১৪.
রক্তাক্ত জয়লাভ সম্পূর্ণতা পেতে পুরো একটা বছর লেগে গেল। সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কৌশলের সফল প্রয়োগ ঘটিয়ে ইতিমধ্যে গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী ইতালীয় পরিবারের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে মাইকেল কর্লিয়নি। বছরটা সমান দুভাগে ভাগ করে লং বীচের হেডকোয়ার্টার আর লাস ভেগাসের বসতবাড়িতে কাটাল ও। বছরের শেষদিকে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, নিউ ইয়র্কের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে, উঠান তার সমস্ত সয়-সম্পত্তি বিক্রি করে দেয়া হবে। তাই শেষবারের মত পরিবারের সবাইকে নিয়ে লাস ভেগাস থেকে নিউ ইয়র্কে এসেছে ও। ঠিক হয়েছে পুরো একটা মাস এখানে থাকবে ওরা। মাইকেল তার ব্যবসা বন্ধ আর সম্পত্তি বেটার ব্যাপারে ব্যস্ত থাকবে, আর ওদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র গুছিয়ে বাক্স বন্দী করবে কে। গৃহস্থালির যাবতীয় মালামাল পাঠানো হবে জাহাজযোগে।
গোটা আমেরিকায় কর্লিয়নি পরিবার এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ক্লেমেঞ্জা এখন তার নিজের একটা আলাদা পরিবারের কর্তা। নিউ ইয়র্কে তার পরিবারটাই সবচেয়ে শক্তিশালী। কর্লিয়নিদের ক্যাপোরেজিমি এখন রকে ল্যাম্পনি। বিরাট একটা পদ দেয়া হয়েছে অ্যালবার্ট নেরিকেও। নেভাডায় কর্লিয়নিদের যত হোটেল রয়েছে সূবগুলোর সিকিউরিটি ব্যবস্থার ডিরেকটর সে। ডন মাইকেল তার পরিবারের একজন প্রবীণ সদস্য হিসেবে টম হেগেনকেও গ্রহণ করেছে।
সময়ের কোমল হাতের ছোঁয়ায় পরানো সমস্ত ব্যথা সেরে যায়। ডন মাইকেলের ওপর এখন আর কোন রাগ বা অভিমান নেই কনি কর্লিয়নির। ভাইয়ের বিরুদ্ধে অতগুলো গুরুতর অভিযোগ আনার মাত্র এক হপ্তা পরই নিজে যেচে পড়ে মাফ চেয়েছে সে। ডন মাইকেলের স্ত্রী কে-কে বলেছে, সেদিন যাই বলে থাকুক সে, তার কথায় কোন সত্যতা ছিল না, হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত সদ্য বিধবার প্রলাপ ছিল ওসব।
অনায়াসে আবার স্বামী পেয়ে গেছে কনি কর্লিয়নি। প্রথম স্বামীর জন্যে শোক প্রকাশ করতে পুরো একটা বছর অপেক্ষাও করেনি সে, যদিও সেটাই নিয়ম। তার দ্বিতীয় স্বামীর বয়স খুবই কম, কনির চেয়ে ছোট হলে হবে তো বড় হবে না। চমৎকার, খাসা ছেলে। বিছানায় প্রথম রাতেই তার প্রেমে পড়ে গেল কনি, ছেলেটা সেক্রেটারির কাজ নিয়ে কর্লিয়নি পরিবারে ঢুকেছিল, এবং দক্ষতা দেখিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল অল্প সময়েই। ভাল ইতালীয় পরিবারের ছেলে, তার ওপর আমেরিকার শ্রেষ্ঠ বিজনেস কলেজ থেকে পাস করেছে। ডনের বোনের সাথে বিয়ে হওয়ায় ভবিষ্যতের জন্যে তাকে আর চিন্তা করতে হবে না।
