পরিশিষ্ট

আদিম রিপু – ১৪

আমাদের পাটনা যাত্রার পর হইতে স্বাধীনতা দিবস পর্যন্ত এই কয় মাস আমাদের জীবনের ধারাবাহিকতা অনেকটা নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। নানা বিচিত্ৰ ঘটনার মধ্যে পড়িয়া অনাদি হালদার ঘটিত ব্যাপারের খেই হারাইয়া গিয়াছিল। এই কাহিনীতে সে সকল অবাস্তর ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবৃতি অনাবশ্যক‌, কেবল সংক্ষেপে এই আট-নয় মাস কি করিয়া কাটিল তাহার আন্দাজ দিয়া নির্দিষ্ট বিষয়ে ফিরিয়া যাইব।

পাটনায় পৌঁছিয়া দশ-বারো দিন বেশ নিরুপদ্রবে। কাটিল; তারপর একদিন পুরন্দর পাণ্ডের সঙ্গে দেখা হইয়া গেল। পাণ্ডেজি বছরখানেক হইল বদলি হইয়া পাটনায় আসিয়াছেন। সেই যে দুৰ্গরহস্য সম্পর্কে তাঁহার সংস্পর্শে আসিয়াছিলাম‌, তারপর দেখা হয় নাই। পাণ্ডেজি খুশি হইলেন‌, আমরাও কম খুশি হইলাম না। পাণ্ডেজি মৃত্যু-রহস্যের অগ্রদূত। আমাদের সহিত দেখা হইবার দু। একদিন পরেই একটি রহস্যময় মৃত্যু আসিয়া উপস্থিত হইল এবং শেষ পর্যন্ত ব্যোমকেশকেই সে রহস্য ভেদ করিতে হইল। একদিন সে কাহিনী বলিবার ইচ্ছা রহিল।

শুধু যে আমাদের ক্ষুদ্র জীবনে বিচিত্ৰ ঘটনার সমাবেশ হইতেছিল তাঁহা নয়‌, সারা ভারতবর্ষের জীবনে এক মহা সন্ধিক্ষণ দ্রুত অগ্রসর হইয়া আসিতেছিল। স্বাধীনতা আসিতেছে‌, রক্তাক্ত দেহে বিক্ষত চরণে দুর্লঙ্ঘ্য বাধা ভেদ করিয়া আসিতেছে। স্বাধীনতা যখন আসিবে হয়তো মুমূর্ষ রক্তহীন দেহে আসিয়া উপস্থিত হইবে। তাহাকে বাঁচাইয়া তুলিতে প্রত্যেক ভারতবাসীকে হৃদয়রক্ত নিঙড়াইয়া দিতে হইবে। তবু স্বাধীনতা আসিতেছে; স্বাৰ্থ-নিষ্ঠুর বিদেশী শাসকের খড়ের্গ দ্বিখণ্ডিত হইয়াও হয়তো বাঁচিয়া থাকিবে। আশা আশঙ্কায় কম্পমান সেই দিনগুলির কথা স্মরণ হইলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়।

একদিন বৈকালে ময়দানে বেড়াইতে বেড়াইতে কৈশোরের এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হইয়া গেল। পরিধানে শেরওয়ানী পায়জামা সত্ত্বেও চিনিতে পারিলাম—স্কুলে যাহার সহিত প্ৰাণের বন্ধুত্ব ছিল সেই ফজলুর রহমান। দু’জনে প্রায় একসঙ্গেই পরস্পরকে চিনিতে পারিলাম এবং সবেগে অলিঙ্গনবদ্ধ হইলাম।

‘ফজলু!’

‘অজিত!’

