‘স, স্‌ স্‌–।’

আর একটি শব্দ কানে আসিল‌, কেহ চাবি দিয়া দ্বারের তালা খুলিতেছে। দরজা একটু ফাঁক হইল‌, বাহিরের আলো আচ্ছাভ পদার মত ধীরে ধীরে প্রসারিত হইল। একটি ছায়ামূর্তি প্রবেশ করিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। আমরা রুদ্ধশ্বাসে কুঠুরির ভিতর হইতে দেখিতে লাগিলাম।

হঠাৎ দোকানঘরের মাঝখানে দপ করিয়া টর্চের আলো জ্বলিয়া উঠিল। আলোর দৃষ্টি ঊর্ধ্ব দিকে‌, সার্চ-লাইটের মত দেয়ালের উপর দিকে পড়িয়াছে। টর্চের পিছনে মানুষটিকে দেখা গেল না।

টর্চ হাতে লইয়া মানুষটি কাউন্টারের উপর লাফাইয়া উঠিল। আমরা পা টিপিয়া টিপিয়া কুঠুরির দ্বারের নিকট হইতে উঁকি মারিলাম। টর্চের আলো বইয়ের সর্বোচ্চ তাকের উপর পড়িয়াছে। মানুষটি হাত বাড়াইয়া একটি বই বাহির করিয়া লইল; আকারে আয়তনে অনেকটা ‘চিলন্তিকা’র মত। তারপর আর একটি বই বাহির করিল‌, তারপর আর একটি। এমনিভাবে পাঁচখানি বই লইয়া মানুষটি লাফাইয়া নীচে নামিল; কাউন্টারের উপর জ্বলন্ত টর্চ রাখিয়া একটি বাজার-করা থলিতে বইগুলি ভরিতে লাগিল।

থলিতে বইগুলি ভরা হইয়াছে‌, এমন সময় ব্যোমকেশ গিয়া মানুষটির কাঁধে হাত রাখিল‌, বলিল‌, ‘থলিটা আমায় দিন।’

মানুষটির গলায় করাতের মত দ্রুত নিশ্বাস টানার শব্দ হইল। তারপর ব্যোমকেশ তাহার মুখের উপর নিজের টর্চের আলো ফেলিল।

মুখখানা ভয়ে ও বিস্ময়ে বিকৃত হইলেও চেনা শক্ত নয়‌, প্ৰভাতের মুখ। তাহার চোখের শাদা অংশই অধিক দেখা যাইতেছে। সে মিনিটখানেক চাহিয়া থাকিয়া অভিভূত স্বরে বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু!’

‘হ্যাঁ‌, আমি আর অজিত। থলিটা দিন।’

প্রভাত একটু ইতস্তত করিল‌, তারপর থলি ব্যোমকেশের হাতে দিল। ব্যোমকেশ থলিটা আমার হাতে দিয়া বলিল‌, ‘অজিত‌, এটা রাখা। বইগুলো ভারি দামী।–প্রভাতবাবু্‌, এবার চলুন।’

প্ৰভাত আরও কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘কোথায় যেতে হবে? থানায়?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘না‌, আপাতত আমার বাসায়। আগে বইগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে।’

তিনজনে দোকানের বাহিরে আসিলাম। ব্যোমকেশের ইঙ্গিতে প্ৰভাত দ্বারে তালা লাগাইল। ফিরিয়া দেখি বিকাশ অলক্ষিতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বিকাশবাবু্‌, অসংখ্য ধন্যবাদ। এবার আপনার ছুটি। কাল সকালে একবার বাসায় আসবেন।’

‘যে আজ্ঞে‌, স্যার–’ বিকাশ অন্তর্হিত হইল। আমি ও ব্যোমকেশ প্ৰভাতকে মাঝখানে লইয়া বাসার দিকে চলিলাম।