ইতিমধ্যে পরিবারের সবাইকে খুশি করার জন্যে ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে কে কর্লিয়নি। ওর ছেলে দুটোও ওই ধর্মীয় নিয়মে মানুষ হচ্ছে। তবে এতে করে একটু অন্তুষ্টই হয়েছে মাইকেল। ছেলেরা প্রটেস্টান্ট হলেই বেশি খুশি হত সে! তার ধারণা, তাতে নাকি আরও বেশি করে মার্কিনী হওয়া যায়।
নেভাডা শুধু ভাল লাগেনি কে-র, জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেছে সে। ওখানের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী জা করেছে তাকে। আকাশ ছোঁয়া পাহাড়, লাল পাথরের গরিখাদ, উত্তপ্ত মরুভূমি, প্রাণ ঠাণ্ডা করা নীল হ্রদ, এমন কি গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড গরমটাও ভাল লাগে তার। ছেলেরা ঘোড়ায় চড়ে খেলে। বাড়িতে বডিগার্ড নয়, চাকরবাকর আছে। আর নেভাডায় আরও অনেক স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। মাইকেল। একটী গৃহ নির্মাণ সংস্থার মালিক সে। বিজনেস ক্লাবের সদস্য হয়েছে। সদস্য হয়েছে পৌর সংস্থার। আজকাল লোকজনের সাথে মেলামেশা করে। সবাই ভারি পছন্দও করে ওকে। রাজনীতি সম্পর্কে চিরকালই উৎসাহী ও, ইদানীং সেটা আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে কে-র কাছে জীবন বড় আনন্দময় বলে মনে হয়। নিউ ইয়র্কের আবাস তুলে দেয়া হচ্ছে, সেজন্যে খুব খুশি কে। এখন থেকে ভেগাসই ওদের স্থায়ী নিবাস হবে। ভেগাস থেকে নিউ ইয়র্কে আসতে একটুও ভাল লাগেনি তার।
নিউ ইয়র্কে আজ ওদের শেষ দিন।
ভোর অন্ধকার থাকতে ঘুম ভেঙে গেল কে-র। উঠান থেকে ট্রাকের ঘরঘর আওয়াজ ভেসে আসছে। বাড়ি খালি করে সম জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়া হবে ট্রাকে করে। দুপুরের পর কর্লিয়নিদের মাকে নিয়ে প্লেনে করে রওনা হবে সবাই। ফিরে যাবে লাস ভেগাসে।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে কে দেখ বালিশে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে সিগারেট ফুকছে মাইকেল।
স্ত্রীকে দেখেই জানতে চাইল মাইকেল, আচ্ছা, রোজ ভোরে গির্জায় না ছুটলেই কি নয়? রোববারে যাও, বাধা নেই, কিন্তু বোজ:এ কেমন কথা? তুমিও তো দেখছি মায়ের, মতই খারাপ হয়ে যাচ্ছ। হাত বাড়িয়ে টেবিলের আলোটা জেলে ঘরের অন্ধকার তাড়াল মাইকেল।
খাটের কিনারায় বসল কে। মোজা পরছে। ক্যাথলিকরা কেমন হয় জানোই তো, বলল সে। তার ওপর আমি আবার দীক্ষা নিয়েছি। এরা সাধারণত আর সবার চেয়ে ধর্মের ওপর গুরুত্ব দেয়।
হাত বাড়িয়ে দিল মাইকেল। কে-র উরু স্পর্শ করল ও। চামড়াটা কোমল আর
না, হাত সরাও, মৃদু তিরস্কারের সুরে বলল কে। তোমার চাল আমি বুঝতে পারছি। লাভ নেই, সাহেব। আজ সুবিধে হবে না।
কেন? কেন?
আজ আমি কমিউনিয়ন নিচ্ছি, বলল কে। মাইকেলের হাত সরিয়ে দিয়ে খার্ট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে।
মৃদু একটু হাসল মাইকেল। বুঝলাম। নিজেকে তুমি গোড়া ক্যাথলিক বলে স্বীকার করছ, বলল ও। কিন্তু কই, ছেলেদেরকে তো কিছু বলো না, ওরা যে এত গির্জা ফাঁকি দেয়?