কিছুক্ষণ পরে বাহুবন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া আমি দুই পা পিছাইয়া আসিলাম‌, ফজলুর দিকে গলা বাড়াইয়া দিয়া বলিলাম‌, ‘নে ফজলু্‌, ছুরি বার করা। এই গলা বাড়িয়ে রয়েছি।’

ফজলু নিজের হাতের মোটা লাঠিটা আমার হাতে ধরাইয়া দিয়া বলিল, ‘এই নে লাঠি, বসিয়ে দে আমার মাথায়। তোদের অসাধ্য কাজ নেই।’

তারপর আমরা ঘাসের উপর বসিলাম‌, ব্যোমকেশের সহিত ফজলুর পরিচয় করাইয়া দিলাম। ফজলু এখন পাটনা হাইকোর্টে ওকালতি করিতেছে‌, প্রচণ্ড পাকিস্তানী। সুতরাং তুমুল তর্ক বাধিয়া উঠিল‌, কেহই কাহাকেও রেয়াৎ করিলাম না। শেষে ফজলু বলিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু্‌, অজিতের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা‌, ওর ঘটে কিছু নেই। কিন্তু আপনি তো বুদ্ধিজীবী মানুষ‌, আপনি বলুন দেখি দোষ কার–হিন্দুর‌, না‌, মুসলমানের?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এক ভস্ম আর ছার‌, দোষ গুণ কবি কার।’

সেদিন বেড়াইয়া ফিরিতে দেরি হইয়া গেল। তারপর আরও কয়েকদিন ফজলুর সহিত দেখা হইয়াছিল। সে নিমন্ত্রণ করিয়া আমাদের খাওয়াইয়াছিল। তারপর–

উন্মত্ত হিংসার পিশাচ-নৃত্য আবার শুরু হইয়া গেল। প্রথমে নোয়াখালি‌, তারপর বিহার। এ লইয়া বাক-বিস্তারের প্রয়োজন নাই। ফজলু এই হিংসা-যজ্ঞে প্ৰাণ দিল। সে সত্যনিষ্ঠ সাহসী পুরুষ ছিল‌, যাহা বিশ্বাস করিত তাহা গলা ছাড়িয়া প্রচার করিত; তাই বোধহয় তাহাকে প্রাণ দিতে হইল। কিছুদিন পরে বাতাস একটু ঠাণ্ডা হইলে আমরা পাটনা সিটিতে ইশাক সাহেবের খোঁজ লাইতে গিয়াছিলাম। তিনিও গিয়াছেন; কেবল তাঁহার দোকানটা অর্ধদগ্ধ অবস্থায় পড়িয়া আছে। এক ভস্ম আর ছার‌, দোষ গুণ কবি কর।

কিন্তু যাক। এবার ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রতর প্রসঙ্গে ফিরিয়া যাই। ইতিমধ্যে কলিকাতা হইতে বিকাশ দত্তর চিঠি আসিয়াছিল; বিকাশ লিখিয়াছিল–

‘প্ৰণাম শতকোটি‌, পুঁটিরামের কাছে আপনার ঠিকানা যোগাড় করে চিঠি লিখছি। আশা করি আপনি শীঘ্রই ফিরবেন।

আমি এখন মাস্টারি করছি। দয়ালহরি মজুমদারের একটা আট-নয় বছরের অকালপক্ক ছেলে আছে‌, তাকে পড়াই। মাইনে পাঁচ টাকা‌, সকাল বিকেল পড়াতে যাই। ছেলেটা হাড় বজাত; এমন ইচড়ে পাকা মিটুমিটে শয়তান আমিও আজ পর্যন্ত দেখিনি। বাড়িতে কে কি করছে‌, কোথায় কি ঘটছে‌, সব খবর সে রাখে।

দয়ালহরি মজুমদার ঢাকার লোক; সেখানে বীমার দালালি এবং আরও কি কি করত। বছরখানেক আগে রাজনৈতিক গণ্ডগোলের আঁচ পেয়ে আগে ভাগেই কলকাতা পালিয়ে এসেছিল। মেয়ে এবং ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই। লোকটা সন্দিগ্ধ এবং ধড়িবাজ।