ওরা ছেলেমানুষ, গির্জায় যাবার সময় পড়ে রয়েছে ওদের, বলল কে। বাড়ি ফিরে নিয়মিত পাঠাব ওদেরকে।
ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে স্বামীকে চুমো খেলো কে। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে একটু দাঁড়াল সে। এরই মধ্যে গরম হয়ে উঠেছে বাতাস। গ্রীষ্মের স উঠছে পূবদিকে, আকাশটা টকটকে লাল। উঠানের ফটকের কাছে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেদিকে এগোল কে।
গাড়িতে ওর জন্যে অপেক্ষা করছেন শাড়ী। বিধবার কার্লো পোশাক পরেছেন তিনি। বউমাকে নিয়ে ভোরের মাস অনুষ্ঠানে যাওয়া রোজকার একটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে তার।
বুড়ি শাশুড়ীর তোবড়ানো মুখে চুমো খেলো কে। তারপর ড্রাইভিং সীটে বসল।
সন্দেহ হওয়াতে বউমাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, নাস্তা খেয়ে এলে নাকি?
না, মৃদু গলায় বলল কে।
সন্তুষ্টচিত্তে মাথা দোলালেন বৃদ্ধা! পবিত্র কমিউনিয়ন নিতে হলে রাত বারোটার পর মুখে কিছু দিতে নেই। নিয়মটা একবার ভূলে গিয়েছিল কে। সে অনেকদিন আগের কথা, কিন্তু শাশুড়ী তা আজও ভোলেননি। রোজই তিনি কথাটা জেনে নেন।
তারপর আবার জানতে চাইলেন, শরীর ভাল তো?
জী।
ভোরের কচি রোদে ছোট গির্জাটাকে কেমন যেন মিয়মান আর বিষণ্ণ লাগে। ভেতরটা খুব ঠাণ্ডা। মনে হয়, এখানে বসে সারাটা দিন বিশ্রাম নিতে পারলে মনটা ভাল হয়ে যাবে। সাদা পাথরের সিঁড়ি বেয়ে শাশুড়ীকে উঠতে সাহায্য করছে কে। তাকেই যেতে দিল আগে। নেদীর একেবারে সামনে বসতে ভালবাসেন তিনি। সিঁড়ির মাথায় কয়েকটা মুহূর্ত নষ্ট করল কে। এতটা কাছাকাছি পৌঁছে সব সময় কেমন যেন ভয় ভয় করে ওর। কেমন যেন একটা অনীহা জাগে মনে।
তারপর শীতল অন্ধকারের ভেতরে প্রবেশ করল কে। আঁধার থেকে পবিত্র জর্দানের পানি নিল আঙুলের ডগায়, ক্রুশচিহ্ন আঁকল শূন্যে, ভিজে আঙুলটা ছোঁয়া শুকনো ঠোঁটে। যীশু আর সন্তদের মূর্তির সামনে লাল শিখা কাঁপছে মোমবাতির। নিজের সারিতে গিয়ে হাটু মুড়ে বসল কে, অপেক্ষা করছে কখন কমিউনিয়ন নিতে ডাক পড়বে। মাথাটা নিচু করে রয়েছে সে, দেখে মনে হয় প্রার্থনা করছে, কিন্তু এখনও মনটাকে তৈরি করতে পারেনি ও।
শুধু এইখানে, এই খিলান দেয়া গির্জার ছায়াছায়া অন্ধকারে কে তার স্বামীর জীবনের আরেকটা দিকের কথা ভাবতে অনুমতি দেয় নিজের মনকে। এখানে বসে, এই সময় এক বছর আগে সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা স্মরণ করে সে। পরস্পরের প্রতি ওদের যে প্রেম আর ভালবাসা রয়েছে তার সুযোগ নিয়ে একটা মিথ্যে কথা তাকে বিশ্বাস করার চেষ্টা করেছিল মাইকেল। বলেছিল, সে তার নিজের ভগ্নীপতিকে খুন করেনি।
অপরাধটার জন্যে নয়, মিথ্যেটার জন্যে স্বামীকে শ্রাগ করে চলে গিয়েছিল কে।
.
এক বছর আগের ঘটনা।
দুই ছেলেকে নিয়ে সোজা বাপের বাড়ি নিউ হ্যাম্পশায়ারে চলে এল কে। লং বীচের কাউকে কিছু বলে আসেনি, কি করবে তাও ভাল করে ভেবে দেখেনি। এখনও।
পরিস্থিতিটা সাথে সাথে বুঝে নিয়েছে মাইকেল। প্রথম দিন একটা ফোন করল কে-কে, তারপর তাকে আর বিরক্ত করেনি।
একটা হপ্তা কেটে গেল। তারপর একদিন একটা লিমুসিন গাড়ি এসে দাঁড়াল কে-র বাপের বাড়ির সামনে। গাড়িটা নিউ ইয়র্ক থেকে এসেছে। সেটা থেকে নামল টমহেগেন।
এই একটা দুপুরের কথা জীবনে কখনও ভুলবে না কে। ওর জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুপুর।
বেড়াতে বেরিয়ে শহর ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গেল ওরা, সেই বনভূমি পর্যন্ত। টম হেগেনকে ছেড়ে কথা বলল না সে।
নির্দয়ভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করার চেষ্টা করল কে। উচিত হয়নি, কেননা ও যে রকম মেয়ে, এত বেশি সরল, তাতে খোঁচা মারার কায়দা-কৌশল রপ্ত করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। চেষ্টা করল, কিন্তু সুবিধে করতে পারল না। সে বুঝি আমাকে ভয় দেখাবার জন্যে পাঠিয়েছে তোমাকে? হেগেনকে জিজ্ঞেস করল, তোমার গাড়ি থামতে দেখে আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম হাতে পিস্তল-রিভলভার নিয়ে তোমাদের গুণ্ডাপাণ্ডারা লাফ দিয়ে নামতে যাচ্ছে। ভাবছিলাম, এই রে, এবার আমাকে টেনে হিঁচড়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
এর আগে হেগেনকে কখনও রাগতে দেখেনি কে, এখন দেখছে। চোখমুখ টকটকে লাল হয়ে উঠল গর, গলার স্বর বদলে গিয়ে এমন কর্কশ হয়ে গেল যে চেনাই যায় না। তুমি কচি খুকীটি নও, কে। এই রকম একটা ছেলেমানুষি ঠাট্টা কিভাবে করো? তোমার মত মেয়ের কাছ থেকে আরও গাম্ভীর্য, আরও বুদ্ধি আশা করি আমি। মাটিতে পা দাও, কে।
বেশ, বলল কে।
পায়ের নিচে কচি সবুজ ঘাস। মফঃস্বলের কাঁচা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ওরা। চলে এলে কেন? শান্তভাবে জানতে চাইল হেগেন।
মূহুর্তে উত্তেজিত হয়ে উঠল কে। বলল, একজনমিথ্যেবাদীর সাথে ঘর করতে পারব না, তাই। আমাকে সে মিথ্যে কথা বলল কেন? চলে এসেছি, কারণ কনির ছেলের গড় ফাদার হয়ে অনেক আগেই বোকা বানিয়েছিল আমাকে সে, তাই সে তার স্ত্রীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাই এই রকম একজন লোককে ভালবাসতে পারব না আমি। স্বামীর চরিত্রে যদি এমন সাঙ্ঘাতিক ধরনের স্বলন থাকে, তাকে আমি সহ্য করতে পারব না-জানি বলেই চলে এসেছি। ওকে আমি আমার ছেলেদের বাপের দায়িত্ব পালন করার অধিকার দিতে রাজি নই।
প্রলাপ বকছ নাকি? বলল হেগেন। তোমার একটা কথাও তো বুঝতে পারলাম না আমি!