মেয়ে শিউলী শান্ত এবং ভালমানুষ গোছের। বাইরে থেকে মনে হয় বিদ্যোধরী‌, কিন্তু আসলে তা নয়। ভাল গাইতে পারে‌, রাতদিন গান বাজনা নিয়ে আছে। গ্রামোফোনে গান দিয়েছে‌, তা ছাড়া টাকা নিয়ে সভাসমিতিতে গাইতে যায়। শিউলীর উপার্জন থেকে বোধহয় সংসার চলে। বুড়োটা কিছু কাজকর্ম করে না।

আপনি অনাদি হালদার আর প্রভাত-এই দুটো নাম মনে রাখতে বলেছিলেন। অনাদি হালদারের খবর পাইনি‌, প্ৰভাতের খবর পেয়েছি। কয়েক মাস আগে প্ৰভাতের সঙ্গে শিউলীর বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল‌, তারপর সম্বন্ধ ভেঙে যায়। কোন ভেঙে যায় তা জানতে পারিনি‌, তবে সন্দেহ হয় কোনও গুপ্তকথা আছে। বিয়ে ভেঙে যাবার আগে প্ৰভাত ঘন ঘন আসত‌, বিয়ে ভেঙে যাবার পরও একবার এসেছিল। দয়ালহরি মজুমদার তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।

উপস্থিত বাড়িতে একজন লোকের খুব যাতায়াত আছে‌, তার নাম জগদানন্দ অধিকারী। শিউলীকে গান শেখাবার ছুতো করে আসে। লোকটার মতলব ভাল নয়। গান শেখানো ছাড়া অন্যভাবে ঘনিষ্ঠতা করতে চায়।

আপাতত এই পর্যন্ত। নতুন খবর পেলে জানাবো। আপনি কবে ফিরবেন? আমার ঠিকানা নীচে দিলাম।

প্ৰণামান্তে বিকাশ দত্ত।’

বিকাশের চিঠিতে নূতন কথা বিশেষ কিছু নাই। আমাদের জানা কথাই পরিকীর্ণ হইয়াছে।

এদিকে পাটনায় আমাদের অনেকদিন হইয়া গেল। কলিকাতায় ফিরিবার উপক্রম করিতেছি। এমন সময় দিল্লী হইতে ব্যোমকেশের নামে ‘তারা আসিল। সদর বল্লভভাই প্যাটেল তাহার সহিত দেখা করিতে চান।

সর্দার বল্লবভাই কি করিয়া ব্যোমকেশের নাম জানিলেন‌, কেন তাহার সাক্ষাৎ চান‌, কিছুই জানা গেল না। রাজনৈতিক আকাশে তখন ঘনঘটা‌, অন্ধকারের ফাঁকে ফাঁকে বজ্ৰবিদ্যুৎ। ব্যোমকেশ আমাকে পাটনায় ফেলিয়া একাকী দিল্লী চলিয়া গেল।

দিল্লী গিয়া ব্যোমকেশ কি করিয়াছিল তাহা পুরোপুরি জানা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। সে ফিরিয়া আসিবার পর ইশারা ইঙ্গিতে যাহা জানিতে পারিয়াছিলাম। তাহা প্রকাশ করার এ স্থান নয়। দেশ তখনও নিজের হাতে আসে নাই‌, ইহারই মধ্যে গুপ্ত ঘরভেদীরা ষড়যন্ত্র আরম্ভ করিয়া দিয়াছিল‌, কে দেশের শত্রু কে মিত্ৰ নিশ্চয়ভাবে জানার প্রয়োজন হইয়াছিল।

ব্যোমকেশ চলিয়া গেলে আমি একলা পড়িয়া গেলাম। দূরে রণবাদ্য শুনিয়া আস্তাবলে বাঁধা লড়য়ে-ঘোড়ার যে অবস্থা হয় আমার অবস্থাও কতকটা সেই রকম দাঁড়াইল। এইভাবে পাটনায় যখন আর মন টিকিল না। তখন কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম।