এতক্ষণে রাগ দেখাবার সঙ্গত একটা কারণ ঘটল, এবং সুযোগটা হাতছাড়া করল না কে, বলল, আমার কথা বুঝতে পারছ না? মাইকেল কর্লিয়নি তার ভগ্নীপতিকে খুন করেছে, আমি সেই কথা বলছি। এবার বুঝতে পারছ কি বলতে চাইছি? একটু বিরতি নিল কে, তারপর আবার বলল, মাইকেল কর্লিয়নি আমার স্বামী হয়ে আমাকে মিথ্যে কথা বলেছে, আমি সেই কথা বলছি। বুঝতে পারছ এবার?
দুজনের কেউই অনেকক্ষণ কথা বলল না। চুপচাপ হাঁটছে।
তারপর হেগেনই প্রথমে মুখ খুলল, এসব অভিযোগ যে সত্যি তা জানার কোন উপায় নেই। তবু না হয় তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া গোল কথাটা সত্যি। আসলেই সত্যি, তা কিন্তু বলছি না-সেটা ভুলে ভেবে বোসা না। কিন্তু যদি বলি, মাইকেল যা করেছে তার পিছনে ন্যায্য যুক্তি ছিল? অন্তত যদি বলি যে ন্যায্য কারণ থাকা সম্ভব, তাহলে?
হেগেনের দিকে তাকাল কে, তার দৃষ্টিতে রাজ্যের তাচ্ছিল্য ফুটে উঠল। বলল, তোমার ওকালতির দিকটা এই প্রথম দেখতে পাচ্ছি আমি। ওটা তোমার শ্রেষ্ঠ দিক নয়, টম।
নিঃশব্দে হাসল টম হেগেন। আচ্ছা, বুঝলাম। কিন্তু আমার সবটা কথা আগে শোনোই তো। যদি বলি, কার্লোই বাৰ্জিনিদের হাতে তুলে দিয়েছিল সনিকে? সে রাতে কনিকে অস্বাভাবিক রকম মারধর করেছিল। যদি বলি, ওটা একটা ষড়যন্ত্র ছিল? ওই ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল সনিকে বাড়ির বাইরে বের করে আনা? যদি বলি, বার্জিনিরা জানত জোনস বীচ ব্রিজের ওপর দিয়ে যাবে সনি? তারপর, আরও যদি বলি, সনিকে শত্রুদের হাতে তুলে দেবার বিনিময়ে প্রচুর টাকা খেয়েছে কার্লো, তাহলে? তাহলে কি বলবে তুমি?
চুপ করে আছে কে।
বলার কথা আরও আছে, থামছে না হেগেন, ধরো, এমন ঘটে থাকে, যে ডন ভিটো কর্লিয়নি একজন মহাপুরুষ ছিলেন বলেই ছেলের খুনের বদলা নেবার জন্যে জামাইকে হত্যা করতে নিজের বিবেককে রাজি করাতে পারেননি, সেটাই তার একমাত্র কর্তব্য জানার পরও যদি বলি এই অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব তিনি পালন করতে পারবেন না বুঝতে পেরেই তার ছোট ছেলে মাইকেলকে উত্তরাধিকারী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, কেননা তিনি ভালভাবেই জানতেন একমাত্র মাইকেলই তার কাঁধ থেকে সে দায়িত্বের বোঝ, সে-পাপের বোঝা নামিয়ে নিতে পারবে?
পানিতে দুচোখ ভরে গেছে কে-র। ধরা গলায় বলল, কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছিল। সবাই সুখে ছিলাম আমরা। ক্ষমা করা যেত না কার্লোকে? কেন যেত না? অতীত তো ভুলেও যাওয়া যায়, কার্লোর ব্যাপারটা যদি সবাই ভুলে যেত, কি এমন ক্ষতি হত তাতে তাকে মেরে ফেলে লাভটা কি হলো?