কিন্তু কলিকাতার বাসা শূন্য। ভাবিয়াছিলাম‌, নিরিবিলিতে উপন্যাসে মন বসাইতে পারিব‌, কিন্তু মন বসিতে চাহিল না। প্ৰভাতের নিকট হইতে টাকা লইয়াছি‌, একটা কিছু করা দরকার‌, এই সঙ্কল্পটাই মনের মধ্যে পাক খাইতে লাগিল।

একদিন প্ৰভাতের দোকানে গেলাম। আমাকে দেখিয়া সে গলা উচু করিয়া বলিল‌, ‘পাটনা থেকে কবে ফিরলেন? আমি মাঝে আপনাদের বাসায় গিয়েছিলাম। ইশাক সাহেবের খবর নিয়েছিলেন?’

ইশাক সাহেবের খবর বলিলাম। প্ৰভাত কিছুক্ষণ অচল হইয়া বসিয়া রহিল‌, তারপর কোঁচার খুঁটে চোখ মুছিতে লাগিল। আমি সান্ত্বনা দিবার চেষ্টা করিলাম না‌, আবার দেখা হইবে বলিয়া চলিয়া আসিলাম।

পরদিন প্ৰভাতের চিঠি লইয়া নৃপেন আসিল। চিঠিতে দু’ ছত্র লেখা—

মাননীয়েষু‌, কাল কোনও কথা হইল না‌, সেজন্য লজ্জিত। ব্যোমকেশবাবুকি ফিরিয়াছেন?

উপন্যাসের কথা স্মরণ করাইয়া দিতেছি। আশা করি অগ্রসর হইতেছে। ইতি নিবেদক প্রভাত রায়।

নৃপেনকে বলিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ এখনও ফেরেনি।–আপনি এখনও প্রভাতবাবুর দোকানেই কাজ করছেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আছেন কোথায়?’

‘পুরানো বাসাতেই আছি। প্রভাতবাবু থাকতে দিয়েছেন।’

‘ননীবালা দেবীর সঙ্গে বেশ বনিবনাও হচ্ছে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ‌, উনি আমাকে খুব স্নেহ করেন।’

‘ওদিকের খবর কি? নিমাই নিতাই?’

‘ওরা আদালতের হুকুম পেয়েছে। আমাদের বাসায় অনাদিবাবুর যেসব জিনিস ছিল সব তুলে নিয়ে গেছে। আলমারিও নিয়ে গেছে।’

‘পুলিসের দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ পেয়েছেন?’

‘কিছু না।’

‘কেষ্টবাবুর খবর কি?’।

‘জানি না। সেই যে বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তারপর আর দেখিনি।’

নৃপেন চলিয়া গেল।

উপন্যাস লইয়া বসিলাম। কিন্তু মন বিক্ষিপ্ত্‌্‌, তাহাকে কলমের ডগায় ফিরাইয়া আনিতে পারিলাম না। আরও কয়েকদিন ছটফট করিয়া পাটনায় ফিরিয়া গেলাম।

ব্যোমকেশ দিল্লী হইতে ফিরে নাই। গোটা দুই অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পোস্টকার্ড আসিয়াছে‌, ভাল আছি‌, ভাবনা করিও না। কবে ফিরিব স্থিরতা নাই।

এদিকে স্বাধীনতা দিবস অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। সমস্ত দেশ অভাবনীয় সম্ভাবনার আশায় যেন দিশাহারা হইয়া গিয়াছে।

আগস্ট মাসের দশ তারিখে হঠাৎ ব্যোমকেশ ফিরিয়া আসিল।

রোগ হইয়া গিয়াছে‌, কিন্তু শুষ্ক মুখে বিজয়ীর হাসি। বলিল‌, ‘আর না‌, চল‌, কলকাতায় ফেরা যাক। পুঁটিরামকে একখানা পোস্টকার্ড লিখে দাও।’