মাঠের ওপর দিয়ে হাঁটছে ওরা। নদীর ধারে এসে গাছের ছোট একটা ছায়ার নিচে ঘাসের ওপর বলল দুজন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল হেগেন। চারদিকের শান্ত, সুন্দর শান্তিময় প্রাকৃতিক দৃশ্যের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তারপর বলল, ক্ষমা? হ্যাঁ, তোমাদের এই জগতে তা করা যায়।
ওকে আমি বিয়ে করিনি, বলল কে। যাকে বিয়ে করেছিলাম তাকে খুঁজে পাচ্ছি না ওর মধ্যে।
তা যদি পেতে, কোমল কণ্ঠে হাল হেগেন, এতদিনে মরে ভূত হয়ে যেত ও। অবশ্য বিধবা হলে কোন সমস্যা থাকত না তোমার।
দপ করে জ্বলে উঠল কে। এ কি ধরনের জন্য মনিকতা! একটু থেমে আবার বলল সে, তুমি তো সিসিলিয়ান নও, একজন মেয়েকে সত্যি কথা বলতে পারো তুমি। একজন মানুষকে মানুষ বলে মনে করা তোমার পক্ষে সম্ভব। জীবনে এই একবার সত্যি কথাটা আমাকে বলো তুমি, টম।
সাথে সাথে কোন জবাব দিল না হেগেন! খানিক পর এদিক ওদিক মাথা নেড়ে বলল, ওকে তুমি ভুল বুঝছ। তোমার রাগের কারণ ও তোমাকে মিথ্যে কথা বলেছে, কিন্তু ও তো,তেমাকে ওর কাজকর্মের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করতে নিষেধ করেছিল, সেটা ভুলে যাচ্ছ কেন? কনির ছেলের গড ফাদার হয়েছিল ও, সেজন্যে ভাবছ ও তোমাকে বোকা বানিয়েছে কিন্তু তুমিই না বিশেষভাবে অনুরোধ করে রাজি করিয়েছিলে ওকে? তবে কৌশলের দিক থেকে বিচার করলে কাজটা করে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিল ও, কার্লোর মন থেকে সংশয় দূর করার জন্যে বেশ ফল দিয়েছিল ওটা। অতি প্রাচীন একটা নিয়ম, শত্রুকে আশ্বস্ত করা। হেগেনের সিটা দেখে ওকে হৃদয়হীন মনে হলো কে-র। সত্যি কথাগুলো বলছি তোমাকে, বিশ্বাস করছ কি?
মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে কে।
আরও কিছু সত্যি কথা বলি, কেমন? আবার শুরু করল হেগেন। ডন কর্লিয়নি মারা যাবার পর মাইকেলকে খুন করার ষড়যন্ত্র পাকানো হয়। জানো, কার হাত ছিল এতে? টেসিওর। তাই মরতে হলো তাকে! বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষমা নেই, তাই কার্লোকেও মরতে হলো। ওদেরকে মাইকেল যদিও বা ক্ষমা করতে পারত, নিজেদেরকে ওরা কখনোই ক্ষমা করতে পারত না। তাই চিরকালের জন্যে বিপদের একটা কারণ হয়ে থাকত ওরা। তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু আমি তো জানি, টেসিওকে খুবই পছন্দ করত মাইকেল। কনিকে ও সত্যি সত্যিই ভালবাসে। কিন্তু টেসিও আর কার্লোকে ক্ষমা করলে মাইকেল তোমার আর তোমার ছেলেদের, নিজের গোটা পরিবার, আমার আর আমার পরিবারের ওপর অন্যায় করত। কর্তব্যে অবহেলা করা ওর মত একজন পরিবার প্রধানের সাজে না। ওরা বেঁচে থাকলে আমাদের ব্যর বিপদের কারণ হয়ে থাকত। চিরকাল।
চোখ থেকে নিঃশব্দে পানি ঝরছে কে-র। জানতে চাইল, মাইকেল কি এসব কথা বলার জন্যে তোমাকে পাঠিয়েছে?
আশ্চর্য হয়ে গেল হেগেন। কিছুক্ষণ অবাক চোখে কের দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলল, না। সে তোমাকে বলতে বলেছে, তুমি যা চাইবে তাই হবে, তোমার কোন ইচ্ছায় বাদ সাধবে না সে। যতদিন ছেলেদের যত্ন নিচ্ছ, ততদিন যা চাইবে তাই পাবে তুমি.। হঠাৎ হাসল হেগেন। বলেছে, তুমিই তার ডন। এটা কিন্তু ঠাট্টা।
হেগেনের একটা কনুই চেপে ধরল কে। আর সব কথা যে বললে ওগুলো আমাকে শোনাতে বলে দেয়নি?
এক সেকেণ্ড ইতস্তত করতে দেখা গেল টম হেগেনকে, যেন ভাবছে চরম সত্যি কথাটা প্রকাশ করবে কিনা। অবশেষে বলল, শোনো তাহলে। তোমাকে আজ যা বলেছি, মাইকেল যদি কোনদিন জানতে পারে, আমাকে আর বেঁচে থাকতে হবে না। একটু থেমে আবার বলল, দুনিয়ায় শুধু তোমার আর তোমার ছেলেদের কোন ক্ষতি করতে পারে না ও।
পাঁচটা মিনিট চুপচাপ গাছের ছায়ায় বসে থাকল ওরা তারপর উঠে দাঁড়াল কে! দেখাদেখি হেগেনও উঠল। বাড়ির দিকে হাঁটছে ওরা।
বাড়ির একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে হেগেনকে স্কুলল কে, ডিনারের পর আমাকে তুমি নিউ ইয়র্কে নিয়ে যেতে পারবে?
সেজন্যেই তো এখানে আসা আমার, বলল হেগেন।
স্বামীর কাছে ফিরে এল কে। ফিরে আসার এক হপ্তা পর ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষা নিল ও।
.
ঢং! ঢং!
গির্জার গহীন কোথাও করুণ অনুতাপের সুরে ঘণ্টা বাজছে ঠিক যেভাবে শেখানো হয়েছে, মুঠো পাকানো হাত দিয়ে নিজের বুকে হালকাভাবে আঘাত করল কে। অনুতাপ প্রকাশের এই হলো ভাষা।
আবার ঘন্টা বাজার সাথে সাথেই নরম আওয়াজ পাওয়া গেল পায়ের। বেদার পাদদেশে, রেইলিং-এর ধারে গিয়ে দাঁড়াল প্রার্থীরা নিজের বুকে আবার আঘাত করল কে।
ওর সামনে এসে দাঁড়ালেন ধর্মযাজক। মাথাটা পিছন দিকে হেলিয়ে, মুখ হাঁ করল কে, গ্রহণ করল ওয়েফার প্রসাদ।
পাপ মুক্ত হয়েছে কে, দাক্ষিণ্য পেয়েছে দেবতার, মাথা নিচু করে বেদীমূলে কপাল ঠেকাল সে, হাত দুটো জোড় করে রাখল। একটু নড়েচড়ে বসল, ব্যথা যাতে একটু কম লাগে হাঁটুতে।
তারপর মন থেকে সমস্ত চিন্তা দূর করে দেবার চেষ্টা করল কে। নিজের কথা ভুলে গেল, ভুলে গেল নিজের সন্তানদের কথা। সব রাগ, সব ঘৃণা, সমস্ত দুঃখ আর সব বিদ্রোহ ঝেড়ে ফেলল মন থেকে। তারপর বিশ্বাস করার প্রবল, সুগভীর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, সৃষ্টিকর্তা যেন তার আকুতি বুঝতে পারেন এই ভিক্ষা চেয়ে, মাইকেল কর্লিয়নির আত্মার মুক্তির জন্যে বাছাই করা প্রার্থনা আবৃত্তি করতে শুরু করল সে।